মাধাই দা
মাধাই দা


“ গিন্নি মা!” হেঁড়ে গলায় এই ডাকটা শুনলেই বল্টুর ঠাকুমা তাড়াতাড়ি বল্টুর মা কে বলতেন, “ বউ মা ! শিগগির এক হাঁড়ি ভাত বসাও। মাধাই এসেছে।“
মাধাইদা বল্টুদের গ্রামের যত জমিজমা আছে তার দেখাশোনা করত। প্রায় সাড়ে ছ ফুট লম্বা, কুচকুচে কালো মাধাইদাকে অন্ধকারে হঠাৎ দেখলে যেকোনো লোকের পিলে চমকে যাবে, সন্দেহ নেই।
মাধাইদা বল্টুর দাদুর আমলের লোক। বল্টুর বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে তাই তারপক্ষে গ্রামে গিয়ে এইসব দেখাশোনা করা সম্ভব হত না। তাই দাদু মারা যাবার পর থেকে মাধাইদাই সব দেখাশোনা করত। প্রত্যেকবার ফসল কাটা হলে চাল, ডাল, সবজি, ফল আর ফসল বিক্রির টাকা পৌঁছে দিয়ে যেত ঠাকুমাকে।
যেদিন মাধাইদা আসতো সেদিন বল্টুদের বাড়ীতে যেন একটা উৎসব। মাধাইদা রিক্সা থেকে নামাতে থাকতো বস্তা বস্তা চাল ডাল আর সেগুলোকে সাজিয়ে রাখতো বাড়ীর দালানে।
মাধাইদা আসলে বলটুর সব ভাইবোন, মায় ওদের আশপাশের বাড়ীর বাচ্ছারা অবধি জড়ো হয়ে যেত। এর অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। প্রত্যেকবার গ্রাম থেকে আসার সময় মাধাইদা বাড়ীর বাচ্ছাদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো, যেমন গুড়ের পাটালি, তালপাতার ভেঁপু বা মাটির পুতুল।
ঠাকুমাকে টাকাপয়সা বুঝিয়ে দিয়ে পুকুরে স্নান করতে যেত মাধাইদা। বাচ্ছার দল পিছু নিত। স্নান করে এসে মাধাইদা ভাত খেতে বসতো। মাধাইদার ভাত খাওয়া দেখার জন্য সব বাচ্ছারা রান্না ঘরের দরজার পিছনে লুকিয়ে থাকতো। বল্টুর মা একটা আস্ত কলাপাতার ওপর পুরো এক হাঁড়ি ভাত ঢেলে দিতেন । তারসঙ্গে দুটো পেঁয়াজ, কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা, নুন আর খানিকটা তরকারি। ভাতের তুলনায় তরকারির পরিমান এতই কম থাকতো যে ওরা ভেবে পেত না কি করে ঐটুকু তরকারি দিয়ে মাধাইদা অতটা ভাত খাবে।
মাধাইদা কিন্তু নির্বিকার বেশীর ভাগ ভাত, নুন, পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে টেনিস বলের সাইজের গাল করে করে তার সঙ্গে সামান্য তরকারির টাকনা দিয়ে পুরো ভাত খেয়ে নিত। তারপর এক ঘটি জল খেয়ে এক বিশাল ঢেঁকুর তুলে , “ আসি গিন্নি মা!” বলে গ্রামে ফিরে যেত।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। বল্টুর ঠাকুমা মারা গেছেন। বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় কানপুর। ওরা গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় । আজ প্রায় পাঁচ বছর হল বল্টুর বাবা রিটায়ার করেছেন। ওদের পুরনো পৈত্রিক বাড়ী ভেঙ্গে একটা বহুতল হয়েছে। তারই দুটো ফ্ল্যাট জুড়ে আপাতত বল্টুরা থাকে।
মাস কয়েক হল বল্টু একটা চাকরি পেয়েছে। আজ বল্টুর বাবার জন্মদিন। নিজের টাকায় ও বাবাকে একটা রকিং চেয়ার কিনে দিয়েছে। দোকানদার বলল বিকালের মধ্যে ডেলিভারি করিয়ে দেব।
এটা বাবার সারপ্রাইজ গিফট। ভিতরে ভিতরে বল্টু খুব উত্তেজিত। বাবার অনেক দিনের সখ একটা রকিং চেয়ারের। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বেজে গেল এখনো এলো না ডেলিভারি। বারান্দায় হানটান করছে বল্টু। প্রায় পৌনে সাতটা নাগাদ একটা বুড়োমত লোক কাঁধে করে সেই বিরাট চেয়ারটা নিয়ে ঢুকলো ওদের বাড়ীর গেটে।
ustify">“এতো দেরি করে?” ধমকে উঠলো বল্টু।
লোকটা কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে একটা ছেঁড়া গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলো।
“বাবা এসো , তোমার জন্মদিনের গিফট এসে গেছে।“
“ আমার জন্য আবার...... ওরেব্বাবা! এতো দারুণ।“ বাবার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল।
মা রান্নঘর থেকে বেরিয়ে এলেন,” বাহ ! বেশ হয়েছে।“
“ গিন্নিমা! একটু জল দেবেন?” বলল লোকটা ।
গলাটা শুনে ওরা সবাই চমকে উঠলো।
“ মাধাইদা? তুমি?”
গলার আওয়াজটা একই রকম বাজখাই আছে। নাহলে ঐ কুঁজো, রোগা, পাকাচুলো বুড়ো মানুষটাকে দেখে মাধাইদা বলে চেনা প্রায় অসম্ভব।
ওরা চিনতে পেরেছে দেখে আরও যেন কুঁকড়ে গেল মাধাইদা।
“ তুমি এখানে?” জিজ্ঞাসা করলেন বাবা।
“ সে অনেক কথা বাবু।“
ওকে ভিতরে নিয়ে এসে বসালো ওরা। জল খেয়ে সুস্থ হল মাধাইদা।
“ গ্রাম ছেড়ে কোলকাতায় কেন এলে?”
“ আপনারা জমি জমা বেচে চলে পর আমি আমার নিজের জমিতে চাষবাস করতুম। সুখেই ছিলুম। কিন্তু পাঁচ বছর আগে বন্যায় আমাদের গ্রাম ভেসে গেল। আমার মাটির বাড়ীতে ভেঙ্গে পড়লো বাবু। আর তার তলায় চাপা পড়ে আমার ছেলে বউ সব মরে গেল।“ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মাধাইদা। বাবা শান্তনা দেবার জন্য মাধাইদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
“ তারপর আর গেরামে থাকতে ইচ্ছা করল নি। শহরে এসে এখন এই কুলির কাজ করি। সোদপুরের কাছে একটা বস্তিতে চারজন কুলির সঙ্গে একটা ঘরে থাকি।“
“ একবার আমায় যদি জানাতে...।“ বললেন বাবা।
“ এয়েছিলুম বাবু । দেক্লুম বাড়ীটা ভাঙ্গা হচ্ছে। আপনাদের ঠিকানা কেউ বলতে পারলো না।“
কথার ফাঁকে কখন যে মা ভাত চড়িয়ে দিয়েছিলেন বল্টুর খেয়াল নেই।
“ এবার দুটো মুখে দাও মাধাইদা । আজ তোমার দাদাবাবুর জন্মদিন।“ খেতে ডাকলেন মা।
“ তাই বুঝি? একটু হাত পা টা ধোব। ”
বল্টু ওকে বাথ্রুম দেখিয়ে দিল।
একটা বড় থালায় মা ভাত বেড়ে দিয়েছেন। সঙ্গে নুন, লঙ্কা, পিঁয়াজ, ডাল আর তরকারি।
“ ভাত!” মাধাইদার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। “ কতদিন বাদে ভাত খাব। আমার সঙ্গের সবাই ছাতু খায় তো। তাই আমিও...।“
খুব পরিতৃপ্তি করে ভাতটা খেতে লাগলো মাধাই দা। সেই ছোটবেলার মত অবাক হয়ে বল্টু ওনার ভাত খা“ তুমি বাড়ী গিয়ে তোমার জিনিষপত্র নিয়ে কাল এখানে চলে এসো। তুমি আমাদের বিল্ডিংএ ওয়াচ ম্যান হয়ে থাকবে। আমি কথা বলে নিচ্ছি। নীচে ওয়াচ ম্যানের জন্য একটা ঘর আছে, সেখাএ বাড়ীতে দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা হবেখ’ন।“ বলতে বলতে বাবার গলাটা ধরে এলো।
সমাপ্ত