Rini Basu

Classics Inspirational Children

4.5  

Rini Basu

Classics Inspirational Children

হিমালয়ের গভীরে

হিমালয়ের গভীরে

16 mins
653



             পথ চলার শুরু                            

২৮শে ডিসেম্বর, ২০২০

শিয়ালদা স্টেশন থেকে পদাতিক এক্সপ্রেস ছাড়লো ঠিক রাত এগারোটা কুড়ি মিনিটে। আমাদের গন্তব্য নিউ জলপাইগুড়ি। বাড়ি থেকেই ডিনার করে আসা হয়েছিল। তাই ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই যে যার বাঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। 


২৯শে ডিসেম্বর, ২০২০

একঘন্টা লেট করে ট্রেন যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে ঢুকলো তখন ঘড়িতে বাজে সকাল দশটা। স্টেশনের বাইরে আমাদের জন্যে ট্র্যাভেল এজেন্সির পাঠানো ইনোভা অপেক্ষা করছিল। তাতে উঠে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। প্রথম গন্তব্য লেপচাজগৎ। 


             লেপচাজগৎ


লেপচাজগৎ হলো হিমালয়ের কোলে অবস্থিত একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। লেপচা সম্প্রদায়ের লোকেরাই হলো এখানকার আদি বাসিন্দা। তাই জায়গাটার নাম লেপচাজগৎ। প্রায় সাত হাজার ফিট উচ্চতার এই গ্রামটি দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৯ কিমি দূরে। কিন্তু এর শান্ত, নির্জন পরিবেশ দার্জিলিংয়ের জমজমাট পরিবেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আকাশ পরিস্কার থাকলে লেপচাজগৎ ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সবকটি চূড়া স্পষ্ট দেখা যায়। জঙ্গল পরিবৃত এই নয়ন মনোহর জায়গাটিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেস্ট হাউস ছাড়াও অনেকগুলি হোম স্টের বন্দোবস্ত আছে। আমাদের জন্যে বুক করা ছিল পাইন ভিউ হোম স্টেতে দুটি ডাবল বেডেড রুম। যখন এসে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় দুটো। দার্জিলিংয়ের চেয়েও বেশি উচ্চতায় অবস্থিত বলে জায়গাটা বেশ কনকনে ঠান্ডা। তবে এদের ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো। এক্সট্রা টাকার বিনিময়ে রুম হিটার পাওয়া গেলো। মোবাইলের টাওয়ার না পেলেও ওয়াই ফাইয়ের কানেকশন পাওয়া গেলো। ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে এদের রুম রেন্ট ও খাবারের দাম আগেই দেওয়া ছিল। লাঞ্চে ছিল সাদা ভাত, মুগের ডাল, পাঁপড়ভাজা, আলু ফুলকপির ডালনা ও ডিমের কারি। সবই গরম গরম, ধোঁয়া উঠছে। এমনকি পানীয় জলও উষ্ণ গরম। রান্নাটাও মন্দ নয়। আসলে খিদের মুখে সবই খেতে বেশ ভালো লাগছিল।

খাওয়া দাওয়ার পর মিনিট পনেরো বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে। শীতকালের বেলা ছোট হয়, তাড়াতাড়ি সূর্যাস্ত হয়। গুগলে কোনো এক ট্র্যাভেল সাইটে পড়েছিলাম যে লেপচাজগতের জঙ্গলে স্নো লেপার্ডের উপদ্রব আছে। জঙ্গলের প্রায়ান্ধকার সরু পাহাড়ি শুঁড়িপথের মধ্যে দিয়ে চড়াই উঠবার সময় মনে একটু টেনশন যে হচ্ছিল সেকথা বলাই বাহুল্য। আসলে লেপার্ডের সঙ্গে আমার সখ্যতা বহুদিনের। যে জঙ্গলেই যাই, তিনি দেখা দেবেনই। এর আগে সুনতালেখোলা, ডুয়ার্স, মুন্সিয়ারী, বীনসর ও লাচুংয়ে টুকটাক লেপার্ডের মুখোমুখি হয়েছি। তবে কি জানি কেন, লেপচাজগতে তিনি দেখা দিলেন না, জঙ্গলের আড়ালে থাকাই পছন্দ করলেন। তাতে অবশ্য আমরা কেউই বিশেষ দুঃখিত হইনি। কারণ সামনাসামনি লেপার্ড দেখার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখপ্রদ নয়। 

তবে লেপার্ড না পেলেও আমাদের যাত্রাপথের বিভিন্ন জায়গায় পেয়েছি বড়ো বড়ো লোমশ পাহাড়ি কুকুরের উষ্ণ সান্নিধ্য। রূপসা আর নীল (আমার মেয়ে ও ছেলে) দুজনেই কুকুরপ্রেমী। মনে আছে বেশ কিছু বছর আগে যখন মুন্সিয়ারীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন ওদের সঙ্গে দুটো বিশাল পাহাড়ি কুকুরের ভারী ভাব হয়ে গিয়েছিল। আমরা যে নেচার রিসোর্টে ছিলাম তাদেরই পালিত কুকুর লালী আর কালুকে ছেড়ে আসার সময় ওদের খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এবারেও সব রিসোর্ট বা হোম স্টেতে থাকার সময় ওদের একাধিক কুকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। কারণ পাহাড়ি কুকুরগুলো স্বভাবতই খুব মিশুকে হয়। 

যাই হোক, নীলের হাত ধরে অনেকটা পথ চড়াই ওঠার পর ভিউ পয়েন্টে পৌঁছনো গেলো। উত্তরবঙ্গে আসার পর থেকেই একটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। এখানে কেউই মাস্ক পরছে না। করোনা বলে একটা প্যান্ডেমিক যে সারা বিশ্বকে আতঙ্কে রেখেছে, মাস্ক পরে সাবধান হওয়াটা যে প্রাণ বাঁচানোর জন্য একান্ত প্রয়োজন, সেটা এখানকার স্থানীয় লোকজন বা ট্যুরিস্টদের দেখে মোটেই বোঝার উপায় নেই। এদের ধারণা, কলকাতার বাইরে নাকি করোনা নেই। তবে এখানে করোনার প্রকোপ অনেকটাই কম দেখলাম। তাই হয়তো অধিকাংশ ট্যুরিস্ট এখানে মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। 

ভিউ পয়েন্টে পৌঁছনো মাত্রই সেই সুন্দরীর ওপর চোখ আটকে গেলো। অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা নীল আকাশের পটভূমিতে স্বমহিমায় বিরাজমান। অস্তমান সূর্যের রক্তিম আলো তার ধবল তুষারচূড়ায় পড়ে শতগুনে তার রূপ বিচ্ছুরিত করছে। অপূর্ব দৃশ্য। চোখ ফেরানো যায়না।

লেপার্ড বাবাজীর মুখোমুখি হবার ভয়ে সন্ধ্যে হবার আগেই নেমে আসা হলো। ভাগ্যিস সঙ্গে ট্রেকিং স্টিক ছিল। নইলে ওই খাড়াই পথ চড়াই উৎরাই করতে বেশ কষ্ট পেতে হতো। 

রোদ পড়ে যেতেই ঠাণ্ডা বেড়ে গেলো। রূপসা ভারী শীতকাতুরে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে রুম হিটার জ্বালিয়ে দিলো। তার একটু পরেই গরম গরম চা আর পাকোড়া এসে গেলো। মৌজ করে সেসব খেয়ে আমরা তাস খেলতে বসলাম। এসব রিমোট জায়গায় টাওয়ার না থাকার কারণে ঘরে টিভির ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ি গ্রামে সন্ধ্যের পর কিছু করারও থাকে না। তাই ডিনারের আগে অবধি টোয়েন্টি নাইন খেলে সময় কাটানো গেল। রাত ন'টা নাগাদ ডিনার দিলো : রুটি, সবজি আর চিকেন কারি। এদের রান্না বেশ ভালোই। খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া হলো। পরদিন ভোরে উঠে আবার পাহাড়চূড়ার ভিউ পয়েন্টে গিয়ে সূর্যোদয় দেখতে হবে। 


৩০শে ডিসেম্বর, ২০২০

খুব ভোরে উঠে সানরাইজ দেখতে যাওয়া হলো। আকাশে একটু কুয়াশা থাকার কারণে সূয্যিমামা দেরি করে দর্শন দিলেন। তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ছ'টা বাজে। নীল তো সূর্যোদয় দেখা যাবে না ভেবে নিরাশ হয়ে ফিরেই আসছিল। সেই সময় কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূয্যিমামার রাঙা মুখটি টুক করে উঁকি মারলো। উপস্থিত সব ট্যুরিস্টরা মোবাইল/ ক্যামেরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অনি (আমার কর্তা) তার নিকণ D40 DSLR ক্যামেরায় একাধিক ছবি তুললো।

ফিরে এসে চা ব্রেকফাস্ট (লুচি-আলু চচ্চড়ি) খেয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো। এবার আমাদের গন্তব্য সান্দাকফু।


               সান্দাকফু


১১,৯৩০ ফিট উচ্চতার সান্দাকফু বা সান্দাকপুর হলো পশ্চিমবঙ্গের উচ্চতম পয়েন্ট। বছরের অনেকগুলো মাস জায়গাটা বরফে ঢাকা থাকে। সান্দাকফু থেকে পৃথিবীর চারটে উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ দেখা যায়। এরা হলো মাউন্ট এভারেস্ট (৮৮৫০ মিটার), কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৬ মিটার), লোৎসে (৮৫১৬ মিটার) ও মাকালু (৮৪৮৫ মিটার)। এর আগে পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কে২ (৮৬১১ মিটার) বা মাউন্ট গডউইন অস্টিনকে দেখেছিলাম গুলমার্গের আফার্বত পাহাড়ের চূড়া(প্রায় ৪৪০০ মিটার উচ্চতা) থেকে।  

সান্দাকফুর বিখ্যাত পর্বতাকার হলো স্লিপিং বুদ্ধ। কাঞ্চনজঙ্ঘার সবকটি শৃঙ্গ ও অন্যান্য কয়েকটি পর্বতশৃঙ্গ মিলে গড়ে উঠেছে এই স্লিপিং বুদ্ধ। দূর থেকে এই পর্বতাকারকে দেখে মনে হয় গৌতম বুদ্ধ যেন পরম শান্তিতে নিদ্রামগ্ন হয়ে আছেন। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর এক দিকের আকাশে সগর্বে বিরাজ করছে মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে ও মাকালু। সে দৃশ্যও অভূতপূর্ব ও নয়নমুগ্ধকর। দর্শকের মনে হবে, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি? সান্দাকফু থেকে এই পর্বতশৃঙ্গগুলি এত পরিস্কার দেখা যাবার একটা প্রধান কারণ হলো, এই জায়গাটা সাধারণ মেঘস্তরের ওপরে অবস্থিত। তবে শীতকালে (নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ অবধি) আকাশ সবচেয়ে বেশি পরিস্কার থাকে, তাই এটাই পর্বতশৃঙ্গগুলিকে দেখার সবচেয়ে ভালো সময়। 

সান্দাকফুতে যাবার জন্যে আগে আমাদের আসতে হলো মানেভঞ্জনে। এখান থেকে আমরা উঠলাম ল্যান্ড রোভারে, যে গাড়ি বিশেষ ভাবে খারাপ ও কঠিন রাস্তায় চলার জন্য তৈরি হয়েছে (মাল্টি টেরেইন ভেহিকল)। গৈরিবাস (প্রথম ১৮ কিমি) অবধি রাস্তা বেশ ভালোই। কিন্তু তার পরের শেষ ১২ কিলোমিটার রাস্তা খুবই খারাপ। ল্যান্ড রোভার ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি সেখানে চলতেই পারবে না। ইদানিং বোলেরোও সেই রুটে যাচ্ছে দেখলাম, যদিও যথেষ্ট রিস্কি ব্যাপার সেটা। 

মানেভঞ্জন থেকে নানারকম স্ন্যাকস ও খাবার জলের বোতল কিনে নেওয়া হলো। কারণ সান্দাকফুতে দুটো হোটেল আর কয়েকটা ট্রেকার্স টেন্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। রিমোট জায়গা বলে সব কিছুই হোটেল থেকে ডবল দাম দিয়ে কিনতে হয়। এর পর শুরু হলো আমাদের পথ চলা।

আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন সঞ্জয় তামাং ভাই। মাঝবয়সী হাসিখুশি ভদ্রলোক। জায়গায় জায়গায় আমাদের সাইট সীইং করানোর জন্যে গাড়ি থামাচ্ছিলেন। যাত্রাপথেই দেখে নিলাম টুমলিং, টুংলু, গৈরিবাস, কালাপোখরি, ডিকেভঞ্জন, ইত্যাদি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি। এইসব জায়গা থেকে বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে দেখা দিচ্ছিল স্লিপিং বুদ্ধ, মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে ও মাকালু পর্বতশৃঙ্গগুলি। সুনীল আকাশের পটভূমিতে সদম্ভে দণ্ডায়মান স্বপ্নিল সৌন্দর্যের প্রতীক এই সুউচ্চ হিমালয়ান পর্বতশিখরগুলিকে দেখে কঠিন যাত্রার ধকল যেন নিমেষে দূর হয়ে গেলো।

গৈরিবাসের পর থেকে শেষ ১২ কিলোমিটার রাস্তা কিন্তু সত্যিই খুব বিপজ্জনক আর কষ্টকর। রাস্তা বলা বোধহয় ভুল হলো, কারণ রাস্তা বলে কিছু নেইই। আছে নুড়িপাথরে ভরা একটা সরু ট্রেকিং রুট, যেখানে গাড়ি চলার সময় ক্রমাগত খেতে হয় প্রবল ঝাঁকুনি। পুরোনো ল্যান্ড রোভারের পেছনের লোহার রডে দুমদাম মাথাও ঠুকে যেতে পারে (আমার তো বেশ কয়েকবার ঠুকেছিল)। এর মধ্যে আবার দুটো গাড়ি মুখোমুখি হলে ক্রস করে যাওয়া মহা সমস্যা হয়। তখন একটা গাড়ি পাহাড়ের দেওয়ালের দিকে দুটো চাকা তুলে দিয়ে খানিকটা জায়গা করে দেয়, আর অন্য গাড়িটা খুব সাবধানে খাদের ধার দিয়ে কোনোমতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। খাড়াই রাস্তার বাঁকগুলো প্রায় সবই হেয়ারপিন বেন্ডস। গাড়ি ঘোরানোর সময় প্রত্যেকবারই মনে হচ্ছিল যেন রাস্তাটা ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। এর পর অতল খাদে গিয়ে পড়বে। এই পড়ে যাবার ভীতিপ্রদ অনুভূতিটা নামার সময় বেশি করে হচ্ছিল। অত্যন্ত এক্সপার্ট ড্রাইভার ছাড়া এ রাস্তায় গাড়ি চালানো একেবারেই অসম্ভব। 

পাহাড় ও হিল স্টেশন আমার পছন্দের তালিকায় প্রথমে আসে। বহু পাহাড়ি জায়গায় ঘুরেছি, বিপজ্জনক রাস্তা পেরোনোর অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তা সত্ত্বেও সান্দাকফু যাত্রাপথের শেষভাগ আমার ভীতিপ্রদ মনে হয়েছে।

কষ্টকর যাত্রাপথের শেষে (শেষ ১২ কিমি পেরোতে প্রায় দেড় ঘন্টা লেগেছিল) যখন সান্দাকফু পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় বেলা একটা। সানরাইজ হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই বরফশীতল ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কা এসে লাগলো মুখে। তীব্র ঠাণ্ডায় সারা শরীর যেন জমে যেতে লাগলো। হাত-পা অবশ হয়ে এলো। ঠিক তখন সামনের দিকে চোখদুটো আটকে গেলো। আরে, ঘুমন্ত বুদ্ধকে তো হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে মনে হচ্ছে! হ্যাঁ, সান্দাকফু থেকে এতটাই কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশ্রেণী ও স্লিপিং বুদ্ধ। নির্মল, ঘননীল আকাশের পটচিত্রে শুভ্র তুষারাবৃত হিমালয় যেন আমাদের চোখকে ধন্য করার জন্যেই সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। এত পথশ্রম সহ্য করে এখানে আসা যেন সার্থক হয়ে গেলো। 

কিন্তু ঠাণ্ডার দাপটে আর বাইরে থাকা গেল না। তাড়াতাড়ি হোটেলে আমাদের ঘরে এসে ঢুকলাম। আমাদের চারজনের জন্য পাশাপাশি দুটো ডাবল বেডেড রুম দেওয়া হয়েছে। ঘরের কাঁচের জানালা দিয়ে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে স্লিপিং বুদ্ধকে। 

ঘরে লাগেজ রেখে সবাই গেলাম একতলার ডাইনিং হলে। খুব খিদে পেয়েছে। বুফেতে দেখলাম সেই একই রকম খাবার রয়েছে: সাদা ভাত, মুগের ডাল, আলু-ফুলকপির তরকারি, পাঁপড় ও ডিম। শুধু ডিমের কারির বদলে ডিমের ওমলেট। এদের রান্না কিন্তু মোটেই ভালো লাগলো না। প্রায় সব পদই আলুনি, আর ওমলেটটা নুনে পোড়া। এমনকি এদের চায়ের কোয়ালিটিও বেশ বাজে। দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত কোনো জায়গার চা যে এমন স্বাদ-গন্ধহীন হয়, না খেলে বিশ্বাসই হতো না। আশা করি ভবিষ্যতে এরা রান্নার উন্নতির দিকে নজর দেবে। হোটেলের আর একটা ব্যাপার নিয়েও আমার কমপ্লেইন আছে। মোবাইলে টাওয়ার না পেয়ে আমরা (ও আরো অনেক ট্যুরিস্ট) হোটেলে এসে ওয়াই ফাইয়ের কানেকশন চেয়েছিলাম। মোবাইল পিছু ৫০ টাকার বিনিময়ে এরা সেই কানেকশন দিয়েছিল, কিন্তু আমরা মুহূর্তের জন্যেও ইন্টারনেট পাইনি। কারণ কেবল ফল্টের জন্য সকাল থেকেই সেই অঞ্চলে কারেন্ট ছিল না। সেটা জেনেও ট্যুরিস্টদের সঙ্গে এনারা এই জুয়াচুরিটি করেছিলেন। 

লাঞ্চের পর হোটেলের ছাদে যাওয়া হলো ৩৬০° ভিউ পাওয়ার লোভে। একদম ন্যাড়া ছাদ। তার ওপর ঝড়ের বেগে হিমেল হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দেবে। চারিদিকের দৃশ্য তো নিঃসন্দেহে অতুলনীয়, কিন্তু সাধ্য কি যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকে তারিফ করি! ঠাণ্ডার চোটে সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসছে, দাঁতে ঠকঠকানি লেগে যাচ্ছে। চটপট কয়েকটা ছবি তুলে নীচে নেমে এলাম। তারপর ঘরের কাঁচের জানালার ভেতর থেকেই দেখলাম অপূর্ব সূর্যাস্ত। বাইরে গেলে হয়তো আরও ভালো করে দেখা যেতো, কিন্তু ঠাণ্ডার দাপটে আর হোটেল থেকে বেরোনোর সাহস হলো না। 

হোটেলের মালকিনের কাছে আমাদের দুটো ঘরের জন্য দুটো রুম হিটার চাইলাম। কিন্তু ও হরি! কেবল ফল্ট হয়েছে, তাই কারেন্ট নেই। হোটেলে জেনারেটর চলছে, কিন্তু তার ভোল্টেজ এতই কম যে তাতে প্রতি রুমে মাত্র একটা করে কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলতে পারে। এমনকি ওয়াশরুমেও আলো জ্বলছে না। আমাদের সঙ্গে কয়েকটা ইলেকট্রিক্ হট ওয়াটার ব্যাগ ছিল। কিন্তু কারেন্টের অভাবে তাদের চার্জ দেওয়া গেল না। তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ালো? এদিকে টেম্পারেচার শূন্যের নীচে (-3℃), অথচ ঘরে না আছে হিটার, না কাজে লাগছে হট ওয়াটার ব্যাগ। তাহলে মানুষ বাঁচবে কি করে? ব্রান্ডি। হ্যাঁ, কয়েক পেগ করে ব্রান্ডি খেয়েই সে যাত্রা ঠাণ্ডা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। 

রাত্রে তাড়াতাড়ি ডিনার(সেই গতানুগতিক রুটি-চিকেন কারি) খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম। কারণ পরদিন ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখতে হবে। কিন্তু শোবার আগে জ্যোৎস্নার আলোয় একবার স্লিপিং বুদ্ধকে দেখার লোভ সামলানো গেল না। সে এক অদ্ভূত অনুভূতি। বহুবছর আগে গ্যাংটক থেকে জ্যোৎস্নালোকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছিলাম। সেও ছিল এক ডিসেম্বরের রাত। আর আজ আর এক ডিসেম্বরের জ্যোৎস্নাধৌত রাত। সামনে গায়ে রুপোলি চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছেন বুদ্ধ। আহা! অপূর্ব, স্বর্গীয় সৌন্দর্য! 


৩১শে ডিসেম্বর, ২০২০

ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে প্রবল ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সোয়েটার-জ্যাকেট-মাফলার-টুপি-শাল দিয়ে নিজেদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বাইরে এলাম। পূবের আকাশে তখন হালকা লালের ছোঁয়া লেগেছে। পশ্চিমের আকাশে দৃশ্যমান অস্তাচলমুখী চাঁদ। হিমেল হাওয়ার দাপট তখনো কিছুমাত্র কমেনি। দাঁতে দাঁত চেপে সবাই সূর্য ওঠার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আকাশের রং বদলাতে শুরু করলো। স্লিপিং বুদ্ধর শুভ্র অঙ্গও তখন সূর্যের সেই রং বদলের খেলায় মেতে উঠলো। লাল-হলুদ-সোনালী-কমলা: কত যে রঙের বাহার! এদিক ওদিক থেকে শোনা যাচ্ছে ক্যামেরার শাটারের ক্লিক ক্লিক শব্দ। উপস্থিত সবাই মোবাইলে ভিডিও তুলতে ব্যস্ত। এমন অভিনব অভিজ্ঞতা তো জীবনে বার বার হয়না। তাই তাকে ক্যামেরাবন্দি করার জন্য সবাই এত ব্যস্ত। তারপর এইসব ছবি পোষ্ট করা হবে ফেসবুক, হোয়াটস এ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায়। বন্ধুরা বাহবা দেবে, কেউ বা মনে মনে হিংসায় জ্বলবে। কিন্তু আমার মনে হয়, চোখ যা দেখে, ক্যামেরার লেন্স ( তা সে যত দামীই হোক না কেন) তাকে কখনোই পুরোপুরি ধরতে সক্ষম হয় না। তাই ছবি তোলার পাশাপাশি কোনো কোনো দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতাকে মনের মণিকোঠায় সযত্নে রেখে দেওয়াই বোধহয় ভালো। সান্দাকফুর সূর্যোদয় সেরকমই একটি অপার্থিব দৃশ্য।

ব্রেকফাস্টের (যথারীতি লুচি-আলু চচ্চড়ি!) পর হোটেল থেকে চেক আউট করে বেরোনো হলো ফালুটের উদ্দেশ্যে। 

সান্দাকফু যাবার রাস্তা খুবই খারাপ, কিন্তু সান্দাকফু থেকে ফালুট যাবার পথ আরো খারাপ; এক কথায় ভয়াবহ! সংকীর্ণ গিরিপথে বড়ো বড়ো বোল্ডারের ওপর দিয়ে টলমল করতে করতে শামুকের গতিতে গাড়ি যখন এগোচ্ছিল, তখন মনে মনে শ্রী কৃষ্ণের নাম জপ করছিলাম। এইরকম রাস্তাবিহীন পথ দিয়ে চলতে হবে সুদীর্ঘ ২১ কিলোমিটার! ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে গাড়ি পৌঁছলো টেবিল টপ বলে একটা জায়গায়। এখানকার সুউচ্চ ভিউ পয়েন্ট থেকে হিমালয়ান পর্বতশ্রেণীর ৩৬০° ভিউ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, মাকালু, স্লিপিং বুদ্ধ ছাড়াও আরো অনেক পর্বতচূড়ার দেখা মেলে। ভিউ পয়েন্ট থেকে অনেক ছবি তোলা হলো। এত কাছ থেকে মাউন্ট এভারেস্টকে কখনো দেখিনি, এমনকি নেপালের নগরকোট থেকেও এমন সুবিশাল ও স্পষ্টরূপে এভারেস্টকে দেখতে পাইনি। 

আবার শুরু হলো সেই প্রাণান্তকর যাত্রা। ঘন্টা দেড়েক লাফানি, ঝাঁকুনি সহ্য করার পর গাড়ি ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। কি ব্যাপার? জানা গেল এর পর আর রাস্তা নেই। শেষ আড়াই কিমি ট্রেক করে যেতে হবে। সর্বনাশ! এই খাড়াই বোল্ডারসর্বস্ব পাহাড়ি রাস্তায় যাওয়া-আসা মিলিয়ে পাঁচ কিলোমিটার ট্রেক করতে হবে?? ভাগ্যিস সঙ্গে ট্রেকিং স্টিকটা ছিল। নইলে সেদিন হাঁটুর দফারফা হয়ে যেত।

ট্রেক করে ফালুট পৌঁছতে লাগলো আরো চল্লিশ মিনিট। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। এত কাছ থেকে এই সুন্দরীকে দেখার সৌভাগ্য আগে কখনো হয়নি। কিন্তু এখানেও সেই ঠাণ্ডা, ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। পথের ধারে একটা লগহাটে বসে একটু বিশ্রাম নিলাম সবাই। ওখানে খাবারের বন্দোবস্তও ছিল। গরমাগরম ম্যাগি ও ডিমের ওমলেট দিয়ে লাঞ্চ সারা হলো। ছবি টবি তুলে এরপর ফেরার পালা। আবার আড়াই কিলোমিটার ট্রেক করে গাড়িতে ফেরা হলো। লাফাতে লাফাতে গাড়ি ফিরে চললো সান্দাকফুর দিকে।

এই সব রাস্তায় নামার সময় সামনের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। ৪৫° এ্যাঙ্গেলে যখন গাড়ি নামে তখন ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় এই বুঝি স্লিপ করলো। কিন্তু অভিজ্ঞ সঞ্জয় ভাই অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে রাত সাতটার মধ্যে আমাদের টুমলিং পৌঁছে দিলেন।


                টুমলিং 


টুমলিংয়েও আমাদের জন্য একটি হোম স্টের দুটো রুম বুক করা ছিল। সারাদিনের কঠিন যাত্রার ধকলে শরীর তখন শ্রান্ত, ক্লান্ত। পা আর চলছে না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সবাই তখন খুঁজছে উষ্ণ-নরম একটি বিছানার আশ্রয়। 

সেদিন ছিল ৩১শে ডিসেম্বর। হোম স্টের মালিকের ছেলে বললো যে তারা একটা ছোট্ট ইয়ার এন্ডিং পার্টি রেখেছে। আমাদের সেই পার্টিতে যাবার নিমন্ত্রণও জানালো। কিন্তু কেউই পার্টিতে যেতে উৎসাহবোধ করলাম না। শরীরে এনার্জিই নেই। ডিনারের তখনো একটু দেরি আছে। অতএব ক্লান্ত শরীরকে চাঙ্গা করার জন্য দুএক পেগ করে ব্র্যান্ডিপান করা হলো। সঙ্গে স্ন্যাকস হিসেবে অর্ডার করা হলো চিকেনের কিছু ড্রাই প্রিপারেশন। তার সঙ্গে চললো টোয়েন্টি নাইনের খেলা। রাত সাড়ে ন' টার মধ্যে ডিনার (সেই রুটি-চিকেন কারি) সেরে তড়িঘড়ি লেপ কম্বলের নীচে ঢুকলাম সবাই। বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম। ঘুমের ঘোরে আবছা কানে আসছিল ইংলিশ মিউজিক ও হৈ হুল্লোড়ের আওয়াজ। এদের পার্টি জমে উঠেছে।


১লা জানুয়ারি, ২০২১

রাতে দারুন ভালো ঘুম হলো। এখানকার ঠাণ্ডা সান্দাকফুর মতো অত তীব্র নয়, ঘরে রুম হিটার পাওয়া গেছে, হট ওয়াটার ব্যাগগুলোতেও চার্জ দেওয়া গেছে। ভোরে উঠে সানরাইজ দেখার তাগিদ আমরা কেউই অনুভব করিনি। সান্দাকফুতে যা দেখে এসেছি তার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? কিন্তু অনি বললো যে ও নাকি অনেক ট্র্যাভেল ব্লগে পড়েছে যে টুমলিংয়ের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত, দুটোই অতীব মনোরম। আমাদের কপালে ছিল না তাই দেখা হলো না। কি আর করা!

সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়ে জলখাবার (আলুর পরোটা, ফর আ চেঞ্জ) খেয়ে ন'টা নাগাদ রওনা দিলাম মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে আবার গাড়ি বদল হলো। ল্যান্ড রোভারের বদলে এবার টাটা সুমো। আমাদের নিয়ে যাবে দার্জিলিং।


               দার্জিলিং


শৈলশহর দার্জিলিংকে বলা হয় পাহাড়ের রানী। উত্তরবঙ্গে আসবো অথচ দার্জিলিংয়ে আসবো না, তাই আবার হয় নাকি? দুবছর আগে(২০১৮) পুজোর ছুটিতে যখন লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ ট্যুর করেছিলাম, তখন পুজোর তিনদিন দার্জিলিংয়েই ছিলাম। সে সময় জেনেছিলাম যে দশমীর পরিবর্তে নবমীতে এখানে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন হয়। নবমীর রাতে ফাঁকা মণ্ডপ দেখে ভারী অদ্ভূত লেগেছিল। দার্জিলিংয়ে আমরা উঠেছিলাম হেরিটেজ হোটেল এ্যালিস ভিলাতে। হোটেলটি সত্যজিৎ রায়ের প্রিয় ছিল। তাঁর লেখা ফেলুদার গল্পেও এই হোটেলের উল্লেখ পাওয়া যায়।

১০০ বছরের পুরনো হোটেলটির সর্বত্র আভিজাত্যের ছোঁয়া। সন্ধ্যের পর ঘরে একা থাকতে হলে বুঝি বা একটু গা ছমছমও করে। সেও এক অভিনব অভিজ্ঞতা। এর আগে কালিম্পঙের 'মর্গান হাউস' এও এই ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমার লেখা 'Shadows in the Dark and Other Ghost Stories' নামক বইতে মর্গান হাউসের ভৌতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা আস্তো গল্পই আছে। এ্যালিস ভিলা হোটেলের অভিজ্ঞতা অবশ্য অত ভয়ঙ্কর ছিল না। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় অন্যেরা বেরোলেও আমি একটু ক্লান্ত ছিলাম বলে হোটেলেই থেকে গেলাম। তখন বার বার মনে হচ্ছিল যে অন্ধকার কোণে নেটের পর্দার আড়ালে অবস্থিত কাবার্ডের সামনে বুঝি বা কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পর্দাটা সরিয়ে দেবার পরও, কি জানি কেন, অস্বস্তিটা রয়েই গেল। ব্যস, এইটুকুই। পরদিন ভোররাতে ওয়াশরুমে যাবার সময় অনিরও নাকি ওই একই অনুভূতি হয়েছিল। কি কাণ্ড!

যাই হোক, দার্জিলিংয়ে এসে পৌঁছলাম নতুন বছরের প্রথম দিনে। সেলিব্রেশন তো করতেই হবে। সারা দুপুর ম্যালে ঘুরে সন্ধ্যেবেলা যাওয়া হলো 'গ্লেনারিস' এ। ওরে বাবা, কি ভিড়! বিশাল লম্বা লাইন পড়েছে। ভিড় এড়িয়ে আমরা চলে গেলাম নীচের বারে। 'ব্লাডি মেরি' আর 'কসমোপলিটন' দিয়ে স্বাগত জানানো হলো নিউ ইয়ারকে। তারপর ওপরের রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে হোটেলে ফেরা হলো। 


২রা জানুয়ারি, ২০২১

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়া হলো 'কেভেন্টার্স' এ। সেখানেও প্রায় পৌনে দু ঘন্টা লাইন দেবার পর টেবিল পাওয়া গেলো। কি যন্ত্রণা! 

পর্ক সম্বলিত ইংলিশ ব্রেকফাস্ট (প্রায় আধ ডজন করে ডীপ ফ্রায়েড হ্যাম-সসেজ-স্যালামি-বেকন, সঙ্গে ডাবল ফ্রায়েড এগ ও বাটার টোস্ট) কেউই পুরোটা খেতে পারলাম না। প্রায় অর্ধেকটা করে প্যাক করে সঙ্গে নিয়ে আসা হলো। সেদিন আর আমরা কেউই লাঞ্চ করলাম না, কারণ ব্রেকফাস্টটা কার্যত ব্রাঞ্চ হয়ে গিয়েছিল। 

এরপর রূপসা আর নীল একটা গিফ্ট শপ থেকে টুকটাক জিনিস কিনলো: নেপালী কুকরী, পাথর বসানো লকেট, ইত্যাদি। তারপর আরেকটু ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফেরা হলো। দুপুরে খানিক বিশ্রাম করে সন্ধ্যের দিকে অনি ছেলেমেয়েকে নিয়ে আবার বেরোলো। কিন্তু সকালে অতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর পায়ে ব্যাথা করছিল বলে আমি হোটেলেই থেকে গেলাম। রুমে একা থাকার অভিজ্ঞতার কথা তো আগেই বলেছি।  


৩রা জানুয়ারি, ২০২১

দার্জিলিং থেকে চলে যাবার পথে বাতাসিয়া লুপ দেখতে যাওয়া হলো। সেখান থেকে আর একবার কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। কোথাও বেড়াতে গেলে সেখানকার স্থানীয় পোশাক পরে ছবি তুলতে আমার ভালোই লাগে। দার্জিলিংয়ের স্থানীয় পোশাক পরে কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর আবার যাত্রা শুরু হলো। এবার আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য অহলদাড়া।


                অহলদাড়া 


সিটংয়ের কাছে ৪৫০০ ফিট উচ্চতার পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত অহলদাড়া। সেই পাহাড়ের গায়ে সিঙ্কোনা (Cinchona) গাছের চাষ করা হয়েছে, যার থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন তৈরি করা হয়। দার্জিলিং থেকে প্রায় ৩ ঘন্টা লাগলো পৌঁছতে। ভিউ পয়েন্টের কাছে অহলদাড়া হোম স্টের পাঁচটা কটেজ। ছবির মতো সুন্দর কটেজগুলিতে রয়েছে ব্যালকনি-সহ একটা করে ৪ বেডেড রুম, সঙ্গে এ্যাটাচড্ ওয়াশরুম। আমাদের থাকতে দেওয়া হলো মাঝের কটেজটিতে। 

সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা হয়েছিল, তাই দুপুরে আর বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হলো না। লাঞ্চের সময়ও হয়ে গেছে। এবড়ো খেবড়ো কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এদের কিচেন-কাম-ডাইনিং রুম। বাহ্যিক আড়ম্বর নেই, কিন্তু যে নেপালী দিদি রান্না করছিল, তার রান্নার হাত বেশ ভালো। লাঞ্চে সেই এগ মিল-ই ছিল, সঙ্গে গরম, মুচমুচে বেগুনি। খাওয়ার পর সবাই ভিউ পয়েন্টে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই সূর্যাস্ত হবে। আকাশে পাতলা কুয়াশার চাদর থাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে একটু অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল। 

সূর্য যত পশ্চিমে ঢলছিল ততই আকাশের রং বদলাচ্ছিল। নীল আকাশ ধীরে ধীরে হালকা কমলা রঙে পরিবর্তিত হতে লাগলো। ক্রমে তার সঙ্গে যুক্ত হলো হলুদ, লাল ও সোনালী রঙের মিশ্রণ। এত রঙিন সূর্যাস্ত খুব কমই দেখেছি। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ওপর যখন সেই রঙের বাহার প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল, আকাশ যেন একটা ক্যানভাস আর কোনো শিল্পীর তুলি যেন তার ওপর রং দিয়ে হোলি খেলে চলেছে। অপূর্ব!

সন্ধ্যের পর যথারীতি কিছুই করার ছিল না। আগেই বলেছি, এসব রিমোট জায়গায় টিভি বা টিভির টাওয়ার কোনোটাই থাকে না। ভাগ্যিস সঙ্গে তাসের প্যাকটা এনেছিলাম। দিব্যি টোয়েন্টি নাইন খেলে আরেকটা সন্ধ্যে কেটে গেল। দার্জিলিং থেকে আসার সময় নানারকম স্ন্যাকস কিনে আনা হয়েছিল। সন্ধ্যের চা-পকোড়ার সঙ্গে সেগুলোরও সদ্ব্যবহার করা হলো।

আমাদের দুদিকের দুই কটেজে কলকাতার দুই বাঙালি পরিবার জোট বেঁধে ছুটি কাটাতে এসেছে। তাদের সঙ্গে আলাপ হলো। সবাই বেশ হাসিখুশি ও মিশুকে। 

সেদিন রাত্রে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ শুনলাম অনি ডাকছে, 'এই, সবাই উঠে পড়ো। এক্ষুনি সানরাইজ হবে।' 

নীল তো ধড়মড় করে উঠে বসলো। ছবি তোলার ব্যাপারে ওর ভারী উৎসাহ। আমিও উঠতে যাবো, এমন সময় রূপসা ওর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বললো, 'বাবাই, কি হচ্ছে কি? এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। যাও, ঘুমিয়ে পড়ো।' 

ওমা সত্যিই তো! ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটাই তো বাজে। কি কাণ্ড দেখেছো! অনি বেচারা অপরাধী মুখ করে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক পর, রাত তিনটের সময় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় রূপসা রীতিমতো রেগে গিয়ে বললো, 'বাবাই, তুমি কি সারারাত ধরে আমাদের সানরাইজ দেখাবে? প্লিজ, এইভাবে সবাইকে ডিস্টার্ব না করে মোবাইলে এ্যালার্ম সেট করো।'

অনি চুপ। সত্যিই তো, বার বার বেচারার ভুল হয়ে যাচ্ছে। এরপর ও এ্যালার্ম সেট করেছিল কিনা জানিনা, কিন্তু ডাকাডাকি অন্তত আর করেনি। 


৪ঠা জানুয়ারি, ২০২১

ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় যখন ঘুম ভাঙলো তখন পূবের আকাশ পরিস্কার হতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে বাইরে এলাম। অনি আগেই ভিউ পয়েন্টে চলে গেছে। বেচারা বোধহয় বাকি রাতটা আর ঘুমোয়ইনি। 

সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে আকাশে আবার শুরু হলো রঙের খেলা। এই ধরণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করা বেশ কঠিন। চোখ যা দেখে, ভাষা সবসময় তার যথার্থ বর্ণনা দিতে পারেনা। এটুকু বলতে পারি যে সান্দাকফুর সূর্যোদয়ের থেকে অহলদাড়ার সূর্যোদয় একেবারেই আলাদা রকম সুন্দর। সান্দাকফুতে স্লিপিং বুদ্ধের শুভ্র গায়ে নবোদিত সূর্যের রঙের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর অহলদাড়ায় সেই একই খেলা চলেছে আকাশের মেঘেদের গায়ে। দুটো দুরকম সুন্দর। এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু হালকা কুয়াশার আড়ালেই থেকে গেছে। সূর্যালোকের রঙের খেলায় মেতে ওঠেনি।

আমাদের বেড়ানো শেষ। অতঃপর ফেরার পালা। সকাল এগারোটায় গাড়ি ছাড়লো নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকা সত্ত্বেও দুটোর মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু ট্রেন তো রাত আটটার সময়। মাঝের ৬ ঘন্টা কি করা যায়? স্টেশনের লকার রুমে লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম শিলিগুড়ির বিখ্যাত হংকং মার্কেটের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে কেনাকাটা সেরে যখন স্টেশনে ফিরলাম তখন বাজে সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা। লকার রুম থেকে লাগেজ নিয়ে ফেরার আগেই প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দিয়ে দিলো। তারপর আর কি! ট্রেনে উঠে যে যার বার্থ দখল করে বসে পড়া। আমি তো আমার আপার বার্থে উঠে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ডিনারটাও করিনি। পরদিন, মানে ৫ই জানুয়ারির ভোরে ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে আমার ঘুম ভেঙেছিল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics