STORYMIRROR

Manab Mondal

Abstract Romance Inspirational

3  

Manab Mondal

Abstract Romance Inspirational

কলমকারি শাড়ি

কলমকারি শাড়ি

6 mins
230

আঁকার স্কুলে যাওয়ার ঝোঁকটা আমার বেড়েছে ।একদিকে বাবা মা , আলোচনা করছিলো ভাইএর স্কুলটা ছাড়িয়ে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করে দেবে। তাই নিজে থেকে বললাম " আমার আঁকার স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা আর নেই। "


কিন্তু যেতে হবে স্কুলে। রাজা বলছে যদি আমি ক্লাবের আঁকা প্রতিযোগিতায় নাম না দিলে, আমার আঁকার স্কুলের মাইনে ও দিয়ে দেবে । আবার জল রং ভালো তুলি কিনে দেবে। যদিও রং তুলির আমার অতো প্রয়োজন নেই। প্নেনসিল সেডে কালো সাদা ছবিই অনেক ভালো। তবে শুধু ছবিতে সবাইতো চায় রঙ আসুক। কেউ কেউ চায় জীবনেও রং আসুক।


আমার জীবনে একটু রঙের ছোঁয়া এসেছে আজকাল ।ছোটবেলা থেকেই লোভ সামলাতে শিখেছি। খেলনা দোকান দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি । কিন্তু আজ কি হয়েছে জানিনা। ঐ যে চোখ টার চাহুনি কতো কি বলে যায় আমায়। মুখে বললে হয়তো বুঝতে পারতাম না। আমার পাড়ায় আজকাল মেয়েটা প্রতিদিনই আসে।পিঁয়ারা পেরে দেবার সময় রাজার বোন জুন নামটাও বললো । মেয়েটার কিন্তু নামটাও বড় শক্ত । সব সময় ইংরেজিতে কথা বলে। ইংরেজি বুঝতে পারি লিখতে ও পারি কিন্তু বলার আত্মবিশ্বাসটা নেই। যদিও বলার ইংরেজি আর লেখার ইংরেজি মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাই আমাদের ইংরেজিটা হয়তো স্মার্ট ইংরেজি নয়, ওদের মতন। আসলে communication জন্য যে ইংরেজি ব্যবহার করা হয় তাতে ব্যকারণ থাকে না। ওগুলো ভাঙা শব্দ দিয়ে শুধু মাত্র ভাবের আদান-প্রদান করে। কিন্তু আমরা লেখার ভাষাতেই কথা বলে ফেলি।


মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি । ভালোবাসা শব্দটা আমাদের কাছে বিলাসীতা। ভালোলাগা টা বহিঃ প্রকাশ করার সাহস থাকলে ও যোগ্যতা নেই জানি।

বয়সে বড় হবার সাথে সাথে , হঠাৎই বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখছি আজকাল। হিন্দি সিনেমার প্রভাব হয়তো। অনেক পরীক্ষা করে দেখেছি, মেয়েটা টেড়া নয়। তাই আত্মবিশ্বাসী ও আমার দিকেই তাকায়। তাছাড়া জুন ও ছোট ছোট আওয়াজ মারে মানে, আড্যাম টিসিজিং যাকে বলে । ওর চোখের একটা ভাষা ছেড়ে দেন। ঠোঁটে ও তো একটা মিষ্টি হাসি আছে, সেটা বলে আমার জন্যে মেয়েটার এই আসা-যাওয়া এই পাড়ায়। সেই হাসি টাই আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আঁকার স্কুলটাও ছাড়া যাবে না। ওখানে তো আমি ওকে দেখতে পারি চোখ ভরে।


মা বলেন, আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখা ভালো নয়। তাই স্বপ্ন একটা হিসাব করেই স্বপ্নটাও দেখি আমি। মাধ্যমিক এ ভালো রেজাল্ট করার তাগিদটা কিছু দিন হলো হারিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ আমাকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াতে গেলে ভাইয়ের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াটা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে ভালোই হলো ভালোবাসা পাবার আশায় ভালো রেজাল্ট করার ইচ্ছাটা আবার জাগছে মনের ভীতরে। ঠিক করেছি উচ্চ মাধ্যমিকটা আর্টস নিয়ে পরবো তবে ইংরেজি ছাড়া ও একটা নতুন ভাষা শিখবো। কিন্তু কোন ভাষাটা শিখবো বলুন তো? ওই যে আঁকার স্কুলের মেয়েটা কথা বলে যে ভাষায় ।


কিন্তু কি ওর মাতৃভাষা। ভারত বর্ষ বৈচিত্রময় । তবে প্রত্যেক এর সংস্কৃতি র একটা নিজস্বতা আছে। সুতরাং ওর ভাষাটা কি বের করাটা তেমন মুস্কিল হবেন আমার ।কারণ আমি তো একটু মাথা খাটাতে পারি। পড়া বই সাথে গল্পের বই ও পড়তে ভালো বাসি, বিশেষ করে গোয়েন্দা গল্প । পড়াশোনার বাড়াতি খরচ চালাতে । মানে এই টেস্ট পেপার, কিছু রেফারেন্স বই কিনতে, ছুটি র দিন, মানে পূজার দিন গুলো তে মামার দোকান কাজ করি আমি। মানে সাহায্য করি আরকি তবে মামা আমাকে টাকা দেয়। আসলে মধ্যবিত্ত আমার এমনিতে কারো সাহায্য নিই না আমরা।


মামাই সমাধান করে দিলো কোন ভাষাটা শিখতে হবে আমায়। ওর মা যে শাড়িটা পরে সেটা মামা র দোকানে ও আছে। শাড়িটা নাম কলমকারি। জানেনতো শাড়ির অনেক নাম আছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শাড়ি পরে। শাড়ি দিয়ে তাই কোনো জাতের মানুষ তা বোঝা যায়।কলমকারি’ কথাটিই আসলে দুটো পারসিক শব্দের মেলবন্ধনে কলম (বা ঘলম) ও কারি (অর্থাৎ কারিগরী)। এই শিল্পে কলমের ব্যবহার হয়, তাই এর নাম কলমকারি। স্বর্ণমুখী নদীর ধারে শ্রীকালহস্তীতে কলমকারি শিল্প গড়ে উঠেছিল আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে । সম্ভাবত বিজয়নগরের তুলুভ বংশের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের (১৪৭০ – ১৫২১) রাজ্যত্বের সময়ের কথা বলছি। বালোজা নামক চুড়ি প্রস্তুতকারী গোষ্ঠী এসময় এই বিশেষ শাড়ি তৈরি র শিল্পকর্মে যুক্ত হয়ে ছিলো। যদিও আজকাল বোধহয় কলমকারি ফুটে ওঠে দুইভাবে কিছু শিল্পী হাতে আঁকেন ও কিছু শিল্পী কাঠের ব্লক করে ছাপেন। কিন্তু আগে কাজটা অতো সহজে হতো না।


আসলে মন্দির ও দেবদেবীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এই শৈলী। স্বাভাবিকভাবেই তাই এই শাড়িতে  আমরা যে ছবিগুলো দেখি তা আসলে, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা বা পুরাণের নানান ছবি। তবে ব্রিটিশ শাসনকালে সাহেবদের মন পেতে কলমকারি শিল্পীরা বেশী করে ফুল লতা পাতা আঁকতেন। ওলন্দাজদের হাত ধরে পট বা পোশাক-আশাক ছাড়িয়ে বিছানার চাদর, পর্দার কাপড় রাঙানো হতে থাকে কলমকারির ধাঁচে।


 কলমকারি আসলে অন্ধ্রপ্রদেশের একটি বহু প্রাচীন শিল্প। একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে যেটুকু দেখাছি , এখানে রেখার ব্যবহার করা হয়েছে তাতে বক্ররেখা ব্যবহার বেশি।প্রাকৃতিক রং দিয়ে, সরু তুলির সাহায্যে অন্ধ্রের শিল্পীরা কাপড়ের উপর ফুটিয়ে তোলন রামায়ণ-মহাভারতের গল্প।কিন্তু এটি করতে প্রচুর সময় লাগে এবং আঁকা হয়ে যাওয়ার পর নদীর বয়ে যাওয়া জলে তা ধুয়ে রং পাকা করতে হয় এ শাড়ির।


শুনুনলাম প্রথমে যে কাপড়টিতে কাজ করা হবে সেটি এক ঘণ্টা গরু বা মোষের দুধে ভেজানো হয় যাতে কাপড়ে রঙ না ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বাঁশ ও খেজুরের কঞ্চির গায়ে সুতির কাপড় জড়িয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে কলম তৈরি করা হয়। তারপর, কালো আউটলাইন আঁকা হয়। এই কালো রঙ তৈরি করা হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। লৌহচূর্ণ দিয়ে, আখের গুড়, খেজুর গুড় জলে গুলে দশদিন ধরে পচিয়ে রাখা হয়।  তারপর সেই মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে কলম দিয়ে আঁকা হয় রেখা। কখনো তেঁতুলের কাণ্ড ও কয়লা মিশিয়ে খসড়া আঁকার কালো রঙ তৈরি হয়। আবার এই কালোরঙটি দীর্ঘস্থায়ী করা হয় মাইরোবালান ফুল (স্থানীয় ভাষায় কারাকাপুড্ডু) ও কুঁড়ির (কোরাকাপিণ্ডে) সাহায্যে নেওয়া হয়। এরপর রঙ ভরার হয় প্রথমে হাল্কা হলুদ, তারপর গাঢ় হলুদ, লাল, সবুজ, গোলাপী ও সবশেষে নীল রঙ লাগাবার পালা। সবগুলি রঙ কিন্তু ভেষজ — নানান ফল, ফুল, লতা, পাতা থেকে সংগ্রহ করা। যেমন হাল্কা হলুদ তৈরি হয় বেদানার খোসা থেকে। আবারহলুদ তৈরী হয় মাইরোবালান ফুল ও এ্যালাম গুঁড়ো করে জলে ফুটিয়ে। চাতালাকোড়ি বা সুরুদুচেক্কা মূল থেকেলাল রঙ তৈরি হয়। মাইরোবালান ফুল, কাসিমকারান ও এ্যালাম মিশিয়ে সবুজ রঙ তৈরি হয়। গোলাপী রঙ চাডালাকোড়ি মূল থেকে বানানো হয়। নীল রঙ হয় তুঁত থেকে। খুব উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করলেও শেষে কিন্তু আমরা দেখি অদ্ভূত কমনীয় একটা ম্যাট ফিনিশ।এক একটি সূক্ষ্ম ছবি করতে তাই নয়-দশ মাসও লেগে যেতে পারে বলল মামা।


কলমকারি শাড়ি সম্পর্কে এতোকিছু জানার আগ্রহ দেখে মামা অবাক হচ্ছিলো। তার উপর কেস খাওয়ালো আমাকে জুনরা । ওকে নিয়ে মামার দোকানে হাজির।টিফিনের পয়সা জমিয়ে কলমকারি প্রিন্টের শাড়ি কিনতে।মোটামুটিভাবে লাভ ছাড়াই শাড়ি টা বিক্রি করতে বাধ্য করালাম মামাকে। তবু ও ওর পছন্দের শাড়িটা নিতে পারলো না।


দোকান থেকে বেড়াবার সময় একটি প্যেকেট দিয়ে বললো এটা তোর বোনাস। আমি বললাম" কি আছে এতে"

মামা বললো " এটা তোর উনি কে দিয়ে দিবি।"


আমি বললাম " না সেটা হয় না , জীবনে মাকে শাড়ি কিনে দিতে পারলাম না আর ,,," কথা শেষ না হতে হতে মামা বললো " ওরে পাকা বুড়ো তোর মায়ের জন্যে ও একটা তাঁতের শাড়ি আছে।" খুশি তে মনে হাজার বসন্ত এসে হাজির হলো।


অনেক রিহার্সাল করেও কথা বলতে গিয়ে যেনো আমি কোষ্ঠকাঠিন্য এর রুগী হয়ে গেলাম। ওর থেকে অনেক প্রশয় পেয়েও কয়েকটি কথা বলতে হাজার বার হোঁচট খেতে হলো আমায়। শেষ মেষ আমার এবড়ো খেবড়ো ইংলিশ এ বললাম" ইউ আর মাই লাকি কাস্টোমার। তাই ডিইস ইস ইয়োর গিফট।"


জুন বলল" চালাকি হচ্ছে। এতো বছর তোদের দোকানে আমরা জামা কাপড় কিনি ।কৈ আমরাতো লাকি কাস্টোমার হলাম না।"

তার পর ফিস ফিস করে ওরা কি একটা আলোচনা করলো।


জুন হাসতে হাসতে বললো "ঠিক আছে ও ওটা নেবে। এবং পড়বেও অষ্টমীর দিন। কিন্তু তুইও থাকবি। কারণ ও ভয়ঙ্কর বাংলা শিখেছে। তুই ওর ভয়ঙ্কর বাংলা কথা গুলো শুনবি । ও কি একটা বলবে তোকে।"


শেষ মেষ অষ্টমী এলো। সংস্কৃত পরীক্ষা দিতে গেলে ,যেমন টেনশন হয় সেরকম টেনশন আসলে সংস্কৃত আমার কোন কাজে আসবে না বলেই পড়িনা কোনদিন। কিন্তু পরীক্ষা র সময় বিপদে পড়ে যাই। যাইহোক অঞ্জলী শেষ একটা পার্কে এসে পোঁছাতে ও বলল" শোনেন তুইকে আমি ভালোবাসি। আপনি কি আমায় ভালোবাসো?"


আমি কি বলবো হৃদয়ে লাড্ডু ফুটিল, পেটে এটোম বোম। জরিয়ে ধরে বললাম " 100% আমার তাঁতের শাড়িতে কলমকারি প্রিন্ট।"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract