Rini Basu

Classics

3.0  

Rini Basu

Classics

বুদ্ধির জয়

বুদ্ধির জয়

5 mins
3.7K


সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সময়ে কোনো এক দেশে ছিলেন এক রাজা। তাঁর ছিল ভারী অহংকার। তিনি ভাবতেন, তাঁর মতো বুদ্ধিমান সারা বিশ্বে বুঝি আর কেউ নেই। দেশ বিদেশের জ্ঞানী গুণী পণ্ডিতদের তিনি নিজের দেশে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। তাঁদের নিয়ে তর্কসভার আয়োজন করতেন। তারপর সেই সভার মধ্যমণি হয়ে রাজামশাই বসতেন। তিনি যা বলতেন সব কথায় পণ্ডিতরা সায় দিতেন। কারণ বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই জানেন যে রাজার কথার প্রতিবাদ করলে মহা বিপদ হতে পারে। তার চাইতে রাজার কথার প্রশংসা করলে মোটা বকশিশ পাওয়া যায়। তাই তাঁরা সেটাই করতেন। তর্কসভার পর পণ্ডিতরা প্রচুর উপহার নিয়ে যে যার দেশে ফিরে যেতেন, আর রাজা খুশি মনে ভাবতেন যে বুদ্ধিতে তাকে কেউ হারাতে পারে না।

রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার আদলে একটি নবরত্ন সভাও তৈরি করেছিলেন। সেই সভার দুজন ছিলেন শ্রুতিধর। প্রথম শ্রুতিধর কোনো কথা একবার শুনলেই তা হুবহু মুখস্থ করে ফেলতে পারতেন। আর দ্বিতীয়জন দুবার শুনলেই তা মুখস্থ করে ফেলতেন।

একদিন এক বিদেশী রাজ্যে রাজা আমন্ত্রিত হয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি শুনলেন যে সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সভাকবি ও তাঁর নবরত্ন সভার উজ্জ্বলতম রত্ন মহাকবি কালিদাসের মতো তীক্ষ্ণ মেধা ও ক্ষুরধার বুদ্ধি পৃথিবীতে কারো নেই। কথাটা শুনে রাজার মোটেই ভালো লাগলো না। তিনি দেশে ফিরে ভাবতে লাগলেন কিভাবে কালিদাসকে অপদস্থ করা যায়। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি একটা উপায় বার করলেন।

পরদিন তিনি ঘোষণা করলেন যে তিনি এক কাব্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। সেখানে কোনো কবি যদি তাঁর স্বরচিত আনকোরা নতুন কবিতা পাঠ করে শোনাতে পারেন তাহলে পুরস্কারস্বরূপ রাজা তাঁকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দান করবেন।

দেশ দেশে হই চই পড়ে গেল। এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তো আর যে সে কথা নয়! দূর দূরান্ত থেকে কবিরা সব আসতে শুরু করলেন। সঙ্গে তাঁদের নব্যরচিত কবিতার গোছা। রাজপ্রাসাদ ঢেলে সাজানো হোলো। রাজসিংহাসনের পাশে রাখা বিশাল সোনার থালায় এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা ঝলমল করতে লাগলো। তাই দেখে সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। ধুমধাম করে শুরু হলো কাব্য প্রতিযোগিতা।

কবিরা সব একে একে নিজেদের কবিতা পাঠ করা শুরু করলেন। কিন্তু এ কি? কেউই তো নতুন কবিতা শোনাতে পারছেন না! তাঁদের কবিতা শেষ হওয়া মাত্রই রাজার এক সভাসদ উঠে দাঁড়িয়ে বলছেন, "এ তো নতুন কবিতা নয়। এই কবিতা তো আমি ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। এখনো মনে আছে।" এই বলে তিনি কবিতাটি হুবহু মুখস্থ বলছেন। তারপর আর একজন সভাসদ সেই একই কথা বলে কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন। দু দুজন এইভাবে কবিতাটি হুবহু শোনানোর পর রাজা সেই কবিদের অপমান করে রাজসভা থেকে বহিস্কার করছেন। তিনদিন ধরে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে লাগলো। উপস্থিত লোকেরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো যে দেশে দেশে কি কবিদের আকাল পড়লো?

কবিদের এই হেনস্তার কথা শেষে মহাকবি কালিদাসের কানে গিয়ে পৌঁছলো। তিনিও খুব অবাক হলেন। শেষে স্থির করলেন নিজের চোখে সব কিছু দেখবেন। সাধারণ লোকের ছদ্মবেশে তিনি রাজার সভায় এসে উপস্থিত হলেন। সব কিছু দেখেশুনে তিনি সহজেই রহস্যভেদ করতে পারলেন।তিনি বুঝলেন যে দুই শ্রুতিধরের সাহায্যে রাজা নিরপরাধ কবিদের অকারণে হেনস্থা করছেন। রাগে তাঁর ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে উঠলো। কিন্তু সেদিন কিছু না বলে তিনি ফিরে এলেন। তারপর ভেবেচিন্তে তিনি একটি নতুন কবিতা রচনা করলেন।

পরদিন সকালে কালিদাস আবার রাজসভায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু এবারে তিনি আর ছদ্মবেশ ধারণ করলেন না। রাজাকে নিজের পরিচয় দিয়ে অভিবাদন জানালেন। রাজা তো মহাকবি কালিদাসকে নিজের রাজসভায় দেখে অত্যন্ত পুলকিত বোধ করলেন। মনে মনে ভাবলেন, এইবার তাঁর মনস্কাম পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু মুখে মধুর হাসি এনে তিনি কালিদাসকে অভ্যর্থনা জানালেন।

"আরে আরে, কি সৌভাগ্য আমার! স্বয়ং মহাকবি কালিদাসের পদধূলি পড়ে আমার রাজসভা আজ ধন্য হলো। দয়া করে আসন গ্রহণ করুন। এবার বলুন, আপনার কি সেবা করতে পারি? আপনার আগমনের হেতুই বা কি?"

কালিদাস একটু হেসে বললেন, "হে রাজন, অভ্যর্থনার জন্য জানাই আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আমার আগমনের হেতু হলো আপনার পাশে রাখা ওই এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। ওই পুরস্কারটি লাভ করার বাসনাই আমাকে এখানে টেনে এনেছে।"

রাজা মনে মনে একটু প্রমাদ গুনলেন। যে সে কবি নন, ইনি সাক্ষাৎ কবিশ্ৰেষ্ঠ কালিদাস। যদি কোনো কারণে কিছু গণ্ডগোল হয়ে যায়? এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা হাতছাড়া করার তাঁর কোনই ইচ্ছে নেই। তারপর তিনি তাঁর শ্রুতিধরদের লাগাতার সাফল্যের কথা ভেবে মনে একটু ভরসা পেলেন। ভাবলেন, 'এবার কালিদাসকে মহা অপমান করা যাবে। মহাকবি যখন নকলকবি হয়ে সর্বসমক্ষে অসম্মানিত হবেন তখন তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধির ভড়ং জনসমক্ষে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।'

রাজা হাসিমুখে কালিদাসকে বললেন, "আপনি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চান এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। মহাকবি কালিদাস নিজকণ্ঠে তাঁর স্বরচিত নতুন কবিতা পাঠ করে শোনাবেন। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? আমি নিজেকে ধন্যবোধ করছি। দয়া করে শুরু করুন।"

কালিদাস সভাস্থলে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে পূর্বরাত্রে রচিত তাঁর কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন।


"হে রাজন, লহ মোর অভিবাদন,

বহু আশায় হেথা করেছি আগমন।

স্বরচিত মোর এই কবিতার বাণী,

মনগড়া কল্পনা নয়, সত্য কাহিনী।

বহুকাল পূর্বে কোনো এক দিন,

তব স্বর্গীয় পিতা লয়েছিলেন ঋণ

এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা মোর পিতার কাছে,

সে কথার প্রমাণ আজও আছে।

মৃত্যুর পূর্বে পিতা মোরে তাই,

বলেন সে ঋণ আজও শোধ হয় নাই।

স্বর্গে মোর পিতা আজি করেছেন গমন

তাঁর স্থলে তাই আজি করি আগমন।

শাস্ত্রমতে পণ্ডিতেরা বলে গেছেন তায়,

পিতৃঋণ শোধ করা সন্তানেরই দায়।

রাজা তুমি মহাশয়, আছে বিচারবোধ,

আশা রাখি করিবে এবে পিতৃঋণ শোধ।

এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তব কাছে পাই,

সত্বর দিয়ে দিলে দেশে ফিরে যাই।"


কবিতা শেষ হবার পর সভায় কারো মুখে কোনো কথা নেই। শ্রুতিধররা কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখে এ ওর দিকে তাকাতে লাগলো। রাজার মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠলো। কিন্তু তিনি যাঁতাকলে পড়ে গেছেন। শ্রুতিধররা যদি বলে যে তারা ছোটবেলা থেকেই কবিতাটি শুনে আসছে ও হুবহু মুখস্থ বলে দেয় তাহলে এটাই প্রমাণ হয় যে কালিদাসের কথা সঠিক। তখন তাঁকে পিতৃঋণ শোধ করার জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা মহাকবিকে দিতে হবে। আর তারা যদি চুপ করে থাকে তাহলে এটাই প্রমাণ হবে যে কালিদাসের কবিতা একেবারে নতুন। তাহলেও রাজাকে পুরস্কার হিসেবে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিতে হবে। এইবার রাজা বুঝতে পারলেন যে কেন লোকে কালিদাসকে ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী বলে। এমন মানুষের কাছে হার স্বীকার করেও সুখ। রাজা মহাকবিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "হে কবিশ্ৰেষ্ঠ, আপনার অদ্ভুত বুদ্ধির কাছে আমি সানন্দে পরাজয় স্বীকার করছি। পুরস্কারস্বরূপ এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করুন।"

এইভাবেই মহাকবি কালিদাস সেই অহংকারী রাজাকে পরাজিত করে প্রমাণ করেছিলেন যে বুদ্ধি যার, বল তার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics