মৃত্যুর পারে
মৃত্যুর পারে
বিগত প্রায় একমাস ধরেই ব্যপারটা ঘটছিল। রাত ঠিক দুটো আড়াইটে নাগাদ ভীষণ ভাবে গায়ে কাঁটা দিয়ে ঘুম ভেঙে যেত। প্রথম দুএক দিন লক্ষ্য করিনি। তবে দিন তিনেকের মাথায় তাকে দেখলাম। মাঘের আধো চাঁদের ছমছমে আবছা আলোয় আমার ঘরের জানালার ঠিক বাইরে হিমসাগর আমের গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে ছিল সে। সেটি মানুষ তো নয়ই, পিশাচ হলেও বোধহয় একটু নিশ্চিন্ত বোধ করতাম। কিন্তু সেটির শুধুমাত্র উপস্হিতিই যে কতটা অস্বস্তিদায়ক, অশুভ হতে পারে তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। একটি জমাট কালো অন্ধকার উপস্হিতি; বুঝতে অসুবিধা হয়না, সে এসেছে জন্ম মৃত্যুর জগতের ওপার থেকে। সেখানে ভয়ংকরতম প্রেতপিশাচও বোধহয় প্রবেশ করতে ভয় পায়।
আমি বুঝলাম আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এই অশুভ উপস্হিতিটি যে কি তা আমি জানি। আমার পিতৃদেব তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে ঠিক এমনই এক উপস্হিতির কথা তাঁর ডায়রিতে লিখে গিয়েছিলেন। আমার বাবা ছিলেন আধ্যাত্মিক পথের পথিক। সংসারে থেকেও ঠিক যেন সংসারে নেই। যাকে বলে তিনি ছিলেন একপ্রকার গুপ্তযোগী। উপনিষদ পাঠ, ধ্যান, নিষ্ঠাচার ছিল তাঁর নিত্য জীবনের অঙ্গ। আমার দীক্ষাগুরুও তিনি। আমায় বলতেন, “প্রতিটি মানুষের আধ্যাত্মিক সাচ্ছন্দ্যের ভাবটি সমান হয়না। কারোর মধ্যে কৃষ্ণ, কারোর মধ্যে মাকালীর জ্যোতির্ময় ভাব প্রকট থাকে। তোর মধ্যে শিবভাবটি বড় বেশি। তাই তোকে সেইভাবেই মণ্ত্র দিচ্ছি।“, বলে আমাকে জপের নিয়মগুলি বলে দিয়েছিলেন। সেই মণ্ত্র যে আমায় কতবার অলৌকিকভাবে প্রকৃতির অশুভ শক্তির হাত থেকে আমায় বাঁচিয়েছে তার হিসেব নেই। সে গল্প অন্য একদিন হবে খন।
সেই বাবা যেদিন চলে গেলেন, ভোররাতে স্নান সেরে তড়িঘড়ি ঠাকুরঘরে ঢুকে গেলেন। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন বেরোচ্ছেন না দেখে মা ঘুমচোখে ডাকতে গিয়ে দেখেন বাবা ধ্যানস্হ। মেরুদন্ড ঠায় সোজা করে বসে চক্ষুমূদিত অবস্হায় স্হির বসে আছেন। মা ডাকতেও সাড়া দিলেন না দেখে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝলেন বাবা আর নেই। ধ্যানের মধ্যেই তাঁর পূণ্য আত্মা এই জড় শরীর ছেড়ে রওয়ানা দিয়েছে লোকান্তরে। মাথার কাছে ব্রহ্মরণ্ধ্রের কাছে হাল্কা রক্ত। মা ধীরে ধীরে অবিচলিত পায়ে নীচের ঘরে নেমে সবাইকে খবর দেন।
এমন পিতৃদেব তাঁর ডায়রিতে লিখে গিয়েছিলেন এই অশুভ অস্তিত্বটির কথা, যার কায়া ছায়া অবর্ণনীয়। শুধু সূক্ষ্ম অনুভূতিতেই ধরা দেয়। বাবা লিখেছিলেন এরা হচ্ছে মৃত্যুদূত। যখন শেষ সময় ঘনিয়ে আসে, এনারা এসে হাজির হন জীবাত্মাকে পরলোকের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তার কর্মফল অনুযায়ী নরক যন্ত্রণা ভোগ করাতে। সবার মৃত্যুর আগেই আসে। কেউ বোঝে। বেশির ভাগই বোঝেনা।
বুঝলাম আমার মৃত্যু আসন্ন, তাই এবার মনে মনে প্রস্তুত হলাম।দিন তিনেক আগে রাতে হঠাৎ বুকের বামদিকটা চিনচিন করে উঠল। পাশে গিন্নি অঘোরে নিদ্রামগ্ন। তাকে কোনোভাবেই বুঝতে না দিয়ে সন্তপর্ণ পায়ে চলে এলাম তিন তলার ঠাকুরঘরে। ধীরে ধীরে ঢুকে দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে আমার ধ্যাণের আসনটি পেতে জপের মালাটি নিয়ে বাবার দেওয়া মন্ত্রটি ভক্তিভরে জপ করতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে বুকের যন্ত্রণাটা বাড়ছে। কিন্তু মন্ত্র মানে তো ঠাকুর বলে গেছেন মন তোর। সেই মনকে নির্লিপ্ত নিমগ্ন করতে বেশি সময় লাগলোনা। ঘন্টাখানেক পরে জপের মালাটিকে শ্রদ্ধাভরে প্রণাম করে গুছিয়ে তুলে রেখে মনে মনে বাবাকে প্রণাম করে ধ্যানে বসলাম। বুঝতে পারছি হৃৎপিন্ডটি প্রাণপনে শরীরের রক্তকে ঠেলতে চাইছে, কিন্তু ক্রমশ তার শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। দরজার বাইরে আছে সেই যমদূত। ভেতরে প্রবেশ করার অধিকার বোধহয় ঈশ্বর তাকে দেননি বলেই বাইরে ধের্য্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
কয়েক মিনিট পরে শরীরটা খুব হাল্কা হয়ে গেল। এক মুহুর্ত কোন জ্ঞান ছিলনা। যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, আমার স্হূল শরীরটা নীচে দেখতে পেলাম। ধ্যানমূদ্রায় উপবিষ্ট। কিন্তু শরীরে প্রাণ নেই। বুঝলাম আমার আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হলো। আবার হলো শেষের শুরু। মনে পড়ে গেল কঠোপনিষদের সেই মহান বাণী।
“न जायते म्रियते वा विपश्चिन्नायं कुतश्चिन्न बभूव कश्चित्। अजो नित्यः शाश्वतोऽयं पुराणो न हन्यते हन्यमाने शरीरे ॥“
শরীরের মৃত্যু হলেও আত্মা শাশ্বত নিত্য। এক দেহ থেকে আরেক দেহে জন্ম জন্মান্তর ধরে তার পথ চলার কোনো শেষ নেই।
কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কালের খেয়া পার করার সেই ভয়াবহ দূত এবার আমার দিকে অগ্রসর। আমার গতজীবনের যাবতীয় কর্মের এবার বিচার হওয়ার পালা। নিকশ কালো তমসাচ্ছন্ন আঁধারের মধ্য দিয়ে অশান্ত ভয়াল প্রেতসাগর পার করিয়ে সে আমায় নিয়ে যাবে নরকপাতালের গর্ভে। যেখানে সাধারণ মানুষ ভোগ করে তার যাবতীয় কৃতকর্মের ফল। সে শাস্তি বড় যন্ত্রণার। মৃত্যুদূত আমার দিকে এগোতে থাকে ধীরে ধীরে। স্হূল শরীর না থাকলেও আমার হাল্কা ধোঁয়াটে সূক্ষ্ম শরীরটায় কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকল। কেমন যেন একটা অপবিত্র অবসন্নতা চেপে ধরতে থাকল আমায়।
এমন সময়ে ঘটল অঘটন। সামনে যখন জমাট কালো অশুভ মৃত্যদূত একদম কাছে, ঠিক তখনই আমার পেছনে কোথা থেকে এল এক চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল স্বর্ণাভ জ্যোতির্ময় স্বত্তা। মুহুর্তে পিতৃসুলভ মমতায় আমায় ঘিরে ধরল সেই পূত নির্মল জ্যোতি। শরীর দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝলাম তিনি আমার বাবা, আমার গুরুদেব। একমাত্র গুরুই রাখেন শিষ্যের নাড়ীর খবর। একাধারে সন্তানের প্রতি স্নেহ, আবার অন্যদিকে শিষ্যের প্রতি গুরুর কর্তব্য পালনের খাতিরে তিনি এসেছেন আমায় রক্ষা করতে; আমায় নিয়ে যেতে উচ্চ লোকান্তরে। শিষ্য ও পুত্রের কঠিন সময়ে এসেছেন তাকে উদ্ধার করতে।
ধীরে ধীরে আমার ক্ষীণ জ্যোতির স্বত্তাটি মিশে গেল সেই অপূর্ব বর্ণচ্ছটার উজ্জ্বল জ্যোতিটির সাথে। পিতা যেন পুত্রকে পরম মমতায় নিজের কোলে তুলে নিলেন। এরপর আমার বিশদে কিছু মনে নেই। মনে পড়লেও সে সুখের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আমরা সাধারণ জীবিত অবস্হায় যে কম্পন (Frequency) স্তরে বাস করি, এই উচ্চতর জগতের কম্পন ছিল আরো সূক্ষ্ম আরো আরো অনেক পূত পবিত্র। হিন্দু পুরাণে যে সাতটি ঊর্ধ্বলোকের কথা আছে, এ হয়তো তারই একটি। সেখানে সময়ের হিসাব নেই। নেই ভালো খারাপ, উঁচু নীচুর বিচার। সে এক নির্বিকল্প নিরাকার শিবময় জগৎ।
কিন্তু সবেরই শেষ থাকে। আমারও সেই নিরাকার অসঙ্গ অহিংস আনন্দ অবস্হার শেষ হল এবং আমি নামতে থাকলাম নিম্নতর লোকে। আমার পূর্বজন্মের কর্মফল অনুযায়ী আবার জন্ম নেব কোনো এক মায়ের কোলে, এই ধরিত্রীর কোনো এক কোনে। আবার নতুন করে সূচনা হবে শেষের শুরু। তখন কিন্তু এতকথাতো আমার মনে থাকবেনা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ে আমার সুষুম্ণা নাড়ীটি তিন জায়গায় ভেঙে চার টুকরো হয়ে যাবে। একটি ভাঙবে মণিপুর চক্রে, আরেকটি ভাঙবে বিশুদ্ধিতে, ঘাড়ের কাছে এবং শেষ টুকরোটি হবে ভ্রূদ্বয়ের মাঝে, আজ্ঞাচক্রে। তখন বিগত জন্মের যাবতীয় স্মৃতি লুকিয়ে পড়বে অবচেতনের গোপন গর্ভগৃহে। যেমন এখন আপনারা ভুলে গেছেন আপনাদের জন্মান্তরের অতীতের সমস্ত কথা।
তাই ভাবলাম আজ কারোর কলমে ভর করে আপনাদের এই কথাগুলো বলে যাই। সবার সাথেই তো কমবেশী এমনই অভিজ্ঞতাই অপেক্ষা করে আছে। তাই একটু আগে থেকে জেনে রাখতে কোনো ক্ষতি নেই, কি বলেন?

