STORYMIRROR

Rini Basu

Drama Tragedy Inspirational

3  

Rini Basu

Drama Tragedy Inspirational

শকুনি গান্ধারী সংবাদ

শকুনি গান্ধারী সংবাদ

9 mins
29

 


(মঞ্চে সূত্রধরের প্রবেশ। তার পরণে সাধুর পোশাক।)


সূত্রধর: 

"কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সতেরো দিন কেটে গেছে। কৌরবদের এগারো আর পাণ্ডবদের সাত, এই আঠারো অক্ষৌহিনী সেনার আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। দু পক্ষের বহু রথী-মহারথীর মৃত্যু হয়েছে। রণক্ষেত্র দিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে গেছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু মৃতদেহের পাহাড়। চারিদিকে শোনা যায় বুকফাটা কান্না আর হাহাকার। সবাই জানে যে এই যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয় নিশ্চিত। কিন্তু গান্ধাররাজ শকুনি এখনো জয়ের স্বপ্ন দেখে চলেছেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁর পাশার অন্তিম চালে পাণ্ডবরা পরাস্ত হবেই।"


(আধা অন্ধকার মঞ্চে শকুনি একটা কৌচের ওপর বসে আছেন। তাঁর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। সামনে একটা টেবিলের ওপর পাশাখেলার বোর্ড রাখা আছে। শকুনি অন্যমনস্কভাবে পাশা দুটো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। আচমকা তিনি বোর্ডের ওপর পাশা দুটোকে ছুঁড়ে ফেললেন।)


শকুনি: 

"পৌনে বারো!"

(বোর্ডের দিকে তাকিয়ে শকুনির মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। পাশা দুটোকে তুলে নিয়ে তিনি সস্নেহে তাদের দিকে তাকালেন।)

"সবাই ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু তোমরা এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে আমার আদেশ পালন করে চলেছো। আমার পিতা, মহারাজ সুবলের মৃত্যুর পর তাঁর দেহের অস্থি থেকে তোমাদের তৈরি করেছিলাম। পিতার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যে তাঁর অস্থিনির্মিত এই পাশা দুটি যেন সর্বদা আমার আদেশ পালন করে। আমার প্রার্থনা বিফল হয়নি। তোমরা সব সময় আমার পাশে থেকেছো। পাশার প্রতিটি দান আমার ইচ্ছে মতো ফেলেছো। তোমরা ছিলে বলেই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা সম্ভব হয়েছিলো। তোমাদেরই বদান্যতায় পাণ্ডবরা বনবাসে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। এই নির্বান্ধব জগতে তোমরাই আমার প্রকৃত বন্ধু।"


(মঞ্চে গান্ধারীর প্রবেশ।)


গান্ধারী: 

"বন্ধু, নাকি শত্রু? ওই সর্বনাশা পাশা দুটিকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলো ভ্রাতা!"


শকুনি: 

"গান্ধারী! হস্তিনাপুরের প্রাসাদ ছেড়ে কুরুক্ষেত্রের এই ভীষণ রণভূমিতে তুমি কেন এসেছো ভগিনী?"


গান্ধারী: 

"পুত্রস্নেহ আমাকে এখানে টেনে এনেছে! মহাদেবের বরে আমি শতপুত্রের জননী ছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমি মাত্র একটি পুত্রের মা! বিগত সতেরো দিনে আমি নিরানব্বইটি পুত্রকে হারিয়েছি। কার জন্য আমার এমন সর্বনাশ হলো ভ্রাতা?"


শকুনি: 

"নিজেকে শান্ত করো ভগ্নী। তোমার এই সর্বনাশের জন্য দায়ী দেবকীনন্দন ওই মায়াবী কৃষ্ণ। সে যদি পাণ্ডবদের অন্যায় যুদ্ধের পথ না দেখাতো তাহলে ভীষ্ম, দ্রোণ আর কর্ণের মৃত্যু হতো না।। এই তিন মহারথী জীবিত থাকলে কৌরবদের জয় নিশ্চিত ছিলো।"


গান্ধারী: 

"ভুল বললে জ্যেষ্ঠ! কৃষ্ণ নয়, তোমরাই পাণ্ডবদের অন্যায় যুদ্ধের পথ দেখিয়েছিলে। অভিমন্যুর নির্মম হত্যার কথা কি তুমি ভুলে গেলে? এক নিরস্ত্র বালককে সাতজন মহারথী ঘিরে ধরে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিলে। সেটা কি ন্যায়যুদ্ধ ছিলো?"


শকুনি: 

"অভিমন্যু দুর্যোধনের জয়লাভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাকে হত্যা না করে উপায় ছিলো না।"


গান্ধারী: 

"কিন্তু তার পরেও কি জয় পেলে? এই যুদ্ধের কি কোনো প্রয়োজন ছিলো ভ্রাতা? কৃষ্ণর শান্তি প্রস্তাব মেনে নিয়ে পাঁচটা গ্রাম কি পাণ্ডবদের দেওয়া যেতো না?"


শকুনি: 

"এ প্রশ্ন দুর্যোধনকে করো গান্ধারী, যে কৃষ্ণকে বন্দী করার চেষ্টা করেছিলো, যে শান্তি প্রস্তাবের উত্তরে বলেছিলো 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী'। এ প্রশ্ন করো তোমার স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে, যে পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে দুর্যোধনকে সমর্থন করেছিলো। এই বিধ্বংসী যুদ্ধের জন্য তারাই দায়ী।"


গান্ধারী: 

"না জ্যেষ্ঠ, তারা দায়ী নয়। এই ভীষণ যুদ্ধের জন্য পরোক্ষে আমিই দায়ী। কারণ আমি তোমার কাছে আমার পুত্রদের মানুষ হতে দিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম যে বিষবৃক্ষের কাছে বিষ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।"


শকুনি: 

"এ কথা বলতে পারলে গান্ধারী? তোমার পুত্রদের আমি নিজের সন্তানদের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি। দুর্যোধনকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসানোর জন্য হেন পাপ কাজ নেই যা করিনি। প্রমাণকোটিতে বালক ভীমকে বিষ খাইয়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছি, বারণাবতে পাণ্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছি, যুধিষ্ঠিরকে কপট পাশাখেলায় হারিয়ে সপরিবারে বনবাসে পাঠিয়েছি। ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য আর তার অতুল ঐশ্বর্য দুর্যোধনের অধিকারে এনেছি। এতো কিছুর পর তুমি আমাকেই দোষী বললে ভগ্নী?"


গান্ধারী: 

"থামো জ্যেষ্ঠ! আমার কাছে অন্তত সত্যি কথা বলো! এসবের পিছনে তোমার আসল উদ্দেশ্য ছিলো গঙ্গাপুত্র ভীষ্মর ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া। ভীষ্মর পরাক্রমকে ভয় পেয়ে পিতা অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি সেই বিয়েকে আমার ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কোনোদিনই মেনে নিতে পারোনি।" 


শকুনি: 

"না, পারিনি! আমার প্রিয় ভগ্নীর এই দুর্ভাগ্যকে আমি কোনোদিনই মেনে নিতে পারিনি! জন্মকুন্ডলী অনুযায়ী তুমি মাঙ্গলিক ছিলে। তোমার বৈধব্যদোষ কাটানোর জন্য ছোটবেলায় একটি বলিপ্রদত্ত মেষের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবার পর ভীষ্ম এ কথা জেনে ভীষণ রেগে যায়। সে পিতাকে বলে, 'আপনার পুত্রী বিধবা একথা আগে জানলে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে কখনোই তার বিয়ে দিতাম না! সত্য গোপন করার অপরাধে আমি আপনাদের সবাইকে বন্দী করছি!' ভীষ্মর আদেশে আমরা বন্দী হলাম। কারাগারে আমাদের যা খাবার দেওয়া হতো তাতে একজনেরও পেট ভরে না। আমি ছোট বলে পিতা আর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারা সব খাদ্য আমাকেই দিতেন। একমাস অনাহারে থাকার পর তাঁদের মৃত্যু হলো। এই চূড়ান্ত অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য শুধু আমিই বেঁচে রইলাম। গান্ধারী, তুমিও চোখে কালো কাপড় বেঁধে নীরবে প্রতিবাদ করেছিলে। কিন্তু সবাই ভাবলো যে অন্ধ স্বামীর যথার্থ সহধর্মিণী হবার জন্য তুমি স্বেচ্ছায় অন্ধত্বকে বরণ করেছো। তোমার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশকে সতীত্বের আখ্যান দিয়ে সবাই তোমাকে সাধুবাদ জানালো। ভীষ্ম করুণা করে আমাকে মুক্তি দিয়েছিলো। গান্ধার রাজ্যে ফিরে যাবার অনুমতিও দিয়েছিলো। কিন্তু আমি ফিরে যাইনি। কারণ আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে ভীষ্মর চোখের সামনে কুরুবংশকে ধ্বংস করে এই নিষ্ঠুর হত্যার প্রতিশোধ নেবো।"


গান্ধারী:

"আমি কিছুই ভুলিনি ভ্রাতা। স্বামীর আয়ু বৃদ্ধির জন্য আমার বৈধব্যদোষ কাটানো দরকার ছিলো। কিন্তু আমার শ্বশুরকুল সেটা বুঝলো না। উপকারের প্রতিদানে তারা আমার পরিবারকে মৃত্যুদন্ড দিলো।"


শকুনি:

"দুর্যোধন যদি জ্যেষ্ঠ কুরুপুত্র হতো তাহলে হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ওপর তারই অধিকার থাকতো। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য যে কুন্তীর আগে গর্ভবতী হয়েও তুমি জ্যেষ্ঠ কুরুপুত্রের জন্ম দিতে পারলে না। কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির আগে জন্মালো। যুধিষ্ঠিরের জন্ম সংবাদ আমাকে খুব আশ্চর্য করেছিলো। বীর্যহীন পাণ্ডু কি করে সন্তানের জন্ম দিতে পারে? যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব - এরা কি পান্ডুর ঔরসেই জন্মেছিলো? আমার বিশ্বাস বংশরক্ষার জন্য পাণ্ডু নিয়োগ প্রথার মাধ্যমে তার দুই স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার করেছিলো।"


গান্ধারী: 

"আমিও সেরকমই শুনেছি। অবশ্য কুরুবংশে এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। আমার স্বামী আর দেবর দুজনেই ব্যাসদেবের ঔরসজাত সন্তান। মহারাজ বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাবার পর তাঁর দুই বিধবা রানী অম্বিকা আর অম্বালিকা বেদব্যাসের কৃপায় দুটি পুত্র লাভ করেছিলেন। দাসীপুত্র বিদুরও তাঁর সন্তান।"


শকুনি:

"আশ্চর্য এই কুরুবংশ! কে যে কার সন্তান বোঝা দায়! ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ বিচিত্রবীর্যের ঔরসজাত সন্তান নয় এ কথা না জানিয়েই তোমার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তাহলে কি সত্য গোপন করার অপরাধে ভীষ্মকেও কারাবন্দী করে অনাহারে মারা উচিত নয়?"


গান্ধারী:

"শরশয্যায় পড়ে থাকা অতিবৃদ্ধ ভীষ্মকে এবার ক্ষমা করে দাও ভ্রাতা। তাঁর চোখের সামনে কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছে। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। এবার তাঁকে রেহাই দাও।"


শকুনি:

"আমার মনোবাঞ্ছা ছিলো দুর্যোধনকে হস্তিনাপুরের রাজা করা। ভীষ্ম আর বিদুর সেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে দেয়নি। তারা প্রথম থেকেই দুর্যোধনকে পছন্দ করতো না। তাদের পছন্দের রাজা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির! যুধিষ্ঠিরের মতো সচ্চরিত্র, মহাজ্ঞানী, মহাধার্মিক, মহানীতিজ্ঞ ধরাধামে নাকি দ্বিতীয়টি নেই! ছোটো ভাইয়ের বউকে যে বিয়ে করে তাকে কি সচ্চরিত্র বলা যায়? নিজের স্ত্রীকে যে জুয়াতে বাজি রাখে সে ধার্মিক? জুয়ার নেশায় যে দুবার তার রাজ্যকে হারায় তাকে জ্ঞানী বলা চলে? যে মিথ্যের সাহায্যে তার গুরুর মৃত্যু ঘটায় তার নীতিবোধ আছে? আমি মানতে পারলাম না।"


গান্ধারী:

"তোমার মানা না মানায় কারুর কিছু আসে যায় না ভ্রাতা! তোমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে আমার নিরানব্বইটা ছেলের প্রাণ গেছে। এবার কি দুর্যোধনের প্রাণটাও নিতে চাও?


শকুনি:

"এমন করে বলো না গান্ধারী! মনে বড়ো কষ্ট পাই। আমি চেয়েছিলাম দুর্যোধনের পথের কাঁটা পাণ্ডবরা ধ্বংস হোক। বারণাবতে যদি ওরা অলৌকিকভাবে বেঁচে না যেতো তাহলে দুর্যোধন আজ সুখে হস্তিনাপুরে রাজত্ব করতো।"


গান্ধারী:

"অধর্মের পথে চলে যে সিংহাসন পাওয়া যায় সেখানে বসে কি কখনো সুখে রাজত্ব করা যায়?"


শকুনি: 

 "অধর্ম? ধর্ম অধর্মের বিচার কে করবে? আমার কাছে যেটা ধর্ম অন্যের কাছে সেটা অধর্ম হতেই পারে। রাজা শিকারে যাবেন সেটা তাঁর কাছে রাজধর্ম, কিন্তু যে পশুদের তিনি হত্যা করবেন তাদের কাছে সেটা অধর্ম। অনেকে বলবে যুধিষ্ঠির বয়সে বড়ো বলে ধর্মমতে তারই রাজা হওয়া উচিত। কিন্তু আমি বলবো মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে ধর্মত দুর্যোধনের রাজা হওয়া উচিত।"


গান্ধারী:

"অতো জটিল তত্ত্ব আমার মাথায় ঢোকে না ভ্রাতা। তবে লোকে যখন দুর্যোধনকে অধার্মিক, স্বার্থপর আর অহংকারী বলে, তখন আমার মনে খুব কষ্ট হয়। কারণ আমি জানি যে মানুষ হিসেবে সে অতটা খারাপ নয়।"


শকুনি:

"অবশ্যই নয়। ভাইদের প্রতি তার অপার ভালোবাসা ছিলো। স্ত্রী ভানুমতীর প্রতি একনিষ্ঠ প্রেম আছে বলে সে দ্বিতীয় বিবাহ করেনি। জাতিভেদ করে না বলে কর্ণকে সে বন্ধুর আসনে বসিয়েছিলো। তার মন উদার বলে সে এক সূতপুত্রকে অঙ্গ দেশের রাজা করেছিলো। এগুলো কি খারাপ মানুষের লক্ষণ?"


গান্ধারী:

"যথার্থ বলেছো ভ্রাতা। হস্তিনাপুরের প্রজারাও তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি।"


শকুনি:

"তাহলেই বলো। লোকে বলে যে কারুর সমালোচনা করার আগে নিজেকে একবার তার জায়গায় কল্পনা করতে হয়। পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত দুর্যোধন জানতো যে সে হস্তিনাপুরের রাজা হবে। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ভীষ্ম অরণ্য থেকে কুন্তী আর তার পাঁচ ছেলেকে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলো। তারা আসার পর দুর্যোধন জানতে পারলো যে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসবে কারণ সে বয়সে বড়ো। এ কথা জানার পর তার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিলো একবার ভেবে দেখো। সিংহাসনে বসার অধিকার কেড়ে নিয়ে দুর্যোধনকে বলা হলো, 'কোনো কিছুই তোমার নয় বাপু, সবই ওই যুধিষ্ঠিরের। ভবিষ্যতে সে-ই হস্তিনাপুরের রাজা হবে। তাকে মান্য করে চলতে শেখো।' এরপর যদি তার মন বিদ্রোহ করে তাহলে কি তাকে দোষ দেওয়া যায়?"


গান্ধারী:

"কিন্তু সবাই তো আর আমাদের মতো করে চিন্তা করে না দাদা। ভীষ্ম আর বিদূর কি করে আশা করেছিলেন যে একজন পনেরো বছরের কিশোর বিনা প্রতিবাদে তার সব অধিকার ছেড়ে দেবে? দুর্যোধনকে তো তাঁরাই ধর্মের পথ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। তার হতাশা আর মনোকষ্ট আমরা ছাড়া আর কেউ অনুভব করেনি।"


শকুনি:

"সঠিক বলেছো। যাই হোক, এবার বলো দেখি কি কারণে এখানে এসেছো?"


গান্ধারী:

"বলছি। কিন্তু আগে বলো দুর্যোধন কোথায়? সে তার শিবিরে নেই কেন? তার সঙ্গে দেখা হওয়া যে আমার খুবই প্রয়োজন।"


শকুনি:

"কর্ণর মৃত্যুর পর দুর্যোধন মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছে। কারণ ভীষ্ম বা দ্রোণ নয়, কর্ণর ভরসাতেই সে এই যুদ্ধ জেতার স্বপ্ন দেখেছিলো।"


গান্ধারী:

"সবাই বলছে কর্ণ নাকি আসলে কুন্তীর ছেলে ছিলো?"


শকুনি:

"ঠিকই শুনেছো। আর এই খবরটা বেশি করে দুর্যোধনের মন ভেঙে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে যে বিয়ের আগে কর্ণের জন্ম হয়েছিলো বলে কুন্তী তাকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলো। ভীষ্মর সারথি অধিরথের কাছে সে মানুষ হয়। কিন্তু পরে তার কবচ কুণ্ডল দেখে কুন্তী তাকে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র বলে চিনতে পারে। যুদ্ধের আগে নাকি কৃষ্ণ আর কুন্তী কর্ণের কাছে গিয়েছিলো। তাদের কাছেই সে নিজের আসল পরিচয় জানতে পারে। তারা তাকে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করতে বলেছিলো, কিন্তু দুর্যোধনের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত কর্ণ রাজি হয়নি।"


গান্ধারী:

"তাহলে তো কর্ণর প্রশংসা করতে হয়। কৃতজ্ঞতাবোধ সকলের থাকে না।"


শকুনি:

"আমার কথা এখনো শেষ হয়নি বোন। কৃতজ্ঞতা আর চক্ষুলজ্জার কারণে কর্ণ পাণ্ডবদের শিবিরে যেতে পারেনি বটে, কিন্তু মনে মনে কি তার যাবার ইচ্ছে ছিলো না? সূতপুত্র থেকে কুন্তীপুত্র হবার লোভ কি তার হয়নি? জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব হিসেবে ইন্দ্রপ্রস্থ আর হস্তিনাপুরের রাজা হবার বাসনা কি তার মনে জাগেনি? অনিন্দ্যসুন্দরী ও অনন্তযৌবনা দ্রৌপদীর স্বামী হবার কামনা কি তার অন্তরে জাগেনি? নিশ্চয়ই জেগেছিলো। মনের সেই ইচ্ছেগুলোকে জোর করে দমন করেই সে দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলো।"


গান্ধারী:

"এ ব্যাপারে তুমি এতো নিশ্চিত হচ্ছো কি করে জ্যেষ্ঠ? দানবীর কর্ণকে সবাই এক মহান চরিত্র বলেই জানে। দুর্যোধনের জন্য সে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। তার নিন্দে শুনতে ভালো লাগছে না।"


শকুনি:

"শুনতে কটু লাগলেও কথাগুলো সত্যি। আচ্ছা বলো তো, নিজের পরিচয় জানার পর কর্ণ তার প্রিয়বন্ধু দুর্যোধনকে সে কথা জানায়নি কেন? যুদ্ধক্ষেত্রে সে কুন্তীর একটি পুত্রকেও হত্যা করেনি। ভীম প্রতিদিন তোমার পুত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে, কিন্তু কর্ণ সুযোগ পেয়েও বধ করেনি। নকুল সহদেবকে সে পরাজিত করেও ছেড়ে দিয়েছে। যুধিষ্ঠিরকে অরক্ষিত পেয়েও তাকে বন্দী করেনি। এসবের একটাই কারণ যে পাণ্ডবরা তার ভাই। অর্জুনবধের জন্য সে ইন্দ্রের কাছে বাসবী শক্তি চেয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সেটা ব্যবহার করেনি। বরং অর্জুনের বানে মৃত্যুবরণ করে সে পাণ্ডবদের জয় সুনিশ্চিত করেছে।"


গান্ধারী:

"তুমি যা বলছো সবই ঠিক। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা যাবে না ভ্রাতা। দুর্যোধন কোথায় সেটা বলো।"


শকুনি: (উচ্চস্বরে)

"রক্ষী! যুবরাজ দুর্যোধনকে খবর দাও যে মহারাণী গান্ধারী তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। যুবরাজ যেন এখনই আমার শিবিরে চলে আসে।"


বাইরে থেকে:

"যথা আজ্ঞা হুজুর।"


শকুনি:

"এবার বলো ভগ্নী, দুর্যোধনের সঙ্গে তোমার দেখা হওয়া এতো জরুরি কেন?"


গান্ধারী:

"কৌরবদের কোনো মহারথী আমার ছেলেদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি ভ্রাতা! ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, সবাই ব্যর্থ হয়েছে। তাই দুর্যোধনের নিরাপত্তার ভার আমি নিজেই নেবো বলে স্থির করেছি।"


শকুনি:

"পরিহাস কোরো না গান্ধারী। একজন সামান্য নারী দুর্যোধনকে কি নিরাপত্তা দিতে পারে? রণক্ষেত্র নারীদের জন্য নিরাপদ জায়গা নয়। পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রাসাদে ফিরে যাও।"


গান্ধারী:

"নারীশক্তিকে তুচ্ছ কোরো না জ্যেষ্ঠ। তপোবলে একজন সামান্য নারীও মহাশক্তির আধার হয়ে উঠতে পারে।"


শকুনি:

"তুমি আবার কোন মহাশক্তির আধার হলে গান্ধারী?"


গান্ধারী:

"তবে বলি শোনো। দুর্যোধনের প্রাণলরক্ষার আবেদন নিয়ে আমি মহামুনি ব্যাসের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন যে তাকে রক্ষা করার শক্তি নাকি আমার মধ্যেই রয়েছে। বহু বছর ইন্দ্রিয় দমন করার ফলে আমার ইন্দ্রিয়, অথাৎ চোখের দৃষ্টিতে যে শক্তিসঞ্চয় হয়েছে তার সাহায্যে আমি দুর্যোধনের শরীরকে বজ্রের মতো কঠিন করে দিতে পারি। এর ফলে আমার পুত্র অজেয় হয়ে যাবে। এটা জানার পরেই কুরুক্ষেত্রে ছুটে এসেছি।"


শকুনি:

"কি বলছো গান্ধারী! তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে দুর্যোধনের জয় নিশ্চিত!"


গান্ধারী:

"মহর্ষি বেদব্যাসের কথা কখনো মিথ্যে হতে পারে না! এই যুদ্ধে দুর্যোধন অবশ্যই জয়লাভ করবে।"


(মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আবার আলোকিত হয়। মঞ্চের মাঝে শকুনি একা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে অত্যন্ত শ্রান্ত ও বিষণ্ন বলে মনে হচ্ছে।)


শকুনি:

"হেরে গেল গান্ধারী। কৃষ্ণের চাতুরীতে আমার প্রিয় বোনের অন্তিম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল! গান্ধারীর আদেশে বস্ত্রহীন দুর্যোধন গঙ্গাস্নান করে ফিরছিলো। পথে তার সঙ্গে কৃষ্ণর দেখা হয়। কৃষ্ণ তাকে বলে যে মায়ের সামনে নির্বস্ত্র হয়ে গেলে তার মহাপাপ হবে। লজ্জিত দুর্যোধন কোমরে কদলীপত্র জড়িয়ে গান্ধারীর সামনে এলো। গান্ধারীর দৃষ্টিবলে দুর্যোধনের দেহ বজ্রকঠিন হলো বটে, কিন্তু কদলীপত্রে ঢাকা অংশে তার দৃষ্টি না পড়ায় কোমর থেকে জঙ্ঘা পর্যন্ত দুর্বল রয়ে গেল। কৃষ্ণ ইচ্ছে করে এই কাজটা করলো যাতে ভীম দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করে দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারে। কৃষ্ণ!! লোকে যাকে বিষ্ণুর অবতার বলে! কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে যে আমার সবচেয়ে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী! আমার সমস্ত রণকৌশল যে বিফল করেছে! কৌরবদের পরাজয়ের জন্য যে সবচেয়ে বেশি দায়ী! অর্জুন তার সখা আর ভগ্নীপতি বলে পাণ্ডবদের প্রতি তার এতো প্রেম! কিন্তু দুর্যোধনকন্যা লক্ষ্মণার সঙ্গে কৃষ্ণপুত্র শাম্বর বিবাহ হবার সুবাদে কৃষ্ণ তো দুর্যোধনেরও কুটুম্ব। তাহলে শুধু পাণ্ডবদের প্রতি কেন তার এই নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব? মহর্ষি জৈমিনির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পঞ্চপাণ্ডব ছাড়া কুরুবংশের সকলেরই মৃত্যু হবে। পাণ্ডবরা যুদ্ধজয় করেও বিজয়ী হবে না। কৃষ্ণ যদি কোনো কপট না করে তাহলে কৌরবদের সঙ্গে পাণ্ডব বংশও ধ্বংশ হবে। আর ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে সেই ধ্বংসলীলা দেখবে। কথাটা ভেবে আমার মনে বড়ো আনন্দ আর তৃপ্তিবোধ হচ্ছে। শুধু একটাই দুঃখ যে গান্ধারীর পুত্ররাও প্রতিশোধের এই ধ্বংসযজ্ঞে বলিপ্রাপ্ত হয়েছে। তাদের দুর্ভাগ্য যে তারা কুরুবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলো। আমার কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের পর এখন বড়ো ক্লান্তবোধ করছি। শুনেছি সহদেব আমাকে বধ করার জন্য পণ নিয়েছে। এসো মাদ্রীপুত্র, কাল রণক্ষেত্রে অন্তিম যুদ্ধের জন্য আমি প্রস্তুত। মৃত্যুর পর ইতিহাস হয়তো আমাকে এক কুটিল খলনায়ক হিসেবেই মনে রাখবে। তাতে কিছু আসে যায় না। বিজয়ীর রচিত ইতিহাসে পরাজিত কখনোই মহান হিসেবে বর্ণিত হয় না। হে পিতা! হে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাগণ! তোমরা স্বর্গ থেকে দেখো যে আমি তোমাদের প্রতি হওয়া চরম অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছি! পুত্র ও অনুজ ভ্রাতার কর্তব্য পালন করেছি! কিন্তু আর নয়। এবার চিরনিদ্রায় মগ্ন হতে চাই। বড় ক্লান্ত আমি, বড়ই ক্লান্ত। হে মাতা! তোমার স্নেহের আঁচল বিছিয়ে রাখো। আমি শীঘ্রই আসছি। তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোব আমি। নিরপরাধ নিশ্চিন্ত ঘুম, শেষ ঘুম!"


(সূত্রধরের প্রবেশ।)


"গান্ধাররাজ শকুনি চিরনিদ্রায় চলে গেলেও তাঁর পাশা দুটি আজও আমাদের মনে জেগে রয়েছে। মানুষের স্মৃতিতে তারা অমলিন হয়ে বেঁচে থাকবে যুগ যুগান্ত ধরে, অনন্তকাল!"


(সমাপ্ত)





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama