Rini Basu

Children Comedy Drama

2.5  

Rini Basu

Children Comedy Drama

করোনার কড়চা

করোনার কড়চা

6 mins
520


এই তো, মাসখানেক আগের কথা। বাজার থেকে ফিরছি, কানে এলো দুই প্রবীণ ভদ্রলোকের কথোপকথন। একজন বলছেন, "আর 'করোনা করোনা' কোরোনা তো! এসব চায়না প্রোডাক্ট মার্কেটে বেশিদিন টিঁকবে না, দেখে নিও।"

উত্তরে অন্যজন বললেন, "না টিঁকলেই ভালো। তবে চায়নার সব প্রোডাক্টই কিন্তু দুনম্বরী নয়। যদিও এটার ক্ষেত্রে দুনম্বরী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।"

এনাদের কথাবার্তার কিছুই মাথায় ঢুকলো না। ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করি, কি নিয়ে কথা বলছেন এঁনারা। কিন্তু রিক্সা স্ট্যান্ডে সবেধন নীলমণি একটিমাত্র রিক্সা দেখে আর রিস্ক না নিয়ে চটপট সেটাকে দখল করে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।

বাড়িতে ঢোকার গলির মুখে এক মুরগী বিক্রেতার অস্থায়ী দোকান আছে। তার সামনে রিক্সাটাকে ছেড়ে দিলাম। রোববারের জন্য মুরগী কিনতে হবে। সেখানে ঢুকেও দেখি সেই করোনার গপ্প। একজন ক্রেতা খুব হাত নেড়ে নেড়ে বলছে, "আরে ভাই, ওই চিনেম্যানগুলো কাঁচা কাঁচা সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, আরশোলা, সব খায়। এমনকি কাঁচা মাছও সুশি বলে কচমচ করে চিবিয়ে খায়। ওদের করোনা হবে না তো কার হবে?" মুরগী বিক্রেতা কাঁচুমাচু মুখে বললো, "আর বলবেন না স্যার। ওই করোনার উৎপাতে আমরা মহা চাপে পড়ে গেছি। কেউ আর মুরগী খেতে চাইছে না।" ক্রেতা ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, "শুধু মুরগী? ডিমও তো অনেকেই খাচ্ছে না এখন।"

আমি একটু থমকে গেলাম। মুরগী কিনবো, না কিনবো না! কি যে কাণ্ড হচ্ছে কে জানে! লোকজন কাকে কি করতে মানা করছে রে বাবা! আর এর মধ্যে চিনেম্যানই বা আসছে কোথ্থেকে? দূর ছাই, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রেতা ভদ্রলোক দেখলাম এটা 'করোনা' ওটা 'করোনা' করে অনেক জ্ঞান ট্যান দিয়ে গোটাকতক সলিড মুরগীর ঠ্যাং কিনে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। ওনাকে দেখে আমিও উৎসাহিত হয়ে একটা মুরগী কিনেই ফেললাম।


বাড়ি ফিরে খবরের কাগজ খুলেও দেখি খালি ওই করোনা আর করোনা। দূর ছাই! কি করবো না সেটা তো খুলে বলবি, নাকি? ও হরি! তারপর ভালো করে পড়ে দেখি 'করোনা' হচ্ছে চীন থেকে আমদানী করা একটা ভাইরাসের নাম। তা ঠিকই আছে। এমন বেকার, বিচ্ছিরি নামের ভাইরাস চীন ছাড়া আর কোথা থেকে আসবে বলো? তাই বাজারে সবাই বলাবলি করছিল যে চীনেরা কাঁচা কাঁচা সব পোকামাকড়, ব্যাঙ, বাদুড় ধরে ধরে খায় আর তার থেকেই করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে। ম‍্যা গো! চীনেগুলোর কি ঘেন্নাপিত্তি বলে কিছুই নেই? ছিঃ!


তা সে যাই হোক, তারপর যত দিন গেছে গোটা বিশ্ব জুড়ে করোনার দাপট আরো বেড়েছে। মানে, এখনো বেড়ে চলেছে। তেনার তাণ্ডবের চোটে জগৎজুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। লক্ষ লক্ষ লোক আক্রান্ত, হাজার হাজার মৃত; কবে যে মা করোনা-কালীর তাণ্ডবনেত্য থামবে তা মা রক্ষেকালীই বলতে পারেন।


টিভিতে, কাগজে, গুগলে, হোয়াটস্ অ্যাপে, ফেসবুকে, সর্বত্র বলা হচ্ছে বাইরে বেরোলে মাস্ক পরো, বারবার স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোও, ঠাণ্ডা লাগলে বা হাঁচি-কাশি হলে তক্ষুনি ডাক্তার দেখাও নয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাও। সবই তো বুঝলুম, কিন্তু মাস্ক আর স্যানিটাইজারের যে বাজারে বড্ড আকাল, সে ব্যাপারে কি? একটা দশ/পনেরো টাকার মুখোশ আমাজনে দেড়শো টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ভরপুর কালোবাজারি হচ্ছে, তাও লোকে কিনছে। মুখোশ পরুক ছাই না পরুক, সঙ্গে রাখা চাইই চাই। যাতে দরকারমতো বার করে টুক করে পরে নেওয়া যায়। মাস্ক পরতে কি আর ভালো লাগে, মোটেই না। বিশেষত মহিলা হলে তো লিপস্টিক লেগে টেগে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু তাও প্রাণের দায় বড়ো দায়। তাই কলেজগামী মেয়েকে তার মা বলছে, "করোনাকে তুচ্ছ কোরোনা, মাস্ক পরতে ভুলে যেওনা। লিপস্টিক যায় যদি যাক, আগে প্রাণটা তো বজায় থাক।" খাঁটি কথা। তাই তো এখন দেখছি রিক্সাচালক থেকে শুরু করে বিমানচালক অবধি সব্বাই মুখোশে মুখ ঢেকে রেখেছে।


পাশের বাড়ির বাবলীর ঠাকুমা দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার করে সাবান দিয়ে হাত ধোন বলে সবাই তাঁকে 'শুচিবাইগ্রস্ত বুড়ি' বলে। আজকাল কিন্তু আমরা সবাই তাঁকেই আদর্শ মেনে চলি। শুচিবাইগ্রস্তদের কাছে নাকি করোনা ঘেঁষতে সাহস করেনা।


রাস্তাঘাটে লোকজন অনেক কমে গেছে। এরপর হয়তো আর দেখাই যাবে না। আমার বিদেশে বসবাসকারী বন্ধুরা হোয়াটস অ্যাপে বলছে যে ওখানকার সুপারমার্কেটগুলো নাকি একদম খালি। রাস্তাঘাট সুনসান। সবাই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র, ইত্যাদি যথেচ্ছ পরিমান কিনে নিয়ে স্বেচ্ছায় (আসলে ভয়ে) কোয়ারেন্টাইনে চলে যাচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল কলেজ সব বন্ধ, বাড়িতে বসে ল্যাপটপ খুলে অফিসের কাজকম্ম কোনোমতে চলছে, বাজারহাট, শপিং মল, সিনেমা হল সব খাঁ খাঁ করছে।


এসব শুনে তো আমার মাথায় হাত। আমাদের এখানেও কি এরকমই হতে চলেছে নাকি? পাড়ার মুদির দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, "দরকার মতো সব কিছু পাওয়া যাবে তো ভাই, নাকি এখন থেকেই চাল ডাল সব কিনে স্টোর করে রাখতে হবে?" মুদিওয়ালা একগাল হেসে বললো, "কি যে বলেন বৌদি! আপনি হলেন আমার রেগুলার খদ্দের। যখন যা লাগবে বলবেন, সব পেয়ে যাবেন।"

যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। করোনার জন্যে অন্তত না খেয়ে মরতে হবে না!


এর মধ্যেই শুরু হলো ছেলের বারো ক্লাসের বোর্ডের পরীক্ষা। উঃ, সে আরেক যন্ত্রণা। পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই মঙ্গল। কিন্তু না। এ হলো সিবিএসই বোর্ড। পরীক্ষা চলছে তো চলছেই। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে চব্বিশে মার্চ শেষ। মানে পাক্কা একটি মাস! এর মধ্যে করোনার আগমন থেকে বিশ্বজুড়ে জাঁকিয়ে বসা সবই হলো। কিন্তু পরীক্ষা আর শেষ হবার নামটি নেই। আজও আমার পুত্র সক্কাল সক্কাল মুখে মাস্ক পরে পকেটে স্যানিটাইজারের ছোট্ট বোতল নিয়ে অঙ্ক পরীক্ষা দিতে গেলো। অঙ্ক পরীক্ষার থেকে এখন করোনা পরীক্ষার আতঙ্ক বেশি দেখছি।


মেয়ের অবশ্য সে সব ঝামেলা নেই। গভর্মেন্টের নির্দেশে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পনেরই এপ্রিল অবধি ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তাই তার ইউনিভার্সিটি বন্ধ। তাই রে নাই রে না। কি মজা! কিন্তু না! এখনকার যুগটাই আলাদা। এদের কাছে ছুটির দিন মানে 'বোরিং' দিন। সত্যিই তো, বন্ধুবান্ধব ছাড়া সারাদিন বাড়িতে বসে করবেই বা কি? এখনকার ছেলেমেয়েদের টিভির নেশা নেই, বই পড়ারও অভ্যাস নেই। তাহলে বেচারারা করেটা কি? কাঁহাতক আর ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইউ টিউব নিয়ে থাকা যায়? হ্যাঁ, ভিডিও চ্যাট তো সবসময়ই করা যায়, কিন্তু সারাদিন সেজেগুজে বসে থাকতে কার আর ভালো লাগে? আর বিনা মেকআপে তো আর ভিডিও ক্যামেরার সামনে যাওয়া যায় না। আর করোনা ব্যাটাচ্ছেলের দাপটে শপিং মলে দেখা করে আড্ডা দেওয়াও যাচ্ছে না। তাই আজকাল সময় কাটানো বড়ই দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছে।


কিন্তু শুধু এখনকার যুগকে দোষ দিলে চলবে কেন? আমাদের জেনারেশনটাই বা এদের চেয়ে কম কিসে? গত কয়েকদিন ধরে মোবাইল খুললেই শ'য় শ'য় হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ ভেসে আসছে। বিভিন্ন বন্ধুগ্রূপের একই কথা। সময় কাটছে না। ক্লাব বন্ধ, অফিসিয়াল পার্টি বা গেট টুগেদার বন্ধ, বেড়াতে যাওয়া বন্ধ, এর ওর বাড়ি বন্ধু সমাবেশ বন্ধ, সমস্ত অনুষ্ঠান বন্ধ, কোথাও যাওয়া বন্ধ, কারও আসা বন্ধ।ধ‍্যাত্তেরি! এর নাম জীবন? ঘ্যানোর ঘ্যানোর চলছেই। তা বাপ মায়েরা যদি এমন ধৈর্যের অভাব দেখায়, তাহলে ছেলেমেয়েদের দোষ দিই কি করে?


তবে একটা ব্যাপার কিন্তু ভালোই হয়েছে। বাজারহাটে, রাস্তাঘাটে, বাসে ট্রেনে ভীড় প্রায় নেই বললেই চলে। সবাই দেখছি আগে থেকেই কোয়ারেন্টাইনে চলে যাচ্ছে। ওই যে কথায় বলে না, 'প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর।' ব্যাপারটা সেই রকমই।


ও হ্যাঁ, আর একটা ভারী দুঃখের খবর তো দিতেই হচ্ছে। জুলাই মাসে আমাদের লাদাখ যাবার পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনা মানে, প্রায় সব ঠিকঠাকই হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে বাদ সাধলো ওই বজ্জাত করোনা। ফ্লাইটের টিকিট কাটার ঠিক দুদিন আগে পেপারে বেরোলো, তিয়াত্তর বছরের এক বৃদ্ধ লে'র হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।' ব্যাস, হয়ে গেল! মুহূর্তে সব বাতিল। ছেলেপুলের প্রাণ নিয়ে তো আর ছেলেখেলা করা যায়না! করোনার দৌরাত্মে এমনিতেই তো প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে আছে।


কাগজে করোনার নানান দাওয়াইয়ের কথা চোখে পড়ছে। গোবর, গোমূত্র, রসুন, ইত্যাদি খেলে নাকি করোনা দূরে থাকে। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু মানুষ নাকি এই সুযোগে গোবর আর গোমূত্র বিক্রি করে বেশ টু পাইস করে ফেলেছে। সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!

আজকের খবরের কাগজে দেখলাম যে প্রত্যেক একশো বছর অন্তর নাকি পৃথিবী মহামারীর কবলে পড়েছে। ১৭২০ সালে বিউবনিক প্লেগ বিশ্বজুড়ে কুড়ি কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। তার একশো বছর পর, অর্থাৎ ১৮২০ সালে কলেরা ও তারও একশো বছর পর, অর্থাৎ ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু বহু মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। এবার দেখার যে ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস কতগুলি প্রাণের বলি নিয়ে বিদায় গ্রহণ করে।

এখন ঈশ্বরই শেষ ভরসা।

জয় শ্রী কৃষ্ণ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Children