বৈ - একটি অনন্য কাহিনী
বৈ - একটি অনন্য কাহিনী


- বৈ...বৈ....বৈ -
হালকা এক গোঙানির শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল । বাইরে বৃষ্টি এখনো থামে নি পুরোপুরি । ঝিরঝির শব্দ এখনও কানে আসছে বেশ স্পষ্ট । লম্ফের আধো অস্পষ্ট আলোয় বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত এখনো গভীর । সবে রাত দুটো ! পাশে আমার বন্ধু পরান শুয়ে গোঙাচ্ছে । ঘুমের ঘোরে বৈ বৈ করে চেঁচাচ্ছে । গায়ে ধাক্কা দিতেই হুড়মুড় করে উঠে বসল । আমি বললাম - কিরে কি হলো তোর? গোঙাচ্ছিলি কেন?
ওর চোখে ঘুম আছে বলে মনে হলো না । লম্ফের আলোয় ওর কপালটা ঘামে চকচক করছে ।
ও কিরকম একটু হকচকিয়ে গেল । তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, ঘুমাও নি ভাই?
আমি বিরক্তির সাথে একটু মেজাজ গরম করেই বললাম - তুমি তো গোঙাচ্ছিলে, ঘুম আসবে টা কি করে?
নমনীয় গলার স্বরে বিড়বিড় করে আমায় কেমন যেন দুঃখিত হবার ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে কি যেন বলল, মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না । তারপর হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল - বৈ আজও এসেছিলো জানো নরেন?
- বৈ? সে কে? দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি কি প্রেমে পড়লে নাকি হে ভায়া?
- আরে না না, বৈ কোনো মেয়ে নয় । বৈ হলো আমার সাধের গাই । গাঁয়ের বাড়ির আমার ছোট্টবেলার বন্ধু ভাই ।
- গরু? ওই গরু তোমার স্বপ্নে আসে রোজ?
- ও কোনো সাধারণ গরু হলে হয়তো আসতো না ভাই । কিন্তু ও যে আমার মা, বাবা ও সাথে পুরো পরিবারটাকে দু-দুবার বাঁচিয়েছে । ও এখন নেই ভাই ।
স্বর্গে গেছে আজ পাঁচ বছর হলো ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ! দেখলাম, পরানের চোখদুটো ছলছল করছে । শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর আটকাতে পারল না । জল খাবার মিথ্যা চেষ্টার অঙ্গিভঙ্গিমায় বিছানা ছেড়ে উঠে জল আনতে চলে গেল ।
পরান এখন আমার খুব ভালো বন্ধু । যতটুকু জানি ওর সম্পর্কে গাঁয়ের বাড়ি থেকে ও কলকাতায় এসেছে আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল । পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে পথ চলার পথটা ও খুব ভালোভাবেই জানে ।
ওর সাথে বন্ধুত্বের তিনটে বছর কেটেছে । কিন্ত তবু ওর গত বিশ বছরের কাটাছেঁড়া সমেত অতীতের কথা আমি কিছুই জানি না । সত্যি বলতে জানবার কোনো ইচ্ছে আমার কোনোদিনই ছিল না । ওর জীবন, আমি জেনে কি করব? কিন্তু আজ ওকে এই অবস্থায় দেখে ওর ওপর ভারি মায়া জন্মালো । এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ও আমায় ওর ঘরে রাতটা কাটাতে দিয়েছে । তবে ঘর বলা ভুল, বলা ভালো একটি ছোট্ট পায়রা থাকার ঝুপড়ি । আর তার উপর লোডশেডিং । ওকে লোডশেডিং এর ব্যাপারে বলাতে ও যা বলল, তাতে চুপ থাকতেই বাধ্য হলাম । বলল, বাড়িওলা নাকি তার কেটে দিয়েছেন !
পরান এলো । এক হাতে জলের গ্লাস ও অন্যহাতে একটি মোমবাতি দানির উপর একটি জ্বলন্ত মোমবাতি ধরে বিছানার সামনে এসে দাঁড়ালো ।
জল খেয়ে গ্লাস রেখে বিছানায় বসার পর নিজ মনেই বলতে লাগলো । বুঝলাম, আজ আর আমার ঘুম হবে না । সারারাত গল্পই শুনতে হবে ।
- আমার শৈশব কেটেছে খুব সুন্দরভাবে । বৈ এর সাথে খেলা, পড়া আর মায়ের বকুনি খেয়ে কবে যে এতো বড়ো হয়ে উঠলাম, বুঝতেই পারলাম না । আমাদের মাটির বাড়ি । অনেক কষ্টে বাবা চাষবাস করে পরিবারটাকে সামলেছেন । আজ বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন । সময়ের সাথে সাথে তাঁর কাজ করার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে ভীষণ রকমভাবে । একমাত্র জীবিকা নির্বাহের সম্বল ওই চাষের জমিটুকুই । কিন্তু আজ থেকে সাত বছর আগে যেবার ভীষণ বন্যা হলো, সেবার আমাদের চাষের জমি একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দু বেলা খাওয়া খরচের হিসেব এতটাই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠল, যে আমার পড়াশোনা এক প্রকার ছাড়তেই হলো । উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডিটাই আমার ছাত্রজীবনের শেষ গন্ডি ।
বন্যা থামার পর, সারা গাঁয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেল । কত চাষীভাই তো পেটের দায়ে আত্মহত্যার পথ বাছলো । হয়তো আমাদের পরিবারও এই পথই বেঁচে নিতো, কিন্তু ওই যে কথায় আছে - " রাখে হরি মারে কে? " মৃত্যু আমাদের ধারে কাছেও আসতে ভয় পেল । সময় মনে করিয়ে দিল, গাঁয়ের এক জমিদারি বংশের সন্তান রতন পাল মহাশয়, চাষীভাইদের জন্যে টাকা ধারে দিচ্ছেন । ত্রাণকর্তা রূপে তাঁর আগমন বেশ অদ্ভুত লাগলো । এর কারণ একটাই, এখনকার বর্তমান যুগের গাঁয়ের জমিদারেরা নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে নয়, শুধু তার জমিদারি বাপের দেওয়া কিছু টাকা, সম্পত্তি, বাড়ি, গহনা ইত্যাদির উত্তরাধিকার রূপে বেকার বাড়িতে বসে চাষীদের জমির উপর ভাগ বসিয়ে কর আদায়ের ফন্দি বের করে পেট চালায় । এরা না কারও ভালো চায়, না কারও ভালো করে । তাই খবরটা শুনে খুব অবাকই হই ।
টাকা ধার দেবার সময় চুক্তি করা হলো । চুক্তির মেয়াদ পনের মাস । কিন্তু এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হবার পরও যখন দেনার অর্ধেকেরও কম পয়সা উপার্জনে ব্যর্থ হয়ে পড়লাম, রতন পাল নিজে বাড়ি আসতে বাধ্য হলেন । কিন্তু ওই আসাটাই বোধ হয় কাল ছিল । রীতিমতো শাসিয়ে গেলেন আমাদের । হাজার বোঝানোর পরও কিছুতেই তিনি বুঝতে চাইলেন না যে আমরা এক সংকটের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি । যেখানে প্রতি
দিন বৈ এর দেওয়া দুধ বিক্রি করে দু বেলা খাবাবের জোগাড় করতে হয়, সেখানে ওনার দেওয়া দেনার টাকা এইটুকু সময়ের মধ্যে পরিশোধ করাটা একপ্রকার দুঃসাধ্যের ।
মেয়াদের পনের মাস হতে বাকি ছিল মাত্র তিনদিন । সেইদিন বৈ একটা সন্তান প্রসব করল । আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না । আর ঠিক তখনি আরও একবার রতন পাল আমার বাড়িতে টাকা আদায়ের জন্যে হাজির হয়েছিলেন বলে শুনলাম ।
কিন্তু ঠিক সেইদিনের পর থেকেই হঠাৎ করেই রতন পাল উধাও হয়ে গেলেন গাঁ থেকে । সমাজে কান রাখতে যেটুকু জানলাম, তার সারমর্ম এই, যে রতন পাল এক খুনের দায়ে পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ।
সংবাদটা খুব আশ্চর্যের হলেও মনে মনে খুশিই হলাম একরকম । দেনাটা শোধ করার সময় আরও কিছু পাওয়া তো গেল !
কিন্তু এদিকে আরও একটি খারাপ সংবাদে মন খারাপ হয়ে উঠলো । দশ দিনের বাছুরটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মারা গেল । আর তারপর থেকে বৈ দুধ দেওয়াটাও চিরদিনের মতো বন্ধ করে দিল ।
তারপর প্রায় আরও তিন মাস কেটে গেল । একদিন সন্ধ্যেবেলা মা তুলসী মঞ্চের সামনে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে পুজো করছেন । বাবা ঘরে আছেন সারাদিনের খাটাখাটনির পর । আমি গোয়াল ঘরে বৈ এর সাথে খেলা করছিলাম । ওর মনটা তখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে নি । বাইরে বৃষ্টি পড়ছে জোরে । এমন সময় হঠাৎ কিছু জন দৌড়ে বাড়িতে ঢুকল । আমি উঠানে এসে দেখলাম যে রতন পাল এসেছেন । রতন পাল এখন এতদিন পর এখানে কেন? - এই প্রশ্নটা মাথায় তখন থেকেই ঘুরপাক খেতে শুরু করে দিয়েছিলো । আমি প্রশ্ন করলাম - আরে রতনবাবু আপনি? আসুন আসুন, বসুন ।
কিন্তু সেসব কথা শোনে কে? সেসব কথা শোনার মতো বোধ হয় সময়ই ছিল না তাঁর কাছে । হঠাৎ করে রতন পাল আমার মায়ের পিছনে এসে মা কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গলায় ছুরি বাগিয়ে ধরল । বাবা ভয় পেয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলেন । আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না । তারপর রতন পাল বাবার দিকে ফিরে ঘড়ঘড় শব্দ করে বলে উঠলেন - টাকাটা ফেরত দিন । জলদি, জলদি । আমার বেশি সময় নেই ।
স্পষ্ট দেখলাম রতন পালের হাত কাঁপছে । কপালে ঘাম লেগে আছে বিন্দু বিন্দু । আমি চাইলে হয়তো ওর হাত থেকে ছুরিটা ফেলে দিতে পারি, কিন্তু মায়ের যদি কোনো ক্ষতি হয়? তবে?
আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম । প্রায় দু মিনিট কাটার পর, হঠাৎই বৈ আমার পিছন থেকে এক জোরে হাম্বা শব্দে গোয়াল ঘর থেকে উঠানে ছুটে এল । রতন পাল বৈ কে দেখে সামান্য ভয় পেলেন হয়তো ! বুঝলাম ওঁর হাত এখন আরও কাঁপছে । তারপর বৈ যা করল তার জন্যে শুধু রতন পালই নয়, আমি, বাবা ও মা তিনজনের মধ্যে কেউই প্রস্তুত ছিলাম না । দুই শিং নিয়ে তেড়ে এগিয়ে গিয়ে রতন পাল কে ওই শিংদুটোর মাঝে গেঁথে ছুট মারল বৈ । তারপর মাঠ সংলগ্ন আলের পথ ঘেঁষে দৌঁড়াতে লাগলো বৈ । দূরে যত দূর চোখ গেল, দেখে বুঝলাম, রতন পাল তখনও বৈ এর শিং এর মাঝখানে ঝুলছে, আর হাত পা ছুঁড়ছে । তারপর ঠিক মিনিট কাটার পর লক্ষ্য করলাম বৈ পুরো মাঠের এক চক্কর লাগিয়ে গোল করে ঘুরে আবার আমাদের বাড়ির পথে আসছে । কিন্তু আবার একি - বৈ পথ পরিবর্তন করলে কেন? হঠাৎই আমার বাড়ির পথ ছেড়ে বাঁ দিকে গোঁসাইজির বাগানের পথের দিকে ছুট লাগলো বৈ । কিন্তু বৈ এর এই পথ পরিবর্তনটাকে দেখে এতটা ভয় লাগতো না জানো? ভয় লাগতো না যদি সত্যিই বৈ কোনো এক বাগানের দিকে যেত ! ভয় পেলাম এটা স্মরণ করতেই, যে গোসাঁইজির বাগান আসার পূর্বে একটি পুকুর পড়ে, যে পুকুরকে পার করে বাগানে ঢুকতে গেলে পাশের একটি ছোট্ট পথ ধরে এগিয়ে যেতে হয় । বৈ এর পক্ষে সে রাস্তা ছুটে পার হওয়া অসম্ভব । আমরা সেই দিকেই ছুট লাগলাম বৈ বৈ করে । তারপর যখন গোসাঁইজির পুকুরের সামনে পৌঁছলাম তখন পুকুরের সামনে লোকেদের ভিড় দেখে আমার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো । তারপর পুকুরে চোখ পড়তে দেখলাম পুকুরের মাঝখানে বৈ ভাসছে । মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আর সেই রক্তের রঙে পুকুরের জল লাল হয়ে গেছে ।
রতন পালকে ওই পুকুর থেকে মৃতাবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো ।
বৈ এর সৎকার হলো জানো বেশ ভালোভাবেই । কিন্তু ওর মৃত্যুর কারণ নিয়ে আমার মনে এক ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল । পরে জেনেছিলাম, বৈ যখন রতন পালকে শিং এ গেঁথে দিয়ে ছুঁটছিল, রতন পাল ওর হাতের ছুরিটা বৈ এর মাথায় গেঁথে দিয়েছিলেন । যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে আমার বাড়ির দিকেই ও আসছিল । কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে শেষ পর্যন্ত নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে নি । রতন পালকে সাথে নিয়েই পুকুরে ঝাঁপ মেরেছিলো । আমার বৈ সন্তানহারা হয়েছিল, তাই আমাকে মাতৃহারা করতে দেয় নি ভাই । তাই তো ও এখনো আমার কাছে অমর হয়ে আছে ! এই দেখো, সকাল হতে চলল আর আমি এসব বলে চলেছি ! আমি একটু আসছি, কেমন? তুমি একটু বসো ভাই !
শেষের কথাগুলো বলার সময় পরানের গলা কেঁপে উঠল । শেষে নিজেকে সামলানোর জন্যে বিছানা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেল । জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, ভোরের আলো ফুটেছে । মোরগের ডাকে প্রভাতের আলো গলা মিলিয়েছে ।
সমাপ্ত...