সেই স্পর্শটা - love -
সেই স্পর্শটা - love -


হাঁটুর উপর কনুইয়ে ভর দিয়ে, তেবড়ানো গালে হাত রেখে বসে আছেন মিসেস দেবনাথ। বসন্তমাখা বাতাসের স্পর্শ নিতে নিতে স্মৃতিসমুদ্রে হাতড়ে চলেছেন, আর বেঞ্চের উপর বসে অপেক্ষা করছেন নাতির ফিরবার জন্যে।
মিসেস দেবনাথের নাতির বয়স মাত্র পাঁচ বছর। ছেলের আদেশ, নাতি যতক্ষণ আঁকা শিখবে, ততক্ষণ সামনের মাঠটায় বসে তাঁকে প্রতীক্ষা করতে হবে।
প্রায় রোজই আসেন তিনি। বেলা পড়ার ঠিক আগেই, নাতিকে সঙ্গে করে নিয়ে ফিরে যান। তবে কিছুদিন ধরে তাঁর অপেক্ষা আরও একজনের জন্যে। তিনি অবশ্য একটু স্পেশাল। মিসেস দেবনাথের বয়স, ঐ পঁয়ষট্টির কাছাকাছি হলেও তাঁর মনের যৌবন এখনও ফিকে হয়ে যায় নি। বেলাশেষে তাঁর গন্তব্য বাড়ি ফিরে যাওয়া হলেও, তাঁর মনের গভীর অন্তরালে যিনি এখনও বাস করেন, তিনি হলেন মিস্টার মিত্র। তাঁরও বয়স ঐ আটষট্টির মতো।
সে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। মিসেস দেবনাথের সাথে মিস্টার মিত্রের সম্পর্ক যখন পাঁচ বছর পূর্ণ হলো, তখন মিসেস দেবনাথ মিস্টার মিত্রের হাতে হাত রেখে বললেন -" চলো না আমরা পালিয়ে বিয়ে করে নি। পাঁচ বছর তো হলো, আর কতদিন নিজেকে প্রমাণ করবে? "
প্রশ্নটা কঠিন হলেও খাঁটি বাস্তব। মিসেস দেবনাথের বয়স তখন ত্রিশ ছুঁয়েছে তখন। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্যে তাড়াও দিতে শুরু করেছে। মিসেস দেবনাথ একথা-ওকথা বলে কাটিয়ে দিলেও, মিস্টার দেবনাথ কিছুতেই মানছেন না। এদিকে মিস্টার মিত্রকেও খুব একটা পছন্দ নয় তাঁর।
মিস্টার মিত্র তখন সবে একটা প্রাইভেট সেক্টরে ঢুকেছেন। সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে নিতে যখন বয়স তেত্রিশ পেরোলো, তখন তিনিও বুঝলেন, এবার সত্যিই কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু পালিয়ে বিয়ে তিনি কখনোই করতে চান নি। সকলের অমতে গিয়ে বিয়ে করাটা তাঁর কোনোদিনই পছন্দের তালিকায় ছিল না। কিন্তু মিসেস মিত্রকেও তিনি কম ভালোবাসতেন না!
নাতির ফিরে আসার সময় হয়েছে। মিসেস মিত্র হাতঘড়ির দিকে চোখ বোলালেন। পাঁচটা বেজে দশ। মাঠের ধারে থাকা ল্যাম্পপোস্টের মড়া হলদেটে আলো জ্বলে উঠতেই, একটা গম্ভীর গলা ধেয়ে এলো মিসেস দেবনাথের দিকে। - " এখনও বসে আছো? গুবলুর ছুটি হয় নি? "
মিসেস দেবনাথ মুখ উঁচিয়ে চাইলেন। চশমা পরিহিত এই মানুষটির চেহারা তাঁর খুব চেনা। পাকা গোঁফ-দাঁড়িতে লুকিয়ে থাকা মুখটার প্রতি মায়া এখনো ফুরিয়ে যায় নি।
মিসেস দেবনাথ তরল গলায় বললেন - " না। তবে হয়তো আর দশ মিনিটের মধ্যেই ছুটি হয়ে যাবে। " সংকোচ এনে প্রশ্ন করলেন -" আজ এতো দেরিতে এলে? "
-" হ্যাঁ, ঐ আজ পুঁটির বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল। মামার বাড়ি থেকে ফিরেছে। প্রায় একঘন্টা লেট্। ম্যাডাম
খুব রেগে গেছিলেন। " বলেই হো-হো করে হাসতে লাগলেন।
মিসেস মিত্রের চোখ ছলছল করছে। মনের মধ্যে জমে থাকা সেই প্রশ্নটা করবো করবো করেও করা হয়ে ওঠে নি তাঁর। তাই তাঁর মনটাও কোনোদিন হালকা করা সম্ভব হয় নি। মনের ভিতর যে পাথর চাপা পড়ে আছে, তার কষ্ট এখনও তাঁকে ভোগ করতে হয়। একজন অচেনা অজানা লোকের সাথে ত্রিশটা বছর কাটানোটা কম কথা যে নয়!
মিসেস দেবনাথের স্বামী আজ থেকে দশ বছর আগেই গত হন। স্বামীর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় খানিক দুঃখ পেলেও, তিনি বেঁচে উঠেছেন। নতুন করে জীবন কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এখন তো আর বাঁচার মতো করে বাঁচা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়! কারণ সমাজের চোখে ভালোবাসার যে এক নির্দিষ্ট বয়স থাকে!
মিসেস দেবনাথ আগের মতো তরল কণ্ঠে -" আচ্ছা। তবে তোমাকে আজ একাই বসতে হবে। কারণ গুবলু এসে গেছে। "
মিস্টার মিত্র লক্ষ্য করলেন, গুবলু কাঁধের ব্যাগ দুলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। এমন সময় একটি বড় পাথরে হোঁচট খেয়ে গুবলু ঘাসের উপর আছাড় খেয়ে পড়লো। মিসেস দেবনাথ ও মিস্টার মিত্র সেই দেখে ছুটে গেলেন ওর দিকে। তারপর উবু হয়ে বসে দুজন দুদিক দিয়ে গুবলুকে ধরে তুলে, পা থেকে ধুলো ঝাড়তে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা। মিসেস দেবনাথ ব্যাস্ত স্বরে বলতে লাগলেন -" আহাঃ, নিচে দেখে তো চলবে গুবলু, দেখলে তো আছাড় খেলে কেমন? "
এদেখে মিস্টার মিত্র বললেন -" আহাঃ, ছেলেটাকে বকছো কেন? আগে দেখোতো, ওর কোথাও লেগেছে কিনা!"
গুবলু কিন্তু চুপ হয়ে আছে। কান্না কান্না পাচ্ছিলো, কিন্তু ওর ঠাকুমা, আর দূরসম্পর্কের এই দাদুর ঠেলায় কান্নাগুলো পালিয়ে গেছে চোখের নিমেষে।
মিসেস দেবনাথের হাতে মিস্টার মিত্রের হাত ঠেকতেই, মনে পড়ে গেল তাঁদের সেই পুরানো দিনগুলোর কথা। যখন তাঁরা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে বসে ভবিষ্যতের প্ল্যান বানাতেন। জীবনের বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে, সেই আশা দেখতেন। কিন্তু আজ সব ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। সেই সকল অনুভূতি কেবলই চাপা পড়ে আছে মিসেস দেবনাথের মনের গভীরে। এখনও তিনি সেই স্মৃতিগুলোকে বাইরে টেনে আনেন। ওদের গায়ে হাত বোলান। কিন্তু তিনি ভুলে যান, যে সেইসকল স্মৃতিগুলোর মালিক শুধু তিঁনিই। মিস্টার মিত্র সব ভুলে গেছেন। ভুলতে চান বলেই হয়তো...
মিসেস দেবনাথ গুবলুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আবছা, অস্পষ্ট কণ্ঠে প্রশ্ন বললেন, -" তুমি কি আজও... "
কথা শেষ হলো না তাঁর। চোখে এলো জল। মুহূর্ত বিলম্ব না করে, গুবলুর হাত ধরে ব্যস্ত হয়ে হাঁটা লাগালেন নিজের বাড়ির পথে।
সমাপ্ত...