লিফট
লিফট
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিলেন ঋতুজা সেন। আজ বহু বছর পর এই শহরটা আবার টানছে তাঁকে। আকাশের কোণে মেঘ জমছে, বৃষ্টি নামার আগেই প্যাট্রিক ডি’সুজার কাছে পৌঁছতে হবে। চোখ বন্ধ করলেই এখন ঋতুজা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন সেই গ্রিক দেবতার মতো সুঠাম, সুদর্শন প্যাট্রিক ডি’সুজার চেহারাটা। রূপ আর বৈভবের আদর্শ মিশেল এই প্যাট্রিক ডি’সুজা।
কড়াৎ করে বাজ পড়লো কোথাও, চমকে উঠলেন ঋতুজা। এই শুকনো বাজে তাঁর বড় ভয়। ড্রাইভারের পাশের খোলা জানালাটা দিয়ে কুলকুল করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে চলেছে অবিরত। কালো মেঘের প্রাবল্য বিকেল পাঁচটা চল্লিশেই সন্ধ্যের অন্ধকার হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ছে একটু একটু করে।
“একটু তাড়াতাড়ি চলুন দাদা, বৃষ্টি নামবে বোধহয়।”
ড্রাইভারকে তাড়া দিলেন ঋতুজা; ড্রাইভারের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলনা। বিরক্ত হলেন ঋতুজা, এমনিতে এই ধরণের ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করার মানুষ তিনি নন, কিন্তু আজ তিনি নিরুপায় তাই চুপ করে বসে থাকাই শ্রেয়।
ছটা পঁচিশ, ট্যাক্সিটা ক্যাঁচ করে ব্রেক কষল।
“কি হলো!”
“পৌঁছে গেছি ম্যাডাম।”
“ওহ, এমন অন্ধকার যে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। বৃষ্টিটা এখনো নামেনি ভাগ্যিস।”
এবারও ঋতুজার কথার কোনো উত্তর দিলোনা ড্রাইভার। বিরক্ত ঋতুজা টাকাটা বাড়িয়ে রাস্তার ওপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন, “এ আমাকে কোথায় আনলে তুমি!”
“যেখানে আনতে বলেছিলেন।” ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিলো ড্রাইভার।
“শাট আপ, ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি ডি’সুজা এন্ড ডি’সুজার অফিসে আনতে বলেছিলাম।”
“হ্যাঁ তো সেখানেই তো এনেছি।”
“কিন্তু এখানে… এখানে তিন তলায় তো খান ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসের অফিস…”
ঋতুজা কথাটা শেষ করার আগেই ড্রাইভার বলে উঠলো,
“ওসব খান টান জানিনা ম্যাডাম, বিগত সাত বছর ধরে পুরো বিল্ডিংটাই ডি’সুজাদের অফিস।”
“সাত বছর…!”
ঋতুজা কথাটা শেষ করার আগেই কালো হয়ে আসা প্রকৃতির মাঝে হুশ করে একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে উধাও হলো ট্যাক্সিটা। সামনে অন্ধকারের চাদর মুড়ি দেওয়া বিল্ডিংটা দেখে অস্বস্তি বেড়ে গেল ঋতুজার। রাস্তা পেরিয়ে ওটার কাছে যাবেন কিনা ইতস্তত করতে লাগলেন তিনি; আর তখনই তাঁর উন্মুক্ত ফর্সা বাহুতে এক ফোঁটা জল এসে পড়ল। ওপরে তাকালেন ঋতুজা, বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। আর উপায় নেই, হ্যান্ডব্যাগটা দিয়ে মাথাটা ঢেকে ছুটলেন তিনি। রিসেপশন ফাঁকা, তবে কিচ্ছুক্ষণ আগেও যে কেউ ছিলো তা বোঝা যায়। একটা নীলচে ডিম লাইট জ্বলছে হলটায় যা পরিবেশটাকে কেমন মায়াবী করে তুলেছে। প্যাট্রিকের ফোনটা আবার কিছুতেই লাগছেনা এখানে আসার পর, তিনি অবশ্য একটু আগেও বললেন আটটা অবধি অফিসে থাকবেন। ঋতুজার তো প্যাট্রিককে একলা পেলেই সুবিধে। ওই বুড়ো নিলয়ের সেনের সাথে কি আর সব আকাঙ্খা মেটে!
চারিদিক আলো করে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো, ঋতুজা চমকে উঠে খেয়াল করলেন কখন যেন একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে। কেমন অজানা একটা ভয়ে ঋতুজা পিছিয়ে গেলেন দু’পা। “ম্যাডাম কি প্যাট্রিক সাহেবের কাছে যাবেন?”
“হ্যাঁ কিন্তু তুমি জানলে কি করে?”
“রিসেপশনিস্ট বাড়ি যাওয়ার আগে বলে গেল যে আপনি আসবেন। সাহেব বোধহয় ওকে বলে রেখেছিলেন।”
“ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কে?”
“আমি হেমন্ত, এই অফিসেই কাজ করি। আমার সঙ্গে আসুন ম্যাম।”
লিফটে উঠে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ঋতুজা, মাসখানেক আগে ঋতুজার সাথে আলাপ হয় প্যাট্রিক ডি’সুজার, প্রথম আলাপেই ঋতুজা বুঝে গিয়েছিলেন নিলয় সেন নামক “লিফ্ট” তাকে খানিক ওপরে পৌঁছে দিয়েছে। এবার আরও ওপরে ওঠার জন্য দরকার তাঁর নতুন লিফট, প্যাট্রিক ডি’সুজা।
হঠাৎ বাইরে একটা বাজ পড়লো, সেই সাথে প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেলো লিফটটা, ভেতরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।
“ক্ক… কি হলো!”
“আটকে গেল লিফটটা, কারেন্ট গেল মনে হয়।”
“মানে! এখন কি হবে?”
“ভয় পাবেননা ম্যাডাম, দেশলাই জ্বালছি আমি।”
“পাগল নাকি! দেশলাই জ্বাললে ভেতরের অক্সিজেন কমে যাবে যে। আ… আমার ফোনটা ব্যাগে আছে। বের করতে হবে। ওতে টর্চ আছে।
ওফফ… পাচ্ছিনা কেন! কোথায় গেল ফোনটা! কি অন্ধকার কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিনা আমি…”
“কষ্ট হচ্ছে জান? ভয় লাগছে?” হঠাৎ করে যেন গলাটা পাল্টে গেল হেমন্তের, পরিবর্তে একটা ভীষন চেনা কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো।
“ক্ক...কে? কে আপনি?”
“চিনতে পারছো না জান? আমি যে তোমারই সইফ।”
“সইফ! ইয়ার্কি হচ্ছে?”
“ইয়ার্কি কেন মনে হচ্ছে তোমার? আমার গলাটা ভুলে গেছো বুঝি?”
“কিন্তু তুমি সইফ কি করে হবে? সইফ মারা গেছে, হি ইজ ডেড।”
“মারা গেলেই কি সব শেষ হয়ে যায় জান? হয়না, কিচ্ছু শেষ হয়না। আমি যে এখানে আজ এতবছর ধরে তোমার প্রতীক্ষায় আছি সোনা।”
“কি বলছ কি তুমি? হেমন্ত কোথায়? হেমন্ত… হেমন্ত…”
“হেমন্ত বলে কেউ নেই এখানে, যে আছে সে শুধু তোমার সইফ, শুধু তোমার।”
“না… না … আমি বিশ্বাস করিনা। এই কে তুমি? আমার সাথে কেন এরকম নোংরা খেলা খেলছ?
তুমি জানোনা আমি কে…”
“আমি সবই জানি, কিন্তু তুমি যে আমার আর কিচ্ছু করতে পারবেনা জান।”
“মানে?”
“জাহানারা তুমি নিলয় সেনকে বিয়ে করবে সেটা আমাকে বলতেই পারতে, তোমার আমার টাকা চাই সেটাও বলতে পারতে কিন্তু তা বলে আমাকে মেরে ফেললে কেন? আমার অনাথ বোনটার কথা একবারও ভাবলে না?”
“কি!”
“আমার বোনটা তো তোমাকে ভাবি বলতে অজ্ঞান ছিল। তার প্রতিও একটু মায়া হলোনা তোমার!”
“সইফ আয়াম সরি... প্লিজ আমাকে মেরোনা…”
“তোমায় আমি কি করে মারব জান? তোমাকে যে আমি খুব ভালোবাসি, তোমার হাতেই নিজের জানটাও তো দিয়ে দিলাম।”
“সইফ প্লিজ আমাকে এখান থেকে বের করো। সইফ...সইফ… আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, এই অন্ধকারে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে…আমার...”
“কষ্ট তো আমারও হয়েছিল জান যখন একটু একটু তোমার দেওয়া বিষটা আমার শরীরে মিশেছিল।”
“সইফ…”
*****
ডি’সুজা এন্ড ডি’সুজা কোম্পানির অফিসের লিফটের মধ্যে সেন প্রোডাকশন হাউসের কর্ণধার নিলয় সেনের স্ত্রীর হার্ট এট্যাক হয়ে মৃত্যুতে যখন তোলপাড় গোটা মিডিয়া তখন শহরের একপ্রান্তে গঙ্গার ধারে বসে ডি’সুজা এন্ড ডি’সুজার অফিসের রিসেপশনিস্ট সুফি…
নিজের প্রেমিকের কাঁধে মাথা দিয়ে সে আস্তে আস্তে বলে উঠল,
“থ্যাংক্স হেমন্ত, আজ তোমার জন্য আমার ভাইজানের আত্মা শান্তি পাবে।”
“থ্যাংক্স বোলো না সুফি, আমি কিছুই করিনি যা করার ঈশ্বর করেছেন। ঋতুজা সেন ওরফে জাহানারা বেগমের মত মহিলাদের এটাই পরিণতি, ওনার আর মিসেস ডি’সুজা হওয়া হলোনা।”
“পরশু প্যাট্রিক স্যার ওর আসার খবরটা বলতেই আমার মাথা ঘুরে যায়। মনে হয় যে এরকম একটা পাপ করেও বুক ফুলিয়ে ঘোরার দিন এবার শেষ ওর, ওর অপরাধের শাস্তি এবার ওকে পেতেই হবে।”
“তুমি তোমার ভাইজানকে খুব ভালোবাসতে তাইনা সুফি? ওনার গলায় গান রেকর্ডিংগুলো এতো যত্নে রেখেছো আজও। ওগুলো না থাকলে আমি কোনদিন সইফ ভাইয়ের গলা নকল করতে পারতাম না।”
“ওগুলোকে আঁকড়েই তো এতো বছর বেঁচে আছি হেমন্ত।”
“মহিলার তো এমনিতেই নিক্টোফোবিয়া ছিল বলে তুমি বলেছিলে, তার ওপর সইফ ভাইয়ের গলা নকল করতেই…”
“কি আশ্চর্য না হেমন্ত যার ভেতরটা অন্ধকারে পরিপূর্ণ সেই আবার বাইরের অন্ধকারকে কত ভয় পায়!”
“হুম, বড় বিচিত্র এ মনুষ্য চরিত্র সুফি, বড়ই বিচিত্র।”