নিরঞ্জন
নিরঞ্জন


ভোর হয়েছে । ভোরের পাখির সুরের সাথে নীল আকাশে মেঘের খেলা আজ যেন একটু নীরব, চারিদিক কেমন যেন বিষণ্নমাখা পরিবেশে আবৃত । পুব আকাশে লাল আভা মুচকি হেসে যেন উন্মুক্ত হচ্ছে - রাত্রির কারাগার থেকে । ওই দিকের পাড়ার প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । তবে এই সকল সত্যাধুনিক আবহাওয়া মানুষের জীবনকে এক নতুন রূপ দিতে পারে কি? কারও মন আনন্দে, কারও বা দুঃখে, কারও বা হাসিতে, কারও বা কষ্টে, কারও বা রাগে এবং কারও বা অভিমানে এই পরিবেশ তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখে ।
আজ দশমী । সকাল থেকেই রবির মনটা খারাপ হয়েছিল । রবির ছেলেবেলা থেকেই সখ কবিতা লেখার তাই সারাটাদিন জানালার সামনে কবিতার ডাইরির খাতাটা নিয়ে বসেছিল । ওর বয়স এখন পনের ! আর এই পনের বছর বয়সেই কত যে কবিতা ওর ডাইরির ভিতর রয়ে আছে কি বলব ! যেমন -
আমার কেটে যাওয়া রোদ্দুরের বেলা
আকাশে মেঘেদের দল করছে যে খেলা ।
কত রাত একলা বসে যে এইরকম কবিতা লিখেছে তার খবর নেই ! সুদূর পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে শরতের নীল ও সোনালী রঙের মিশ্রনে মেতে ওঠা আকাশ, সাদা সাদা মেঘ একে পরস্পরের পিঠে যেন উঁকি দিচ্ছে । এই সকল মনোমুগ্দ্ধ পরিবেশ রবির হৃদয়ের দৃশ্যপটে সারাজীবনের জন্য এক ছবি এঁকেছিল ।
সন্ধ্যেবেলা সময় যখন 6 টা, রবির বাড়িতে চার বন্ধু এলো । প্রস্তাব - সব বন্ধু মিলে ঘাটের পাড়ে দাঁড়িয়ে মায়ের বিসর্জন দেখবে । রবির মা কিছুটা অসম্মতি জানালেও পরে বন্ধুদের কথায় তিনি রাজি হয়ে যান । তবে শর্ত রাখলেন যে - এখন সন্ধ্যে 6 টা, বাড়ি ঢুকতে হবে রাত 9 টার মধ্যে । আর রবি যেন ঘাটের খুব কাছে না যায় ! দূর থেকে যেন বিসর্জন পালা দেখে খুবই সতর্কভাবে !
যখন সব বন্ধু মিলে ঘাটে পৌঁছানো গেল, তখন পৌনে সাতটা । ঘাটে মানুষের ভিড় একেবারে সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে । রবি ও তার চার বন্ধু মিলে ঘাটের পাঁচিলের উপর উঠে গেছে ।
- ওই দেখ, ঘোষপাড়ার প্যান্ডেলটা ।
- আরে হ্যাঁ হ্যাঁ । কি বড়ো রে ঠাকুরটা ।
p>ঘোষপাড়ার ঠাকুর তখন সবে বিসর্জন হয়েছে । এমন সময় রবির চোখ পড়ল ঘাটের একেবারে শেষ সিঁড়িটার বাঁ দিকে ছোট্ট গাছটির দিকে । আর চোখ পড়তেই রবির সারা শরীর হিম হয়ে গেল । সিঁড়িতে একটা বাচ্ছা ছেলে, বয়স আন্দাজ ছয় কি সাত হবে, ছোট্ট গাছটির পাশে দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে । সাথে কেউ নেই । এদিকে ওই পাড়ের আঁধো-আলো-অন্ধকারের দৃশ্যপটে রবি ও ঘাটের সমস্ত মানুষ বুঝতে পারল, যে বাণ আসতে চলেছে ।
হুলুস্থূল বেঁধে গেল । কোন দিকে যে মানুষ দৌড়ে পালালো, তা কেউ জানে না । এদিকে রবি ওই ভিড়ের মধ্যেও দেখতে পেল এক মহিলা উচ্চস্বরে চেঁচাচ্ছেন আর ঘাটের এদিক আর ওদিক করছেন ।রবি কিছুটা সামনে যেতেই স্পষ্ট শুনতে পেল - বিল্টু ও আমার বিল্টু রে, কোথায় গেলি !
রবি বুঝলো যে ওই ছেলেটির নামই বিল্টু । রবি এখন খুব ভয় পেয়ে গেল । সে দেখল গঙ্গার জল সিঁড়ি ছাপিয়ে অনেক উপরে উঠে এসেছে । সমস্ত লোক হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছে । কেবল একজন বাদে । খানিক পর রবি দেখল - দূরে, আঁধো-আলো চন্দ্রালোকের দৃষ্টিতে ও ঘাটের ল্যাম্পের আলোয় দেখা গেল গঙ্গার বুকে সমস্ত দূর্গা-কাঠামো ভেসে যাচ্ছে আর তার পাশে এক শিশু । যার নাম বিল্টু ।
সমস্ত লোক যখন ঘাটের দুপাশে ভাগ হয়ে এসে দাঁড়ালো, শোনা গেল গঙ্গার হুঙ্কার । কিন্তু রবি সেসব কিছুই শুনতে পেল না । সে শুধু শুনল - সেই মায়ের হাহাকার - বিল্টু রে, তুই কোথায় গেলি, ওরে বিল্টু !
পরদিন ভোরেই রবির যখন ঘুম ভাঙল, তখন সকাল সাতটা । উঠেই সে ছাদে চলে গেল । পুব আকাশে আজ আর রোদ ওঠে নি, কালো মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে আছে । রবির চোখে ভেসে উঠল, কালকের সেই দৃশ্য, ভেসে উঠল সেই মায়ের সন্তান হারানো চিৎকার । এইসব ভাবতে ভাবতেই সে যেন কতকটা নিজের খেয়ালেই বলে উঠল -
আজ খুলল মনের বদ্ধ দুয়ার
ভাসছে তরী, আসছে জোয়ার !
দুই চোখেতে জল আসছে মাগো
স্মরণ তোমায় করে !
মুছিয়ে দিও, আজ সেই জল মাগো
দিয়ে তোমার আঁচল কোণে !
সমাপ্ত...