Chitta Ranjan Chakraborty

Classics

4  

Chitta Ranjan Chakraborty

Classics

ক্ষমা করো

ক্ষমা করো

4 mins
734


প্রতিদিনের অভ্যাস এর মত আজ বিকেলে রাজবাড়ির বড় পার্কে ওই নির্দিষ্ট বেঞ্চটিতে তিনজনে বসলেন। বেঞ্চের পেছনে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আদিম মানুষের কয়েকটি পাথরের মূর্তি সাজানো রয়েছে। আর অন্যপাশে নেতাজির "দিল্লি চলো" ডাকে সাড়ি দিয়ে সৈনিকরা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যপাশে গান্ধীজীর মূর্তি বসানো আছে। মূর্তিগুলো খুব সুন্দর দেখে মনে এক নতুন অনুমতি দোলা দেয়। এক পলকে অতীতের ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।ওরা যেন প্রতিদিন আমাদের দেখছে। ওরা স্ট্যাচু নয় যেনো জীবন্ত মানব। আমাদের দেখছে আমরা সভ্য মানুষ কি করে সমাজ, দেশ, তথা সমগ্র মানবজাতিকে শেষ করে দিচ্ছে।

বেঞ্চে বসে আছেন রনজয় বাবু, রঞ্জিতবাবু, অমিয় বাবু। তিনজনে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। রনজয় বাবু ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন, রঞ্জিতবাবু জলসম্পদে পদস্থ অফিসার ছিলেন, আর অমিয় বাবু কলেজে প্রফেসর ছিলেন। তিনজনই ছোটবেলার বন্ধু। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। অবসরের পর পুরনো অভ্যেসে তিন বন্ধু রোজ বিকেল হলেই এই পার্কে এসে নির্দিষ্ট ঐ বেঞ্চে বসেন। প্রথমে রনজয় বাবু বললেন, আজকের খবরের কাগজ দেখেছো আমিয়? মানুষ কত নিষ্ঠুর, নিলজ্জ ,স্বার্থপর, দেখলাম সরকারের দেওয়া রেশনে চাল,গম রেশন ডিলার ও আর কিছু সাগরেদ চুরি করে সেগুলি বিক্রি করে দিচ্ছে। তিনি আরো বললেন, ডাক্তার পেটানোর কথা খবরের কাগজে বেশ ফলাও করে বেরিয়েছে।এগুলি একদম ঠিক নয় কিন্তু এসব যেন বর্তমান সমাজে কালচারে পরিণত হয়েছে। অমিয় বাবু বললেন, ঠিকই বলেছ, শুধু কি তাই? আমরা ছোটবেলায় দেখেছি মানুষ মানুষের প্রতি স্নেহ, মায়া, ছিল অগাধ। বড়দের কে সম্মান করা। এখন আর এসব নেই। সমাজটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কি আর হবে বলো। স্কুলের শিক্ষকদের উপর ছাত্রদের আক্রমণ , নকল করতে না দিলে শিক্ষকের উপর অত্যাচার পারলে শিক্ষকের বাড়িতে হামলা করে। আজকাল যেন এসব কোন ব্যাপারই নয়। রঞ্জিতবাবু বললেন, দেখো আমার পাড়ার কয়েকজন ছেলে সন্ধ্যে হলেই মদের আসর নিয়ে বসে।সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম পল্টু নামের একটি ছেলে আমাকে দাদু বলে। সে মাতাল হয়ে টলতে টলতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। আমি নিজেই মাথা ঘুরিয়ে না দেখার ভান করে চলে গেলাম।দেখনা মদ খেয়ে কত সংসারের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি হয়। কত সংসার ভেঙে যাচ্ছে। খুন খারাপি পর্যন্ত হচ্ছে। তাই তো বলছি শেষ বয়সে আরো যে কত কি দেখতে হবে।

অমিয়বাবু বললেন, সেদিন শুনলাম আমাদের পাড়ার একটি সাত বছরের মেয়ে বারান্দার গ্রীলে ওড়না জড়িয়ে পাশ দিয়ে মারা গেল। এটুকু শিশু কিভাবে মারা গেল। ওর বাবা-মায়ের কাছে জানলাম টিভিতে কি সব সিরিয়াল দেখে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে মেয়েটি।

রঞ্জিতবাবু বললেন, দেখনা খবরের কাগজ খুললেই খুন, ধর্ষণ এসব খবর থাকবেই। নির্ভয়া কান্ডটি মিডিয়ার দৌলতে দেশের সবাই জানতে পারল। কিন্তু এমন নির্ভয়া কান্ড কত যে প্রতিদিন ঘটে চলছে কে তার খবর রাখে।

রনজয় বাবু বললেন,দেখনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে চলে গেলো। এর আগে এত বড় জালিয়াতি আর হয়নি। সরকার তাকে আজ পর্যন্ত দেশে ফিরিয়ে আনতে পারল না। কি হবে বলো? যারা দেশ চালাচ্ছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ এমএলএ,এমপি, মন্ত্রীরাই দুর্নীতিগ্রস্ত। ডজন ডজন খুন ধর্ষণ মামলার আসামি। তারা কি করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে।

আগের শিক্ষাব্যবস্থা আর এখনকার শিক্ষাব্যবস্থা রাতদিন তফাৎ। এখন বই বিষয় নয় বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর পড়লেই পরীক্ষায় পাশ।

অমিয় বাবু বললেন, ভুল বললে রনজয় পাশ তো নেই, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল নেই। এমন শিক্ষায় কি শিখবে শিশুরা? বড় হয়ে এরা কি করবে? ‌ যদি সবার সার্বিক শিক্ষা না থাকে তবে কি করে তারা জীবনে উন্নতি করবে। আমরা নীতি-নৈতিকতার পাঠ নিতাম, এখন এসবের বালাই নেই।

দেখো না বিএ এমএ পাস করা ছেলেমেয়েদের ‌ যদি প্রশ্ন করি এবার কততম প্রজাতন্ত্র দিবস ওরা বলতে পারবে না। অনেক শিক্ষিতরাই বলতে পারবেনা দেশের বা রাজ্যের মন্ত্রীদের সবার নাম।বলতে পারবেনা জাতীয় সংগীত আর রাষ্ট্রীয় সংগীত কে রচনা করেছিলেন। ভারতের প্রথম রাষ্টপতির নাম কি। অমিয় বাবু বললেন, ঠিক বলেছ রনজয় এসবের জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিকতা আর যারা নীতি নির্ধারণ করে তারা দায়ী। তাদের আগে নীতি-নৈতিকতার পাঠ নেওয়া দরকার।অনেক সময় শুনি সামান্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা নেতা ভোটে জিতে দেশের শিক্ষা মন্ত্রী হচ্ছে। বড় লজ্জার কথা, তার থেকে সঠিক শিক্ষার কি নীতি আশা করা যাবে।

ধর্মীয় গোঁড়ামি তে সমাজ আজ দ্বিধা বিভক্ত, প্রতিদিন খানখান হচ্ছে ভালোবাসা, সামাজিকতা। আমরা ধর্মকে না জেনেই ধর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা করে নিরপেক্ষতার বাণীর অপমান করছি।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের বই পড়ে না। এঁদের চেনেও না। এরা জানে মাইকেল জ্যাকসন, পিটবুলের কথা, তাদের গান এদের সবার মুখস্থ। রবীন্দ্রনাথকে না জানলে কি করে সমাজকে জানবে দেশকে জানবে।

রনজয় বাবু বললেন, দেখতে পাচ্ছ আজকের ছেলেমেয়েরা কত নিলজ্জ। দেখো পার্কের সব গাছের ছায়ায় বেঞ্চ সব জোড়ায় জোড়ায় বসে দখল করে আছে প্রেম নিবেদন করছে। কোন লজ্জা ভয় এদের নেই। আমাদের সময় কি এসব কথা ভাবতে পারতাম? ছিঃ মনে হয় এখানে আর বেশিদিন আসা যাবেনা।

পেছন ফিরে স্ট্যাচু দের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখো লজ্জায় মুখ ঢাকছে আমাদের আদি বংশধরেরা সবাই কেমন মুখ লুকিয়ে বসে আছে। দেখো ওরা যেন বলতে চাইছে এটা কোন সভ্যতা, এরা কি আমাদের উত্তর পুরুষ? আজকাল এরা নিজেদের শিক্ষিত বলে বোমা তৈরি করছে', মহাকাশে রকেট পাঠাচ্ছে। অথচ অনৈতিক শিক্ষায় ওরা সমাজ, দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। লজ্জা দুঃখে ওরা মুখ লুকিয়ে রাখছে।

শব্দ, বায়ু দূষণে সুন্দর পৃথিবী কে ধ্বংস করে দিচ্ছে, বন শেষ করে দিয়ে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়হীন করছে, নির্মমভাবে হত্যা করছে। নেতাজি সুভাষ তিনি কি এমন ভারত বর্ষ দেখার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন? পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নেতাজি, মহাত্মা গান্ধীজি কোন ভারত দেখতে চেয়েছেন। আমরা তার উত্তরসূরি, আমরা কি ঠিক কাজ করছি।

তিনজন একসঙ্গে সায় দিলেন এই কথায়।তিনজনে মূর্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বললেন,হে আমাদের পূর্বপুরুষগণ তোমাদের সেখানে কোন কথায় আমরা রাখতে পারিনি, তোমাদের দেখানো পথে আমরা চলিনি। তোমরা আমাদের ক্ষমা করো।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics