Ranu Sil

Tragedy Classics

4  

Ranu Sil

Tragedy Classics

কুটিলার বনবাস

কুটিলার বনবাস

11 mins
285



মানুষের মন বড়ো বিচিত্র, বিচিত্র তার তরঙ্গায়িত পথ। প্রতিটি তরঙ্গের পরতে পরতে জমে থাকা পলি গড়ে তোলে ভিন্ন ভিন্ন মূর্তির অবয়ব। অচেনা হয়ে যায় চেনা মানুষ , কখন যেন অচেনা মানুষও হয়ে ওঠে একেবারে আপনজন..... 

************


অন্ধকার হয়ে এলো। হরিণশিশুটি ঘাস থেকে মুখ তুলে তার মাকে দেখতে পেলনা কোথাও। এবার হিংস্রতার রাজত্ব শুরু হবে অরণ্য জুড়ে। শিশুটি ভীত সন্ত্রস্ত ছোটো ছোটো ডাকে খুঁজতে থাকে মাকে। হঠাৎ চোখ পড়ে ঝোঁপটার ওপর। একটু নড়ে উঠলো যেন.....পরক্ষনেই হলুদ-কালো একটা শরীর তির বেগে বেরিয়ে এলো...... হরিনশাবকটি হঠাৎ গতি নিয়ে দৌড় দিলো। সে তার মায়ের কাছে শিখেছে, এসময়ে কি করতে হয়

***************


ঘন অরণ্যের মধ্যে একটা পর্ণ কুটিরে প্রদীপ জ্বালছে এক প্রৌঢ়া নারী। একটা কুঁজ আড়াল করে রেখেছে তার শরীরের অনেকটা। প্রদীপের কম্পমান আলোয় তার ছায়া পড়েছে, মাটির দেওয়ালে, ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে সেই ছায়া। রূপোর অলঙ্কারগুলো আজও রয়ে গেছে তার অতীতের সাক্ষী হয়ে। সেগুলো ঝিকমিকিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। 


কুটিরের ভিতরে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, জীবন ধারনের উপকরণ সামান্যই। পুর্বদিকের কোনায় একটা মাটির কলস, তার গায়ে অপূর্ব কারুকাজ। সম্ভবত কোনো ফুলের রঙ্ দিয়ে আঁকা। একটা লতাপাতার গালচে মতো রয়েছে মাটির মেঝেতে। বোধহয় ঐটিই প্রৌঢ়ার শয্যা। অন্য কোনায় একটি গাছের ডালের দন্ড, বেশ বলিষ্ট তার গঠন, ওটা ছাড়া তার পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়। আর রয়েছে একটি বস্তু, যা এই পরিবেশে সম্পূর্ণ বেমানান। একটা রত্ন খচিত তরবারি। 


এসব ছাড়াও রয়েছে খুটিনাটি কয়েকটা জিনিস।

কিছু বস্ত্র। এই উপকরণগুলি দেখলে বোঝা যায়, এ কোনো সামান্যা নারী নয়। কোনো স্বেচ্ছা- নির্বাসিত তপস্বিনী নয়। প্রদীপটিও তার মাটির নয়। একটি অষ্টধাতুর পিলসুজের ওপর সেটা সগর্বে অতীত ঐতিহ্য ঘোষণা করছে।


একটা কিছুর দ্রুত ছুটে আসার শব্দে মুখ ফেরালো সে। মনে হলো একটা বিশাল বাঘ তার কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আজকাল আর ভয় করেনা তার। একটা মশাল জ্বালিয়ে বেরোতেই একলাফে সেটা উধাও হয়ে গেল। ফিরে আসতে গিয়ে চোখে পড়লো, একটা ভীত হরিণশিশু অশ্বত্থ গাছের আড়ালে। 


মশালের আলোয় এবার তার মুখটি দেখা গেল, শীর্ণ মুখাবয়ব, টিকোলো নাক, ঘাড়ের কাছে কুঁজের ওপর ঝুলছে একটা বিশাল খোঁপা। অন্ধকারে বর্ণ ঠিক বোঝা গেল না, তবে অরণ্যচারীদের মতো নয়। অদ্ভুত তার চোখদুটি, কোটরাগত, কিন্তু দেখলে মনে হয়, যেন আগুন জ্বলছে। একটা ভয়ের অনুভূতি হয় তার কুদর্শন মুখ দেখলে।

শিশু হরিণটিকে দেখে হাসলো সে।

হাসিতে আরো ভয়ঙ্কর হলো মুখ। হিসহিসে গলায় বললো,

-------ও ও ও ! তাই বলি হঠাৎ বাঘের উদয় কেন ? তুই তাহলে ওর শিকার-----

বলে কয়েক পা এগিয়ে গেল সে,

------তা এই মন্থরার কুটিরে কেন বাবা ? আমার এই বিভৎস চেহারা দেখে তোর ভয় হয় না ? আমার কুটিল মনকে তোর ঘেন্না হয় না ? তবে আয় কুটিরে আয়.... বাঘটা আশেপাশে থাকতে পারে....সবাই যে কেন এই বুড়ির কুটিরে আসে !! এই সেদিন একটা বাঁদরকে বাঘে নিলো। ওর ছানাটা আমার কাছে ছিলো বেশ কদিন.... আজ আসেনি......কে জানে ! বেঁচে আছে কিনা......


মন্থরা হরিণশিশুটিকে কোলে তুলতে গিয়ে পারলোনা,

-------বাব্বা এতো ওজন ! 

ওর মাথায় গলায় শিরাওঠা হাত বুলিয়ে দিলো, হরিনটা ওকে অনুসরণ করে কুটিরের ভেতরে এলো। মন্থরা দেখলো ওটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কিছু বিশেষ ধরনের পাতা তুলতে হবে বন থেকে। দিতে হবে প্রলেপ। বাঘটা থাকতে পারে কাছাকাছি। সে তরবারিটা তুলে নিলো, সতর্ক পায়ে কুটিরের দ্বার বন্ধ করে দিলো বাইরে থেকে। দাঁড়ালো একটু। কিছু কি শুনতে পাওয়া যায় ? নাঃ চারিদিক নিঃশব্দ। সন্তর্পনে এগোলো বনের পথে......


পাতা তুলে এনে, থেঁতো করে প্রলেপ দিলো হরিণের পায়ে, পরম স্নেহে। কথা বলতে লাগলো যেন কতো আপনজন,

-----তোর মা কোথায় গেলো !! তোকে ছেড়ে ? তুইও আমার মতো হতভাগী নাকি ? কেউ ভালোবাসে না ? তুই তো কতো সুন্দর ! আমার মতো কুৎসিৎ নয়। দুটো চোখ ঝাপসা হয়ে এলো মন্থরার। কুঁচকে যাওয়া চোখের কোলে দুচারফোঁটা অশ্রু জমা হলো। ফুটে উঠলো অতীতের ছায়া ছায়া ছবি। প্রায় স্বগোতোক্তির মতো বলে চললো সে,


------ তোর রঙ্ এতো গাঢ় কেন রে ! ঠিক যেন রাজা অশ্বপতির অতিপ্রিয় ঘোড়া রোহিত। যখন তেজী লাল রোহিতের পিঠে সওয়ার হতেন, তখন তাঁকে না ঘোড়াটাকে, কাকে দেখবো ভেবে পেতাম না। আমি ঘোড়া খুব ভালোবাসি। জানিস !!------

মন্থরা দেখলো, হরিণশিশুটি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠিক যেন শিশু কৈকেয়ী-----


ও তরবারিটা নিয়ে, কুটিরের দ্বারে বসলো। হাত বুলালো তরবারি তে, এটা দিয়েই, তার আদরের ভরত তাকে....... !!!

------- তার ডান বাহুতে একটা পুরোনো ক্ষতে হাত রাখলো----- আকাশ ভর্তি জ্যোৎস্না, মটিতে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। কাছেই একটা অশ্বত্থ গাছে দুটো বক থাকে। ওরা এখন পরম নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন। ওদের দুটো ছানা আছে। ঠিক সেই সময়, সড়সড়্ করে একটা শব্দে সতর্ক হলো মন্থরা, চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা চকচকে সরীসৃপ ঐ গাছের দিকে এগোচ্ছে। মন্থরা ঘুমন্ত হরিণশিশুটির দিকে তাকালো একবার। কুটিরের দ্বার বন্ধ করে মশালটা গেঁথে দিলো দরজায়। বাঘটা ভয় পাবে এতে। 


একটা মোটা গাছের ডাল হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো সরীসৃপটার দিকে। ওর লকলকে শরীরটা তখন গাছে উঠতে শুরু করেছে। মন্থরা একবারও ভাবলোনা, বাঘটা ওকে ধরে ফেলতে পারে....... একবারও ভাবলোনা সাপটা ওকে মেরে ফেলতে পারে.....ওর মনে একটাই চিন্তা বকের পরিবারটাকে বাঁচাতে হবে..... 


এখন ওকে দেখে বিশ্বাস করা যাবেনা, একটা রাজপরিবার ও ভেঙে দিয়ে এসেছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে কয়েকটা জীবনের শান্তি। শুধু ওর জন্য......তরুণ রামচন্দ্র আজ বনবাসী.....হ্যাঁ এখন সে ত্রানকর্ত্রীর ভূমিকায়। 


গাছের ডালটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলো সাপটাকে। পড়ে গেল ওটা গাছের তলায়। লেজের দিকটা আছড়াতে লাগলো পড়ে গিয়ে।ওটার শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। আহারে ওটা তো ক্ষুধার্ত !! মন্থরা নিয়ে চললো টানতে টানতে কুটিরে।

শুশ্রূষা করতে হবে, ভেঙে গেছে মেরুদন্ড ! বোধহয় কুঁজ হবে....একটা ব্যথা আর ব্যঙ্গ মেশানো হাসি ফুটে ওঠে কুব্জার মুখে।কতকগুলো বিশেষ পাতা ছিঁড়ে নিলো সে....


মশালটায় আবার ডালপালা জড়িয়ে আগুন বড়ো করলো, সাপটার ভাঙা জায়গায় পাতা থেঁতো করে লাগিয়ে রাখলো ঝুড়ি চাপা দিয়ে।আবার গিয়ে বসলো কুটিরের দ্বারে, আজকাল আর রাতে ঘুম হয়না। ভিড় করে আসে স্মৃতিরা.....


এরকমই এক রাতে দেখা হয়েছিল তার আর অশ্বপতির।নিভৃতে। হঠাৎই দেখা হয়েছিল। মন্থরা তখন ষোড়শী। সুন্দরী না হলেও সুশ্রী বলাই যেত। এক ক্রীতদাসীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন রাজা । 


অতীত যেন খুব কাছে চলে এসেছে, অন্ধকারময় এই বনবাসের দিনগুলোয়। অশ্বপতি ছিলেন এক বিরল ক্ষমতার অধিকারী। তিনি পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারতেন, কিন্তু গুরুর আদেশ-----

পারবেন না ব্যাখ্যা করতে। এখানেই ছিল প্রহসন ---- 


*******************

খুব কাছেই যেন বাঘটা ডেকে উঠলো। মন্থরা একটু কেঁপে উঠলো। একা পর্ণকুটিরে থাকা..... অনেক সাহস লাগে.......তবে সাহসের অভাব নেই তার। বঞ্চনা আর অপমান নিত্য সঙ্গী ছিলো ছোটো থেকেই। আর্য- অনার্যের মাঝখানে পিষ্ট হয়েছে সে। তার মায়ের কথা মনে পড়লে, শুধু ব্যঙ্গের হাসিটাই মনে পড়ে যেদিন শেষ দেখেছিলো মাকে......


মন্থরার মা ছিলেন অন্ত্যজ বধূ , ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।কিন্ত কি এক দুরন্ত অকর্ষণ ছিলো তার। কেকয়ের রাজার এক কর্মচারীর ভালো লেগেছিলো তাকে। তখন কোনো অন্ত্যজ প্রজার সাধ্য ছিলনা কোনো রাজপুরুষকে নিরস্ত করার। তারা ভূমিদাস......

সেই শুভ্র সুন্দর রাজপুরুষ পিতা মন্থরাকে দিয়েছিলেন.... তামাটে বর্ণ....বাদামি চোখ.... টিকোলো নাক...

কিন্তু এসব----তাকে না দিলো ভুমিদাসদের পরিচয়, না দিলো উচ্চশ্রেণীর সম্মান।



একদিন কেকয় রাজপুত্র অশ্বপতির অভিষেক উপলক্ষ্যে এক'শ ক্রীতদাসীর দরকার হলো। ওদের গ্রামে এলো রাজার দূত দাসী কিনতে, সঙ্গে সেই রাজপুরুষটি। মন্থরার মা দেখলো তাকে। ঘিনঘিনিয়ে উঠলো ভেতরটা। ঐ মানুষটার জন্য তার স্বামী,সংসার, সন্তান,শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। ওর পাপটাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে, এতোগুলো বছর ধরে, এবার এসেছে সময়....


ঘরে ফিরে চললো ও, মন্থরাকে চুল বেঁধে একটা পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে হিড়হিড় করে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলো দাসীদের দলে। অনেক স্বর্ণমুদ্রা, জমি, ধান পাওয়া যাবে। মন্থরা অবাক হয়ে দেখে, ওর মায়ের মুখের অদ্ভূত হাসি, ব্যঙ্গ আর ব্যথায় মেশানো। 

যখন স্বর্ণমুদ্রা দিতে এলো দূত, মন্থরার মা সেই রাজপুরুষের অবাক চোখের সামনে দাঁড়িয়ে মন্থরার কপালে চুম্বন করেছিলো। মন্থরা সেই প্রথম পেয়েছিলো, মাতৃঅধরের স্পর্শ, স্নেহচুম্বন ছিলো কি ওটা ? সেই সঙ্গেই রোপিত হয়েছিলো প্রতিহিংসার বীজ ওর মনে।


এর পর থেকে মন্থরার জীবন বইলো অন্য খাতে, অশ্বপতির স্ত্রীর খাস পরিচারিকা সে। রাজার জন্য সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে হতো রাণীকে।কারণে অকারণে পদাঘাত ছিলো তার পুরষ্কার। কিন্তু অশ্বপতির বোধহয় সংসারে মন ছিলো না। রাণীর উগ্র মেজাজ তিনি ভালোবাসতেন না। তবুও রাণীর কোলে এলো কৈকেয়ী, কেকয় রাজকণ্যা।


রাণী রাজার সাথে বিহার করছিলেন রাজপুরীর উদ্যানে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলো মন্থরা। গুলঞ্চ গাছের তলায় সরোবরের তীরে দুটি রাজহংস ডেকে উঠেছিল। রাজা হেসে উঠলেন,বোধহয় ওদের কথা শুনেই। রাণী বায়না জুড়ে দিলেন,

---------ওরা কি বললো মহারাজ ? 

রাজা অবাক হলেন,

---------তুমি তো জানো রাণী, আমার গুরুর বারন আছে----- ব্যাখ্যা করলেই মৃত্যু অনিবার্য ।

রাণীর তবু অবুঝ কৌতুহল,

---------কিছু হবে না মহারাজ, আমি আপনার গুরুদেবকে বলবো , মৃত্যু হলে আমার হবে....আপনি বলুন দেব......

রাজা বুঝলেন, বিন্দুমাত্র দাম নেই তাঁর রাণীর কাছে। 

মন্থরা কৈকেয়ীকে কোলে নিয়ে দেখলো সব, শুনলো সব....

রাজা রাণীর নির্বাসন ঘোষণা করলেন। মন্থরা খুশি হয়েছিলো । কিন্তু কেন ? বোধহয় মাতৃ প্রদত্ত প্রতিহিংসার বীজটা অঙ্কুরিত হচ্ছিলো নিজের অজান্তেই।


একদিন মন্থরা পাল্কিতে যাচ্ছিলো ভৈরব মন্দিরে পুজো দিতে, সঙ্গে ছিলো শিশু কৈকেয়ী। হঠাৎই একজন ঘোড়-সওয়ারের উন্মাদ ঘোড়া ছুটে এসেছিলো, পাল্কি বাহক ভয় পেয়ে কেউ পড়ে গেল, কেউ পালালো। কৈকেয়ী ও মন্থরাও ছিটকে পড়েছিলো। মন্থরা কৈকেয়ীকে নিজের শরীরের তলায় আড়াল করেছিলো, কিন্তু ততক্ষণে ঘোড়াটা খুব কাছ চলে এসেছে,----- ওর পিঠের ওপর দিয়ে চলে গেল ওটা। সেই থেকে ওর মেরুদন্ড বিকৃত। অশ্বপতি তো রেগেই অস্থির, জানা গেল ঐ ঘোড়সওয়ার ছিলো অযোধ্যার দূত, সে আসছিলো রাজার কাছে।


রাজা দূতকে বন্দী করে, খবর পাঠালেন অযোধ্যরাজ অজকে। তিনি বললেন, ঐ দূত তাঁর দূরসম্পর্কের ভগিনেয়, তাছাড়া একটা দাসীর জন্য, শত্রুতা ঠিক নয়। অশ্বপতিও মেনে নিলেন। 


ততদিনে মন্থরার পিঠে জন্মেছে কুৎসিৎ মাংসপিন্ড, খিটখিটে হয়ে উঠেছে তার মেজাজ, সারা বিশ্বের ওপর প্রতিশোধ নেবে সে। চিরকালের মতো সে, কুব্জা মন্থরা, কুৎসিৎ মন্থরা, কুটিলা মন্থরা......


আর অশ্বপতি তাকাতেন না তার দিকে, কৈকেয়ীকে নিয়েই থাকতো সে। অজপুত্র দশরথের দ্বিতীয় রাণী হিসেবে কৈকেয়ী নির্বাচিত হলো যখন, মন্থরাকে আসতে হলো অযোধ্যায়। এখানে তার অনেক হিসেব বাকি। রাণীদের সাজানোর দায়িত্ব পড়লো তার। সে ছিলো কবরী রচনায় পারদর্শিনী। স্বাভাবিক জ্ঞান ও রুচি ছিলো তার, বোধহয় রাজরক্তের কল্যানে......


কিন্তু কৌশল্যা ঘৃণা করতেন তার মতো কুৎসিতের কাছে শৃঙ্গার করতে। একদিন কবরী পছন্দ না হওয়ায় কৌশল্যা পদাঘাতে সরিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,

-------তোর মতোই কুৎসিৎ তোর কবরী----


জ্বলে উঠলো মন্থরা। প্রতিহিংসার ডালপালা ছড়ালো বিষবৃক্ষ। এবার তোমাদের দুঃখের দিনের জন্য প্রস্তুত হও অযোধ্যার রঘুবংশ......


পাখির ডাকে সম্বিত ফেরে তার, ক্ষিধে পেয়েছে ওর। কাল রাতে কিছু খাওয়া হয়নি। এই ক্ষিধে, স্মৃতি আর একাকীত্ব, বেশ আছে সে। কিছু ব্যাধ আছে, তারা তাদের শিশুদের ওর কাছে রেখে নিশ্চিন্তে বনে শিকার করে, মেয়েরা ফল, কাঠ কুড়োয়, ফুল তুলে এনে মন্থরার কাছে খোঁপা বেঁধে যায়। ওদের খাদ্য-ফলমূলের ভাগ মন্থরাও পায়। ওদের বড়ো আপনজন মনে হয়। আসে আরোও একজন আসে সকাল হলে, বস্ত্র-ফল-মূল-পাঠায় তাকে কৈকেয়ী। 

-----এই জীবনটা আগে কেন দাওনি ঠাকুর !! তবে আর বারবার অপমানিত হতে হতো না তাকে। 


মনে পড়ে, একটা দিনের কথা বড়ো বেশি মনে পড়ে...,.., সেদিন কৈকেয়ী খুব খুশি ছিল। তার প্রিয় রাম রাজা হবে, মহারাজের সিদ্ধান্ত।

মন্থরার মনে পড়ে যায়, কৌশল্যার চন্দনরেখা সামান্য বেঁকে যাওয়ায়, তাকে পদাঘাত করে বলেছিলো,

---------দূর হ কুব্জি !!

সমস্ত দাসীরা হেসেছিলো। মন্থরা ধীরে ধীরে ফিরে এসেছিলো সেদিন।

আজ সুযোগ এসেছে গর্বিতা রাণী, কৌশল্যা.......


মন্থরা কৈকেয়ীর ঘরে গিয়েছিল সেদিন। 

-------- মা কৈকেয়ী, তুমি এতো খুশি কেন ?

-------- জানো না মন্থরা-মা ? রাম তো যুবরাজ হবে। খুশি হবো না ?

------- না হবে না-----

------সে কি ! কেন !!

------ এতে তোমার কি লাভ হবে ??

------ লাভ ?

------তুমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাওনা ! ভরতের কি হবে ? ------ভরত রাজা হবে,তুমি রাজমাতা হবে,

চাও না ? 

কৈকেয়ী থমকায় একটু, মন্থরা আবার বলে,

-------কবে কাজে লাগবে রাজার বর ?

কৈকেয়ীর কপালে ভাঁজ......

মন্থরা দরজাটা বন্ধ করে দেয় দাসীদের চলে যেতে বলে হাত নেড়ে, মাথায় কুটিল প্যাঁচ আরোও গভীর হয়.......আরোও ভালো করে মাথায় ঢোকাতে হবে কৈকেয়ীর....ও কৈকেয়ীর কাছে এগিয়ে গেলো..........


হ্যাঁ, সবকিছু চলছিলো হিসেব মতোই, রাম-সীতা বনে গেলো, লক্ষ্মণ তাদের সঙ্গ নিলো। সুমিত্রা আর উর্মিলার জন্য একটু কষ্ট হয়েছিলো, কি আর করা যাবে, লক্ষ্মণকে তো আর বনবাস দেওয়া হয়নি.....কিন্তু..... ভরত এসেই........

*******************

ওর চিন্তায় ছেদ পড়লো, সূর্য উঠছে, কুটিরে একটা সোনালি রশ্মি এসে পড়েছে। জেগে উঠেছে হরিণশিশুটি। কিসের শব্দে বাইরে তাকালো মন্থরা, একটা মা হরিণ.... হাসি খেলে গেল মুখে, স্বস্তির হাসি। বাচ্চা হরিণটা এবার

মার কাছে ফিরে গেল মৃদু ডেকে........অশ্বত্থ গাছের বক-পরিবার জেগে উঠেছে.........ওরা এখনই খাবার আনতে যাবে------মন্থরা ওদের বাচ্চার দিকেও নজর রাখে, ওরা না বললেও রাখে।


ঝুড়ি খুলে দেখলো সাপটাকে। বেঁচে গেছে ওটা, আরো একটা দিন রাখতে হবে ওকে। ব্যাধেরা এলে দূরে ছেড়ে দেবে। 


আগের দিনের বুনো ফল বার করলো মন্থরা, একটু জল, দিয়ে নিবেদন করলো দেবতার উদ্দেশ্যে, নিজেও খেলো। যেতে হবে কাছের নদীতে, জল এনে দিতে হবে গাছে.......তুলে রাখতে হবে আজকের রসদ। ও কলস নিয়ে এলো লাঠিটা ধরলো শক্ত করে, পায়ে চলা পথ ধরে এগিয়ে চললো নদীর দিকে। পাখিরা তখন মুখর করে তুলেছে বনটা......একটা আধখাওয়া ফল এসে পড়লো পায়ের কাছে.......

মুখ তুলতে কষ্ট হয় মন্থরার, তবু অতিকষ্টে দেখলো, ঐ বাঁদর ছানাটা গাছ থেকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে.........ও কুড়িয়ে নিলো ফলটা হাসিমুখে......লাঠিতে ভর করে এগিয়ে চললো, ভবিষ্যতের দিকে........


কুব্জা মন্থরা.... কুৎসিৎ মন্থরা...... কুটিলা মন্থরা.....







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy