SHUBHAMOY MONDAL

Abstract Inspirational

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Abstract Inspirational

মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা

মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা

7 mins
927


মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা

শুভময় মণ্ডল


‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা/যথা ইচ্ছা তথা যা'

খনার বচন, এই রকমই একখান শুভলগ্নে আমার আজ যাত্রা শুরু হয়েছিল, কিন্তু কলিতে নাকি সবই সম্ভব! এমনকি খনার বচনও মিথ্যা প্রমাণ হয়! ভাবা যায়, যুগ যুগ ধরে বাপ ঠাকুরদা, মানে আমার চৌদ্দ পুরুষ যে বচনকে নিছক সত্য বলে মেনে যথাবিহিত কাজকর্ম করে এসেছেন, তা'ই কিনা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো?

ঘটনাটা একটু খুলেই বলি, পেশায় আমি এক নামজাদা উকিলের মুহুরী। তাঁর পসার ভালোই, সেই দৌলতে আমার রোজগারও মন্দ নয়। রোজ সকালে পাঁচটা পঞ্চান্নর ট্রেন ধরে, আমি হাজির হই কলকাতা হাইকোর্টে। তারপর কিছু গতানুগতিক কাজকর্ম করতে হয়, যেমন - আমার সাহেবের হাতের কোন কেস, কোন কোর্টে, কেস-লিস্টে কত নম্বর পজিশনে আছে, সব নোট করে রিপোর্ট করতে হয় তাঁকে, তিনি সেইমতো অফিস থেকে কোর্টে আসেন।

আজ একটা ৪৯৮-কেসের হিয়ারিং ছিল বারো নম্বর কোর্টে – এক গৃহবধূকে নির্যাতন ও বধূহত্যার কেস। বাদী পক্ষের উকিল ছিলেন এরশাদ সাহেব, যিনি সরকারি পক্ষের অনেক বয়স্ক উকিল, কিন্তু তাঁর পসার বিশেষ ভালো না। তার উপর আবার তাঁর আছে সমাজসেবার ব্যারাম। এই কেসটা তিনি মৃতা মহিলার বাবার হয়ে লড়ছিলেন। লোয়ার কোর্টে গো-হারান হেরে গিয়ে, ভদ্রলোক হাইকোর্টে অ্যাপীল করেছিলেন। আমার সাহেব ছিলেন বিরোধী পক্ষের, মানে মৃতার শ্বশুরবাড়ির পক্ষের উকিল।

কেস ফাইলটা প্রথমদিন পড়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বিস্তর গড়বড় করে আসল ঘটনা চাপা দেওয়া হয়েছিল মূল কেসটা লোয়ার কোর্টে ফাইলিং-এর সময়। যদিও কিচ্ছু করার ছিল না আমার, কারণ সবকিছু জেনে বুঝেও কেসটা নিয়েছিলেন আমার সাহেব, আর তিনি সহজে হেরে গেছেন কোনও কেসে - এ আমি আজ অবধি দেখিনি।

বুঝলাম, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে মৃতা সেই অভাগিনী হয়তো সুবিচার পাবে না এই কোর্টেও! যথারীতি হিয়ারিং শুরু হতেই, আমার আশানুরূপ অভিমুখেই কেস এগোতে লাগলো। হাইকোর্টেও নিজেদের হার যে প্রায় নিশ্চিত - বুঝতে পেরেছিলেন মৃতা কন্যার জন্য সুবিচারপ্রার্থী সেই হতভাগ্য পিতাও।

তাই একদিন, আমাদের অফিসে এসে তিনি হাতে-পায়ে পড়লেন আমার সাহেবের। তাঁর মেয়েকে সুবিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে করজোড়ে অনুরোধ করলেন এবং যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে গেলেন। কোর্টে নিজেদের জয় দেখতেই অভ্যস্ত এই আমারও সেদিন মনে হয়েছিলো, এই কেসটা সাহেব হেরে গেলেই বোধহয় ভালো হয়। যদিও জানতাম, আমার চাওয়া না-চাওয়ায় কিছুই এসে যায় না।

আজ সেই কেসের ফাইনাল হিয়ারিং ছিল। খনার ঐ বচন অনুযায়ী আজকের যাত্রা-লগ্নও ছিল শুভ, অর্থাৎ আমার যাত্রা বৃথা যাবার কথা ছিল না। আর আমার যাত্রার উদ্দেশ্য তো একটাই - সময়মতো কোর্টে পৌঁছানো, তারপর সাহেবকে কেস চলাকালীন প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র বাড়িয়ে দিয়ে, সুষ্ঠুভাবে কেস লড়তে সাহায্য করা!

মানে মোদ্দা কথা হচ্ছে, কোর্টে আমার সাহেবেকে ঐ কেসটা জিততে সাহায্য করার জন্যই আমি আজ বাড়ি থেকে যাত্রা করেছিলাম! কিন্তু অমন শুভ লগ্নে যাত্রা করেও, আমার সেই যাত্রা আজ বৃথা গেলো! অবশ্য এমন কিছু একটা অঘটন যে ঘটতে চলেছে, তা' আজ বেশ কয়েকবার আমার মনে হয়েছিল।

প্রথমত, ফেরিঘাটের গাছতলায় এক সাদা থান পরা বৃদ্ধা বসে ছিলেন। আমাকেই উদ্দেশ্য করে কিনা জানিনা, কিন্তু তিনি বলে উঠলেন হঠাৎ - পারবি না, কিছুতেই আটকাতে পারবি না, ধর্মের কল ঠিক বাতাসে নড়বে। ওরা সব নির্বংশ হবে, নির্বংশ...

এপারে পৌঁছে নৌকা থেকে জেটিতে নামার সময়, একবার তাকালাম পিছন ফিরে ওপারের দিকে। দেখি, সেই বৃদ্ধা ঐ গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে, চেয়ে আছেন যেন আমারই দিকে! দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো আমার! আমাকে ঐভাবে সেই গাছ পানে চেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, আমার সহযাত্রীদের অনেকেই তাকালেন ঐ গাছের দিকে। কিন্তু তাঁরা কেউই যে কিছুই দেখতে পাননি, তা' তাঁদের মুখ দেখেই বুঝলাম।

ট্রেন ধরার তাড়া ছিল আমার, তাই আর দেরি না করে দৌড়ালাম স্টেশন পানে। ট্রেনটা দেখি এসে দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। সামনের কম্পার্টমেন্টে ঠাসাঠাসি ভিড়, তাই বাধ্য হয়ে দৌড়ে ভেন্ডারে গিয়ে উঠতে হল আমায়। ট্রেনটা ছেড়ে দেবার পরেও মালপত্র নামাচ্ছিল কয়েকজন। তাই তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে, তাদের গায়ে ঈষৎ ধাক্কাই লেগে গেল আমার।

তাদেরই একজন ঐ প্ল্যাটফর্ম থেকেই আমার উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে বলে উঠলো - ওঃ গায়ে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে! যাচ্ছিস যা, কিন্তু পারবি না, কিছুতেই আটকাতে পারবি না, ধর্মের কল ঠিক বাতাসে নড়বে। ওরা সব নির্বংশ হবে, নির্বংশ... শুনে তো বিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে চেয়ে দেখি – স্মিতবদনে, আমারই পানে তাকিয়ে, প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে ফেরিঘাটের সেই বৃদ্ধা!

হাওড়ায় ট্রেন থেকে নেমেই দৌড়ে লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম, কিন্তু ততক্ষণে রোজ যে লঞ্চটা ধরি সেটা ছেড়ে গেছে। তাই, স্বভাবতই পরের লঞ্চে ঠাসাঠাসি ভিড় হলো। বাবুঘাটে ঠেলাঠেলি করে লঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে দেখি, জামার পিছনটা আটকে গেছে লঞ্চের গ্রিলের খোঁচায়, না থামলে সেটা ছিঁড়েই যাবে।

অগত্যা সেখানেই একটু থেমে, সাবধানে সেই খোঁচা থেকে জামাটা ছাড়িয়ে নিতে হলো। তারপর যেই জেটিতে নেমেছি, ঠিক তখনই শুনলাম, লঞ্চের উপরের তলা থেকে মহিলা কন্ঠে কেউ যেন বলছে – পারবি না, কিছুতেই আটকাতে পারবি না, ধর্মের কল ঠিক বাতাসে নড়বে। ওরা সব নির্বংশ হবে, নির্বংশ...

আমি সেই জেটিতে দাঁড়িয়ে লঞ্চের উপরতলার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম - প্রত্যাশিতভাবেই সেখানে কোনো যাত্রী উপস্থিত ছিল না। স্ট্র্যাণ্ড রোডে এসে, আরও একবার পিছন ফিরে চাইলাম সেই লঞ্চের দিকে। তখন দেখি, তার দ্বিতলে দাঁড়িয়ে আমার পানেই চেয়ে হাসছেন সেই বৃদ্ধা!

কোর্টে পৌঁছেই দৌড়ালাম আজকের কেস-লিস্ট দেখতে, কিন্তু তার আগেই সাহেবের সঙ্গে দেখা! বললেন - কি ব্যাপার, আজ এত দেরি করে এলে যে? ক'টা বাজে খেয়াল আছে? ওদিকে ৪৯৮-এর হিয়ারিংটাও হয়ে গেল! ফাইনাল সাবমিশনের সময়, আজ কি বলতে যে কি বললাম, আর কি সব ডকুমেন্টস যে আমি জমা করলাম কোর্টে, তা' নিজেই জানিনা!

বললাম - হিয়ারিং হয়ে গেল? আপনি ডকুমেন্টস কোথা থেকে সাবমিট করলেন? পুরো ফাইলটাই তো আমি বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম বাইন্ডিং করে আনবো বলে! এইতো আমার ব্যাগেই রয়েছে এখনও।

সাহেব বললেন - জানিনা, কোর্টে ঢুকতেই আজ কেমন অদ্ভুতভাবে সব গুলিয়ে গেল যেন আমার। এক বৃদ্ধা এসে আমায় বেশ কিছু কাগজপত্র দিয়ে বললেন সেগুলো জজসাহেবকে দিতে, আরো কি কি সব বলতে বললেন! আমি কাকাতুয়ার বুলি আওড়ানোর মতই তাঁর সেই কথাগুলো গড়গড় করে বলে গেলাম কোর্টে, আমাকে দেওয়া তাঁরই সেই ডকুমেন্টসগুলো বিনা দেখেই তুলে দিলাম জজসাহেবের হাতে!

কোর্টে আজ কি যে বললাম, কি দেখালাম, কিছুই মনেও করতে পারছিনা আমি। শুধু এইটুকু মনে আছে, তা'তে জজসাহেব খুব খুশি হলেন, এরশাদ সাহেবও। কোর্টে উপস্থিত বাকিরাও দেখলাম খুব খুশি হয়েছেন। কিন্তু সবাইকে এত খুশি করতে পারার মত কাজটা যে আমি ঠিক কি করলাম, নিজেই সেটার কিচ্ছু মনে করতে পারছি না।

বলতে বলতেই হঠাৎ সংজ্ঞা হারিয়ে ওখানেই পড়ে যাচ্ছিলেন সাহেব। আমি ব্যাগপত্র ফেলে দুই হাত দিয়ে তাঁকে আঁকরে ধরে কোনক্রমে সামলে নিলাম। তারপর তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এলাম আমাদের অফিসে। আমার মনে তখন খচখচ করছে শুধু একটাই প্রশ্ন - এক বৃদ্ধা? এক বৃদ্ধা এসে কিনা সাহেবের হাতে কাগজপত্র ধরিয়ে, কোর্টে তাঁকে দিয়ে সব বলিয়ে এবং সাবমিশন করিয়ে নিয়েছে!

কেমন যেন সব গোলমেলে লাগছিলো আমার। একটু সুস্থ বোধ করে সাহেব উঠে বসতেই, কথায় কথায় তাঁর থেকে ঐ বৃদ্ধার বিষয়ে সব জানলাম। সব শুনে বুঝলাম, এই বৃদ্ধাটি অন্য কেউ না, আমার সাহেব সেই বৃদ্ধাটিরই কথায় চালিত হয়েছেন, যাকে আজ সকাল থেকে বারবার দেখেছি আমি! কিন্তু রহস্যটা কি? কে এই বৃদ্ধা? কী সম্পর্ক তার এই কেসের সাথে? কেনই বা সে এভাবে এসে কেসটার সমাপ্তি ঘটালো?

হঠাৎ কি মনে হতে, নিজের ব্যাগটা খুলে আমারই বাঁধিয়ে আনা এই কেসের ফাইলটা বের করলাম। অবাক হয়ে দেখি, এতদিন ধরে এই কেসের যে ফাইল ও কাগজপত্র ঘেঁটে এসেছি আমি, তার একটাও নেই আমারই বাঁধাই করা ঐ পেপারবুকে! কি করে এই অসম্ভব সম্ভব?

সাহেব আর বেশিক্ষণ থাকলেন না আজ অফিসে, শরীরটা ভালো লাগছে না বলে বাড়ি চলে গেলেন। আমি একাকী ওখানেই বসে, পেপারবুকটা খুলে পরীক্ষা করতে লাগলাম। মূল কেসের সঠিক আদ্যোপান্ত, আসল নথিপত্র যত, সবই ছিল সেই পেপারবুকে। সেখানেই দেখলাম, একজন বয়স্কা মহিলা নাকি এই কেসে পুলিশকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, তিনি এই কেসের সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করেও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে, তাঁর সেইসব সাক্ষ্য প্রমাণের উল্লেখই হয়নি - লোয়ার কোর্টে ঐ কেসটা ফাইলিং-এর সময়!

ঐ পেপারবুকেই থাকা বেশ কিছু নিউজপেপার-কাটিং পড়ে জানতে পারলাম, সেই মহিলা সম্ভবত এই কেসের মৃতার প্রতিবেশী বা কোন আত্মীয়া ছিলেন। লোয়ার কোর্টে এই কেসের হিয়ারিং চলাকালীন, একদিন কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার সময় নাকি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি!

সেই মহিলার নাম ঠিকানা সবই ছিল ফাইলে। তাই নিছক আগ্রহবশতই গিয়ে হাজির হলাম সেই ঠিকানায়। শুনলাম, ঐ মহিলা নিজের সন্তানকে হারিয়েছিলেন অজানা অসুখে। এই কেসের ঐ মৃতার মুখের আদলে তিনি তাঁর সেই স্বর্গগতা মেয়েকে দেখতে পেয়েছিলেন যেন! তাই, বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে, মেয়েদের যে মা পাতানোর একটা রেওয়াজ আছে না, সেই রীতি মেনে তাকে মেয়ে পাতিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ঠিক নিজের মেয়ের মতই নাকি সেই মহিলা খুব ভালোবাসতেন এই মৃতাকে। শৈশবে মাতৃহারা হওয়া সেই অভাগিনীর প্রকৃতার্থেই মা ছিলেন নাকি তিনি।

তাই, তাঁর ঐ মেয়ের উপর হওয়া সমস্ত অত্যাচার অবিচারের ঠিকুজি কুষ্ঠি সব জোগাড় করেছিলেন তিনি, সেই অবিচারের প্রতিকার করবেন বলে। কিন্তু পুলিশকে আগেই হাত করে ফেলেছিল তাঁর ঐ মৃতা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তাই তাঁর জোগাড় করে দেওয়া সেই সাক্ষ্যপ্রমাণ সব লোপাট করে দেয় তারা। এমনকি খুব যত্ন করে, তারা সেই বিষয়গুলোকে বাদই দিয়েছিল কেসটা সাজাবার সময়।

তবুও, কোর্টে হিয়ারিং এর সময় তাঁকে রোজ হাজির থাকতে দেখে, তারা সন্দেহ করে - যদি অন্য কোনভাবে কিছু করে বসেন তিনি? তাই কোর্ট থেকে ফেরার পথে একদিন তাঁকে খুন করে, সেটাকে দুর্ঘটনা বলে তারা এলাকায় রটিয়ে দিয়েছিল।

কথা হচ্ছিলো সেই মহিলারই বাড়িতে বসে, তাঁর ভাইয়ের সাথে। কথা বলতে বলতেই ভদ্রলোক তাঁর দিদির একটা ছবিও দেখালেন আমায়। আমি যা ভেবেছিলাম তাই - আমার এবং আমার সাহেবের দেখা সেই বৃদ্ধা আর কেউ নন, এই বয়স্কা মহিলাই, যিনি নিজে মারা যাওয়ার পরও, তাঁর সেই পাতানো মেয়েকে সুবিচার পাইয়ে দিয়ে গেলেন!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract