#মিথ্যে সত্যির মোড়কে
#মিথ্যে সত্যির মোড়কে
ছোটগল্প
বিষয়: সামাজিক
কলমে: বুলা বিশ্বাস
শিরোনাম:
#মিথ্যে সত্যির মোড়কে
'কাকীমা ও কাকীমা।'
'এই এসে গেছেন নবাব নন্দিনী! দাঁড়া, দাঁড়ারে কাজল। চাবিটা ওপর থেকে নীচে ফেলে দিচ্ছি। দরজার তালাটা খুলে উপরে আয়।' বলে সোনালী চাবির গোছাটা নিয়ে দোতলার ব্যালকনির দিকে যাবে বলে ঠিক করেছেন, অমনি কাজল চিৎকার করে বলে উঠলো, 'ও কাকীমা, তোমায় এখুনি চাবি ফেলতে হবে না। শুধু তুমি মুখ বাড়িয়ে দেখে নাও। আমি কাল রাতেই সইয়ের বাড়ি থেকে এসে গেছি।'
ততক্ষণে সোনালী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্যালকনির কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখেন, কৃষ্ঞবর্ণা কাজলের মুখে তখনো সাজের শেষ অংশটুকু রয়েছে। কালো চাঁদপানা মুখটায় লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে। বয়স খুব বেশি হলে চব্বিশ বছর হবে। গায়ে একটা লাল কুর্তি, পরণে একটা রং ওঠা পাজামা। দন্ত বিকশিত করে বললো, 'তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, কাকীমা। বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেছে। একটা বাড়ি সেরেই তোমার বাড়ি আসছি। '
সোনালীও অমনি বলে উঠলেন, 'মনে থাকে যেন। দু'দিন তুমি আসো নি। বাসি ঘরদোর সব পড়ে আছে। বাসন এক ডাঁই। না আসলে কিন্তু এবার মাইনে কাটবো।'
'ঠিক আছে। তুমি দেখো ঠিক আসবো।' বলে কাজল প্রায় এক ছুট্টে বেরিয়ে গেলো।
বেলা তিনটে বেজে গেছে। সোনালী ওর ফোনে ফোন করতে গিয়ে দেখে, সুইচ অফ।
এসব কাজলদের এক একটা ছলছুঁতো। সোনালী বুঝে নেয়, আজ আর ও আসবে না। কাল অবশ্য সব বাড়ির আগে সোনালীর কাজ করতে আসবে। এভাবেই যে ও মানিয়ে গুছিয়ে কাজ করে। সবারইযে ওকে আগে দরকার। ও বেচারাতো একটাই মানুষ। ব্যালান্স করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সোনালী কাকীমা জানেন, গতকাল ঔ কেন আসেনি বা ফোনের সুইচ কেন অফ ছিলো, কাজলের কিছ থেকে জানতে চাইলে ও নিশ্চিত করে বলবে, 'কাকীমা চার্জ চলে গেছিলো যে।' এরকম বহুবিধ ছলনা ও করে থাকে। করতেই হয়। এতগুলো কাজ, পেরে ওঠে না যে। কিন্তু করতেই হবে। পেটের দায়, বড় দায়।
নিজেদের অস্তিত্বকে টিঁকিয়ে রাখতে গিয়ে, ওরা নিছকই মিথ্যেসত্যির বেসাতি করে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করতে গিয়ে কাজল ওর জিভের ডগায় পিচ্ছিল মিথ্যে সত্যি লাগিয়ে রাখে। কারণে অকারণে, ও এসবের আশ্রয় নিয়ে থাকে। আর এমন নিঁখুতভাবে ইনস্ট্যাণ্ট বলে যায়, কেউ বুঝতেই পারে না, কাজলের কোনটা আসল আর কোনটা নকল। এছাড়া ওরও যে কিছু করার নেই। ওও তো মানুষ। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর অ্যালার্ম দিয়ে যখন ঘুমিয়ে পড়ে, এক একেক দিন এমন হয়, ঘুম ভাঙানোর অ্যালার্ম বেজে যাবার পরও ঘুম ভাঙেনি। ঘড়ির কাঁটাতো আর থেমে থাকে না। কাজল পড়িমরি করে ছুটতে থাকে। তাছাড়া, কি করবে ও?
মোট আট বাড়ি ও কাজ করে। সিরিয়ালি কাজ করতে করতে, বেলা একটা বেজে যায়। এই একটার মধ্যে আটবাড়ি কাজ সারতে, ওকে ভোর পাঁচটায় উঠতে হয়। স্বামী অনিল দাস, ক্ষৌরকার্য করে, পাতিবাংলায় আমরা নাপিত বলে থাকি। পাড়ার বটগাছটার তলায় বসে যা রোজগার করে, তাতে নিজে, তিনটে ছেলে, কাজল, কাজলের মা, বাবার ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় না। কাজলের মায়ের নিজের ওই একটা কুঁড়েঘর ছিলো, তাই রক্ষে। নাহলে অনিলের বাসস্থান বলে কিছু ছিলো না যে। বিয়ের সময় একটা ঘর ভাড়া করেছিলো বটে, কিন্তু সেরকম আয় নেই, তার উপর পরপর তিনটে ছেলে হয়েছে। এতগুলো লোকের খাবারের সংস্থান করতে গিয়ে, বাসস্থানের ভাড়া দিয়ে উঠতে পারছিলোনা। বেশ কয়েকমাস ডিফল্টার হয়ে যাবার পর, বাড়িওয়ালা নিজে এসে ওদের চলে যেতে বলে।
শ্বশুর শাশুড়ির আবার দয়ার শরীর! মেয়ের এমনতর ঘোর বিপদের দিনে, ওদের সবাইকে নিজেদের কুঁড়েতে নিয়ে চলে আসে। সেখানে অত লোকের জায়গা সংকুলান হয় না। এসব দেখে, শালা শালার বৌএর চক্ষু চড়কগাছ। মায়ের ঘর, তার উপর বোনের বেসাহারা অবস্থা দেখে কাজলের দাদার বড় মায়া হয়। বৌ'কে নিয়ে নীলমণি তাই অনিলদের নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে, অন্যত্রবাসা ভাড়া করে চলে যায়। তাতে অবশ্য দু'ভাই বোনের মধ্যে একটু মনোমালিন্য হয়েছিলো। কিন্তু কিছুই করার নেই। ঘরটা বড় হলেও, তিনটে পরিবার একসাথে থাকতে পারে না। এর থেকেও বলা উচিৎ, এভাবে জড়াজাপ্টি করে থাকাটা মোটেই শোভনীয় নয়।
ওরা চলে যাবার পর মেয়ে জামাই আর ওদের বাচ্চারা ঘরের ভিতরটা থাকে, আর কাজলের মা বাবা দালানে একটা তক্তাতে ঘুমায়। ঝড়বৃষ্টি হলে অবশ্য অন্য কথা। নিরুপায় হয়ে, সবাই একঘরেই থাকে। এভাবেই ওদের দিন যাপন হয়।
কালে কালে পেট বড় হচ্ছে। অর্থাভাব কাজলের চিত্তকে নাড়া দিয়ে ওঠে। ও লোকের বাড়িতে কাজে নেমে পড়ে। স্বামীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আয় না করলে চলবে কী করে? বাচ্চা তিনটেকেতো মানুষ করতে হবে। নিজে নবমশ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। তারপর চুলবুলি, রসের নাগরী, কাজল ফুটপাতবাসী অনিলের প্রেমে পড়ে। কোথায় কী করে বসে, এই সংশয়ে কাজলের মা কাজলকে পড়াশুনা ছাড়িয়ে, ওই চালচুলোহীন অনিলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।
প্রথম প্রথম কাজ না করতে হলেও, কাজল এখন পরী, মুন্নি, প্রমিলাদের সাথে ভোর হলেই হাসির কলতান তুলে কাজের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এভাবেই যে ওদের বেঁচে থাকতে হয়।
--------------
কলমে: বুলা বিশ্বাস
ফোন নাম্বার: 7980205916
মেল আইডি:
bulabiswas60 @gmail.com
