লকডাউনের রোজনামচা ১৪
লকডাউনের রোজনামচা ১৪
ডিয়ার ডায়েরি, ৭ই এপ্রিল, ২০২০... লকডাউনের চতুর্দশ দিনে "আমার পাড়ার ক্লাব"
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুকনো জামা কাপড় তুলছিলাম। সামনে শুনশান ফাঁকা রাস্তা। অপেক্ষাকৃত সরু পাড়ার ভেতরের রাস্তা হলেও খুব ব্যস্ত রাস্তা। সবসময় জমজমাট... সাইকেল, রিক্সা, টোটো, বাইক, স্কুটারে। বাচ্চারা আমাদের ফ্ল্যাটের উল্টোদিকের একচিলতে মাঠটায় খেলে বিকেলটায়। কিন্তু এখন এই লক ডাউন চলছে। ঐ জন্যই যেন একেবারে নিঝুম পুরী। হঠাৎ নীচের রাস্তা থেকে দুটো ছেলে ডাকলো, কাকিমা করে। আশেপাশে আর কোনো ফ্ল্যাটে আর কেউ কোথাও আছে কিনা তা জানিনা। তাও তাকালাম নীচে, "কিছু বলছো?" "হ্যাঁ কাকিমা", মাথা নেড়ে ছেলেদুটো বললো। জোরে জোরে কথা বলছি শুনে মেয়ে আর হাজব্যান্ডও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ছেলেদুটো এবার হাজব্যান্ডকেই বললো, "কাকু, আমরা এই সামনের মাঠটার লাগোয়া ঐযে ক্লাবটা, ঐ ক্লাবের ছেলে। পাড়ার ক্লাব। পাড়ারই এক ঠাকুমা ছিলেন... ওনার নামে, ওনার ছেলেই পাকা করে দিয়েছেন ক্লাবঘরটা। তা আমরা সবসময় আমাদের সাধ্য অনুযায়ী কিছু কিছু সমাজসেবার কাজ করি।
পাড়ার সব বাড়ি ও ফ্ল্যাটগুলো থেকে চাঁদা তুলে। খুব সামান্যই চাঁদা। কারুর যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। ঐ জন্যই এসেছিলাম।" আমার হাজব্যান্ড ছেলেগুলোর মুখ চেনে। নীচের দিকে তাকিয়ে বললো, "এখন কিইবা করবে সমাজসেবা। দেখছো তো কোনো জমায়েত নিষিদ্ধ।" ওরা বললো, "হ্যাঁ কাকু, ঠিকই বলেছেন। তবে আমরা ওভাবে জমায়েত করে কিছু করছি না। আসলে এই লক ডাউনের জন্য গঙ্গার ধারে বা স্টেশনে যেসব ভিখারী, ভবঘুরে, পাগল, অথর্ব মানুষ থাকে তারা আসলে নিয়মিত খাবার পাচ্ছে না দুবেলা। দোকান বাজার বন্ধ না থাকলে ওরা একরকম যাহোক করে দুবেলা খাবারটা ঠিক পেয়ে যায়। এখন পুলিশ অবশ্য খাবার দিচ্ছে অনেককে, দু-একটি এনজিওও দিচ্ছে, তবে তাও অনেকে বাদও পড়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তো। ঐ জন্য আমরা পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছি। আমাদের এই অঞ্চলের এই না খেতে পাওয়া মানুষগুলোকে আমরা দুবেলা একটু খাবার দেবার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের ছোট ক্লাব, অত ফাণ্ড তো নেই। তাই পাড়ার সকলের কাছে অনুরোধ, সবাই কিছু কিছু সাহায্য করুন। যে যেমন পারেন... টাকা পয়সা না দিয়ে যদি একমুঠো চাল একমুঠো ডাল আর যেকোনো একটা কাঁচা সবজি দেন। যার ঘরে যেমন থাকবে। কোনো চাপ যাতে কারুর ওপর না পড়ে, তাই এইরকম ভাবেই করছি আমরা। যা কালেকশন হচ্ছে চাল ডাল সবজি তাই দিয়ে আমরা ক্লাবের ছেলেরাই মিলে মিশে খিচুড়ি রান্না করছি। তারপর বড় ডেকচি ভরে সাইকেল ভ্যানে চাপিয়ে ঘুরে ঘুরে খাবারটা ঐ ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কাছে গিয়ে বিলি করে দিচ্ছি।
কাকু আপনারা সবাই সাহায্যের হাত বাড়ালে আমরা নিশ্চিন্তমনে ভালো করে কাজটা করতে পারি।" মন দিয়ে শুনছিলাম ওদের কথা। আমার দিকে ফিরে হাজব্যান্ড বলে, "কিগো এভাবে দিতে অসুবিধা হবে? দেখো চিন্তা করে।" জোর দিয়ে বললাম, "একদমই না।" হাজব্যান্ড ছেলেগুলোকে বলে, "এসো, ওপরে এসে নিয়ে যাও।" ছেলেদুটো হেসে বলে, "না কাকু, এখন না। লক ডাউন মিটুক। সংক্রমণ বন্ধ হোক, তারপরে একদিন ওপরে গিয়ে দেখা করে আসবো। আপনারা বরং প্যাকেট বা ব্যাগে করে দড়ি দিয়ে ওপরের বারান্দা থেকে নামিয়ে দিন।" ছেলেদুটোর সচেতনতা ভারী ভালো লাগলো। বললাম, "একটু দাঁড়াও।" ভেতরে গিয়ে একটা প্যাকেটে দুকাপ চাল, এককাপ ডাল, দুটো বড়ো আলু, দুটো পটল আর একটা করে টমেটো আর পেঁয়াজ পুরে একটা ক্যারি ব্যাগে ভরলাম। তারপর বারান্দায় এসে হাজব্যান্ডের হাতে ধরালাম ব্যাগটা। হাজব্যান্ড শোবার ঘরে ঢুকে কুড়িটা টাকাও এনে ঢুকিয়ে দিলো ব্যাগের মধ্যে।
তারপর খবরের কাগজ বেঁধে নীচ থেকে ওপরে তোলার দড়িটাতে বেঁধে নামিয়ে দিলো। ছেলেদুটো হাসিমুখে ব্যাগটা খুলে নিলো দড়ি থেকে। হাজব্যান্ড চেঁচিয়ে বলে দিলো, "রোজ রোজ এসে কিন্তু মনে করে নিয়ে যেও। আর এসব মিটলে একদিন সবাই মিলে এসে চা খেয়ে যেও। খুব ভালো উদ্যোগ নিয়েছো। ভীষণ ভালো লাগলো।" ওপর থেকেই দেখলাম ওরা এগিয়ে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আবেদন জানানোর জন্য। এই চৈত্র দুপুরের খর রোদে ওদের দুজনের জামা সপসপে হয়ে ভিজে পিঠে চিপকে গেছে। তাতে ওদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ওদের সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে কয়েকটা ব্যাগ জমা হয়েছে এরমধ্যেই। কত বড়ো একটা কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে একেবারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। সত্যিই প্রশংসনীয়! কাল থেকে প্যাকেটে করে চাল ডাল আলু সবজি টাকা সব গুছিয়ে ক্যারি ব্যাগে ভরে রেখে দিতে হবে। পালা করে আসবে বলেছে ওরা। আশা করি, নিয়মিত আশেপাশের সব ফ্ল্যাট থেকেই সাহায্য করবে সবাইই কমবেশি, নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী। পাড়ার সবাই ক্লাবের উদ্যোগে সামিল হলাম, দুবেলা কতগুলো অভুক্ত অসহায় মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে। পাড়ায় পাড়ায় এই ছোট ছোট অনামী ক্লাবের মতো ক্লাব আছে বলেই এখনো সমাজে অনেক শুভ কাজ হয়। অনেক শুভেচ্ছা রইলো পাড়ার সবাইয়ের, ক্লাব মেম্বার তরুণ প্রজন্মের একঝাঁক ছেলেকে।