জোড়া খুনের রহস্য(তৃতীয় পর্ব)
জোড়া খুনের রহস্য(তৃতীয় পর্ব)


পরদিন পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গেলো, রমলা মাসিমাকে শ্বাস রোধ করে খুন করা হয়েছে। আর তন্নি অত ওপর থেকে পড়ে মাথায় ও মেরুদন্ডে আঘাত পেয়ে মারা গেছে। সময় প্রায় একই দেখাচ্ছে। তন্নি সাড়ে পাঁচটায় ছাদে যেত এখানে থাকলে, এটা এখানে সবাই জানত। এখন খুনি হয় আগে মাসিমাকে মেরে ছাদে গেছিল, নয় আগে ছাদে গিয়ে তন্নিকে ফেলে দিয়ে তারপর ঘরে গিয়ে মাসিমাকে মেরেছে। এখন প্রশ্ন ঘরে কি বেল বাজিয়ে ঢুকেছিল ? অত সকালে যদি বেল ও বাজায়, মাসিমা চেনা লোক ছাড়া দরজা খুলতো না। দরজা খুলেছিল মানে চেনা কেউ ৷ মাসিমা ডিভানে বসেছিল, আগন্তুক কুশন দিয়ে মুখ চেপে ধরেছিল। ওদের ছোট ওয়ান 'বি-এইচ-কে' ফ্ল্যাট, তন্নি আর মাসিমা বেডরুমেই শুতো। ডিভানে মাসিমা এসে বসেছিলেন মানে ঘুম থেকে উঠে গেছিলেন। তন্নি দরজা খুলেই ঢুকত রোজ। হয়তো দরজার আওয়াজে মাসিমা ভেবেছে তন্নি ফিরল। তখনি খুনি কুশন দিয়ে মুখটা চেপে ধরেছে।
সোসাইটিটা কেমন থমথম করচে। 'পিএনপিসিও' চলছে। যাদবদার বৌ আর মিসেস আগরওয়াল তো মেহুলকেই সন্দেহ করছেন। সাহানাকে ডেকে ওনারা বলেছিল মেহুলের ব্যাপারে খোঁজ নিতে।
পরদিন সকালে চা খেতে খেতে আলোক বলে, -" খুনি আগে তন্নিকে মেরেছে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘরে এসেছিল।"
সাহানা ভ্রু কুঁঁচকে তাকায়।
-"প্রথম দিন ঘরের মেঝেতে স্টোন চিপস্ আর সিমেন্টের গুঁড়ো পেয়েছিলাম যা পরীক্ষা করে দেখেছি ছাদের । তার মানে যখন তন্নি নিচে পড়ে যায় খুনি তখন ওদের ঘরে এসে রমলা মাসিমাকে খুন করে। সিঁড়িতেও ঐ গুঁড়ো ছিল।" আলোক বলে৷
-"বক্সিদার সাথে ওর অফিসে যাবো আজ। যে চারটি মেয়ে সেদিন ওর সাথে ডিউটি করেছিল তাদের সাথে কথা বলব। যদি কিছু জানা যায়।"
চা শেষ করে বেরিয়ে যায় আলোক।
একটু পরেই মিসেস গুপ্তা আর যাদবদার বৌ এলো। ওরা দুধওয়ালা, ফুলওয়ালা, পেপার বিক্রেতার কথা বলল। এরা অনেক সময় টাকা ধার চাইত। মাসিমা দিয়েও দিতেন। সে সব কারনে যদি কেউ......। মেহুলের কথাও ওনারা তুলছিল বারবার। সাহানা ওদের কল্পনা প্রবনতা দেখে মনে মনে হাসলেও সবকটা কথাই মাথায় রাখছিল। গুপ্তা ভাবী কিচেনে এসে চুপিচুপি বললেন যাদবদার বৌ ও দশ হাজার ধার নিয়েছিল মাসিমার থেকে কদিন আগেই। তবে ও যে খবরটা দিল এটা বলতে বারণ করল সাহানাকে।
সন্ধ্যায় আলোককে বেশ খোস মেজাজে পাওয়া গেলো। ও আজ বক্সিদার সাথে অনেক জায়গা ঘুরে এসেছে। সাহানা জানে প্রশ্ন করে লাভ নেই। শুধু অনেকের সন্দেহ যে দুধ, ফুল বা পেপার বিক্রেতার দিকে সেটা বলে দিলো একবার। যাদবদার বৌএর টাকা ধারের কথাটাও বলল।
আলোক হেসে বলল -"দশ হাজারের জন্য দুটো খুন করার মত মানসিকতা যাদবদার বৌয়ের নেই। এটা যে করতে পারে সে একজন শক্ত অপরাধী।"
একটু পরে বেলের আওয়াজে দরজা খুলেই সাহানা দেখে মেহুল এসেছে। আলোক বোধহয় ওর অপেক্ষাতেই ছিল। টিভিটা অফ্ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, -"পুলিশকে যেটা বলনি আমায় বলতে পারো।আমি হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারবো।"
মেহুল চারপাশটা দেখে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। সাহানা জানে এটা ভাইটাল সময়, ও কফি করে এনে দেয়। এতক্ষণ মেহুল কিছুই বলেনি।
আলোক আবার বলে, -"একটা আলাদা সিম্ থেকে 'মিসকল' যে তুমিই দিতে আমরা জেনেছি।"
সবে কফির মগটা তুলেছিল মেহুল। চুমুক না দিয়ে নামিয়ে রাখে। বলে, -" আমি..... মানে ...
তন্নিকে..... কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কিছু করি নি।"
-"তুমি যা বলতে চাও খুলে বলো। নাহলে ফেঁসে যাবে। " আলোক একটু কঠোর গলায় বলে।
-"ওকে ভালো লাগত। রোজ দেখতাম। কথা বলতে সাহস পাই নি। তাই 'মিসকল' দিতাম। কথা বলিনি কখনো। " চোখ নামিয়ে নেয় মেহুল।
-"ওদের দিদা নাতনীর মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়েছিল ? " আলোক ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
-"কক্ষনো না। সেদিন রাতে ফেরার পর ওরা গল্প করেছিলো, সব কথা তো শোনা যায় না পরিস্কার, আবিরা বৌদির নামটা শুনেছি। একবার কথা বলতে বলতে তন্নি বারান্দায় এসেছিল। কিছু কাপড় মেলছিল। তখন বলল 'কালকেই আবিরা বৌদিকে জিজ্ঞেস করবো আমি .....' । আর তেমন কিছু শুনি নি। আমার মর্নিং ডিউটি, সাতটায় গাড়ি আসে। ভোরে উঠে যাই। দরজার আওয়াজে ওকে ছাদে যেতেও দেখেছি আই হোল দিয়ে। একটু পরে বোধহয় দুধ এলো। কারণ ওদের ঘরে বেল বাজলে আমার ড্রইং রুমে শোনা যায়। তারপর আমি পেপার নিতে দরজা খুলে মাসিমাকে পেপার আর ফুলের প্যাকেট নিতে দেখেছি। এরপর আমি টয়লেটে থাকা কালিন একটা হাল্কা আওয়াজ পাই, শিওর না, জল খোলা ছিল।তার পাঁচ মিনিটের ভেতর ওদের ঘরের বেল আবার বেজেছিল। আমি তখন দাড়ি কাটছি। ঘড়িতে ছটা সাত। ভাবলাম তন্নি আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলো! আই হোলে চোখ দিতেই দেখলাম তন্নি নয়, অন্য কেউ ওদের ঘরে ঢুকছে। কিন্তু পেছন থেকে বুঝতে পারিনি কে। নেভি ব্লু প্যান্ট অথবা কালো। আসলে তন্নি নয় দেখে মাথা ঘামাই নি। নিচেও একটা হাল্কা চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। তাই আবার দাড়ি কাটায় মন দিয়েছিলাম। ওদিকে নিচের গুঞ্জন কোলাহলে পরিনত হচ্ছে দেখে বারান্দায় গেলাম। সবাই উল্টো দিকে যাচ্ছে দেখে বুঝলাম কিছু হয়েছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে নিচে নেমে আসি আমিও। সেদিন আর অফিস যেতেই পারিনি এসব দেখে।"
মেহুল একটানা কথা গুলো বলে থামল। সাহানা পুরোটাই ওর অলক্ষ্যে রেকর্ড করে নিয়েছে। আলোক বলল-" তারমানে তুমি খুনিকে ঢুকতে দেখেছো। এটা একটা ভাইটাল পয়েন্ট। খুনি বেল বাজিয়ে ঢুকেছে। দুধ, ফুল, পেপার আসার পর ঢুকেছে। এবং তন্নিকে মেরে ফেলার পর ঢুকেছে। আপাতত তুমি সাবধানে থেকো। খুনি কিন্তু ডেয়ার ডেভিল। কথা গুলো কাউকে বলো না আর।"
-"কেন মেয়েটাকে এভাবে ফেলে দিল? মাসিমাকেই বা মরতে হল কেন?" মেহুল প্রশ্ন করে।
-"বলব, সব বলব, আর একটু অপেক্ষা করো।কাল সকালে একটা ঘরোয়া সভা হবে ওদের স্মৃতিতে, সেখানে এসো। " আলোক বলে।
আলোক নিজেই বিল্ডিং এর সবার ঘরে ঘুরে ঘুরে সভার কথা বলে আসে। ও সবাইকে বলেছে এবার খুনি ধরা পড়বে। কেউ একজন খুনিকে দেখেছে। নামটা বলা হবে না আপাতত। তবে এই বিল্ডিংয়েই সে থাকে। তারপর বক্সিকে ফোন করে প্রচুর আলোচনা করে। ব্রজেন বাবুর মন্ত্রী মহলে পরিচিতি রয়েছে। তাই চাপ আসছিল। সবার কাজ আছে। শহরের বাইরে যেতে হবে অনেককেই। রোহিত আর যাদবদা সেদিন বিকেলেই ট্যুরে যাবে বলে দিয়েছিল।
রাতে সাহানা আলোককে বলে,'' স্কাই ওয়াক থাকায় আপাতত তিনটে ব্লক জুড়ে আছে। অন্য ব্লক থেকে ঐ পথে এসে যদি কেউ কাজটা করে থাকে! শুধু এই বিল্ডিং কেন ? তিনটে বিল্ডিং এর লোককেই সন্দেহ তালিকায় রাখা উচিত৷''আলোকের একটা ফোন এসেছিল । ও বলে, -"মেমরী কার্ডটার সব ফটো পেন ড্রাইভে নিয়ে আসুন। "
-"হ্যা, শেষের ফটো গুলোই....."
-"হোয়াটস-আ্যপের কনভারসেশন টাও......"
ফোনটা রেখে সাহানাকে বলে, -" অন্য বিল্ডিং এর লোক অত ভোরে এসে বেল দিলে মাসিমা কি দরজা খুলত? উনি খুব একটা বার হতেন না, ঐ সাত তলা ছাড়া আমাদের ঘরেও বড় একটা আসেননি কখনো। তাই ওনার পরিচিত মানে এই বিল্ডিং এর লোক।"
সাহানা বলে -"তুমি জেনে গেছো তাহলে....."
-"জেনেছি, কিন্তু প্রমান নেই। সেটাই তৈরি করছি এবার। তুমি শুয়ে পড়ো৷"রাত দশটায় আলোক ফোন পেয়ে বেরিয়ে গেলো। সাহানাকে বলেছে কোনো পরিস্থিতিতেই দরজা খুলতে না। ও ফিরে ফোন করলেই যেন দরজা খোলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সাহানা আলোককে আর দেখতে পায় না। তবে কি ছাদে গেলো ? একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যায় সাহানার। মাঝ রাতের দিকে তুমুল চেঁঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে সাহানার। সাততলাতেই হচ্ছে চিৎকার। আলোককে ফোন করলেও ধরে না আলোক। সাহানার প্রতিটা মুহূর্ত কে ঘন্টা মনে হচ্ছে।(চলবে)