লোভ
লোভ
ষড়রিপু তাড়িত মানুষ আমরা প্রত্যেকে । প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রিপুর তারণা আছেই , সে যতই অস্বীকার করুক না কেন । ছয়টি রিপুর অন্যতম একটি হলো লোভ । লোভ মানেই কি খারাপ ? লোভ কথাটা কি সবসময় নেতিবাচক ? না একদম না । আজ একটা লোভের গল্প বলি । সহজ , সরল , নিষ্পাপ লোভের গল্প ।সত্যসুন্দর চ্যাটার্জীকে চিনি অনেক বছর ধরে । মা দুর্গার পরম ভক্ত । আজীবন স্ব পাকে একবার আহার করেন । কি শীত , কি গ্রীষ্ম তিনি সবসময় পুকুরে স্নান করেন । কৃচ্ছ সাধনের মধ্যে দিয়েই জীবন কাটানো মানুষটার দিকেও আঙ্গুল উঠতে পারে সত্যি ভাবতে পারিনা । গ্রামের বাড়িতে দুর্গা দালানে মায়ের ম্যারেই পুজো হয় সারাবছর । পুজোতে ওই ম্যারে মাটি পরে , রং হয় । মৃন্ময়ী মা রূপ ধারণ করেন দশভূজা অসুরদলনী মা দুর্গার । সত্যসুন্দর কাকুকে দেখি দিবারাত্রি লেগে আছেন পুজোর জোগাড় নিয়ে । সদা হাসিমুখে একচালা দুর্গা মূর্তিটির এমন যত্ন নিচ্ছেন যেন সদ্যোজাত কোন শিশুর দেখভাল করছেন ।
ওনার ইমোশনটা বুঝতাম আমি । অন্যান্য লোভী পৈতেধারী বামুনের মত ছাদা বাঁধতে ওনার কোন আগ্রহ নেই । গ্রামের পুজোটা কোন আড়ম্বর ছাড়াই বেশ কেটে যেত কারণ সত্যকাকু ছিল সেই পুজোর হোতা ।আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের দশমী তিথিতে শ্বশুরবাড়ি কৈলাসে পাড়ি দেন দেবী দুর্গা। বিষাদের সুরেই সেইদিনে বিজয়া পালন করেন মর্ত্যবাসী। পুরাণে কথিত আছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ও ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে জয় লাভ করেন দেবী দুর্গা। সেই জয়কেই চিহ্নিত করে বিজয়া দশমী।
তবে উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য ভিন্ন। বাল্মীকি রচিত রামায়ণে কথিত আছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের দশমী তিথিতেই নাকি রাবনকে বধ করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র। পুরাণ মতে, অপরাজিতা আরাধনা দুর্গাপুজোরই অন্য অঙ্গ। কারণ, উমা তথা দুর্গার অন্য নামই নাকি অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম। অপরাজিতা চতুর্ভূজা। হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা শোভিত, ত্রিনয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা সম্বলিত এই দেবী নীল বর্ণা বলে পুরাণে কথিত। সেবার দেখি অষ্টদল পদ্ম এঁকে রীতি অনুযায়ী মায়ের ঘট নাড়িয়ে বিসর্জন করার ঠিক আগে সত্য কাকু মায়ের ঘটটির কাছে মাথা নিচু করে শিশুর মত কেঁদে চলেছেন । হাউ হাউ করে কেঁদে কেঁদে তিনি বলছেন , মা রে চলে যাবি ? আর কটা দিন কি থাকা যায়না রে মা ? ছেলেকে ফেলে যাস না রে মা .. ছেলেকে ছেড়ে যাস না ।
চণ্ডীপাঠ করেন যে পুরোহিত তিনি সত্য কাকুকে টেনে তুলতে পারছেন না । তিনি ও কেঁদে ফেললেন সত্য কাকুকে দেখে । অনেক কষ্টে সত্য কাকুকে বুঝিয়ে তুলে ঘট বিসর্জন পর্ব সারা হলো । তখন যারা যারা দুর্গা দালানে উপস্থিত ছিল অনেকেই কাকুকে দেখে চোখ মুছলেন আবার অনেকেই ফিসফিস করে বললেন যত ঢং । আমি বুঝলাম না ঢং এর কি আছে এতে ? একটা অকৃতদার মানুষ যে সারাটা জীবন দিয়েছে ঈশ্বরের আরাধনায় , তার আরাত্রিকে .. সে তার তিলে তিলে গড়ে ওঠা প্রতিমার বিসর্জনে কাঁদলে কি করে সেটা ঢং হয় ! সত্য কাকুর কাছে তো ওই চারদিনের পূজিতা দেবী মৃন্ময়ী থেকে চন্ময়ী হয়ে উঠেছে । যেটা আমাদের কাছে মুর্তিমাত্র তা ওর কাছে মা ভিন্ন আর কেউই নয় । মানুষটার লোভ ওর আরাধ্যাকে একটু আটকে রাখার । এটা জেনেও যে শাস্ত্র মতে সেটা সম্ভব নয় তবুও অবাধ্য ছেলের মত মাকে জড়িয়ে ধরে থাকার আকুতি । কিছু হৃদয়হীন মানুষের কাছে এই মানুষটি ও লোভী তকমা পেয়ে যায় । ভাবি হায়রে সমাজ , হায়রে ঈশ্বর !জীবন সম্পর্কে শ্রী রামপ্রসাদ বলেছিলেন "এমন মানব জমিন রইল পতিত , আবাদ করলে ফলত সোনা "।আচ্ছা যারা মানব জমিনে সোনা ফলাতে চায় তাদের কি আমরা স্বাভাবিক চোখে দেখি ?