শুভ চক্রবর্তী

Horror Tragedy Thriller

3  

শুভ চক্রবর্তী

Horror Tragedy Thriller

মায়া

মায়া

4 mins
298


তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে । আকাশ পরিষ্কার থাকায় সুরেন বুঝতে পারে নি যে বৃষ্টি আসতে পারে বলে । ও ছাতা নিয়েও বেরোয় নি । টোটোতে উঠেছে, এমন সময় বৃষ্টির আগমন । এখন বেচারা নামবে কি করে?

নেমেছে - কি ভিজেছে !

ওর হাতে এখন প্যাকেট ভর্তি ফুলের মালা । কাল যে বৃহস্পতিবার ! সকাল, সন্ধ্যা দু বেলা যে লক্ষ্মী পুজো আছে !

সুরেন একজন ছাত্র মাত্র । ইলেভেনে উঠেছে । সময়ের হাতে সে সর্বদা ধরা দিয়েছে ছোট্ট শিশুর মতোই । জয় পরাজয়ের খেলায় সর্বদা জিতেই এসেছে । সে খেলার মাঠেই হোক, বা শিক্ষাক্ষেত্রে ।

ছোটোবেলা থেকে আদর, যত্নে মানুষ হয়েছে সৎ মায়ের কাছে । ও ! ভুলেই গিয়েছি বলতে, সুরেনের যে মা নেই । সেই যখন ছোট্ট সুরেন প্রথম বন্ধু বানালো, ' ইস্কুলে ' ভর্তি হলো, তখনই ওর মা মরে গিয়েছিলো । খুব কেঁদেছিলো ও । যতই হোক, ও তো খুব ছোটো ছিল তখন । বাবা অনেক কষ্টে শান্ত করেছিলেন তাঁর আদরের বাবান কে ।

তারপর তো সুরেন নতুন মা পেল । প্রথম প্রথম সুরেন কষ্ট পেলেও ওই কষ্টটা বোধ করি নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলো কয়েকদিন বাদেই । পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যাবার পর সুরেন বুঝলো, জন্ম মৃত্যু সকলি নিয়তির নিয়ম মাত্র । " জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে " কথাটা মনে করতে থাকে বারংবার ।

কিন্তু সুরেনের সৎ মা তাঁর ' সৎ ' শব্দটির সাথে সুরেনকে খুব একটা পরিচয় করালেন না । বরং শেষের ওই ' মা ' শব্দটির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিলেন খুব ভালোভাবেই ! ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দিয়ে যে বিনা রক্তের সম্পর্ককে এতটা কাছের করে তোলা যায়, তা তিনিই শিখিয়ে দিলেন ।

কিন্তু বিধাতা এক অদ্ভুত ভয়ঙ্কর খেলা খেললেন । যে খেলায় নষ্ট হতে বসলো তিন তিনটে জীবন । সময়ের অদ্ভুত পরিহাসে জীবন মরণ হয়ে উঠলো সুরেনের ব্যক্তিগত জীবনের এক উপসংহার মাত্র ।

ঘুম থেকে উঠে ঘুমচোখে প্রায় দিনকতক সুরেন লক্ষ্য করেছে বিছানার পায়ার সামনে খান চারেক খালি মদের বোতল ! সুরেন বুঝেছে সংসারে অশান্তি আসতে চলেছে । কিন্তু সেই অশান্তি যে কি, তা সে বুঝতে পারে নি, হাজার হোক সুরেন খুব ছোটো তো !

- " বাবু, নামো । এসে গেছে তোমার প্রফুল্ল মিষ্টির দোকান "

- " হ্যাঁ কাকু, নামছি " বলে দশ টাকার নোট বের করে টোটোচালককে দিতে দিতে মনে মনেই বলল - কি করে যাবো এই বৃষ্টির মধ্যে?

এমন সময় সুরেনের ছোট্ট ফোনটা বেজে উঠলো ।

নম্বরটা অপরিচিত । সুরেন ফোন রিসিভ করলে ওপার থেকে এক মহিলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ।

-" কে? কে বলছেন? "

- " আমি বাবু, তোর স...স..."

-" হ্যালো, কে? কে বলছেন? "

ইতিমধ্যে চালক বার কয়েক সুরেনকে টোটো থেকে নেমে যাবার জন্যে অনুরোধ জানিয়ে দিলো ।

-" হ্যাঁ, হ্যাঁ কাকু, নামছি । "

বলে এক দৌড়ে ফোনটা পকেটে পুড়ে নিয়ে দোকানের টিনের শেডের তলায় গিয়ে দাঁড়ালো সুরেন ।

-" হ্যাঁ হ্যালো, কে বলছেন? আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না । হ্যালো.. "

- " আমি তোর বাবাকে বলে দিয়েছি, ছাতাটা নিয়ে তোকে আনতে যাবার জন্যে । তুই ওখান থেকে এক পাও নড়বি না । "

ফোনটা কেটে গেল । এই বর্ষার রাতে হিমশীতল বায়ুর স্পর্শেও সুরেনের কপাল ঘেমে উঠলো । গলাটা ওর চেনা ! সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল কিছু ঘটনার ছবি । চোখ ছলছল করে উঠলো ওর ।

পাঁচ মিনিট পর সুরেন দেখলো ওর বাবা ছাতা হাতে হাজির হয়েছেন । - " কত করে বললাম, ছাতাটা নিয়ে বেরোতে, একটাও তো কথা শুনিস না তুই । নে নে ছাতাটা নে । চল, জলদি, পুজো করতে বসেছিলাম, আর তখনই.. "

- " তখনই কি বাবা? "

-" মনে মনেই কে হঠাৎ বলে উঠলো জানিস, তুই বৃষ্টির জন্যে আটকে আছিস রাস্তার মধ্যে । পুজো করছিলাম, হয়তো মা কালীই মনে মনে বলে দিলো ! জয় মা কালী, জয় মা কালী । "

সুরেনের বাবা দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানিয়ে কালী নাম করলেন বার কয়েক ! তারপর -" চল চল, বাকি কথা পরে হবে ক্ষণ বাড়িতে গিয়ে " বলে ছাতা খুলে সুরেনের আগে আগেই চলতে শুরু করলেন ।

একমাসও হয়নি সুরেনের সৎ মা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, যে সুরেন ফোনে যে গলাটা শুনেছে, সেই গলাটা তার সৎ মায়েরই । সুরেনের তাই গলাটা চিনতে খুব একটা অসুবিধে হয় নি । ওর মায়ের সাথে ওর বাবার ঝামেলা হতো ঠিকই, কিন্তু সৎ ছেলেকে এখনও পর্যন্ত বোধ হয় তিনি ভুলতে পারেননি । সম্পর্ক তো শুধু রক্তেরই হয় না ! সম্পর্ক ভালোবাসাতেও গড়ে !

সুরেন বুঝলো সে এখন একা হয়েও একা নয় । তার জন্মদাত্রী মা তাকে ছেড়ে চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু যিনি সুরেনকে আরও বাকি দশটা বছর দেখলেন, দশটা বছর নিজের আঁচলের নিচে লুকিয়ে রেখে স্নেহ, প্রেম ও মমতা দিয়ে গড়লেন, তিনি দেহটাকে ত্যাগ করলেন, কিন্ত আত্মাটাকে সুরেনের কাছে সমর্পণ করলেন । তাঁর মুক্তি চাই না । তাঁর চাই ভালোবাসা ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror