Aritra Das

Classics

5.0  

Aritra Das

Classics

LegendofRam-Sight Beyond Sight

LegendofRam-Sight Beyond Sight

33 mins
1.3K


আদিপর্ব


বুড়ো শকুনটার মনে আজ বড় আনন্দ৷


বয়সের ভারে ঘ্রাণ ও দর্শনশক্তি, দুটোরই ধার কমে গিয়েছে, পাখার জোরও আর আগের মতন তেমন নেই; একটু বেশি ডানা নাড়লেই বুড়ো হাড় পর্যন্ত খটখটিয়ে ওঠে। ফলে দল বেঁধে সে আর আগের মত বেশিদূর শিকারে যেতে পারে না। এই অবস্থায় যা ঘটবার তাই ঘটছে; বেশিরভাগ দিনই অনশন। কি যে অবর্ণনীয় অবস্থা; আগের বহু প্রতাপের সেই সোনালী দিনগুলি পেরিয়ে এসে আজ তার হাড়-জিরজিরে দশা।


কিন্তু আজকের দিনটি একটু অন্যরকম। আগের কয়েকটা দিন এখানে যেন সর্বক্ষণের একটা ঝড় বইত। হইচই, কোলাহল, দো-পেয়েগুলির হল্লা; আর্তনাদ, আওয়াজ, চীৎকার – কান পাতাই যেত না। ওর দলের কয়েকজন তো ভয় পেয়ে উড়েই গেছিল অন্যত্র। গতকাল সন্ধের পর আওয়াজ একটু থেমেছিল; রাত্রির পর তো সবই শান্ত। আর আজ সকালে উঠে যে দৃশ্যটা দেখা গেছে তাতে সকলেই খুশিতে ডগমগ- বিশাল এই বনানীর প্রান্তসীমায় যে মাঠ তাতে দো-পেয়েগুলির ছেড়ে যাওয়া অগুন্তি মাংস! কাতারে কাতারে, থরে থরে! আর কত বড় বড় মাংসের টুকরো! এখন যে খাদ্যের জন্য কয়েকদিন কোন চিন্তা করতে হবে না সে তো বলাই বাহুল্য! খুশির ঢেউ-এ ঝটপটিয়ে উঠল সুপ্রাচীন দুটি পাখা; দিকচক্রবালে একবার বোঁ করে ঘুরেই দেহটা নেমে এল সিধে মাংসের টুকরোগুলিকে লক্ষ্য করে। যে মাংসের টুকরোর পাশে ভীড় কম,অভুক্ত চঞ্চুগুলি এগিয়ে গেল সেদিকে। অহেতুক গাদাগাদি করে লাভ নেই, মাংসের টুকরো ছড়ানো চারিদিকেই। আজ তাদের চড়ুইভাতি।


কাতারে কাতারে মানুষ আজ নিথর হয়ে পড়ে আছে অনার্যভূমির প্রান্তসীমায়। বিশৃঙ্খল সজ্জায় শায়িত দেহগুলি আজ শুধুই মাংসভূক পক্ষীদের খাদ্য। অনার্যভূমির প্রান্তদেশে স্বজনহীন, বান্ধবহীন মানুষদের নিস্পন্দ দেহ এবং তাদের ঘিরে কাক-চিল-শকুনের ঘোরাঘুরি; মৃতদেহ থেকে খুবলে খুবলে মাংস খাওয়ার দৃশ্য – বড়ই নির্মম ও বেদনাদায়ক। প্রান্তসীমার যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই খালি অগুন্তি দেহ – সদ্যমৃত, টাটকা, বাসি, পচনধরা – সবরকম প্রজাতির আর সেগুলিকে ঘিরে মাংশাষি প্রাণীদের জটলা – রূঢ় বাস্তব।


অদূরে একটা নাতিউচ্চ পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্র নিরীক্ষণ করছিলেন চারজন মানুষ। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, তিনি মহর্ষি বাল্মীকী। অনন্যসাধারন জীবন তাঁর! একটা সময় ছিল যখন আর্যাবর্তের মানুষ কাঁপত দস্যু রত্নাকরের ভয়ে। আজ এই শান্ত, স্থিতধী, সৌম্যদর্শন ঋষিকে দেখে কে বলবে যে সেই দস্যুই আজ নব অবতারে প্রতীয়মান!


-“যুদ্ধের অন্তিম পরিনতি শ্মশান!” – বলে উঠলেন ধর্মক্ষেম, ঋষিপ্রবরের বয়স্য ও প্রধান পরামর্শদাতা – “আর একেই বলে শ্মশান-শান্তি!”

জবাবে শুধুই ঘাড় নাড়লেন বাল্মীকী।


দলটিতে সবচেয়ে নবীন ও ছটফটে ব্যক্তি হলেন শুভামঙ্গল। সবসময় যেকোন বিষয় নিয়ে অনর্গল তর্ক করে যাওয়া প্রাণচঞ্চল তরুন চোখের সামনে মৃত্যুর এই বিশাল নগ্নরুপ দেখে কেমন যেন থমকে গেছিলেন; এবার সুযোগ পেয়ে ফোঁসফোঁস্ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তিনি প্রশ্ন করলেন –

কিন্তু কি জন্য এই বিপুল প্রাণনাশ? কারা এরা? কি এদের পরিচয়? এখানে এত লোকের মৃত্যু কি জন্যে?


একজন সদ্যতরুনের এই সহজ প্রশ্ন নির্বাক করে দিল সকলকে। প্রত্যেকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন মহর্ষির দিকে। আর মহর্ষি স্বয়ং? নিবাত, নিষ্কম্প, স্থিতধী এই বৃদ্ধ তাকিয়ে রইলেন দূরে,তাঁর স্বপ্নালু চোখদুটি নিয়ে। ক্ষনিকের এক অস্বস্তিকর নীরবতা – তারপর কথা বলা শুরু করলেন তিনি:


-“অনেকদিন আগে, আমার পুনর্জন্মের বহু বছর আগে, একবার দলবল নিয়ে আক্রমন চালিয়েছিলাম একদল তীর্থযাত্রীদের ওপর। এরা সকলেই ছিলেন ‘মৎস্য’ রাজ্যের বাসিন্দা, যাবে কোশলে তীর্থ করতে। পথের মাঝে বিরাট বন, সেখানে থেমেছিল একটু বিশ্রামের আশায়; এমন সময় অতর্কিতে আমরা আক্রমন করি।


তিনদিক দিয়ে দল বেঁধে আক্রমন হয়। উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার – শক্তসমর্থ লোকেদের বিভ্রান্ত করে দিয়ে পালাবার সুযোগ করে দেওয়া, অতঃপর বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে লুঠপাট চালিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়া। কম মৃত্যু, বেশি লাভ। এই ধরনের অভিযাত্রী দলের সঙ্গে ভাড়া করা প্রতিহারী থাকে বটে কিন্তু বিপদের সময় এরাই সব থেকে আগে পগাড় পার হয়। কাজেই বাকিদের বাগে আনাটা কোন ব্যাপার নয়, অন্তত এমনটাই আমরা ভাবতাম।


কিন্তু সেবারে হিসেবে একটু ভুল হয়েছিল। এবারের অভিযাত্রী দলটির সাথে যে প্রতিহারী দলটি ছিল তারা প্রকৃতপক্ষে কেউ ভাড়া করা নয়, এরা সকলেই পরিবার সমেত তীর্থযাত্রা করছিল – এই তথ্যটি আমরা জানতাম না। ফল যা হওয়ার ছিল তাই হল।


প্রথমে অতর্কিত আক্রমনে এরা কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়, তারপর এরা ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা লড়াই শুরু করে। প্রথম দফার প্রতিরোধ শুরু হতেই আমাদের কয়েকজন মাটিতে শুয়ে পড়ে; আর উঠে দাঁড়ায় নি তারা। এরপর শুরু হয় ভীষণ লড়াই।


আমাদের দলে চন্ড বলে খুব জনপ্রিয় একজন লোক ছিল। গোলমাল বাঁধল চন্ডের মৃত্যুর পর। ওদের একজনের ছোঁড়া বর্শার আঘাতে মৃত্যু হয় চন্ডের। অকুস্থলেই। এরপরই আমাদের লোকরা যেন ক্ষেপে উঠল। এতক্ষণ চেষ্টা করা হচ্ছিল মহিলা ও শিশুদের বাঁচিয়ে যোদ্ধাদের আহত করবার; কিন্তু কেউ আর কিছু মানতেই চাইল না। সবকিছু নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া হল ওদের ওপর।


এরপর কয়েক মুহূর্ত তান্ডব নৃত্য চলল। মূল কথায় আসি, ছোট ঐ অভিযাত্রী দলের কেউ আর বেঁচে রইল না। বনের এই অংশটি যাদুমন্ত্রের ছোঁয়ায় এতক্ষণ যেন সজীব ছিল- ব্যস্ত লোকজনের হাঁকডাক, মহিলাদের কলকাকলি, হাস্য-প্রীতি সম্ভাষণ, মঙ্গোলোচ্চারন – শেষ লোকটি মাটি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দ শেষ। গাছের ডালে পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ পর্যন্ত না! সব শেষ।


এরপর আমরা লুঠের মালের সন্ধান করতে লাগলাম মৃতদের দলে। ওঁদের দেহ, ওঁদের ব্যবহার করা প্রত্যেকটি সামগ্রী লন্ডভন্ড করে আমরা খুঁজে ফিরলাম আমাদের সাধের জিনিষ। কিছু লাভ হল, কিছু ক্ষেত্রে হতাশা। কিন্তু মোটের ওপর ডাকাতি সার্থক।


এবার আসি এই গল্পের সবচেয়ে অদ্ভুত অংশে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা তাঁবুর ভিতরে নড়াচড়ার শব্দ! ব্যাপারটা কি জানবার জন্য তাঁবুর ভিতরে গেলাম কয়েকজনকে সাথে নিয়ে। লক্ষ্য করে বুঝলাম যে তাঁবুর এককোণে ডাঁই করে যেসব পরিধেয় রাখা আছে আওয়াজ আসছে সেখান থেকেই। আমার ইশারায় কানু এগিয়ে গিয়ে প্রথমে আলগোছে কয়েকটি পরিধেয় সরাল; অতঃপর ক্ষিপ্রগতিতে সেখান থেকে বের করে আনল – একটা বাচ্চাকে!


সপ্তম থেকে দশম বর্ষীয় এক বালক। ভয়ে অর্ধমৃত! পালে ডাকাত পড়তেই ওর মা ওকে এখানে এনে ওর ওপর পরিধেয় চাপা দিয়ে ওকে বাঁচাতে চেয়েছিল নিশ্চই, ভেবেছিল হয়তো আগুয়ান ডাকাতদের প্রতিহত করা যাবে; কিন্তু বিধি বাম! এখন উপায়?


বালকটিকে নিয়ে কি করা যায় এই নিয়ে সকলেই যখন আলোচনা করছি অকষ্মাৎ ঘটল ছন্দপতন! আমার পাশ দিয়ে শাঁ করে উড়ে বেড়িয়ে গেল একটা বর্শা, পরক্ষণেই দেখি প্রাণহীন বালকের দেহ লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। বর্শাটা সিধে ওর বুকের ওপর প্রোথিত!


এতক্ষনে একটু অনুতাপ হল। বালকটিকে কি না মারলে চলত না? এত সুন্দর তরতাজা এক বালক, ও কার কি ক্ষতি করেছে? কিন্তু মানবিক অনুভূতি সবার মধ্যে সমানভাবে প্রভাব বিস্তার করে না; ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়ে থাকবে। আর তাছাড়া, এই বালকটিকে আমরা রাখতামই বা কোথায়? আমাদের বন্ধুপ্রবর একটা স্থায়ী সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে, যদিও নির্মম, কিন্তু চিরস্থায়ী! ঢাকী সমেত বিসর্জন!!


ভারি হৃদয় ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেড়িয়ে এলাম তাঁবুর ভিতর থেকে; বালকটির মৃতদেহ কোলে নিয়ে। এই মৃত্যুপুরীতে ওর বাবা-মার খবর দেবেই বা কে? ততক্ষণে অন্যান্য মৃতদেহগুলিকে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে খোলা প্রান্তরে। এটাও আমাদের উদ্দেশ্য-প্রণোদিত কার্য। যখন কেউ এদের দেখবে তখন তারা বুঝবে প্রতিরোধের ফলাফল কি,তাহলে কেউ আর ভবিষ্যৎে প্রতিরোধ করবে না – এই উদ্দেশ্যেই প্রতিবার ডাকাতির পর আমরা মৃতদেহ এইভাবে সাজিয়ে রেখে দিয়ে আসি। এদের মধ্যে একজন অল্পবয়স্কা বধূর মৃতদেহের পাশে বাচ্চাটিকে আমরা শুইয়ে দিয়ে এলাম, কিছু ফুল ও লতাপাতা দিয়ে ঢেকে। তারপর আমরা ওখান থেকে চলে এলাম।”


-“কিন্তু এর সঙ্গে সদ্য ঘটে যাওয়া যুদ্ধের সম্পর্ক কি মহর্ষি? ক্ষমা করবেন, বিষয়টা আমি ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না...”


-“যুদ্ধ মানবতার বধ্যভূমি, শুভামঙ্গল! ঐ দিকে দেখ, ঐ যে, প্রান্তরের কাছে ঐ টিলার নিকটে, ঐ কিশোরকে দেখতে পাচ্ছ? অনার্য, আনুমানিক ষোড়শবর্ষীয় ঐ বালক। কেউ যদি বলে, না, ওর বয়স চৌদ্দ তাহলেও আমি বিষ্মিত হব না। এই বয়সে ওর জীবনকে উপভোগ করবার কথা; সেখানে, তাকিয়ে দ্যাখ, বুকে, মাথায় আর গলায় তিনটি শর বিঁধে এখন শকুনদের খাদ্যে পরিণত হচ্ছে। দ্যাখ একবার!”


আবার ক্ষণিকের নীরবতা। এরপর মুখ খুললেন মহর্ষি –



[একটি তুচ্ছ বিবাদ, এবং…]


-“সামান্য ঘটনা নিয়ে সূত্রপাত। আর্যাবর্ত এবং অনার্যভূমির বিবাদ। রাজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা। ঘটনার সূত্রপাত আর্যাবর্তের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত রাজ্য অযোধ্যা এবং দক্ষিণে অনার্য রাজ্য অবন্তীর সামান্য একটুকরো জমির ওপর কর্তৃত্ব লাভের প্রশ্নে। প্রথমে অনুরোধ, আলোচনা – পরবর্তিকালে তার থেকে বিরোধ। অবস্থা এতটাই খারাপের দিকে যায় যে মাত্র তিনপুরুষের ব্যবধানে এঁরা একে অপরের মহাশত্রুতে পরিণত হয়। দুটি প্রাচীন বংশ একে অপরের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে।”


যুদ্ধ-বিরোধ, খুন, অপহরণ – এগুলি হয়ে উঠেছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। যুদ্ধ বাধতো যখন-তখন! দুটিই বড় রাজ্য। অবন্তির সাম্রাজ্য বিন্ধ্য পর্বতের তল থেকে সমুদ্রতীর অবধি; আবার অযোধ্যার বিস্তার পূর্বে গঙ্গা থেকে পশ্চিমে নর্মদা ব্যাপী। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না।


অবন্তীর বর্তমান রাজা শৈলেন্দ্রর একটা চারিত্রীক ত্রুটি ছিল, সুন্দরী মেয়েদের প্রতি তিনি খুব সহজেই আকৃষ্ট হতেন। অযোধ্যর রাজা দশপালের কন্যা জানকি ছিলেন অসামান্য বিদূষী ও রূপবতী। এ হেন পরিস্থিতিতে শৈলেন্দ্রের দৃষ্টি যে জানকির ওপর পড়বে এতে আশ্চর্য কি? শৈলেন্দ্রর জানা ছিল যে স্বামী হিসেবে জানকি কোনদিনই তাকে মেনে নেবে না; তাই তিনি মনে মনে ছক কষা শুরু করে দিয়েছিলেন।


ঠিক এই সময়তেই ঘটল একটি অঘটন। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সমুদ্রতীর পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট এই ভূমির মধ্যভাগে, বিন্ধ্য পর্বতমালার গা ঘেঁষে রয়েছে বৈবস্বত মুনির আশ্রম। সম্ভ্রান্ত রাজপরিবারের সদস্যরা এখানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসেন। রাজা দশপালের দুই সন্তান রামপাল ও লোকপাল – তাঁরাও এখানেই আসেন শিক্ষাগ্রহণের উদ্দ্যেশে।


কিন্তু গন্ডগোলটা বাঁধে অন্যত্র। বৈবস্বত মুনির এই আশ্রম একটি পর্যটন কেন্দ্রও বটে। অনার্যভূমির থেকে অনেকেই আসে এই আশ্রম ও আশ্রম সংলগ্ন অঞ্চলে পরিভ্রমণের নেশায়। এখানকার মনোরম পরিবেশ ও অভয়ারণ্য সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সমাদৃত। মহিলারাও এখানে আসেন পরিভ্রমণের জন্য। বিস্তৃত এই ভূভাগের বিভিন্ন অংশের রাজারা নিজেদের মধ্যে সন্ধিস্থাপন করেছেন এই অংশে যুদ্ধবিগ্রহের প্রশ্নে। মসীক্ষেত্রে অসির আস্ফালন মোটেও উচিৎ কার্য নয়।


মহারাজ শৈলেন্দ্রের ভগিনী বিভূতিকা একদিন এই আশ্রমে আসেন পরিভ্রমণের ঊদ্দেশ্যে। মহিলা বলে একে মোটেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কোরো না। অনার্যভূমির অন্যান্য মহিলাদের মত ইনিও ছোট থেকেই অস্ত্রশিক্ষায় পারদর্শী। অনার্যভূমিতে লোকে এঁকে চেনে ‘শবরদলনী’ হিসাবে। শবররাজ্য জয়ে ইনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং শোনা যায়, শবররাজকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করেন। অগ্রজ ভ্রাতা ও ভগিনী – দুজনের মধ্যেই কামতৃষ্ণা অতীব প্রবল। শোনা যায়, শোনা কথা অবশ্য, চোখে দেখি নি তাই নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়; কিন্তু শুনেছি প্রত্যহ ইনি যখন স্নানে যান সেখানে শতখানেক সুদর্শন পুরুষ উপস্থিত থাকেন, প্রত্যেককেই বিবস্ত্র থাকতে হয়। সকলকেই তাঁর স্নানে সহযোগিতা করতে হয় এবং এঁদের মধ্যে একজন দুজনকে বাছাই করে অন্দরমহলে নিয়ে যান স্বয়ং বিভূতিকা।


অনুজ ভ্রাতা লোকপাল ছিলেন খুবই সুদর্শন। কাজেই এহেন মহিলার নজর যে তার ওপর পড়বেই এ তো বলাই বাহুল্য। আর হলও তাই। লোকপালকে দেখে বিভূতিকার কামরোগ চড়চড় করে বেড়ে গেল। কিন্তু বৈবস্বত মুনির আশ্রমের পরিচ্ছন্নতা লঙ্ঘন করা যাবে না, বিভিন্ন দেশের রাজারা নিজেদের মধ্যে চুক্তিতে আবদ্ধ আছেন। কোন প্রকার আগ্রাসনের অর্থ যুদ্ধ! কাজেই চতুর বিভূতিকা অন্ধকারের রাস্তা ধরলেন।


তাঁর অনুচরেরা একদিন রাত্রিকালে অপহরণ করল লোকপালকে। রাত্রির অন্ধকার থাকতে থাকতেই তাঁরা রওনা দেন রাজধানীর ঊদ্দশ্যে। চতুর বিভূতিকা আগেই অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলেন আশ্রম ত্যাগের যাতে লোকপাল অপহরণে তাঁদের ভূমিকা কেউ উপলব্ধি করতে না পারে। কিন্তু তাঁদের অশুভ উদ্দেশ্য সফল হয় নি।


অগ্রজ রামপাল ছিলেন খুবই শক্তিশালী অসাধারন চতুর বুদ্ধির একজন মানুষ। বিভূতিকা বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে যখন তিনি লোকপাল অপহরণের ছক কষছিলেন, আড়াল থেকে তাঁর কর্মকান্ডের প্রতি সজাগ দৃষ্টি ছিল রামপালের।


বিভূতিকার মনোভাব তিনি স্পষ্টতই ধরতে পেরেছিলেন তাই উচিৎ কর্তব্য বিধানে তাঁর বেশি দেরি হয় নি। সঙ্গী রাজপুত্রদের শিবিরে পড়াশোনার অছিলায় তিনি রয়ে গেছিলেন তাঁদের সঙ্গে; তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিজ শিবিরে থাকলে ওরা লোকপালের কোন ক্ষতি করত না, কিন্তু তাঁকে কেটে রেখে চলে যেত। তাই রামপাল নিজ শিবিরের বাইরে থেকে যান এবং আশ্রমের সবার চোখ এড়িয়ে সঙ্গী-সাথী সমেত আশ্রম থেকে একটু দূরে যাতায়াতের পথে অপেক্ষা করতে থাকেন বিভূতিকার জন্য। তারপর আর কি? তষ্কর আসতেই একেবারে বমাল সমেত গ্রেফতার!


বিভিন্ন দেশের রাজারা আগেই রুষ্ট ছিলেন রাজা শৈলেন্দ্রের কিছু অতীত আচরণের জন্য; এই ঘটনায় তাঁরা প্রত্যেকেই যেন দাবানলের মত জ্বলে উঠলেন। যুদ্ধ একটা লেগেই যেত, কিন্তু তাঁতে আপত্তি জানালেন স্বয়ং দশপাল। দুই ছেলের পিতা মহারাজা দশপাল সকলকে করজোড়ে অনুরোধ জানালেন যুদ্ধ এড়াবার জন্য; রাজা শৈলেন্দ্র দাক্ষিণাত্য থেকে দৌড়ে এলেন বৈবস্বত মুনির আশ্রমে, করহস্তে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন সকলের কাছে। কিন্তু অপরাধ যখন সংঘটিত হয়েছে তার প্রতিবিধান তো অবশ্য কর্তব্য! তাহলে উপায়? রাজা দশপাল বিচারের ভার দিলেন অগ্রজ পুত্র রামপালের ওপর।


আগেই বলেছি রামপাল অত্যন্ত চতুর ও কুশলী লোক ছিলেন। বৈবস্বত মুনির আশ্রমে সংগঠিত সেই বিচারসভায় তিনি উপস্থিত সকলের সামনে – রাজা দশপালের সামনে, বৈবস্বত মুনির সামনে, উপস্থিত অন্যান্য রাজা-রাজড়াদের সামনে, সর্বোপরি বিভূতিকার অগ্রজ ভ্রাতা রাজা শৈলেন্দ্রের সামনে স্বহস্তে বিভূতিকার নাসিকা কর্তন করেন। শুধু তাই নয়, সেই সভায় বিভূতিকার কর্তিত নাসিকা নিয়ে তিনি শৈলেন্দ্রকে সাবধান করেন – এরপর যে কোন আগ্রাসনের শাস্তি মৃত্যু। এইভাবে গোটা আর্যাবর্তের রাজন্যবর্গকে রামপাল সমর্থ হয়েছিলেন এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে – মতাদর্শগতভাবে।


এই ঘটনার পর কয়েকদিনের জন্য মহারাজা শৈলেন্দ্র একটু বিমর্ষ হয়ে গেছিলেন। যেদিন থেকে তিনি চোখের সামনে আপন প্রিয়তমা ভগিনীর অঙ্গচ্ছেদ হতে দেখেছেন সেদিন থেকে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যান। মহিলাদের প্রতি আসক্তির বিষয়টি বাদ দিলে তিনি কিন্তু উদারনৈতিক, স্বাধীনচেতা ও প্রজাবৎসল রাজা হিসেবে পরিচিত ছিলেন; প্রজাদের অকুন্ঠ আনুগত্য ছিল শৈলেন্দ্রের প্রতি। তারাও চাইছিলেন শৈলেন্দ্র প্রতিশোধ নিন। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ ছিল না। তোমাদের কারোর মনে শৈলেন্দ্রের প্রতি প্রজাদের আনুগত্য নিয়ে যদি কোন প্রশ্ন থেকে থাকে, তবে একবার দেখে নিও তিনটি শর বেঁধা ঐ শবদেহটিকে। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ওখানেই পাবে।


এবারে আসা যাক কেন অযোধ্যাকে সরাসরি আক্রমণ করা যেত না।


প্রথমতঃ- রাজ্য হিসেবে অযোধ্যা নিজেই একটা মস্ত বড় রাজ্য। জনসংখ্যা বেশি, তাই লোকবলও অনেক বেশি। ফলে মুখোমুখি আক্রমণে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু ফলাফল অনিশ্চিত। বস্তুতঃ এর আগেও কয়েকবার মুখোমুখি আক্রমণ হয়েছে; শৈলেন্দ্রর পিতা দামোদর দুবার সন্মুখযুদ্ধে যান, কিন্তু দুবারই ফলাফল অমীমাংসিত থাকে।


দ্বিতীয়তঃ- অযোধ্যার প্রবাদপ্রতিম সুরক্ষা ব্যবস্থা। অতীতে বৃহৎ সেনাদল নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেও অমীমাংসিত ফলের অন্যতম কারন। দূর্গের মূল ফটক তো অনেকদূরের গল্প, রাজধানীর বার-প্রাচীরের কাছে পৌছাতে পৌছাতেই আর্ধেক সৈন্য শেষ! কোথায় কোন অংশে পায়ের নীচের মাটি সরে যাবে, কোন অংশে ওপর থেকে প্রস্তরখন্ড নেমে আসবে, অথবা ভারি কীলক বিঁধে যাবে শরীরে; অথবা গায়ে প্রথমে তেল পড়বে পরে ভষ্মীভূত হয়ে যাবে আগুয়ান সেনা তা কেউ হলপ্ করে বলতে পারবে না। চতুর অযোধ্যাবাসীরা ফাঁদ তৈরীতে কারিগর।


তৃতীয়তঃ- জনসমর্থন। জানকীর প্রতি তাঁর আকর্ষণের কথা সর্বজনবিদিত; তায় আগুনে ঘি ঢেলে ফেলেছে বিভূতিকার আগ্রাসন। বৈবস্বত মুনির আশ্রমের ঘটনাকে উপলক্ষ করে সব রাজারা একজোট হয়েছেন দশপালের সমর্থনে। এর অর্থ, সমগ্র আর্যাবর্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ! কার্যত, এটি অসম্ভব।

তাহলে, এখন উপায়?


সুযোগ এসে গেল অযাচিত ভাবে। অথবা হয়তো বিধাতা সেই সুযোগ করে দিলেন শৈলেন্দ্রর বিনাশের উদ্দ্যেশ্যেই। যাই হোক, দাক্ষিণাত্যে সেইসময় এক প্রলয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয় - বন্যা। অবন্তি সাম্রাজ্যর বাইরে সেইসময় চৌদ্দজন রাজা রাজ্যশাষণ করতেন। অবন্তী সাম্রাজ্যের সমুদ্রোপকূল অঞ্চল ও দাক্ষিনাত্যের প্রায় সমগ্র ভূমি বন্যা-কবলিত হয়ে পড়ে। হাহাকার, আর্তনাদ ও মৃত্যু – এই ছিল চারিদিকের চিত্র। পরিস্থিতিকে কাজে লাগান শৈলেন্দ্র। বন্যাত্রানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরিবর্তে লাভ করেন চৌদ্দজন রাজার কৃতজ্ঞতা। এতক্ষণে পায়ের নীচের জমি একটু শক্ত হয় তার।


একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন – অযোধ্যায় গিয়ে যুদ্ধ করাটা আত্মহত্যার নামান্তর। ঐভাবে নয়, টেনে আনতে হবে ওদের এইখানে। সেটা কি করে সম্ভব? চতুর শৈলেন্দ্র উপায় একটা বের করলেন। জানকি অপহরণ হল। তাকে নিয়ে আসা হল অবন্তীতে। এইখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, তাঁকে হরণ করলেও শৈলেন্দ্র কিন্তু তাঁর ওপর কোন বিষয়ে জোর খাটাননি। তাঁর চরিত্রের এটা একটা অন্যতম গুণ, তিনি কিন্তু অসহায় স্ত্রীলোকদের বাধ্য করতেন না কোন অধার্মিক কাজে; জানকীর জন্য সুরক্ষার সবরকম ব্যবস্থা তিনি করেছেন, তাঁকে বন্দীশালায় না রেখে রেখেছেন অতিথিশালায়; শুধু তাঁর চলাফেরা নিয়ন্ত্রন করা হয়। মহিলা প্রহরী মোতায়েন করা হয়েছিল তাঁর সুরক্ষার জন্য।


এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু অর্থবহ। রাজা দশপাল, তাঁর দুই পুত্র, সহযোগি রাজারা সকলে একযোগে আক্রমণ হানল অবন্তী সাম্রাজ্যের ওপর। যুদ্ধ হল ভয়ানক, ভয়ংকর। পনেরজন রাজার যুগ্ম সেনাদল সন্মিলিত প্রচেষ্টা করল অনার্যভূমির সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার। দীর্ঘদিনব্যাপী সেই যুদ্ধের পর দেখা গেল – সবংশে নিহত রাজা শৈলেন্দ্র। তার দুই ভাইয়ের একভাই, তাঁর সবকটি পুত্র – সবাই নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। এমনকি রাজা দশপালও অলঙ্ঘনীয় ছিলেন না; তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মারা যান এই যুদ্ধে। দূর্দম অনার্যভূমি চলে যায় আর্যদের দখলে। সর্বসন্মতিক্রমে শৈলেন্দ্রের একভাই বিভীষন রাজা হয়ে যান; যুদ্ধক্ষেত্রেই রাজা ঘোষিত হন তিনি। তিনিই একমাত্র অনার্য রাজ সদস্য যিনি যোগ দেন আর্য শিবিরে। করদাতা রাজ্য হিসেবে আর্যদের প্রতিনিধি হয়ে তিনি রাজত্ব করবেন দাক্ষিণাত্যে; বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার!”


-“কিন্তু মহর্ষি, বিভীষণ তো সত্যের পথে চালিত হয়ে এই কার্য করেছেন” – সুযোগ পেয়ে বলে ওঠেন শুভামঙ্গল – “তাঁর সম্পর্কে আপনার এই মূল্যায়ন কি সঠিক?”


-“আমি তো কোন মূল্যায়ন করি নি শুভা! আমি শুধু একটা সত্যকে সামনে তুলে ধরছি মাত্র। আর ‘সত্যের পথে চালিত হয়ে’ তিনি এ কার্য করেছেন এমন ধারণা তোমার হল কেন? সত্যের পথে যদি তিনি থাকতেন তবে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াতেন। তিনি অনুরোধ করতেন যেন তাঁর অপর ভাই বা ভ্রাতষ্পুত্রদের যেন ক্ষমা করা হয়। তিনি তা করেন তো নিই, উপরন্তু নিজের ভ্রাতষ্পুত্র জীমূতবাহনকে অন্যায়ভাবে গুপ্তহত্যা করিয়ে ছিলেন সন্মুখযুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে। এ তো যুদ্ধ নয়, এ হত্যা! নিজের রাজ্যলাভের আকাঙ্ক্ষা তাঁর অনেকদিনের। মেজভাই শৈলেন্দ্র শক্তিশালী, তথা বুদ্ধিমান। তাঁর কূটনীতির জোরেই অবন্তী দক্ষিণে সমুদ্রতীর অবধি বিস্তার লাভ করে। তিনি রাজা হন তাঁর পিতার মনোনয়নে। বড়ভাই ঘটকর্ণ। তাঁর স্বভাব ঋক্ষদের মত। ঘুমকাতুরে, অলস প্রকৃতির। কিন্তু শারীরিক দিক দিয়ে অধিক বলশালী। বেঁচে থাকতে থাকতে তিনি অযোধ্যার মিলিত সৈন্যের প্রভূত ক্ষতি করে যান। আত্মভোলা, নিজের মত থাকতে ভালোবাসতেন। ছোটভাই ছিলেন এই বিভীষণ। ঊচ্চাকাঙ্খী, কিন্তু শারীরিক বলও কম, বুদ্ধির মানও সংকীর্ণ। এর আগেও ষড়যন্ত্র করেছিলেন সিংহাসন লাভের আশায়। শৈলেন্দ্রের ঔদার্যে চূড়ান্ত শাস্তির হাত থেকে রেহাই পান। তবে রাজসভার পদ থেকে ইনি বিতাড়িত হন। আরও শুনবে? বল? তোমাকে যদি বলা হয় এঁকে নিয়ে একটা উপাখ্যান লিখতে, তবে তুমি কি লিখবে? কোন চরিত্রের আদলে তুমি তৈরী করবে একে?”


মাথার ওপরে তখন চক্রাকারে পাক খাচ্ছে চিল-শকুনের দল। তাঁরা যে অংশটিতে দাঁড়িয়ে আছেন অদ্ভুত তাঁর ভূ-প্রকৃতি। পাহাড়ও আছে, সমুদ্রও আছে। পাহাড় বলতে ছোটো-খাটো টিলা, নাতিঊচ্চ খাড়া শৈলশিরা। পাহাড় শেষ হয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে যদ্দূর চোখ যায় এবড়ো-খেবড়ো ভূমি-প্রান্তর, তারপর বালুকাবেলার শুরু; তারপরই অসীম বারিধি। আশেপাশের ভূ-প্রকৃতি একটু জরিপ করে নিলেন মহর্ষি বাল্মীকী।


-“হুঁ, যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে জায়গাটা খারাপ নয়। অসাধারন স্থান নির্বাচন করেছিলেন শৈলেন্দ্র। একদিকে নাতিঊচ্চ পাহাড়, একদিকে মহাবন, আর একদিকে সমুদ্র। পশ্চাদাপসরণের কোন জায়গা নেই। সরতে হলে দক্ষিণে, আরও দক্ষিণে। আর যত সরবে, রসদ সরবরাহ আরও কমবে। এমন একটা জায়গা পেয়েও হেরে গেল শৈলেন্দ্র? মানুষের অনৈতিক কর্মফল বোধহয় তাকে বিনাশের দিকে টানে।”


-“এখন আমরা, মানে, আমাদের কি করণীয় মহর্ষি?” - জিজ্ঞেস করলেন অষ্টবসু, বাল্মীকী সর্বাপেক্ষা স্নেহাষ্পদ শিষ্য – “মানুষগুলির অন্তিম পরিনতি দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁদে উঠছে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কি সমীচীন হবে?”


-“মহর্ষি মার্কন্ডেয় আমাদের এই স্থান নির্দেশ করেছিলেন অষ্টবসু। ওঁনার সঙ্গে দেখা না হলে আমাদের যোগসূত্র হারিয়ে যেতে পারে। অদূরে ঐ তিনটি টিলা দেখতে পাচ্ছ? ঐ মাঝের টিলাটির পাশে যখন হীরক দ্যুতির প্রভা দেখতে পাবে – ঐ দেখ, বলতে না বলতেই দেখা যাচ্ছে, ওটাই সংকেত। চল, পা চালিয়ে চল। উনি ওখানেই আছেন।“


-“মহর্ষি মার্কন্ডেয় কে মহর্ষি?”

-“চল, যেতে যেতে বলছি-"।


এবড়ো খেবড়ো প্রান্তর দিয়ে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন মহর্ষি বাল্মীকী।


[মার্কন্ডেয়র কথা]


-“আকাশে রাত্রির অন্ধকারে সাতটি তারা, সপ্তর্ষিদের দেখেছ অষ্টবসু? সাতজন পবিত্র ঋষিদের নামে ঐ সাতটি তারা। এঁদের নাম অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রেতু, বশিষ্ঠ, মরিচী। আমাদের সময়ের অনেক আগে যখন মানবসমাজ তৈরী হচ্ছে, ধর্ম তৈরী হচ্ছে, এঁরা সেই যুগের ব্যাক্তি। এঁদের আগমন কবে, কবেই বা প্রয়ান কেউ জানে না। মানুষগুলি আর নেই, রয়ে গেছে তাঁদের সুনাম। অমর হয়ে আছেন তাঁরা, তারাদের মাঝখানে।


মহর্ষি মার্কন্ডেয় এঁদেরও পূর্বেকার মানুষ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ কিন্তু এঁকে – চমকে উঠলে কেন? ভয় পেয়ো না, তিনি কিন্তু তোমার-আমার থেকেও বেশি জীবন্ত। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বুঝতে পারবে তিনি কতটা সহাস্যমুখ! সদাচঞ্চল একজন ঋষি। বয়সে আমার চেয়ে হয়তো বড়, কিন্তু দেখলে মনে হবে আমার চেয়ে ছোট। যদিও ওঁনার বয়স নির্ণয় অসম্ভব।


ইনি এক সুপ্রাচীন রাজবংশীয় জাতক ছিলেন; কিন্তু পরবর্তিকালে ইনি রাজবংশ পরিত্যাগ করে বেড়িয়ে আসেন এবং সাধক হিসেবে পরিব্রাজন করেন বিভিন্ন অঞ্চলে; বহুবর্ষব্যাপী সাধনার পর অবশেষে ইনি এক নতুন ধর্মমত পত্তন করেন। ভক্তদের মধ্যে বহুল প্রচারিত হয় তাঁর এই ধর্ম। আটখানি সহজ জীবনপ্রণালীর মার্গ দর্শন করান তিনি অস্থিরচিত্ত জনতাকে। শেষে জন্মস্থল থেকে অনেক দূরে নিজের মৃত্যুর একটা নাট্যরূপ রচনা করে জনসাধারনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি।“


-“ক্ষমা করবেন মহর্ষি, কিন্তু নতুন ধর্মমতটি কি খুব স্বল্প পরিচিত? আটখানি মূল নিয়মের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা এরকম কোন ধর্মমতের কথা তো শুনতে পাই না, কোথায় প্রবর্তন হয়েছে এই নবধর্মের?”


-“এই ধর্মের কথা তোমার আমার পক্ষে না জানাই সম্ভব অষ্টবসু! এই ধর্মের উদ্ভব আমাদের কালে নয়। না, আমাদের আগেও নয়। এই ঘটনা আমাদের অনেক পরের কালের! প্রকৃতপক্ষে মহর্ষি মার্তন্ডের জন্ম না আমাদের সময়ে, না আমাদের আগে; ওঁনার আগমন অনেক পরে, ভবিষ্যৎের গর্ভে। এমন একটা সময় যখন পরিস্থিতি আরো অস্থির, আরও গম্ভীর। ভাই ভাইকে হত্যা করবে, মাতা তাঁর সন্তানদের, বধূ তাঁর স্বামীকে, সন্তান তাঁর আপন পিতাকে। মধুর সমস্ত সম্পর্কগুলি ফিকে হয়ে আসবে, বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। জটিল সময় ও সম্পর্কের ঘূর্ণিপাকে জন্ম নেবে আভন্তরীন বিবাদ ও গৃহযুদ্ধ।


ঠিক এইরকমই একটা কঠিন সময়ে দেবতাদের আশীর্বাদে জন্ম নেবেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়; কোন এক নদীতীরে, রাজবংশের সন্তান হিসেবে। সৃষ্টি করবেন এক মহান ধর্ম যা অস্থির সময়ে মানুষকে ভরসা দেবে, সাহস দেবে, পথ দেখাবে। এরপর পৃথিবীতে যখন তিনি তাঁর দু-কুড়ি-সাতের খেলা সাঙ্গ করবেন ঠিক তখনই পুনর্জন্ম নেবেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়। কালের নিয়মের বাইরে থাকবে তাঁর অবাধ গতিবিধি।”


-“কিছুই বুঝতে পারছি না মহর্ষি! কালের নিয়মের বাইরে, ভবিষ্যতে জন্ম, ভবিষ্যতে কর্ম, ভবিষ্যতের গর্ভেই মৃত্যু.. আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চলেছি…..আচ্ছা, আপনি কি স্বয়ং ওঁনাকে দেখেছেন?”


-“তুমি যথার্থই উচ্চ মেধাসম্পন্ন অষ্টবসু! তোমার প্রশ্নটিও বেশ ঈঙ্গিতবাহী। স্বীকার করছি কিছুক্ষণ আগে দেখা যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখে আমারও মনটা বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে আছে; কিন্তু তাই বলে আমার মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যায় নি। যা শুনছ তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে সত্যি। আর হ্যাঁ, মহর্ষি মার্কন্ডেয়র সঙ্গে স্বয়ং আমার কথা হয়েছে। তবে, এঁনার আরও কিছু কাহন এখনও বাকি আছে।


শোন তবে! তোমরা সকলেই শোন। আগেই বলেছি যে ইনি এঁনার নিজের মৃত্যুর একটা নাট্যরূপ নির্মান করেন। এরপর, কালাতীতের সৌজন্যে তিনি সম্পূর্ন ভিন্ন এক কালে এসে উপস্থিত হন। এখানে তিনি কিছুকাল জঙ্গলে কাটান। এরপর তিনি কালাতীতের সাথে বিচরণের অনুমতি পান। এ বিষয়ে একটা খুব সুন্দর গল্প চালু আছে, পরে কোন প্রসঙ্গে বলব; যাই হোক, এ গল্প উদ্দ্যেশ্য প্রণোদিত যাতে বর্তমান যুগে আমরা, সভ্য মানবপ্রজাতি সহজেই বিষয়টা বুঝতে পারি। আপাতত সারবত্তা শুনে রাখ – মহর্ষি মার্কন্ডেয় হল একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তিনবার এই পৃথিবী ধ্বংস ও পুনর্নির্মান হতে দেখেন।”


-“মহর্ষি, এতক্ষণ আপনি ধাঁধাঁয় কথা বলছিলেন, এখন আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন! তিনবার পৃথিবী ধ্বংস! মানে?”


-“স্বীকার করছি শুভামঙ্গল, এই জায়গাটির মানে বুঝতে আমিও অপারগ; মার্কন্ডেয়র কথাগুলি এক্ষেত্রে কিরকম যেন ভাসা ভাসা, যেন কিছু একটা লুকোতে চাইছেন তিনি; রহস্যাবৃত বাক্য, তুলনায় আমার মস্তিষ্ক ক্ষুদ্র। তাঁর কথায় এটুকু বুঝতে পেরেছি যে মনুষ্যসভ্যতার আগে তিনবার পৃথিবী সুজলা-সুফলা হয়; কিন্তু তিনবার এঁর বিনাশ হয় এবং নতুন করে সভ্যতার পুনর্নির্মান করতে হয়।”


-“কিন্তু এ যে সাংঘাতিক কথা মহর্ষি!!” – বলে ওঠেন অষ্টবসু – “তিনবার পৃথিবী ধ্বংস ও পুনর্নির্মান! এ তো অসম্ভব! উনি ঠিক বলছেন তো?”


-“আমি তো প্রথমেই বললাম, আমাদের বুদ্ধি নগণ্য; ভাঙা-গড়ার এই খেলা বোঝবার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা এখনও বুদ্ধির সেই স্তরে পৌছাই নি যাতে আমরা এই খেলা বুঝতে পারব; এতে অংশগ্রহন করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। মহর্ষি মার্কন্ডেয়কে আমি এ বিষয়ে অনেকবার প্রশ্ন করেছি, প্রত্যেকবার উনি একটাই কথা বলেছেন, ‘সময় এলে বিষয়টি তোমাকে ব্যক্ত করা হবে।’ কে ব্যক্ত করবেন, কিভাবে ব্যক্ত করবেন তা আমার কাছে অজানা। তবে একটা বিষয় আমার কাছে একটু খটকা লেগেছে। মহর্ষি প্রত্যেকবার স্বয়ং আমার সঙ্গে দেখা করেছেন; উনি আসবার আগে আকাশে একটা সংকেত দিতেন, সেই সংকেত দেখে আমরা প্রস্তুত হতাম। কিছুক্ষণ পর ওঁনার আবির্ভাব ঘটত। প্রথম সাক্ষাতের পর সেইরকমই ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু এবারের সংকেত প্রণালী অন্যরকম। কিছু ঘটল কিনা কে জানে! ”


-“পৌছে গিয়েছি মহর্ষি!” – হেঁকে উঠলেন ধর্মক্ষেম – “ঐ যে দূরে তিনটি চূড়ো দাঁড়িয়ে আছে। এর পর কি কর্তব্য মহর্ষি?”


-“ঐ মাঝের চূড়োটার দিকে চল। ঐটেই আমাদের গন্তব্য।”


এগিয়ে গেলেন চারজনে টিলাটির দিকে।



পাহাড়ের গায়ে নানান্ পাকদন্ডী কেটে এবড়ো-খেবড়ো, প্রস্তরপূর্ণ ঢালু পাহাড়ি পথের গা বেয়ে খুব দূর্বিষহ রাস্তা। বেশিরভাগ সময়ে মাথা নীচের দিকে করে রাস্তা দেখে যাওয়াই সমীচীন, কারণ একবার পদস্খলনের মানে ঢালু পথে গড়িয়ে অনেকটা নীচে নামতে হবে। এতে জীবন হয়তো যাবে না কিন্তু শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির পূ্র্ণ সম্ভাবনা। এই পথের দুধারে যে দৃশ্যপট তাতেও খুব একটা রকমফের নেই। সেই ন্যাড়া প্রান্তর, কিছু গুল্ম জাতীয় গাছ, ইতি-উতি পাথর, মাঝে মধ্যে কিছু বুনো ঝোপঝাড়।


-“সাবধানে দেখেশুনে পা ফেল সবাই। পথ ঢ়ালু এবং পিছল। আর হ্যাঁ, কোথাও হাত রাখতে হলে আগে ভালো করে আশপাশ দেখে নেবে। এইসব পাহাড়ি অঞ্চলের সর্পকূল সমতল অঞ্চলের সর্পদের থেকে ঢের বেশি বিষধর।” বলে উঠলন বাল্মীকী।


কিন্তু কয়েকটা মোড় ঘুরতেই যে দৃশ্যপটের সামনে এসে তাঁরা উপস্থিত হলেন তাঁতে তাঁদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল; প্রত্যেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন সামনের দিকে। স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকীকে দেখে মনে হল তিনিও প্রস্তুত ছিলেন না এমন দৃশ্য দেখবার জন্য। এ তো কল্পনাতেও আনা যায় না, এমন দৃশ্য কি সত্যিই বাস্তব না কোন রূপকথা? এ তো অবিশ্বাস্য!!


দূর থেকে যে তিনটি চূড়ো তাঁরা দেখেছিলেন তার মধ্যে দুটি প্রাকৃতিক। পাহাড়েরই অংশ সেগুলি, পাহাড়ের বর্ধিত অংশ যা দূর থেকে প্রতীয়মান। এতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মাঝের যে অংশটিকে তাঁরা দূর থেকে চূড়ো বলে ভাবছিলেন, সেটি পাহাড়ের কোন অংশ নয়! পাহাড়টির সঙ্গে তার কোন যোগ নেই, সেটি স্রেফ পাহাড়ের মাঝখানে একটা সমতল অংশের ওপরে দন্ডায়মান; যদিও দূর থেকে দেখে এটি পাহাড়চূড়ো বলে ভ্রম হওয়াই স্বাভাবিক। তার গায়ের বর্ণ প্রস্তরখন্ডের সঙ্গে মিশে গেছে, দেহটাও দেখে পাথর কুঁদে তৈরী বলে ভ্রম হয়; বিরাটকায়, মাটি থেকে উল্লম্ব হয়ে খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে; দুটি পাশেই নীচের দিক করে দুটি বিরাটকায় চক্র; তাদের ওপর ভর করে যানটি দাঁড়িয়ে আছে। যান? এছাড়া অন্য কোন উপমা তো মাথায় আসছে না! এতবড় যানকে এখানে টেনে আনতে কমপক্ষে হাজারখানেক হস্তীর প্রয়োজন। এত হস্তী এলই বা কোথা থেকে আর গেলই বা কোথায়?


তাছাড়া আরও বিশেষত্ব আছে প্রকল্পিত এই ‘যান’-টিতে। এর গায়ে বিভিন্ন অংশে বাতায়ন দেখা যাচ্ছে; কিন্তু সেগুলিও যেন যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অদ্ভুত গড়ণের! কোনটা চৌকো, কোনটা গোল, কোনটা বিশাল আবার কোনটা অতীব ক্ষুদ্র। দিনের আলো কমে এসেছে, বাতায়নের মধ্য দিয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আলো বাইরে ঠিকরে বেরোচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোন কাঠের খিলান নজরে আসছে না। কি অদ্ভুত যান! নীচের দিকেও মনে হল যেন চারটি ছোট পা রয়েছে, তাতে আবার শালুকপানা চাকাও লাগানো!!


সব মিলিয়ে যে বেজায় অদ্ভুত যান সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু জিনিষটা কি?


-“আদেশ করুন মহর্ষি। কি করণীয়?” – বলে উঠলেন ধর্মক্ষেম।


-“এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই, আমাদের যে দিগনির্দেশ করা হয়েছিল তা এই স্থানটিকেই ঈঙ্গিত করছে। এখানে তো কোথাও অন্য কোন দ্বিতীয় পাহাড় নেই; যা আছে তা সব নাতিউচ্চ প্রস্তরসমষ্টি। এটাই শেষ পাহাড় এই অঞ্চলে।“


-“আপনি কি নিশ্চিত?”


জবাবে ঘাড় নাড়লেন মহর্ষি। অতঃপর হাত নেড়ে সবাইকে থামতে ঈঙ্গিত করে নিজে এগিয়ে গেলেন যানটির দিকে।


-“সাবধান মহর্ষি, বেশি নিকটে যাবেন না!” পিছন থেকে সতর্ক করলেন অষ্টবসু।


হাত নেড়ে সবাইকে আশ্বস্ত করে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেন বাল্মীকী যানটির দিকে। কিন্তু কিছুই ঘটল না তো! আরেকটু এগিয়ে এলে কেমন হয়?


ইতস্তত করে কয়েক পা এগিয়ে আসতেই শুরু হল বিপর্যয়। প্রথমে মনে হল তাপমাত্রা যেন একটু বৃদ্ধি পেল; এরপর তিনি বুঝলেন আটকে গেছে পদযুগল! অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন, কোন এক অমোঘ আকর্ষণের ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন তিনি!! স্বাধীনভাবে হাত পা তো নাড়তে পারছেনই না উল্টে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাঁর শিষ্যদের যে সহযোগিতার জন্য ডাকবেন সেই উপায়টাও নেই। সম্পূর্ণভাবে তিনি বন্দী!


তাঁর শিষ্যরাও একটা বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এগিয়ে আসতে গিয়েও বিপদ! অজ্ঞাত কোন তাপোৎপাদক বস্তু তাঁদের গায়ের চামড়া পর্যন্ত যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে! একমাত্র পেছিয়ে গেলেই সব আবার স্বাভাবিক! এখন উপায়?


সকলেই যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মহর্ষি বাল্মীকী যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন, এমন সময় মনে হল যেন যানের একটা দরজা মত কিছু একটা খুলে গেল আর একজন কেউ যেন বেরিয়ে এল সেই দরজা দিয়ে। তারপর একটা আওয়াজ ভেসে এল তাঁদের কানে-


“মহর্ষি বাল্মীকী এসে গেছেন? ওহোঃ, দুঃখিত। দাঁড়ান;”

(পরবর্তিকালে অষ্টবসু এই আগমন সম্পর্কে বলেছিলেন, “মনে হল একটা কুমীর বিরাট বড় হাঁ করলে যেমন দেখতে লাগে,যেন ঠিক সেইরকম ভাবে খুলে গেল যানের দরজাটি!”)


আস্তে আস্তে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে মহর্ষি অনুভব করলেন তিনি আবার তাঁর হাত-পায়ের স্বাভাবিক ক্ষমতা ফেরৎ পেয়েছেন; পরিবেশের তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আগেকার সেই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি আর নেই।


-“আপনাদের অহেতুক কষ্টদানের জন্য দুঃখিত। কেমন আছেন মহর্ষি বাল্মীকী?” জিজ্ঞেস করলেন আগুন্তুক।


-“কেমন ছিলাম সেটা জিজ্ঞেস করলে বরং বাধিত হতাম।” – ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন মহর্ষি বাল্মীকী – “যাক গে, সবাই এনাকে প্রণাম কর, ইনি মহর্ষি মার্কন্ডেয়। আর এঁরা আমার তিন শিষ্য ও পার্শ্ব-সহচর। আপনার আদেশ মত এই তিনজনকেই আমি স্বয়ং নির্বাচন করেছি।”


-“আপনাকে আদেশ করব এরকম প্রজ্ঞা আমি এখনও লাভ করিনি মহর্ষি! আমি পৃথিবীতে পরিচিত আমার মরণশীল নামে, কিন্তু আমার নিজ নামে আমি কখনোই পরিচিত হব না। এটাই আমার বিধান। কিন্তু আপনি…থাক। ভবিষ্যতের কথা তুলে লাভ নেই। আমরা সবাই ঘটমান বর্তমানের সন্তান। আসুন, এখন আমাদের সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করবেন।”


“’আমাদের ’,মহর্ষি?”


-“স্বয়ং কালাতীত আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। ওঁনার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ করানোর ভার উনি আমার ওপরে ন্যস্ত করেছেন।”


অষ্টবসু লক্ষ্য করলেন ‘কালাতীত’ প্রসঙ্গ উঠতেই মহর্ষি বাল্মীকী একটু যেন সতর্ক ও গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিন্তু কালাতীত কে?


-“কিন্তু কোথায় উনি? তাঁকে দর্শন করবার জন্য খুব উদ্গ্রীব হয়ে উঠছি। তাঁর নাম প্রচুর শ্রবন করেছি বহু যুগ ধরে। কোথায় অবস্থান করছেন উনি?” – জিজ্ঞেস করলেন বাল্মীকী।


-“আসুন, আগে আমাদের এই মহার্ণব-পোতের ভিতর। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। রাত বাড়লে এখানে আবার জংলী জানোয়ারদের উৎপাত বাড়ে। আসুন ভিতরে।”


-“যাক, তাহলে ভাবতে খুব একটা ভুল হয় নি।” – যানের দিকে যেতে যেতে চিন্তা করলেন অষ্টবসু – “এটি তাহলে একপ্রকার যান। কিন্তু উনি তো অর্ণবপোত বলেছেন! এখানে সমুদ্র-উপকূল থেকে জায়গাটি অনেকটাই দূরে, সংযোগকারী কোন নদীও নেই মধ্যিখানে, তাছাড়া যানটি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাথায়। ধারে কাছে কোথাও অন্য কোন নদীও নেই। তাহলে এই অর্ণবপোত এখানে এল কি করে?” – এরকম সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করলেন অষ্টবসু, বাকি প্রত্যেকের সঙ্গে।


কেউই খেয়াল করলেন না, তাঁদের প্রবেশের কিছুক্ষণ পরেই যানের প্রবেশদ্বারটি নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল।


[কল্পযানের ভিতর...]


প্রকান্ড এক অধিবেশন কক্ষের ভিতরে উপবিষ্ট ওঁরা পাঁচজনে। মধ্যমণি স্বয়ং মহর্ষি মার্কন্ডেয়। তাঁর পার্শ্বে মহর্ষি বাল্মীকী। তিনি স্থিতধী, কিন্তু বর্তমানে সামান্য একটু চঞ্চল হয়ে পড়েছেন ভিতরে ভিতরে তা বোঝা যায়। বাকি তিনজন মূহ্যমান।


তারা যে কক্ষে রয়েছেন তা এই যানের একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। প্রকান্ড এই পোতের একেবারে মধ্যবর্তি স্থানে এটি। অনেকগুলি সিঁড়ি, অনেকগুলি ছোট কক্ষ পেরিয়ে তবে পৌছান যায় এইখানে।


আশ্চর্যের বিষয়,‘সিঁড়ি’ শব্দটি উচ্চারণ করা হল বটে তার কারণ তাতে পাদানিও ছিল আর তা দিয়ে ওপরে আরোহন করাও যাচ্ছিল; কিন্তু মজার বিষয় কষ্ট করে পদক্ষেপ নেওয়ার দরকারই পড়ে নি সেখানে। সিঁড়িগুলি স্বয়ংক্রিয়! প্রথম পাদানিতে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে সেই যে সিঁড়িগুলি চলতে শুরু করে দিল তা থামল একেবারে তাঁদের গন্তব্যে পৌছে দিয়ে! সে এক দৃশ্য বটে, কতবার যে এ ওর গায়ের ওপর পড়ে গেলেন তার কোন সীমা নেই! একবার তো ধর্মক্ষেম মহর্ষি বাল্মীকী ওপরেই—


সিঁড়ি তো তাও প্রহেলিকার একটা অংশ মাত্র, কিন্তু কক্ষগুলি? আর আলো? ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সেই আলো। আর বড় অদ্ভুত! এই আলো কিন্তু আগুন থেকে আসছে না; আগুন নয়, অথচ আলো দিচ্ছে, তার কোন তাপ নেই, এমন কথা কেউ শুনেছে কি? দেওয়ালগুলি স্বচ্ছ স্ফটিকের, মেঝেও স্ফটিকের; তাতে যেন মুখ অবধি দেখা যাচ্ছে। কক্ষগুলির মধ্যে কোনটার তাপমাত্রা বিশাল, কোন ঘরে চ্যাটালো পাথরের মত সমকোণি চৌকো আকৃতির মেজ্, তাতে অজস্র চক্ষু। কিন্তু কোনটাই মানুষের নয়! মানুষের চোখে পলক পড়ে, এতে পড়ে না; মানুষের চোখ সাদা, এখানে কোন চোখ লাল, কোনটা পিঙ্গল, কোনটা সবুজ, আরও কতরকমের বর্ণ কে জানে! শুভামঙ্গল ভয় পেয়ে গেছিল এইসব মায়াবী চোখের মায়াতে!!


মজার বিষয় এখানে এতরকম কক্ষের মাঝে অন্ততঃ একটি কক্ষ আছে যা খুব সম্ভব এদের শবাগার হিসেবে ব্যবহার হয়। ‘শবাগার’ এই কারণেই বলা কারণ এতগুলি দেহ একত্রে আর কোথাও দেখা যায় না শবাগার ব্যতীত। অগুন্তি শবদেহ, কিন্তু প্রত্যেকটিই একটি করে কাঁচের আচ্ছাদনের ভিতরে রাখা এবং প্রত্যেকেই বুক অবধি তরলে নিমজ্জিত। যে শবগুলি ভিতরে রাখা তাদের গড়নও কি অদ্ভুৎ! বেশিরভাগটাই মনুষ্য-গড়ন দ্বিপদবিশিষ্ট প্রানী, কিন্তু কোনটা বিরাট উঁচু, তাঁদের মাথার ওপরেও বিরাট লম্বা, ভয়াবহ চেহারা; কোনটা তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতি কিন্তু সুদর্শন, মুখের গড়ন আলাদা। এছাড়াও যে কত কিম্ভূৎ-কিমাকার সাড়ে-বত্রিশ ভাজা প্রজাতির দেহ যে সেখানে রাখা তার কোন সীমা নেই! একটি পাখীর দেহ দেখলেন তাঁরা, তাঁর ডানা আছে বলে তাকে পাখী বলা যেতে পারে; কিন্তু পাখীর দেহ যে এত বিশাল হয়, সেটি যে সরীসৃপের মত হয় এবং তার দাঁতগুলি যে এত সুঁচোল হয় তাই তাঁদের ধারনায় ছিল না। অন্যান্য পাখীদের সঙ্গে কোন মিলই নেই তার। আর, গোটা ঘর জুড়ে এক বিশ্রী গন্ধ! একে চাপা দেওয়ার জন্য নিশ্চই সুগন্ধী কিছু দেওয়া আছে ঘরে, কিন্তু তাতে এই বাসি মড়ার মত গন্ধ চাপা যাচ্ছে না। সকলেরই বমনোদ্রেক হয়েছিল ভিতরে। আর বেশিক্ষণ ভিতরে থাকলে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তেন তাঁরা!


যাই হোক, তাঁদের অবস্থা দেখে মহর্ষি মার্কন্ডেয়র মনে নিশ্চই কোন দয়ার উদ্রেক হবে; তিনি আর কালবিলম্ব না করে তাঁদেরকে এনে বসান এই কক্ষে, নিজ হাতে পরিবেশন করেন মিষ্টি পানীয়, কবোষ্ণ খাদ্য। এখন অনেকটাই সুস্থ বোধ করছেন তাঁরা।


-“এরপর বিজ্ঞানের যুগ আসতে চলেছে মহর্ষি” – বলে উঠলেন মার্কন্ডেয় – “এখনও এই বিশেষ জ্ঞানকে ভয় করলে চলবে?”


মহর্ষি বাল্মীকী মার্কন্ডেয়র পূর্ব পরিচিত, কিন্তু বাকিরা নন। সকলেই তাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন ওঁনাকে। দীর্ঘ উন্নত গ্রীবা, আকারে বর্তুলাকার একটি মস্তক, কোঁকড়ানো চুল, পক্ককেশ, যদিও চামড়া এখনো টানটান। উন্নত, বুদ্ধিদীপ্ত মায়ামাখানো চক্ষুদ্বয়। দীর্ঘ নাসা, এবং তার কানদুটো! এতবড় কান যে আগে তাঁদের চোখে পড়ে নি কেন তা ঈশ্বরই জানেন কিন্তু মানুষের বহির্কর্ণ যে এত দীর্ঘসূত্রী হতে পারে চোখে না দেখলে তাঁরা বিশ্বাসই করতেন না! বেশবাসও অদ্ভুত! কাপড়খানা এত আঁটোসাঁটো যে শরীরের প্রত্যেকটা খাঁজ বলে দেওয়া যায়। তাছাড়া, কাপড়ের গোঁজ তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না! অদ্ভুত এই অর্ণবপোত যার থেকে সর্বক্ষণ হাজার একটা মৌমাছির গুঞ্জন বেরোচ্ছে, যার জলে চলবার কথা কিন্তু যার আশেপাশে কোন নদী বা সমুদ্র নেই; একটা ঘর যাতে স্তুপীকৃত করে অজস্র মৃতদেহ সঞ্চিত করে রাখা; একটা মানুষ, অথবা মানষের মত কিছু একটা যার পরণে অদ্ভুত পোষাক এবং যার কথাবার্তা অসংলগ্ন – সব মিলিয়ে যে বেশ একটা জগাখিচুড়ি পরিবেশ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।


-“ইয়ে, বলছিলাম আর কি” – থাকতে না পেরে অবশেষে প্রশ্ন করে উঠলেন শুভামঙ্গল – “এই যানে দ্বিতীয় কোন জীবিত প্রানী আছে? না মানে যারা শবাগারে রয়েছে তাঁদের তো আর হিসেবে রাখা যাবে না!”।


পাশ থেকে ধর্মক্ষেম একটা কনুইয়ের খোঁচা মারলেন। এটা একটা ঈঙ্গিত চুপ করে যাওয়ার জন্য।


-“নিশ্চই!” – বলে উঠলেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়। তিনি অবশ্য এ নিয়ে দ্বিতীয় কোন কথা বললেন না। মহর্ষি বাল্মীকীও চিন্তিত মুখ করে বসে আছেন। কোন চিন্তায় তিনি ডুবে আছেন কে জানে?


এমন সময় কক্ষের একদিকের দরজা খুলে প্রবেশ করলেন একজন। দীর্ঘাঙ্গী এই মানুষটিকে ‘মানুষ’ না বলে প্রানী বলাই ভালো, কারন আজ অবধি এত লম্বা মানুষ পৃথিবীতে কেউ কোনদিন দেখে নি! বিরাট উচ্চতা, বিশাল বক্ষ, সেই একইরকমের আঁটোসাঁটো পোষাক, ধাতব কোমরবন্ধনী। সবচেয়ে আশ্চর্য তাঁর চক্ষু! চোখে কিছু একটা যেন কৃত্তিমভাবে বসানো আছে বলে মনে হল, কিন্তু সেটা ঠিক কি তা ঠাওর করা গেল না। প্রানীটি যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, এসেই সেটি প্রায় ঝুঁকে পড়ল মহর্ষি মার্কন্ডেয়র ওপর; ফিসফিস্ করে কিছু একটা বলল কানে, তারপর উল্টো পদে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হল কক্ষ থেকে। 


-“শুনুন সকলে!” – বলে উঠলেন মহর্ষি মার্কন্ডেয় – “আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রা শুরু করবে আমাদের এই যান। কিন্তু যাত্রা শুরুর সময় ও শেষের সময় বেশ কিছুক্ষণ আমাদের রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হবে। না, কোন প্রশ্ন নয়, সময় অত্যন্ত হ্রস্ব। এ আমাদের প্রত্যেকের সুরক্ষার প্রশ্ন। আপনাদের সঙ্গে আমিও থাকব রজ্জুবদ্ধ অবস্থায়। এমনকি এই জাহাজে অবস্থানরত প্রত্যেকে। অবশ্য, শুভামঙ্গলকে উদ্ধৃত করে বলা যায় শবাগারের প্রানীরা বাদে, তাঁদেরকে তো আর হিসেবে রাখা যাবে না! প্রত্যেকে বসবার আসনে নিজের শরীর এলিয়ে দিন আর দুপাশের হাতলে হাতদুটোকে রাখুন।”


মহর্ষি মার্কন্ডেয়র ব্যক্তিত্ব নিশ্চই তাঁদের মনে কোন প্রভাব বিস্তার করে থাকবে, অথবা পারিপার্শ্বিক ঘটনা তাঁদের মনে কোন ছাপ ফেলে থাকবে, মোদ্দা কথা তাঁরা আদেশমত কার্য সম্পাদন করলেন। দুপার্শ্বে হাত রেখে শরীর এলিয়ে দিতেই ঘটে গেল আশ্চর্য ঘটনা!


বসবার আসনটিকে তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দেন নি, যদিও অন্যান্য সাধারণ আসনের থেকে সেটি একেবারে আলাদা। শ্বেতকায়, অনেকটা সিংহাসনের মত গড়ন, যদিও তার থেকে অনেকটাই ছোট। শরীর এলিয়ে দিতেই পিছন থেকে দুটি ধাতব পাত বুকের কাছে চেপে বসে গেল; হাত দিয়ে প্রতিহত করতে যেতেই বোঝা গেল সেটাও করা যাবে না কারণ অনুরুপভাবেই তাঁদের কব্জি বাঁধা পড়ে গেছে আসনের হাতলের সঙ্গে দুটি পৃথক ধাতব বন্ধনি দ্বারা! পায়ের অবস্থাও তথৈবচ! নড়াচড়া করবার উপায়টুকু পর্যন্ত নেই।


-“কোন ভয় নেই! দেখুন আমার দিকে, তাকান। আমারও অবস্থা আপনাদের মতই। এটা করা হয়েছে আমাদের নিজ নিজ সুরক্ষার জন্য যাতে কারো কোন শারীরিক ক্ষতি না হয়। শুধু তাই নয়, আমাদের যাত্রাপথকেও আমরা পরিষ্কার দেখতে পারব। একটু ধৈর্য্য ধরে বসুন। ঐ দেখুন, আপনাদের সামনের দেওয়াল উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। দেখুন এবারে বাইরের দিকে।”



বাস্তবিক। কক্ষের একদিকের দেওয়াল সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য। কিন্তু, এত আলো কোথা থেকে এল? আর এত ধোঁয়া?


-“গবাক্ষ বন্ধ করুন মহর্ষি!” – চীৎকার করে উঠলেন অষ্টবসু – “এ ধোঁয়া ভিতরে প্রবেশ করলে আমরা সকলেই মারা যাব।”


-“কোন ভয় নেই অষ্টবসু! এ ধোঁয়া কখনোই ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না। তোমরা ভাবছিলে না আশেপাশে কোন নদী নেই, কি করে চলবে এই যান? এবারে দেখতে পাবে কি করে চলে এই যান!”


সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! বাইরে এতক্ষণ যা ছিল শুধুই ধোঁয়া, এখন তা যেন মূর্তিমান আগুনের লেলিহান শিখা। যানটি প্রথমে মৃদুমন্দ গতিতে, অতঃপর থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। অজস্র কালবৈশাখী ঝড় যেন খাড়া লম্বা এই যানটির ঘেঁটি ধরে নাড়িয়ে দিচ্ছে। যে দুটি চাকাকে ঢোকবার সময় তাঁরা দেখেছিলেন যানের সঙ্গে উল্লম্ব অবস্থায়, এখন তাঁদের চোখের সামনে সেগুলি যেন হয়ে গেল অনুভূমিক! তারপর, প্রথমে ধীরে, তারপর মধ্যম, শেষে তীব্রগতিতে ঘূর্ণন আরম্ভ হল। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই—


চারজোড়া বিষ্মিত চোখের সামনে অত বড় যানটি মাটির সব মায়া কাটিয়ে খাড়া হয়ে উঠতে শুরু করল ওপর দিকে! একটু একটু করে তাঁদের চোখের সামনে ক্ষুদ্র হতে লাগল নাতিউচ্চ তিনটি, থুড়ি দুটি শৃঙ্গসমেত সেই পাহাড়, ঊষর প্রান্তর; একটু পরেই তাঁদের চোখের সামনে উন্মুক্ত হল বন-বনানী সমেত সেই গোটা অঞ্চলটি যা পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে তাঁদের সময় লেগেছিল গোটা একটা দিন! ঊর্দ্ধে মুখ তুলে তারা পরিষ্কার দেখতে পেলেন বায়ুমন্ডল, এত কাছে যেন মনে হয় হাত বাড়ালেই ধরা যাবে! কিছুক্ষণ পরে দেখলেন মেঘ-টেঘ সব উধাও; শুধু নিকষ কালো এক আকাশ ভর্তি তারা। নিচের দিকে তাকিয়ে আর কিছু দেখা গেল না, শুধু যেন ঘন মেঘের একটা স্তর।


কিছুক্ষণ পরেই তাঁদের শরীরের সব বাঁধন খুলে গেল, মুক্ত হলেন তাঁরা।


[কল্পনা নয়, আমরা সত্যিই তবে উড়ছি!]


ক্ষের ভিতরের অবস্থা তখন সত্যিই মূহ্যমান!


প্রত্যেকের ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে! শুভামঙ্গল চোখ বন্ধ করে একমনে ইষ্টনাম জপ করছেন; তাঁর ধারণা তিনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বর্গে পৌছিয়ে যাবেন। ধর্মক্ষেম এমনিতেই চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ, বর্তমান পরিস্থিতে আরোই চুপ। মুখ দিয়ে আর কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না। অষ্টবসু ফ্যালফ্যাল্ করে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে; কোনদিকে দেখছেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্থিতধী মহর্ষি বাল্মীকী শান্ত; এই বিস্ময়কর ব্যাপার-স্যাপারে তিনি একটু ঘোরের মধ্যে আছেন বটে, কিন্তু মোটের ওপর তিনি শান্তই বলা যায়। মহর্ষি মার্কন্ডেয় এগিয়ে এসে হাত রাখলেন বাল্মীকী কাঁধে। এই প্রথম মুখ খুললেন বাল্মীকী:


-“আমরা উড়ছি তবে, মহর্ষি!”


-“হ্যাঁ, আমরা উড়ছি, পাখিদের মত, আকাশে। কিন্তু আপনি ঠিক আছেন তো মহর্ষি?”


-“জীবনে অজস্র প্রতিঘাত সহ্য করে এসেছি মহর্ষি”- বলে ওঠেন প্রাজ্ঞ বাল্মীকী – “বিস্ময় নয়, আপনার এই উড়ান-যানের অতুলনীয় শক্তি ও সীমাহীন সম্ভাবনা আমার মুখের বাক্য কেড়ে নিয়েছে। একে আপনারা কি নামে ডাকেন মহর্ষি?”


-“ব্যোমযান। তবে এই বিশেষ যানটি আন্তর্গ্রহ পরিভ্রমন করতে পারে, তাই একে আমরা অন্তরীক্ষ যানও বলে থাকি। ব্যোমযান অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির যাতে কোন গ্রহের বায়ুমন্ডলের সীমায় একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যাতায়াত করা যায়। কোন একটি গ্রহের পরিমন্ডলের মধ্যেই এর বিচরণ। ঐরকম একটা যানে চেপেই আপনার দর্শনে আসতাম মহর্ষি বাল্মীকী!”


-“পাহাড়চুড়োয় যানের আশেপাশের অঞ্চলে পোড়া দাগ খেয়াল করেছিলাম। তবে আমি আশা করেছিলাম স্বয়ংচালিত শকট। উড়ন-যান আমার কল্পনাতেও আসে নি।“


কিছুক্ষণ কি ভাবলেন মহর্ষি বাল্মীকী, তারপর মুখ তুলে বললেন-


-“আমি আজ থেকে এই প্রত্যেকটি যানের নাম দিলাম ‘বিমান’।”


-“বিমান!”


-“যার কোন উপমা নেই। যার কোন তুলনাও নেই। যা অন্তরীক্ষে স্বাভাবিক স্বাচ্ছ্যন্দে চলবে। আজ আপনার এই যান আমার মুখের বাক্য হরণ করে নিয়েছে। মাটির মায়া ত্যাগ করে একটি যান অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করছে, তার পিছনে আগুনের লেলিহান শিখা, অগ্নিপুচ্ছ। এমন যানকে এককথায় কিভাবে বর্ণনা করি বলুন তো?”


-“এর মধ্যে অসাধারণত্ব কিছু—আচ্ছা, আপনাকে সোজা ভাষায় বুঝিয়ে বলি। ভূমি ত্যাগের সময় এই যানের দরকার হয় ঊৎক্ষেপনশক্তি। পারদ আমাদের সেই শক্তির যোগান দেয়। এই বৃহৎ চক্রগুলি উল্লম্ব অবস্থান থেকে সমান্তরাল হয়ে যায় পারদ সম্ভূত শক্তির সাহায্য নিয়েই। প্রত্যেকটি চক্রের সঙ্গে দুটি করে উপচক্র থাকে, এরা পরষ্পরের বিপরীতে একটি ঘূর্ণন প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করে দুটি পাশ থেকেই। এর ফলে মাধ্যাকর্ষণ বিরোধী এক বলের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে পারদশক্তির প্রয়োজন ক্রমশঃ ম্লান হয়ে আসে। পৃথিবীর বা অন্য কোন গ্রহের বায়ুমন্ডল ত্যাগের পর পারদশক্তির প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন যান চালনার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায় মহাবিশ্ব স্বয়ং।-”


-“প্রাযুক্তিক বিবরণ আমাদের কাছে অর্থহীন, মহর্ষি! আমি, আমরা সবাই সাহিত্যের ছাত্র, বিজ্ঞান আমাদের কাছে এখনও নবীন। যাই হোক, আমি এর নামকরণ করলাম ‘বিমান’। এখন প্রশ্ন হল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?”


-“কালাতীতের সঙ্গে দেখা করতে মহর্ষি।”


-“বুঝলাম এবং বুঝলাম না। কেন, তাঁর কি দরকার আমাদের সঙ্গে?”


এই প্রশ্নে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়। এরপর তিনি বললেন –


-“দরকারটা খুবই বৃহদাকার মহর্ষি বাল্মীকী। বিশদে ওঁনার কাছ থেকেই শুনবেন। তবে আপনার সাহিত্যপ্রতিভাকে উনি কাজে লাগাতে চান মানবজাতির স্বার্থে। স্বার্থদুষ্ট মানবজাতি যাতে নিজেকে ভেঙে টুকরো টুকরো না করে ফেলে সময়ের আগেই, তারই একটা আগাম সতর্কবার্তা তৈরি করে রাখা। বিশদ বিবরণ না দিলে আপনি বিষয়টা বুঝবেন না, আর না বুঝলে ঘটে যাবে বিপর্যয়।”


-“এর…মানে..?”


-“মানবজাতির একটা রক্ষাকবচ লাগবে। না, কোন উন্নত অস্ত্র নয়, নিজেদের ধ্বংসসাধনের লক্ষ্যে নতুন অস্ত্র উদ্ভাবনে মানবজাতি সদা তৎপর থাকবে, তা দিয়ে আমরা তাঁদের কোন উপকার করব না। আমরা তাদেরকে দেব বিবেক যা তাদের সঠিক মার্গ দর্শনে সহায়তা করবে। তার জন্য দরকার এমন এক সাহিত্য যা কালজয়ী হবে।কালের বেড়া ভেঙে প্রাসঙ্গিক থাকবে সব যুগেই। আর এ কীর্তি একমাত্র আপনার দ্বারাই সম্ভব। হ্যাঁ, বল শুভামঙ্গল।”


শুভামঙ্গল মধ্যিখানে হাত তুলেছিলেন; প্রশ্ন করাতে একটু থতমত খেয়ে মাথা চুলকে প্রশ্ন করে বসলেন-


-“সাহিত্য কি আমাদের সবাইকে কালোতীত – মানে ঐ যে কি যেন, তাঁর সামনে বসেই সম্পাদন করতে হবে?”


হেসে উঠলেন দুই মহর্ষি, প্রশ্নের কারণ বুঝে। উত্তরটা অবশ্য দিলেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়-


-“না, তোমরা আপন আশ্রমে বসেই কার্যটি সম্পাদন করতে পারবে। তবে তুমি যদি ব্যগ্র হও ওঁনার সঙ্গে থাকতে তাহলে একটা ব্যবস্থা অবশ্য--” - এ কথা শুনে তড়িঘড়ি বসে পড়লেন শুভামঙ্গল। অন্তরীক্ষ যান উড়ে চলল আপন গন্তব্যের দিকে।।


[অভিযাত্রীর চোখে মহাবিশ্ব – অষ্টবসুর কথা]


অদ্ভুত এই প্রকৃতি! মানবপ্রজাতির সীমিত জ্ঞ্যান, অপরিসর দৃষ্টির বাইরে কত বিস্ময় যে ছড়িয়ে রয়েছে তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। সীমিত জ্ঞান ও বদ্ধ পরিবেশ মানুষকে আবদ্ধ করে রেখেছে সংকীর্ণ গন্ডীর মধ্যে। চেনা পরিমন্ডলের বাইরে মানুষ যদি পা রাখে, তবে হয়তো স্বার্থদুষ্ট সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে সেটা হতে পারে মুক্তির মাধ্যম। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হার মানতে পারে জ্ঞানের ঊৎকর্ষতার কাছে; কূটনীতি হার মানতে পারে বৌদ্ধিক উন্নতির কাছে; রণনীতি অকেজো হয়ে যেতে পারে সৌভ্রাতৃত্ববোধের কাছে। মানুষ কি বুঝতে পারবে চরম ঊৎকর্ষের সংজ্ঞা?


আপাতত এই কথাগুলিই চিন্তা করছিলেন অষ্টবসু তার জন্য নির্দিষ্ট করা কক্ষের বাতায়নের ধারে বসে। বর্তমানে তাঁদের অবস্থান- বৃহষ্পতি ও মঙ্গলের মাঝের গ্রহানুপুঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে গ্রহানুটি, তাঁর মধ্যে। এই গ্রহানুটির নাম বড় অদ্ভুত –‘সোমরস’। মদিরার নামে গ্রহানুটির নামকরণ কেন তা তিনি অনুমান করতে পারেন মাত্র, তবে নিশ্চিত নন। ঘন কৃষ্ণকায় গ্রহানু; আর তেমনি অদ্ভুত এখানকার পরিবেশ। এখানে আকাশ সবসময়ই মসীকৃষ্ণ, তারারা সর্বক্ষণ প্রতীয়মান! দিনের আলো নেই, ফলে কোন সবুজ বৃক্ষ নেই। পশু-পাখী, নদী-নালা কিচ্ছুটি নেই! এখানে বসবাসকারী দেবগণ (‘সোমরস’-এ অবতরণের সময় এঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, ভারি অমায়িক প্রকৃতির লোকজন এঁরা,দোষের মধ্যে উচ্চতা অত্যন্ত বেশি! শুভামঙ্গলের ঘাড়ে ব্যথা ধরে গেছে এঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে।), এবং তাঁদের সৃষ্ট প্রাণী ছাড়া অপরাপর আর কেউ বসবাস করে না। আর যা কিছু প্রাণ, সবকিছু সীমিত একটি কাঁচের ঘেরাটোপের মধ্যে; এর বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। কোন কারণে সীমানা অতিক্রম করে কোন প্রাণী যদি বাইরে বেড়িয়ে আসে তো পরিণাম, তাৎক্ষনিক মৃত্যু! ঠান্ডায়, বায়ুহীনতায়। ‘সোমরস’ গ্রহানু প্রাণধারন করে না।


মহর্ষি মার্কন্ডেয়র সঙ্গে সাক্ষৎকারের সময় থেকে শুরু করে এই গ্রহানুতে পদার্পণ করা অবধি যে সকল অদ্ভুত ঘটনার সন্মুখীন হতে হয়েছে তা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়! তবে বিষ্ময়ের মাত্রারও একটা সীমা আছে। অনেক কিছু এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।


যেমন, যে স্থানে তাঁদের বিমান অবতরণ করল সেখান থেকে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট করা আবাসন অবধি আসতে হল একই শকটে। অদ্ভুত শকট সেটি, নিজে থেকেই গতিশীল, কোন অশ্ব বা বলদ ছাড়াই সেটি চলতে সক্ষম!


আর এই আলো! বিমানে আসবার সময়তেই তিনি লক্ষ্য করেছিলেন আলোৎপাদক বস্তুটিকে। আলো, অথচ কোন আগুন নেই! এ যে আরেক বিস্ময়! সেই আলোক যে কত শক্তিশালী হতে পারে তা বোঝা যায় এঁদের বাসস্থান দেখলে। পথে-ঘাটে সর্বত্র সেই একই রকম আলো, আরও শক্তিশালী! চতুর্দিকে অন্ধকার বলে আর কোন কিছু নেই, অথচ আলোক উৎসের কাছে গেলে কোনভাবেই গা পোড়ে না, বা একটুও গরম লাগে না! এ কিরকম আলো?


তাঁদের যাত্রাপথটিও কি কম বিস্ময়? আসবার সময় বিমানের জানালার কাছে নিয়ে গিয়ে অনেকরকম দৃশ্য দেখিয়েছেন মহর্ষি মার্কন্ডেয়, পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অনেক নতুনত্বের সঙ্গে। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ তো মহাবিশ্বে থাকাকালীন রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়েছে; মহর্ষি বলেছেন এই স্থলে আমরা যদি মুক্ত থাকি তবে হাওয়ায় ভেসে থাকতে হবে, বনবন্ করে ঘুরতে হতেও পারে; মাধ্যাকর্ষণ এখানে কাজ করে না (মাধ্যাকর্ষণ নাকি এমন একটা আকর্ষণ বল যা প্রত্যেকটি বস্তুকে পৃথিবীর বুকে ধরে রাখে! কি অদ্ভুত, তাই না?)। আবার, একটা লাল গ্রহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেটি দেখিয়ে মহর্ষি বললেন এটি মঙ্গল। বহুযুগ আগে এখানে নাকি প্রাণ ছিল! বুঝুন বখেরা! প্রাণ ছিল তো গেল কোথায়? প্রশ্ন করায় তিনি বললেন যে প্রাণ এখন আর নেই; সমস্ত প্রাণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে – বলে তিনি চুপ করে গেলেন। কিন্তু কে করল সেই প্রাণ বিনাশ? কোন দানবীয় শক্তির প্রভাবে এ ঘটনা ঘটল? আর এত বড়, এত সুন্দর গ্রহ থেকে প্রাণ বিনষ্ট করা সম্ভবই বা হল কেমন করে? তিনি অবশ্য নিরুত্তর রইলেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics