STORYMIRROR

Manab Mondal

Abstract Romance Inspirational

3  

Manab Mondal

Abstract Romance Inspirational

কুলুঙ্গি

কুলুঙ্গি

7 mins
354

এ বাড়িতে প্রথম এসছি তা নয়। কিন্তু ভাবতে পারি নি মদন‌ আমাকে চিনতে পারে যাবে। এখন আর মদনকে এ বাড়ির চাকর না বলে অবশিষ্ট পুরুষ বলতে পারেন। ওর বাবা এ বাড়ির চাকর ছিলেন। উনি কিন্তু অভিভাবক হয়ে গেছেন এ বাড়ির। হবেন না কেন, সব কাজ সামালায় একা হাতে। এ বাড়ির সব চাকর বাকর চলে গেলেও, উনি থেকে গেছেন। এ বাড়ির ছেলে শ্রীমন্ত আমার বন্ধু ছিলেন। শহরের কলেজ পড়াকালিন বন্ধুত্ব। বছর দুই তিনেক আগেও হাজির হয়েছিলাম এ বাড়িতে । তাছাড়া মদন আমাকে চিনতে পারবেন না কেন ? আমি তো উনার অপচ্ছন্দের মানুষ বলতে পারেন।

এ বাড়ির মূল আকর্ষণ হলো দোচালা মন্দির। দোচালা মন্দির চেয়ে বড়ো কথা এখানে একটি নীল রঙের কাঠের কৃষ্ণ মূর্তি আছে। কৃষ্ণ মূর্তি সাধারণত কালোই হয়। এখানে সেটা নয়। মাটির মূর্তির স্থায়ীত্ব কম , পাহাড় পর্বত না থাকায় , এখানে পাথরের যোগান কম। তাই পাথরে মূর্তির তৈরি বদলে , কাঠের মূর্তি তৈরি চল হয়েছিলো বোধহয় এ বাংলায় । অনুরূপ ভাবে  এই একই কারণে মন্দির গঠনশলী এক অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো এসেছে এ বাংলাতে ।এই টেরাকোটা কাজ গুলো এসেছে বাংলার মন্দিরে । এই মন্দিরে কুলুঙ্গি খুব সুন্দর আলপনা করা ছিলো। টেরাকোটা কাজ গুলো যদিও অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে ,তবু এগুলো অসাধারণ ছিলো। তবে তুলসী মঞ্চটিও অসাধারণ ছিলো। তুলসী মঞ্চ এ প্রদীপ রাখার জন্য কুলুঙ্গি ও ছিলো।



আরো আকর্ষণীয় ছিলো চন্ডিমন্ডপ।চণ্ডীমণ্ডপটা দেখলে মনে হবে কোনো সম্পন্ন লোকের বাড়ি । মাটির দেওয়ালের উপর খুব যত্ন করে খড়িটি করা। তুষ, পাটের কুচা আর কাদা খুব মিহি করে, তাই দু' আঙ্গুল পুরু করে দেওয়ালের উপর বসানো, আর বেশ করে পিটিয়ে দেওয়া। এখন কার প্লেস্টার পারিস করা ঘরে থেকেও সুন্দর। খড়িটি করা দেওয়ালের উপর নানা ছবি।আগে রোজ আগাগোড়া নিকানো করা হলে—চক্-চক্ করতো নাকি দেওয়াল গুলো আগে । চণ্ডীমণ্ডপটির দেওয়াল দেওয়া মাঝে ফাকা, দুইটা মোটা মোটা শালের খুঁটি আছে সেখানে । আর এই কাঠের উপর নকশা করা। খুঁটি দুটির উপর দুইখানা আড়া, আর দক্ষিণের দেওয়াল দুটির উপর দুইখানা আড়া, এই চারি আড়ার উপর চারখানা প্রকাণ্ড চালা। এই আড়ার শাল কাঠেও কাজ করা। আড়ার উপর তীর। তার উপর আবার আড়া। তার উপর মাঝখানে একটি তীরের উপর মাথালির বাঁশ। চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বারান্দার সব শালের খুঁটি, পুব-পশ্চিম সব খোলা বারান্দা। পূর্ব-পশ্চিম দিকের শেষে দুটি মাটির তাকিয়া , করে দেওয়া আছে। কেউ ইচ্ছা করলে হেলান দিয়ে বসতে পারেন।

সাবেকি এই চণ্ডীমণ্ডপগুলির গঠনবৈশিষ্ট্য শুধু বাঁকানো দোচালা বা চারচালা খড়ো ঘরের স্থাপত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। এগুলির অঙ্গ-সৌষ্ঠবে শিল্পীরা তাদের কারিগরি দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন, তার মধ্যে একটি হল 'রূপসী কাজ'। মণ্ডপের খড়ের চাল যাতে নিচে থেকে দেখা না যায়, তার জন্যে চাল ছাইবার আগে ময়ূর পালকের সাদা ডাটি বা রঙ করা শরকাঠি বা বাঁশের সরু বাখারি চালের কাঠামোর উপর গায়ে গায়ে বসিয়ে দেওয়া হত। তারপর এগুলির উপর বেতের পাতলা ছিলে বা লাল-নীল রঙিন সুতো দিয়ে বুনোন করে , ফুলকারি বা জ্যামিতিক নকশার অলঙ্করণ করা হত। কখনও বা এইসব সুতোর বুননের মধ্যে অস্ত্রের টুকরো কিছুটা ছাড়া ছাড়া বসিয়ে দেওয়া হত। মোটামুটি সব মিলিয়ে এইগুলিই ছিল 'রূপসী-কাজ'।

এরপর মণ্ডপের কাঠের খুঁটি ও কড়ি-বরগাগুলির উপর করা হত নানান কারুকার্য। তার উপর কার্নিসের ব্র্যাকেট বা চলতি কথায় শুঁড়োগুলিতে খোদিত হত হাতির মাথা বা প্রসারিত হাতি শুড় বা মেয়ের মূর্তি, কখনও ময়ূরের নকশা থাকতো। এ ছাড়া স্তম্ভশীর্ধে ও কড়ি-বরগার জোড়মুখে বিবিধ বিষয়ক কাঠের মূর্তি বসানো হত— যা ছিল বাঙালি সুত্রধর-শিল্পীদের অসামান্য কুশলতার নিদর্শন।

উনি আমাকে দেখে ইতস্তত হয়ে বললো " আমি আগেই বলেছি এ বাড়ি বিক্রি হবে না। তবু এসে হাজির হয়েছো।"

দোতলা থেকে শ্যামা বললেন " উনি তো অনেক দূর থেকে এসেছে। ওপরে কোনে ঘরটা তে উনাকে বিশ্রাম নিতে দাও। কিছু খাওয়া দাওয়া পরে কথা বললো।"

উনার মন কি আছে কে জানে উনি মানে শ্যামা দেবী ও আমাকে সুনজরে দেখতে না।ঘরে ঢুকে দেখলাম । কুলুঙ্গি তে বেশ যত্ন করে রাখা আছে। আমার ফেলে যাওয়া আনন্দ মঠ উপন্যাস আর ডাইরী টা। কুলুঙ্গি ঘরে  মধ্যে একটা ছোট আলমারি মতো জায়গা। যেখানে অনেক কিছু রাখা যায় অথচ একটা জায়গায় যার মধ্যে কোনো দরজা নেই মনে গোপনীয়তা নেই। অনেকটা ঐ মদনের মতো খোলা মেলা , খুব ই সামান্য অথচ অনেক খানি গুরুত্ব আছে তার।

বাড়িটি প্রায় 33শতক জমির উপর অবস্থিত। ও শতক কি ?ভূমির পরিমাপ একক , ডেসিমেল বা শতাংশ বা শতক। মোটের উপরে এটি দ্বিতল ভবন, পুকুর ও গাছগাছালি ভরা। মোটের উপর বিঘা তিনেক জমি।বাড়ির উত্তরের অংশটি দোতলা এবং দক্ষিণের অংশটি একতলা। বাড়ির দুই দিকে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ।ভবনটির নিচ তলায় ৭টি কক্ষ এবং সামনে সরু বারান্দা রয়েছে। এই বারান্দা থেকে ভিতরে ঢোকার একাধিক দরজা রয়েছে। দেওয়ালে অনেক কুলুঙ্গি আছে। বারান্দার সামনে রয়েছে নকশাকরা সেগমেন্টাল খিলানযুক্ত স্তম্ভ। উত্তর-পূর্ব কোণে ভবনটির দোতলায় উঠবার একমাত্র সিঁড়ি। উত্তরের দোতলা অংশে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা বারান্দাসহ তিনটি কক্ষ রয়েছে। বারান্দার সামনে রয়েছে সেগমেন্টাল খিলানযুক্ত স্তম্ভ। উভয়তলার প্রায় প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক কুলঙ্গী ও দেয়াল আলমারি। বাড়ির দরজা, জানালার কপাটে ফুল-লতাপাতার অলংকরণ, এবং দেয়াল আলমারিতে কাঠের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। নিচ তলার সামনে বারান্দার দেয়ালে বাংলায় নাম লেখা আছে বাড়ির নাম

" বসন্ত" । ব্রিটিশ অমলে তৈরি বাড়িটির নির্মাণশৈলী সাধারণ। বাড়ি তৈরীতে ইট, চুন-সুরকি এবং ছাদে কাঠের বর্গার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ছাদ বরাবর রয়েছে বাহুভাজ নকশাবিশিষ্ট কার্নিস।

আমি বলেছিলাম মদন বাবু র আমার উপর রাগের কথা।কারণ এ বাড়িটি বিক্রি করতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ওদের অর্থনীতি অবস্থা তখন খারাপের পথে । এই গন্ডগ্রামে তো প্রমোটার পৌঁছায় না। কিন্তু আমার এক ধনী মাড়োয়ারী সাথে পরিচয় ছিলো। এটা বাগান বাড়ি হিসেবে কিনতে রাজি করিয়ে ছিলাম তাকে। অবশ্য মোটা দালালি পেতাম আমি। সব কিছু না বুঝে জেনে উনাকে কিছু টাকা উপঠোকন দিতে চেয়েছিলাম। সেই থেকেই উনি আমার উপর রেগে।

অনেক দিন পর ঘরের রান্না আবার , পুকুরের মাছের ঝোল বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। মদনের রাগ কিছুটা কমেছে।শ্যামা দেবী আমাদের এক সাথে খেতে দিয়েছে। আমার সরলতা হয়তো ওনাকে আমার প্রতি একটু সন্তুষ্ট করলো উনাকে। এ সময়েও আমার পত্রলেখার অভ্যাসটা বাঁচিয়ে রেখেছিল এই বাড়িটা । আমি বিদেশ থেকে চিঠি পাঠাতাম । শ্রীমন্ত ফোন ব্যবহার করত না। প্রতিটা চিঠীর জবাব দিয়েছে, তবে শেষ চিঠির জবাব দিতে পারে নি। আসলে সেই চিঠির জবাব দেবার জন্য জীবিত ছিলো না।

শ্যামা দেবী বললেন " আপানার সব কয়টি চিঠি দাদা আমাকে পড়াতেন। বিদেশে চাকরি করে কিছু পয়সা রোজগার করলেও সুখ আসেনি আপনার জীবনে ।শহরের ফ্লাট কালচারে ঠিক শান্তি পাচ্ছেন না । তাই এই বাড়ির কিছু অংশ আপনি কিনতে চেয়েছিলেন। পরে দাদা আপনাকে এ বাড়িতে থাকতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে পরিবারের বন্ধু হিসেবে। এটাই দাদা র শেষ ইচ্ছে ছিলো কিন্তু এটা আপনাকে জানতে পারেন নি।"

আমি বললাম" মদন দা , আমার কেউ নেই। এ বাড়িতে জায়গা দিলে ভালো হয়। তবে বাড়ির মালিক না হতে দেবেন না ঠীকই , ভাড়াটে হিসেবে থাকতে দেন। জ্যাঠা মশাইয়ের আমার জীবনের প্রতি অনেক অবদান আছে। আপনাদের প্রকাশনা থেকেই বেড়িয়ে ছিলো আমার প্রথম বই।"

আমার অনুরোধ রাখা হলো। মাসখানেক কাটল ভালোই। আমার ডাইরিটা আজ সম্পূর্ণ করা হলো। শ্যামা দেবী কুলুঙ্গি তে প্রদীপটা ধরালেন। অপরূপ সুন্দরী লাগছিলো আজ উনাকে। লিখছি না দেখে , উনি জিজ্ঞেস করলেন-" কি হলো আজ লিখছেন না। "

আমি বললাম " আজ শেষ হলো লেখাটি। তবে আর একটি কথা, আপনাকে বেশ সুন্দর লাগছে।'

উনি নিরুত্তাপ । বললেন" রসিকতা করছেন। ভালো । আপানার লেখাটি আমি পড়ে ছিলাম। কারণ চিঠিতে এই ডাইরির কথা উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন ওটা একটি উপন্যাস এর পান্ডুলিপি । তাই পড়েছিলাম। সম্পূর্ণ হলো , যখন পড়তে দেবেন একদিন। "

আমি বললাম " আজ নিয়ে যান। তবে রসিকতা করছিনা । এই উপন্যাসের নাম " কালো মেয়ে" । আপনি জানেন না এই উপন্যাসে নায়িকা আপনি ই। আপনাকে দেখেই, শুরু করেছিলাম এটি।"

উনি বললেন - " জানি" উনার চোখে জল। কুলুঙ্গি তে প্রদীপটার সোজা টান টান হয়ে দেখছে আমি কি করি। আমি ভুরুক্ষেপ না করে , আমি উনাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম " ঘর পেলাম একটা সংসার করতে সাধ হয় অনেক।" কুলুঙ্গি প্রদীপটা মিটমিট করে হেসে যেনো সম্মতি দিলেন।

আজ বহু বছর পর "বসন্ত" বাড়িতে অনুষ্ঠান হলো। মদন বাবু তো খুব খুশি। প্রমাণ করালাম, বললাম" খুশী তো। "

উনি মজা করে বলেন " ভায়া তুমি দালালিটা একটু বেশি নিয়ে নিলে।"

সারা বাড়িতে নতুন করে বিদুৎ সংযোগ নিয়েছি। শুধু এই ঘরটা বাদে। কারণ কুলুঙ্গি তে প্রদীপ জ্বেলেতে , এসেছিলেন যখন উনি তখন আমি উনাকে প্রথম দেখে ছিলাম। তখন ই প্রেমে পড়ে ছিলাম ওনার।দরজা খুলে দেখলাম আমার কালো বউ সেজে গুজে বেসে আছে । খুব সুন্দর লাগছে। যদি বাহ্যিক সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করে না। মন ভিতরে সৌন্দর্য আসল। বিবাহের সময় লোকজন বলেন মেয়ে টি ভালো কি? পচ্ছন্দ হলো কি? আচ্ছা মেয়েকি বাজারে আলু পটল মুলো যে ভালো খারাপ হতে যাবে । আর পছন্দ কথাটা টিও বিরক্তিকর । এটি মেয়ে একটি ছেলে বিবাহ তখন হওয়া উচিত যখন মনের মিল হবে।

ও ঘোমটা খোলার সাথে সাথে বললো " এ বাড়ির সব মেয়ের মতো কুলুঙ্গিকে একটু ভালো বাসি। এখানে আমরা রেখে দিতাম আমাদের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তেল, চিরুনী , আয়না , সিঁদুর কোটো। যদিও আমি জানতাম না সিঁদুর কোটো রাখা হবে কিনা আমার কুলুঙ্গি তে। ছোট বেলায় ঠাকুর মা আমার জন্য, পয়সা, আমশক্ত, তেঁতুল , কুলের আচার উপহার হিসেবে রেখে দিতো আমার জন্য এই কুলুঙ্গিতে। আজ আপানার জন্য কিছু উপহার রেখেছি।"

দেখলাম একটা ছোট টিনের পানের বাক্স, তাতে রাখা আছে সেই পুরনো মুদ্রা গুলো যেটা আমি ওদের কাছে থেকে নিয়ে অনেক বার বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম "এগুলো তো আপনার খুব প্রিয়।"

উনি বললেন " এ গুলো বিক্রি করে "কালো বৌ "' বইটা প্রকাশ করুন‌। আমাদের প্রকাশনা ব্যবসাটা আবার শুরু করুন। অর্থের লোভ আমার নেই কিন্তু সঞ্চয় তো এদিন শেষ হয়ে যায় বলুন। এবাড়ির প্রতিটি কুলুঙ্গি তে আগে রাখা থাকতো লক্ষীর ভাড়া আজ নেই। কুলুঙ্গি গুলো বড়ো ফাঁকা । আমার মতো ফাঁকা একা । আজ আর আমি একা নেই তাহলে ওরা থাকবে কেন?"

কুলুঙ্গি র প্রদীপটা নিভিয়ে দিলাম। ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। কাল ও ঘর আলোকিত হবে নতুন সূর্য এর আলোতে এখন শুধু প্রতীক্ষা।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract