প্যান্টো জলে ভাসি গিলা
প্যান্টো জলে ভাসি গিলা
তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আগের বছরটা 'ফার্স্ট ইয়ার, নো ফিয়ার' করে বিন্দাস কেটে গেছে। কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারের শেষে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা আছে। অতএব পড়াশোনায় মন দিতেই হবে। মা ধমকে চমকে রেখেছে যে রেজাল্ট খারাপ হলে জে ইউ ছাড়িয়ে অতি সাধারণ কমলা দেবী কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবে। উঃ, ওই এক তাস যে মা কত বছর ধরে খেলছে! স্কুলে পড়ার সময় ভয় দেখাতো যে রেজাল্ট খারাপ হলে সাউথ পয়েন্ট ছাড়িয়ে পাড়ার বংশীধর গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। আর এখন বংশীধরের জায়গা নিয়েছে কমলা দেবী। সত্যি, ভদ্রমহিলা পারেনও বটে!
যাহোক, 'ঠাকুর ঠাকুর' করে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা তো শেষ হলো। রেজাল্ট বেরোনোর আগে মাস খানেক ছুটি পাওয়া গেলো। এ্যাদ্দিন পড়াশোনা করার পর সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত...এক কথায় বোর হয়ে গেছে। এর মধ্যে একদিন কলেজ বোর্ডে নোটিস জারি করা হলো যে আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে তিনদিনের জন্য দীঘা ট্যুরের আয়োজন করা হয়েছে। যে সব ছাত্রছাত্রীরা যেতে ইচ্ছুক তারা যেন এই ট্যুরের ভারপ্রাপ্ত প্রফেসরের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
খবরটা আমাদের মধ্যে মহা আনন্দের ঢেউ নিয়ে এলো। বেড়াতে যেতে কে না ভালোবাসে, তাও আবার বন্ধুদের সঙ্গে, পরীক্ষার পর? আমাদের ক্লাসের অনেকেই মহা উৎসাহে নাম এনরোল করালো। বলাই বাহুল্য, যে আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। এর তিন সপ্তাহ পর এক রোদলা সকালে চার্টার্ড বাসে করে সবাই মিলে রওনা হলাম দীঘা।
সারাটা রাস্তা হই হই করতে করতে করতে যাওয়া হলো। কখনো কোরাসে গান গেয়ে, কখনো কোনো বন্ধুর পেছনে লেগে, কখনো বা জোকস বলে দিব্যি সময়টা কেটে গেল। উৎসাহের আতিশয্যের চিৎকার চেঁচামেচিতে অনেকেরই গলা ধরে গেল। মেছেদা পৌঁছে গরম গরম কচুরি আর জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করা হলো।
দীঘা পৌঁছতে পৌঁছতে মাঝদুপুর হয়ে গেল। আমাদের জন্যে আগে থেকেই নিউ দীঘার সরকারী গেস্ট হাউসের বেশ কিছু কটেজ বুক করা ছিল। তার মধ্যে কয়েকটাতে ছেলেদের সঙ্গে প্রফেসর রায় স্যার থাকবেন, বাকিগুলোতে মেয়েদের সঙ্গে মালতী ম্যাডাম থাকবেন। হুটোপাটি করে সবাই যে যার পছন্দমতো কটেজে চলে গেলো। ভরদুপুরের চড়া রোদে কেউই সী বীচে যাওয়ার উৎসাহ দেখালো না।
কাছেই একটি পাইস হোটেলে আমাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তাদের লাঞ্চ টাইম শুরু হয়ে গেছে। হোটেল থেকে একটি বাচ্চা ছেলে এসে আমাদের তাড়া দিয়ে গেল। বললো যে বেশি দেরি করলে নাকি খাবার পাওয়া যাবে না। সবাই চটপট স্নান করে লাঞ্চ সেরে একটু গড়িয়ে নিলাম। ঠিক হলো, বিকেলে রোদ পড়লে বীচে যাওয়া হবে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে শুরু হলো কিছু নেকু মামণিদের সাজুগুজু। মালতী ম্যা'ম বললেন, "ওরে, তোরা তাড়াতাড়ি কর, নইলে সানসেট-টা মিস করবি তো।" কিন্তু কাউকেই সানসেট মিস করা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত বলে মনে হলো না। সী বীচে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। সমুদ্রকে পেছনে রেখে ছবি তোলা গেল না বলে নেকু মামণিদের অনেকেই দুঃখপ্রকাশ করলো। কয়েকজন ওই অন্ধকারেই ঘোড়ার পিঠে চেপে ছবি তুললো। যাক বাবা, এত মেকআপের কিছু সদ্ব্যবহার তো হলো!
ছেলেগুলোর অবশ্য ছবি টবি তোলার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। তারা এসেই শর্টস আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সমুদ্রস্নানে নেমে পড়েছে। রাত বাড়তে বীচ গার্ড এসে বলে গেল, "রাতে সমুদ্রে নামবেন না। মাস কয়েক হলো এদিকটায় কামটের উপদ্রব বেড়েছে। গত মাসে দুজন ইন্জিওর্ড হয়েছে।"
কথাটা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। সবাই 'বাপ বাপ' বলে জল থেকে উঠে এলো। শুধু সুরজ পাত্তা দিলো না। সুরজ ডাকাবুকো পাহাড়ে চড়া ছেলে, সামান্য কামটের ভয়ে সে পালিয়ে এলো না। গার্ডের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে অনেক রাত পর্যন্ত সে সমুদ্রে সাঁতার কাটলো। এর জন্য অবশ্য পরে তাকে প্রফেসর রায়ের কাছে অনেক বকুনি শুনতে হয়েছিল।
ডিনারের পর গেস্ট হাউসের বাগানে বসে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হলো। ছেলেরা কেউ কেউ খাবার জলের সঙ্গে চুপি চুপি হুইস্কি বা রাম মিশিয়ে খাচ্ছিল। একটু পরেই তাদের কথা জড়াতে আর পা টলতে শুরু করলো। প্রফেসর রায় বুদ্ধিমান মানুষ। সবাইকে ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বললেন।
পরদিন ভোরে উঠে সানরাইজ দেখতে যাওয়া হলো। যে ছেলেগুলো বেশি মদ্যপান করে ফেলেছিল তাদের ঘুম থেকে ওঠানো গেল না। একজন আধা ঘুমে বললো, "যা, যা, অমন অনেক সানরাইজ দেখেছি। ওর জন্যে ভোরের ঘুম নষ্ট করে এখন বীচে দৌড়তে পারবো না। তোরা যাবি তো যা, আমাদের ডিস্টার্ব করিস না।"
হুঁঃ! ঘুমোবিই যদি, তো বাড়িতে বসে থাকলেই তো পারতিস বাপু! পয়সা খরচ করে বেড়াতে এলি কেন?
আমরা বীচে গিয়ে চমৎকার সানরাইজ দেখলাম আর মজাসে গরমাগরম চা খেলাম। অনেকেই সমুদ্রস্নান করতে নামলো। তাদের মধ্যে ছিল সুতনু, সোমক আর কিংশুক। তিনজনে দারুন বন্ধু, যাকে বলে হরিহর আত্মা। আমরাও সমুদ্রের ধার ঘেঁষে কিছুক্ষণ ঢেউয়ের তালে নাচানাচি করলাম। তারপর রোদের তেজ বাড়লে কটেজের দিকে হাঁটা লাগালাম। খিদেও পেয়েছে খুব। চোখে পড়লো একটু দূরে সুতনু, সোমক আর কিংশুক সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। ব্যাপার কি? এরা কি ব্রেকফাস্ট করবে না?
কটেজে ফেরার পর এক মজার কাণ্ড হলো। আগের রাতে সুরজ বিছানায় আরো দুজনের সঙ্গে গাদাগাদি করে না শুয়ে মাটিতে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়েছিল। সকালে উঠে ও ওর রুমমেটদের বললো, "এই, আমি এখন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরোবো। তোরা একটু বাইরে যা তো।" রুমমেটরা ওর কথা শুনে খুব হাসাহাসি করলো, "কেন, আমরা ঘরে থাকলে তোর লজ্জা করবে নাকি?" সুরজ আবার বললো, "বাইরে না গেলে কিন্তু তোরা নিজেরাই পস্তাবি।" সে কি, কেন? উত্তরে সুরজ বললো যে আগের দিন নাকি ও আটটা ডিম খেয়েছে। কেউ কিছু বুঝলো না, তাই কথাটাকে পাত্তাও দিলো না। কিন্তু সুরজ যখন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরোলো তখন হাড়ে হাড়ে তার কথার মর্ম বোঝা গেল। উরে বাবা, দুর্গন্ধের চোটে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড় হলো। আটটা ডিম তখন এ্যাটম বোম হয়ে সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাক চেপে তখন সব বাইরে পালাতে পারলে বাঁচে। সুরজ বাথরুমে ঢোকার সময় হাসতে হাসতে বললো, "তোদের তো আমি আগেই সাবধান করেছিলাম।"
বাপরে বাপ! কে ভেবেছিল যে 'থ্রি ইডিয়টস্' ছবির চতুর রামলিঙ্গমকে আমাদের মধ্যেই পাওয়া যাবে? জিগনেশ পোজ মেরে ছবির ডায়লগ বললো, "ইয়েহি শালা গ্লোবাল ওয়ার্মিং কে লিয়ে জিম্মেদার হ্যায়!"
এর মধ্যে সোমক আর কিংশুক বীচ থেকে ফিরে এলো। জিজ্ঞেস করলাম, "সুতনু কোথায়? ও এলো না?" সোমক মিচকে হেসে বললো, "ও ব্যাটা এখনো সমুদ্রে সাঁতার কাটছে।" বাব্বাঃ! কি এনার্জি!
আমরা ব্রেকফাস্ট করে ফিরে এলাম। তখনো সুতনু ফেরেনি। চিন্তিত প্রফেসর রায় সোমককে বললেন বীচে গিয়ে ওর খোঁজ করতে। সোমক সবে পায়ে চটিটা গলিয়েছে, এমন সময় ভিজে কাক হয়ে সুতনু ফিরলো। খালি গা, পরনে একটা ভিজে, খাটো গামছা। এসেই কোনদিকে না তাকিয়ে জামাকাপড় নিয়ে সিধে বাথরুমের দিকে ছুটলো। দেখি সোমক আর কিংশুক খুক খুক করে হাসছে। ভাবছি ওদের হাসির কারণটা জিজ্ঞেস করবো, এমন সময় দেখি একটা কালোকোলো ছোট্ট নুলিয়া ছেলে এসে দরজায় দাঁড়ালো। আমাদের দিকে তাকিয়ে সে একগাল হাসলো। প্রফেসর রায় জিজ্ঞেস করলেন, "কে রে তুই? কি চাই?" উত্তরে ছেলেটা বাথরুমের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, "বাবু কহিলা, প্যান্টো জলে ভাসি গিলা, মু ন্যাংটো। গামছা আনি দিলা, দশ তঙ্কা দিব।"
(বাবু বললেন যে আমার প্যান্ট জলে ভেসে গেছে, আমি উলঙ্গ। একটা গামছা এনে দিলে তোকে দশ টাকা দেবো।)
প্রফেসর রায় দশ টাকা দিয়ে ছেলেটাকে বিদায় করার পর সোমক আর কিংশুককে জিজ্ঞেস করলেন, "কি ব্যাপার বল তো? মনে হচ্ছে তোদেরই কোনো বাঁদরামি হবে।" ওরা দুজনেই বললো, "না স্যার, আমরা কিছু জানিনা।" সুতনু বাথরুম থেকে বেরিয়ে কটমট করে ওদের দিকে তাকিয়ে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্যার আর ব্যাপারটাকে নিয়ে বেশি ঘাঁটালেন না।
পরে সোমক আর কিংশুকের কাছে আসল ঘটনাটা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার জোগাড় হয়েছিল।
সমুদ্রে স্নান করতে করতে সুতনুর নাকি হঠাৎ শখ হয়েছিল যে সে জামাকাপড় খুলে ন্যুড সুইমিং করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। জলের মধ্যেই শর্টস আর গেঞ্জি খুলে সে বন্ধুদের (সোমক আর কিংশুক) কাছে রাখতে দিল। প্ল্যান ছিল যে খানিকক্ষণ ন্যুড সাঁতার কেটে তারপর জলের মধ্যেই সে বন্ধুদের সাহায্যে জামাকাপড় পরে নেবে। কিন্তু বন্ধু দুটি তো একেকটি যন্তর পিস। তারা সুতনুকে ওই অবস্থাতেই জলের মধ্যে রেখে তার জামাকাপড় নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়েছে। তার পরের ঘটনা তো আমরা জানিই। সেই যে, "প্যান্টো জলে ভাসি গিলা"। ভাগ্যিস নুলিয়া ছেলেটি সুতনুকে গামছা এনে দিয়েছিল, নইলে সেদিন তার প্রেস্টিজ একদম 'জলে ভাসি' যেতো। রাগের চোটে বাকি ট্রিপটায় সুতনু তার বজ্জাত বন্ধু দুটোর সঙ্গে আর কথাই বলেনি।
ইউনিভার্সিটিতে এই ঘটনাটা এমন চাউর হয়ে গিয়েছিল যে তারপর থেকে সুতনুকে দেখলেই সবাই বলতো, "প্যান্টো জলে ভাসি গিলা!"
