লকডাউনের রোজনামচা ৬
লকডাউনের রোজনামচা ৬
ডিয়ার ডায়েরি, ৩০শে মার্চ, ২০২০...
গত কয়েকদিন ধরেই আমি আমার ডোমেস্টিক হেল্পারদের ছুটি দিয়েছি। সেই জনতা কারফিউয়ের দিন থেকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তার খাতিরে এটাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। আর তাছাড়া যেহেতু সবাই গৃহবন্দী, তাই সকালে হুড়োহুড়ি করে বেরোনোর তাড়াটা একেবারেই নেই। কাজেই ধীরেসুস্থে পরিবারের সবাই মিলে ভাগাভাগি করে চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে ঠিকই, তবুও দায়িত্বের কাজের সিংহভাগই আমাকে সামলাতে হচ্ছে। ফলতঃ শরীর সাংঘাতিক ক্লান্ত হয়ে পড়ছে অনভ্যাসজনিত কারণে। তার ওপর হঠাৎ করে গত দুদিন ধরে ভীষণরকম গরম পড়েছে। এবং ঠাণ্ডা গরমে শরীর খারাপ হয়ে পড়ে পাছে, তাই আপাতত এসিও চালানো হচ্ছে না। গরমে ঘুমের কিছুটা ব্যাঘাতও হচ্ছে। এইসব কারণ মিলিয়ে মিশিয়ে ভোরের দিকে খুব গাঢ় ঘুম হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু মর্নিং ওয়াকও বন্ধ, সেইহেতু সকালে দেরী করেই উঠছি। এদিকে আজ কাকভোরে ফোনটা বাজছে। ভয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেলাম আমি। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামতে নামতে তখন ভাবছি নির্ঘাত বাবা বা মায়ের ফোন। ওদের দুজনের মধ্যেই কেউ একজন অসুস্থ। নাহলে এতো সকালে ফোন করার মতো তো কেউ আর নেই। চশমাটা চোখে দিয়ে মোবাইলে ভেসে ওঠা নামটা দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। আমাদের আবাসনের প্রতিবেশী, দোতলার মাসীমা। তিনিই বা এতো সকালে কেন? সকাল পাঁচটা দশে? যাই হোক ধরলাম ফোন। মাসীমা ভোরবেলা উঠে চা করতে গিয়ে দেখেন গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। উনি সিলিণ্ডার পালটাতে পারছেন না। এদিকে ওনার মর্নিং ওয়াকে যাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। উনি জানেন যে আমি খুব ভোরে উঠি, তাই আমাকে ফোন করেছেন। আমাকে একবার নীচে ওনার ঘরে গিয়ে ওনার গ্যাস সিলিণ্ডার পালটে নতুনটা লাগিয়ে দিতে হবে। ওনার ঘরে ছেলে ছেলের বৌ ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। রাতে তারা অনেক দেরীতে শুয়েছে, সুতরাং ভোরবেলা এতো তাড়াতাড়ি তাদের ঘুম নাকি ভাঙানো যাবে না। তাই আমাকে ডাকা... বোঝো কাণ্ড! মাসীমার কথা শুনে প্রথমটায় ভয়ানক রাগ হলো।
কিন্তু পরক্ষণেই রাগটা ঝেড়ে ফেললাম। নিজের বয়স্ক বৃদ্ধ বাবা মায়ের মুখ মনে পড়ে গেলো। আমিও তো বাবা মাকে রোজই বলি, "হঠাৎ করে কোনো অসুবিধায় পড়লে আগে পাশের বাড়ীর প্রতিবেশী কাউকে খুলে নিজের সমস্যা জানাবে। একদম সঙ্কোচ করবে না। দূরে থাকি আমি। কাজেই তোমাদের কাছে আমার পৌঁছতেও তো খানিকটা সময় লাগবে, তাই না।" মাসীমার কাতর ডাক শুনে খুব খারাপ লাগলো। ডায়াবেটিক মানুষ। বললাম, "আমি আসছি মাসীমা।" আসছি তো বললাম, কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্ন উঁকি দিলো মাথায়। যাইহোক মিনিট পাঁচ সাতের মধ্যে গিয়ে মাসীমার কলিং বেলে হাত ছোঁয়ালাম। আমার মুখে মাস্ক, মাথায় শাওয়ার ক্যাপ, গায়ে মেয়ের বাতিল রেনকোট, পায়ে দুটো বড়সড় প্লাস্টিকের প্যাকেট পরা গার্ডার দিয়ে আর দুই হাতে প্লাস্টিক গ্লাভস... হেয়ার ডাইয়ের প্যাকেটের সাথে ফ্রিতে পাওয়া। আমার পিপিই... মানে পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট আইডিয়া কী খুব খারাপ হলো? কে জানে! মাসীমার গ্যাস সিলিণ্ডার লাগিয়ে দিয়ে যখন ফিরছি তখন মাসীমার মুখে ভারী অপ্রস্তুতের হাসি। আমি বললাম, "মাসীমা একটা মাস্ক রাখবেন হাতের সামনে, বাইরের লোকের সাথে সামনাসামনি কথা বলার আগে।" মাসীমার ছলছলে চোখ দুটো দেখে আবার আমার মা বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে ঐসব ধরাচূড়ো খুলে প্যাকিং করে মুড়ে বেঁধে আরেকটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম ওটা ল্যাণ্ডিঙের কোণে মিউনিসিপ্যালিটির ওয়েস্ট বাস্কেটে। ঘরে এসে বাথরুমে ঢুকে ভাবলাম, "যে যেমনই হোক, আমি আমার মতো। তবে বুদ্ধি খাটিয়ে আরেকটা পিপিই সেট বানাতে হবে। কখন কি দরকার পড়ে কে বলতে পারে?