ইতি অশ্বত্থামা
ইতি অশ্বত্থামা
নাটক: ইতি অশ্বত্থামা
কুশীলব:
●অশ্বত্থামা
●শ্রী কৃষ্ণ
●দ্রৌপদী
●কুন্তী
দৃশ্য - ১
(প্রেক্ষাপটে যুদ্ধের দৃশ্য।)
পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসছে:
"অশ্বত্থামা হত... ইতি গজ।" ('অশ্বত্থামা হত' উচ্চৈঃস্বরে ও 'ইতি গজ' মন্দ্রস্বরে বলতে হবে)
এরপর প্রেক্ষাপটে একে একে স্টিল ছবি ভেসে উঠবে:
১) পিছন ফিরে একজন বৃদ্ধ যোদ্ধা অস্ত্র ত্যাগ করছেন। ২) তলোয়ার ধরা পুরুষের হাত। ৩) সেই তলোয়ার পিছন ফিরে বসা এক বৃদ্ধের মুন্ডচ্ছেদ করছে। ৪) কাটা মুন্ড মাটিতে একজনের পায়ের কাছে ছিটকে পড়ছে।
পুরুষ কণ্ঠের আর্তনাদ:
"পিতা!"
(প্রেক্ষাপটে রাতের যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য। অশ্বত্থামার প্রবেশ। তার পরণে লাল পোশাক ও লাল উত্তরীয়, মাথায় লাল উষ্ণীষ, কোমরে তলোয়ার। তার দুই চোখের মাঝে শিরোমণি/চিন্তামণি জ্বলজ্বল করছে। কপালের উপরিভাগে রক্ত তিলক আঁকা।)
অশ্বত্থামা:
"মহাবলী ভীম আজ গদাযুদ্ধের নিয়ম ভেঙে যুবরাজ দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করেছে। এই নক্কারজনক কাজের জন্য ভীমকে ধিক্কার জানাই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আঠারো অক্ষৌহিনী সেনার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু দুর্যোধনের মতো অন্যায় যুদ্ধে খুব কম যোদ্ধারই পতন হয়েছে। যুবরাজ এখন অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার মৃত্যু শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তবু সে হার মানেনি। তাই সে আজ আমাকে কৌরবদের নতুন সেনাপতি নিযুক্ত করেছে। হ্যাঁ। কুরুক্ষেত্রের এই মহাযুদ্ধে আমি অশ্বত্থামা কৌরবসেনার পঞ্চম ও শেষ সেনাপতি। দুর্যোধন বলেছে যে পঞ্চপাণ্ডবের মৃত্যু সংবাদ শোনার আগে সে মৃত্যুলোকে গমন করবে না। আমি তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবো বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। কৌরব পক্ষে আমি ছাড়া আমার মাতুল কৃপাচার্য ও যাদব বীর কৃতবর্মা জীবিত আছেন। কাল প্রাতে আমরা তিনজন রণক্ষেত্রে উপস্থিত হবো। জয়লাভ করতে না পারি, মৃত্যু বরণ তো করতে পারবো।"
(প্রেক্ষাপটে একটি গাছ ও রাতের আকাশে উড়ন্ত প্যাঁচার ছবি। নেপথ্যে প্যাঁচার ডাক ও ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা যায়।)
অশ্বত্থামা (ওপরের দিকে তাকিয়ে):
"ও কি? এক নিশাচর প্যাঁচা রাতের অন্ধকারে কাকের বাসায় ঢুকে তার ঘুমন্ত ছানাদের ভক্ষণ করছে! কাক দম্পতি রাতে দেখতে পায় না বলে তাদের রক্ষা করতে পারছে না। ওই তো, কার্য শেষ করে প্যাঁচাটি নিশ্চিন্তে উড়ে চলে গেল। সত্যি, পশু পাখিদের থেকেও আমাদের কতো কিছু শেখার আছে। এই সামান্য প্যাঁচাটি আমাকে জয়লাভের পথ দেখিয়ে দিলো। মিত্র দুর্যোধন! আর প্রতীক্ষা নয়! শীঘ্রই তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে চলেছে।"
(মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আবার অল্প আলোকিত হয়ে একটা আলো আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি হলো। প্রেক্ষাপটে তাঁবুর দৃশ্য। পা টিপে টিপে অশ্বত্থামার প্রবেশ। তার মুখের নিম্নভাগ লাল উত্তরীয়/উষ্ণীষের প্রান্ত দিয়ে ঢাকা। হাতে খোলা তলোয়ার। কপালের শিরোমণি জ্বলজ্বল করছে। দুই চোখে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। সে ভ্রুর ওপরে হাত রেখে সামনের দিকে ভালো করে ঠাহর করলো। তারপর তলোয়ারটা দু হাতে ওপর দিকে ঘুরিয়ে নিঃশব্দে ও দ্রুত গতিতে মঞ্চের অন্যদিকে চলে গেল। প্যাঁচা ও শৃগালের ডাক শোনা গেল। সঙ্গে মেঘের গর্জন ও বজ্রপাতের শব্দ। মুহূর্তকাল পরে অশ্বত্থামা ফিরে এলো। তার তলোয়ার থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। উন্মুক্ত মুখ ও পোশাকে রক্তের ছিটে লেগে আছে। তার চোখে মুখে এক পৈশাচিক উল্লাসের ভাব। রক্তমাখা তলোয়ার ওপর দিকে তুলে ধরে সে নিঃশব্দে হাসলো। তারপর মুখের নিম্নভাগ আবার কাপড়ে ঢেকে, সন্তর্পণে চারিদিকে তাকিয়ে সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।)
দৃশ্য - ২
(মঞ্চে কুন্তীর প্রবেশ। প্রেক্ষাপটে যুদ্ধক্ষেত্রের তাঁবুর দৃশ্য)
কুন্তী: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
"শেষ পর্যন্ত তবে যুদ্ধ শেষ হলো। এই যুদ্ধে আমার পুত্ররা বিজয়ী হলেও আমি সুখী নই। জ্যেষ্ঠ পুত্র কর্ণকে হারানোর শোকে আমি রাতে ঘুমোতে পারি না। (হঠাৎ চমকে উঠে) কিন্তু ও কি! এই গভীর রাতে কৌরব শিবির থেকে চুপি চুপি ও কে বেরোলো? এতো অন্ধকারেও ওর মুখ এমন আলোকিত কেন? অশ্বর পিঠে চেপে ও দ্রুত বেগে পলায়ন করছে! ওর পরিচয় জানতেই হবে! রক্ষী!"
(ভিতর থেকে দ্রৌপদীর আর্তনাদ শোনা যায়। কুন্তী চমকে উঠে সেদিকে তাকায়। মঞ্চে ক্রন্দনরতা দ্রৌপদীর প্রবেশ।)
কুন্তী:
"কি সংবাদ পাঞ্চালি? বিজয়ের দিনে তুমি এমন বিচলিত কেন?"
দ্রৌপদী: (কাঁদতে কাঁদতে)
"সর্বনাশ হয়ে গেছে মাতা! রাতের অন্ধকারে আমার নিদ্রিত পুত্রদের কেউ নৃশংসভাবে হত্যা করেছে!"
কুন্তী:
"কি বলছো তুমি? এ কথা কি সত্য?"
দ্রৌপদী:
"নির্মম সত্য মাতা! আমি স্বচক্ষে আমার পুত্রদের রক্তস্নাত, নিষ্প্রাণ দেহ দেখে এসেছি। প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক, শ্রুতসেন, কেউ বেঁচে নেই! তরবারির আঘাতে কেউ নির্মমভাবে তাদের মুন্ডচ্ছেদ করেছে! পাণ্ডব বংশ ধ্বংশ হয়ে গেছে!"
কুন্তী:
"হায় ঈশ্বর! আমাদের এতো বড়ো সর্বনাশ কে করলো?"
দ্রৌপদী:
"জানি না মাতা! সেই গুপ্ত ঘাতক আমার পুত্রদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। সে আমার দুই ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখন্ডীসহ আমাদের অবশিষ্ট সৈনিকদেরও হত্যা করেছে! হায় ঈশ্বর! কেন সে আমাকেও হত্যা করলো না? প্রিয় পুত্রদের হারানোর পর মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই যে আমার কাম্য নয়!"
কুন্তী (দ্রৌপদীকে জড়িয়ে ধরে):
"শান্ত হও পুত্রী। সন্তান হারানোর যে কি ভীষণ কষ্ট সেটা আমিও জানি। সত্য করে বলো দেখি, আমার পাঁচ পুত্র কি এখনো জীবিত আছে, নাকি তাদেরও হত্যা করা হয়েছে?"
দ্রৌপদী:
"ঈশ্বরের কৃপায় পঞ্চপাণ্ডব সুরক্ষিতই আছেন। বিজয়ী পাণ্ডব সৈনিকরা আজ পরাজিত কৌরবদের শিবিরে রাত্রিবাস করেছিলো। তাদের মধ্যে আমার হতভাগ্য পাঁচ পুত্রও ছিলো। কিন্তু সখা কৃষ্ণের পরামর্শে পঞ্চ পাণ্ডব নিজেদের শিবিরে ছিলেন বলে গুপ্ত ঘাতকের তরবারির আঘাত থেকে তাঁরা রক্ষা পেয়েছেন। হা ঈশ্বর! আমার পুত্ররাও কেন তাঁদের সঙ্গে রইলো না! হায় কৃষ্ণ! কোথায় তুমি? এই অসহনীয় কষ্ট থেকে আমায় মুক্তি দাও সখা!"
(কৃষ্ণের প্রবেশ।)
কৃষ্ণ:
"শান্ত হও সখী। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগেই তো আমি তোমায় বলেছিলাম যে এই যুদ্ধে তোমার পাঁচ স্বামী ছাড়া সকলের মৃত্যু হবে। তুমি তো সেটা জেনেই এই যুদ্ধে রাজি হয়েছিলে।"
দ্রৌপদী:
"জানি সখা। তুমি বলেছিলে যে অধর্মের বিনাশ ও ধর্মস্থাপনের জন্য এই যুদ্ধের একান্ত প্রয়োজন আছে। বলেছিলে যে আদর্শ রাজার ধর্ম হলো যে কোনো মূল্যে প্রজাদের কল্যাণ সাধন করা। তোমার যুক্তি শুনে ভবিষ্যৎ জেনেও আমি যুদ্ধের ব্যাপারে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি সন্তান হারানোর বেদনা এতো ভীষণ হয়! হে বাসুদেব! হয় আমাকে মৃত্যু দাও, নয়তো এই যন্ত্রণা সহন করার শক্তি দাও!"
কুন্তী:
"স্থির হও দ্রৌপদী। আগে এই হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে হবে। একটু আগে লাল বসন পরিহিত এক ব্যক্তিকে আমি কৌরব শিবির থেকে চুপিসাড়ে নিস্ক্রান্ত হতে দেখেছি। তার মুখের একাংশ লাল বসনে আবৃত ছিলো। আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে গহন অন্ধকারেও তার মুখমন্ডল আলোকিত ছিলো।"
দ্রৌপদী:
"বুঝেছি! অশ্বত্থামা! অতি অবশ্যই এ অশ্বত্থামা হবে! তার কপালে যে শিরোমণি আছে তারই আলোকে তার মুখ আলোকিত হয়েছিলো!"
কৃষ্ণ:
"ঠিক বলেছো সখী। কৌরবদের আর মাত্র তিনজন সৈনিক জীবিত আছে। কৃপাচার্য এই গর্হিত কাজ কখনোই করবেন না, আর কৃতবর্মার এ কাজ করার সাহস হবে না। তাই ওই ব্যক্তি অবশ্যই অশ্বত্থামা ছিলো। আমার ধারণা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য সে মহামুনি ব্যাসের আশ্রমে গেছে। পাণ্ডবদের অবিলম্বে তার সন্ধানে সেখানে যাওয়া উচিত।"
দ্রৌপদী:
"প্রায়শ্চিত্ত? যে ভীষণ পাপ সে করেছে তার জন্য অখন্ড নরকবাসও পর্যাপ্ত শাস্তি নয়! ওই কাপুরুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই আত্মগোপন করে থাক, পাণ্ডবদের তাকে খুঁজে আনতেই হবে! আমার পুত্ররা তো তাঁদেরও পুত্র ছিলো! তাদের হত্যাকারীকে শাস্তি দিতেই হবে!"
কৃষ্ণ:
"অবশ্যই। কিন্তু পাণ্ডবরা সেটা করবে না এটা তুমি ভাবছো কেন?"
দ্রৌপদী:
"অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ ও গুরুপুত্র বলে পাণ্ডবরা তাকে বধ করতে দ্বিধা করতে পারে। কিন্তু আমি সেটা মানবো না! হে সখা! মহাবলী ভীম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর অর্জুনকে তুমি বলে দিও যে তাঁরা যদি অশ্বত্থামাকে হত্যা না করেন, তাহলে আমি অনাহারে প্রাণত্যাগ করবো।"
কৃষ্ণ:
"তোমার মানসিক যন্ত্রণা আমি বুঝতে পারছি সখী। কিন্তু আবেগের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। অশ্বত্থামাকে বধ করা অসম্ভব। তার মস্তকের চিন্তামণি তাকে অমর করেছে।"
দ্রৌপদী:
"যদি তাই হয়, তাহলে ওই মণিকে তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। অশ্বত্থামার মতো পাপিষ্ঠর মস্তকে চিন্তামণি শোভা পায় না। ও মণি ধারণ করার তার কোনো অধিকার নেই। ওই দৈব মণিকে আমি সম্রাট যুধিষ্ঠিরের রাজমুকুটে দেখতে চাই। পাণ্ডবরা আমার ইচ্ছাপূরণ না করলে আমি এখানেই প্রায়োপবেশনে বসবো।"
কুন্তী:
"ক্রোধ সংবরণ করো পুত্রী। তোমার স্বামীরা নিশ্চয়ই তোমার মনস্কামনা পূর্ণ করবে। কৃষ্ণ! পাণ্ডবদের নিয়ে তুমি এখনই অশ্বত্থামার সন্ধানে মহামুনি ব্যাসের আশ্রমে যাও।"
কৃষ্ণ:
"তথাস্তু।"
দৃশ্য - ৩
(প্রেক্ষাপটে জঙ্গলের দৃশ্য। অশ্বত্থামার প্রবেশ।)
অশ্বত্থামা:
"হায়! ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে এ আমি কি করে ফেললাম! রাতের অন্ধকারে চোরের মতো শিবিরে ঢুকে ঘুমন্ত পাণ্ডবদের আমি হত্যা করেছি। প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য এমন বর্বরোচিত কাজ আমি কি করে করতে পারলাম? পিতা বেঁচে থাকলে এমন কাপুরুষোচিত কাজের জন্য আমায় কখনোই ক্ষমা করতেন না। লোকে আমায় মহাবীর ও মহারথী অশ্বত্থামা বলে জানে। মহর্ষি ভরদ্বাজের পৌত্র ও গুরুশ্রেষ্ঠ দ্রোনাচার্যের পুত্র আমি। সেই মহান বংশকে আজ আমি কলুষিত করেছি। হায়! ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে কি করে এমন নক্কারজনক কাজ করতে পারলাম? এক ইতর পক্ষীর দ্বারা কেন এমন প্রভাবিত হলাম? তবে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করার জন্য আমার মনে কোনো অনুতাপ নেই। সে আমার বৃদ্ধ পিতা দ্রোনাচার্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো। সে সময় তিনি ছিলেন নিঃশস্ত্র ও পুত্রশোকে কাতর। সেই সুযোগে সে তাঁর মুন্ডচ্ছেদ করতে দ্বিধা করেনি। তাই নিদ্রিত ও নিঃশস্ত্র অবস্থায় তাকে হত্যা করে আমিও কোনো অন্যায় করিনি। আর পাণ্ডবদের হত্যা করেই বা আমি ভুল কি করেছি? যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা বচন বিশ্বাস করেই তো আমার পিতা অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন। তাঁর হাতে অস্ত্র থাকলে অর্জুন ছাড়া আর কারো তাঁকে পরাজিত বা হত্যা করার ক্ষমতা হতো না। অর্জুন তো আমার পিতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও অতি প্রিয় শিষ্য ছিলো। পিতা তাঁর সমস্ত বিদ্যা উজাড় করে শিখিয়ে তাকে পৃথিবীর সর্বোত্তম ধনুর্ধর তৈরি করেছিলেন। সেই গুরুকে নির্দয়ভাবে হত্যা করার জন্য অর্জুন ধৃষ্টদ্যুম্নকে কি শাস্তি দিয়েছিলো? কিছুই না! কারণ সে পাঞ্চালির ভ্রাতা! নিষ্ঠাহীন অর্জুনের কাছে গুরুর চেয়ে শ্যালকের গুরুত্ব বেশি ছিলো। তাই তাকে আর তার ভ্রাতাদের হত্যা করে আমি কোনো অন্যায় করিনি। মৃত্যুর আগে মিত্র দুর্যোধন বলেছিলো যে ভীষ্ম, দ্রোন, কর্ণ, শল্য যে কাজ করতে পারেননি, আমি আজ সেটা করে দেখিয়েছি। পাণ্ডবদের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর সে পরম শান্তিতে মৃত্যু বরণ করেছে। এটাই আমার পুরস্কার। (হঠাৎ চমকে উঠে)
কিন্তু ও কি? জঙ্গলের পথে ও কারা আসছে? একজন তো অবশ্যই কৃষ্ণ। কিন্তু বাকি পাঁচজন কারা? ওরা কি পঞ্চপাণ্ডব নাকি? না না! আমার নিশ্চয়ই দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে।"
(কৃষ্ণের প্রবেশ।)
কৃষ্ণ:
"না অশ্বত্থামা! তোমার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি! পঞ্চপাণ্ডব জীবিত আছে। তাদের হত্যা করার সাধ্য তোমার নেই!"
অশ্বত্থামা:
"এ কি করে সম্ভব? পাণ্ডবরা জীবিত আছে? তাহলে শিবিরের মধ্যে আমি কাদের হত্যা করলাম?"
কৃষ্ণ:
"ধিক অশ্বত্থামা! পাণ্ডবদের পরিবর্তে তুমি তাদের বালক পুত্রদের হত্যা করেছো! তোমার চেয়ে ঘৃণ্য কে আছে?"
অশ্বত্থামা:
"হা ঈশ্বর! এ আমি কি করেছি! এমন ভুল আমার কি করে হলো? প্রতিশোধস্পৃহায় শেষ পর্যন্ত নিরপরাধ বালকদের রক্তে আমার হাত রঞ্জিত করেছি? হে মহাদেব! এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য আমায় ক্ষমা করো!"
কৃষ্ণ:
"কিন্তু পাণ্ডবরা কখনোই তোমায় ক্ষমা করবে না! অর্জুনের হাতে মৃত্যু বরণ করার জন্য প্রস্তুত হও!"
অশ্বত্থামা:
"অর্জুন আমায় শাস্তি দেবার কে? নিজের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মকে সে কাপুরুষের মতো শিখন্ডীর আড়াল থেকে শরাঘাতে পতিত করেছিলো। রথহীন, নিরস্ত্র কর্ণকে সে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলো। গুরুর হত্যাকারী ধৃষ্টদ্যুম্ন তার শ্যালক বলে সে তাকে ক্ষমা করেছিলো। যে নিজে এতো অধর্ম করেছে, অন্যকে শাস্তি দেবার তার কি অধিকার আছে?"
কৃষ্ণ:
"যাঁদের কথা তুমি বলছো তাঁরাও অধর্ম করেছিলেন। কৌরব সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ভীষ্ম ও দ্রোন নীরব ছিলেন। কর্ণ পাঞ্চালিকে পতিতা বলে অপমান করেছিলো। অভিমন্যুর হত্যাকারীদের মধ্যে তোমার পিতা আর কর্ণও ছিলো। সুতরাং তারা কেউই নির্দোষ নয়। কিন্তু তুমি কি করে নিরপরাধ বালকদের হত্যা করলে?"
অশ্বত্থামা:
"উপপাণ্ডবদের হত্যা করার জন্য আমি লজ্জিত। কিন্তু পাণ্ডবদের প্রতি আমার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের বধ করার জন্য আমি দুর্যোধনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য এখনই আমি ব্রহ্মশির দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে তাদের হত্যা করবো।"
কৃষ্ণ:
"প্রতিহিংসার বশে তুমি কি উন্মাদ হয়েছো? তুমি কি জানো না যে মহাদেবের বরে অর্জুনের কাছেও ব্রহ্মশির প্রয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে? তুমি ব্রহ্মশিরকে আহ্বান করলে অর্জুন কি চুপ করে থাকবে? তখন সে-ও তার অস্ত্রকে আহ্বান জানাবে। তখন দুই মহাশক্তিশালী দিব্যাস্ত্রের সংঘর্ষে পৃথিবী ধ্বংশ হয়ে যাবে!"
অশ্বত্থামা:
"হলে হবে। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। পৃথিবীকে সুরক্ষিত রাখার দায় তো ধর্মের ধ্বজাধারী পাণ্ডবদের। তারা তাদের কর্তব্য পালন করুক। আর আমি আমার প্রতিজ্ঞা পালন করি। (সামনের দিকে তাকিয়ে) কি বললে অর্জুন? আমি ব্রহ্মশিরকে আহ্বান করলে তুমিও সেটাই করবে? বেশ, তাই করো! মরতে আমি ভয় পাই না। কিন্তু তুমি তো ধর্মের প্রতীক! আত্মরক্ষার তাগিদে পৃথিবীকে ধ্বংশ করবে? সাহস থাকে তো সেটা করে দেখাও!"
(অশ্বত্থামা তার ধনুকে তীর সংযোজন করে। মেঘগর্জন ও বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। আলোতেও সেটা reflected হবে। অশ্বত্থামা তীর নিক্ষেপ করে। প্রকৃতিতে তান্ডব চলতে থাকে। )
অশ্বত্থামা:
"হায় মহাদেব! অর্জুনও তার ব্রহ্মশির অস্ত্রকে আহ্বান জানিয়ে তাকে নিক্ষেপ করেছে। এবার অবশ্যই পৃথিবী ধ্বংশ হবে! কিন্তু না! কৃষ্ণর সুদর্শন চক্র দুটি দিব্যাস্ত্রর মাঝে এসে তাদের অনিবার্য সংঘর্ষকে নিবৃত্ত করেছে। কৃষ্ণ দুজনকেই অস্ত্র নিবারণ করতে বলছে। ওই যে, কৃষ্ণের কথায় অর্জুন ব্রহ্মশির অস্ত্রকে নিবারণ করলো। কিন্তু হে কৃষ্ণ! আমি তো এই অস্ত্র নিবারণ করার উপায় জানি না! পিতা শুধু এটি আহ্বান করার পন্থা শিখিয়েছিলেন, কিন্তু নিবারণ করার উপায় তো বলে যাননি!"
কৃষ্ণ:
"দিব্যাস্ত্র নিবারণ করতে জানো না যদি, তাহলে তাকে আহ্বান করার সাহস পেলে কি করে? এখন এই বিধ্বংসী অস্ত্র তুমি কার ওপরে নিক্ষেপ করতে চাও? পাণ্ডবদের সুরক্ষার দায়িত্ব আমার! সুতরাং তাদের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও কোরো না।"
অশ্বত্থামা:
"না কৃষ্ণ। আমি জানি যে তুমি থাকতে পাণ্ডবদের ক্ষতি করা সম্ভব নয়। তাই আমার অস্ত্র পাণ্ডব বংশকে ধ্বংশ করুক!"
কৃষ্ণ:
"অর্থাৎ?"
অশ্বত্থামা:
"অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর বিধবা স্ত্রী উত্তরার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে, আমি চাই আমার অস্ত্র পাণ্ডবদের সেই শেষ বংশধরকে নষ্ট করুক!"
(প্রেক্ষাপটে রাত্রিবেলা ঝড়ের ছবি। তীব্র মেঘ গর্জন ও বজ্রপাতের শব্দ)
কৃষ্ণ:
"ধিক অশ্বত্থামা, ধিক! প্রথমে বালক উপপাণ্ডবদের হত্যা করে এখন একটি অজাত শিশুকে হত্যা করলে? এর শাস্তি তোমায় পেতে হবে! অর্জুন! অশ্বত্থামার মস্তকের ওই চিন্তামণি তুমি কেড়ে নাও। ওই পাপিষ্ঠের কপালে ওই দৈব মণির কোনো স্থান নেই।"
অশ্বত্থামা:
"তিষ্ঠ অর্জুন। কৃষ্ণর সঙ্গে আমি সহমত। আমার মতো শিশুহন্তার কপালে চিন্তামণি শোভা পায় না। তাই আমি নিজেই এই মণি ছুরিকার সাহায্যে আমার মস্তক থেকে বিচ্ছিন্ন করে কৃষ্ণকে দিচ্ছি। দ্রৌপদীর কাছে আমি অপরাধী। তার পুত্রদের হত্যা করে আমি যে মহাপাপ করেছি তার সামান্য প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ এই অনন্য মণিটি আমি তাকেই সমর্পণ করলাম।"
(অশ্বত্থামা কোমর থেকে একটি ছুরি বার করে। তারপর সে মুখ নিচু করে সেই ছুরি তার কপালে স্পর্শ করে। সে মুখ তুললে দেখা যায় যে তার কপাল থেকে রক্তস্রোত নেমে এসেছে। তার হাতে ধরা রক্তমাখা চিন্তামণি। সেটা সে কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে দেয়। কৃষ্ণ সেটি তার হাত থেকে তুলে নিলো।)
দৃশ্য - ৪
(প্রেক্ষাপটে রাতের জঙ্গলের দৃশ্য। অশ্বত্থামা মঞ্চে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে মুখে রক্তমাখা, সর্বাঙ্গে রোগের চিহ্ন।)
অশ্বত্থামা:
"চিন্তামণি ত্যাগ করেও আমি রক্ষা পেলাম না। অবশ্য যে ভীষণ পাপ করেছি তার পরিবর্তে এমন কঠোর শাস্তি ছাড়া আর কিই বা আমার প্রাপ্য হতে পারে? কৃষ্ণ বলেছে যে সে তার অলৌকিক শক্তিবলে উত্তরার গর্ভস্থ সন্তান, অর্থাৎ পাণ্ডবদের শেষ বংশধর পরীক্ষিতকে জীবনদান করবে। এতে আমি খুশিই হয়েছি। কারণ বালকদের হত্যা করার পরিকল্পনা আমার কখনোই ছিলো না। কিন্তু আমার জীবনটা যে অভিশপ্ত হয়ে গেল। কৃষ্ণর অভিশাপের বাণী এখনো আমার কানে ধ্বনিত হচ্ছে।"
(ব্যাকগ্রাউন্ডে কৃষ্ণের গলা শোনা যায়। তার সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়ানো অশ্বত্থামা expression দেবে।)
কৃষ্ণ (only echo voice):
"হে অশ্বত্থামা! এক অজাত, মাতৃগর্ভস্থ শিশুকে হত্যা করে তুমি যে মহাপাপ করেছো তার শাস্তিভোগ করার জন্য প্রস্তুত হও! শুনেছি তুমি নাকি মৃত্যুকে ভয় পাও না। তাই আজ মৃত্যুকেই তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলাম। কলিযুগের অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত তুমি এক অপ্রিয়, বিতাড়িত, কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু কোথাও শান্তি পাবে না!"
অশ্বত্থামা:
"হা কৃষ্ণ! এমন ভয়ানক অভিশাপ আমায় কেন দিলে? মণিহারা অশ্বত্থামাকে তোমার সুদর্শন চক্র দিয়ে তো হত্যা করতে পারতে? তোমার হাতে মৃত্যু হলে আমার স্বর্গলাভ হতো। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে সেটা হলো না। অবশ্য ভাগ্য কবে আমার সহায় ছিলো? আমরা দরিদ্র ছিলাম বলে বাল্যকালে মাতা দুধ বলে আমায় পিটুলির ঘোল খাওয়াতেন। সেটা জানতে পেরে আমার বন্ধুরা আমায় বিদ্রুপ করতো। একটি গাভীর আশায় আমার পিতা তাঁর বাল্যবন্ধু পাঞ্চালরাজ দ্রূপদের কাছে গেলে তিনি তাঁকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কৃপায় আমার পিতা কুরু রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু হলেন। আমাদের দারিদ্রের দিন শেষ হলো। অর্জুনের মধ্যে প্রতিভা ছিলো বলে পিতা তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। সেই জন্য তার প্রতি আমার প্রবল ঈর্ষা ছিলো। সেই কারণে তার ভ্রাতারাও আমার কাছে প্রিয় ছিলো না। পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষ আমাকে দুর্যোধনের বন্ধু করে তুলেছিলো। শত্রুর শত্রু তো বন্ধুই হয়। কিন্তু পরে বুঝলাম যে পিতা অকারণে অর্জুনকে স্নেহ করতেন না। তিনি বুঝেছিলেন যে একমাত্র অর্জুনের মধ্যেই দ্রূপদকে পরাজিত করার ক্ষমতা ছিলো। তার পরাক্রমের ফলেই আমি অর্ধেক পাঞ্চাল দেশের রাজা হতে পেরেছিলাম। সত্যি বলতে অর্জুনের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু তাকে আমি চিরকাল ঈর্ষা করে গেছি। আজও তাকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যেই ব্রহ্মশির অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলাম। কিন্তু বরাবরের মতো আজও হেরেই গেলাম।
শুধু অর্জুন কেন, মিত্রতার লড়াইয়ে অঙ্গরাজ কর্ণের কাছেও কি আমি হেরে যাইনি? সবাই দুর্যোধন আর কর্ণর মিত্রতার জয়গান করে। কিন্তু দুর্যোধনের সঙ্গে আমার মিত্রতার কথা কেউ বলেনা। পিতা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাননি। তিনি বলেছিলেন যে এই যুদ্ধ আমাদের নয়, তাই হস্তিনাপুর ছেড়ে আমাদের আশ্রমে ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু দুর্যোধনের অনুরোধে আমি সেটা হতে দিইনি। সেদিন পিতার আদেশ মানলে আজ তিনি জীবিত থাকতেন। যুবরাজের প্রতি আমার ভালোবাসা পরোক্ষে পিতার মৃত্যুর কারণ হয়েছে। তার সুখের হেতু নরশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়েও আমি শিশুহত্যার মতো মহাপাপ করেছি। সেই জন্যই আমাকে অনন্তকালের শাপিত জীবন মেনে নিতে হয়েছে। এগুলো কি আমাদের মিত্রতার যথেষ্ট প্রমাণ নয়?
কিন্তু আর না। এবার অনুশোচনা আর প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে। ভয়ানক কুষ্ঠরোগ আমার দেহকে কুৎসিত করলেও মনকে শুদ্ধ করেছে! একদা কলুষিত মনে আজ কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। নেই কোনো ক্রোধ, ঈর্ষা, মোহ বা লোভ। শ্রীকৃষ্ণের কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা। হে নারায়ণ! তুমি আমায় ক্ষমা কোরো প্রভু।"
(সমাপ্ত)
