জোড়া খুনের রহস্য(প্রথম পর্ব)
জোড়া খুনের রহস্য(প্রথম পর্ব)
বেডরুমের ভারী পর্দার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক মিষ্টি রোদ এসে বিছানায় পড়েছিল। সাহানা আবার বরাবর একটু দেরিতে ওঠে। সকালের এই ঘুমটা ও এনজয় করে। আলোক অবশ্য শীত গ্রীষ্ম বারো মাস ভোর পৌনে পাঁচটায় ওঠে। পনেরো মিনিটে রেডি হয়ে জগিং করতে চলে যায়। পুরো ক্যাম্পাসের দশটা চক্কর কেটে ও মাঠে নামে। কখনো ফ্রি হ্যান্ড, ব্যায়াম আবার কখনো ফুটবল খেলে। সাড়ে ছটায় ঢোকে জিমে। আধ ঘন্টা মত ওয়ার্ক আউট। এটা ওর বরাবরের রুটিন্। সোওয়া সাতটায় ওর বেলের আওয়াজে সাহানার ঘুম ভাঙ্গে।
ফ্রেশ হয়ে দু কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে ওরা ব্যালকনিতে বসে। আলোক খবর কাগজটা ভালো করে পড়ে। সাড়ে আটটার পর বাজার যায়। প্রতিদিন প্রায় একই নিয়মে দিনের শুরু হয়।
ছোট কুশনটা চোখের উপর চেপে ধরে সাহানা পাশ ফেরে। এই সময়ের ঘুমটা বড্ড আরামের। প্রথম প্রথম কয়েকদিন আলোক চেষ্টা করেছিল ওকেও সঙ্গী করার। কিন্তু সাহানা ঘুম ছেড়ে ওসব করতে রাজি নয়। তাই আলোক হাল ছেড়ে দিয়েছে। সাহানা অবশ্য নিয়ম করে বিকেলে জিম করে। ওদের সোসাইটির পুলে সাঁতার কাটে গরমে।
ঘুমের মধ্যেও সাহানার হঠাৎ মনে হল কেমন একটা চাপা গুঞ্জন কানে আসছে। পাঁচ তলায় এত সকালে এমন গুঞ্জন তো শোনা যায় না। খোলা জানালা দিয়ে একটা চিৎকার চেঁচামেচির রেশ আসছে নিচ থেকে, বাড়ছে ধীরে ধীরে। একটা অস্বস্তি নিয়ে ও উঠে পরে বিছানা ছেড়ে। জানালা দিয়ে দেখে অনেকেই নিচে জড়ো হয়েছে। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে দেখে সবাই তাদের বিল্ডিং এর পেছনে ছুটছে। ওধারেও একটা ড্রাই ব্যালকনি আছে। সাহানা কিচেনের দরজা খুলে ওধারে যায়। আলোক খুব ব্যস্ত হয়ে ফোনে কথা বলছে। প্রচুর লোক জমে গেছে। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের দত্তদা, ঘোষ বাবু, সবাই নেমে গেছেন।
একটা জটলার ফাঁকে হঠাৎ দুটো কালো প্যান্ট পরা পা দেখতে পায় সে। একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াতেই ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। সাহানা তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে নেমে আসে। পিছনে আসতে আসতেই শুনতে পায় সাত তলার তন্নি আত্মহত্যা করেছে, ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে বলছে সবাই।
তন্নি সাত তলায় ওর দিদার ফ্ল্যাটে থাকত। শিলচরের মেয়ে। এয়ার হোষ্টেসের চাকরী করতো জেট এয়ার ওয়েজে। খুব হাসি খুশি উচ্ছল ছিল। ছয় মাস হবে এখানে আছে। সাহানা গিয়ে দেখে মেয়েটা কেমন একটা এঁকে বেঁকে পড়ে রয়েছে, মাথাটা থেঁতলে গেছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
আলোক পুলিশ অফিসার বক্সিকে হাত নেড়ে কি বুঝিয়ে বলছিল। সাহানা উপরে তাকায়, দশ তলা টাওয়ারের প্রত্যেকটার সাথে প্রত্যেকটাকে স্কাই ওয়াক দিয়ে জোড়ার কাজ চলছে। ওদের বিল্ডিং এর ছাদের দেওয়াল ভেঙ্গে স্কাই ওয়াক এর কাজ শেষ প্রায়। রেলিং এর কাজ হচ্ছিল। ছাদে এসব কাজ হচ্ছে বলে তালা দেওয়া থাকত। কোনো বাচ্চা যাতে ছাদে চলে না যায় তার জন্য সতর্কতা আর কি। তবুও কেউ কেউ মর্নিং ওয়াক করতে বা কাপড় মেলতে ছাদে যেত। তন্নিও মর্নিং ওয়াক করত ছাদে। আসলে বড় বড় ছাদ গুলো গাছ পালা ঘাস দিয়ে সাজানো, অনেকেই নিচে না গিয়ে ছাদে আসতো।
মেয়েটা যে ভাবে পড়ে রয়েছে সেটা দেখা সাহানার মনে প্রশ্ন জাগে হত্যা নাকি আত্মহত্যা!! কানে হেড ফোন গোঁজা দেখে অনেক রকম সম্ভাবনাই মাথায় আসে। দু একজন তো' ব্লু হোয়েলের' কথাও আলোচনা করছিল। কিন্তু সাহানার অভিজ্ঞ চোখ ওর হাতে কোনো তিমির ট্যাটু দেখতে পায়নি। তাছাড়া মেয়েটা ভালো চাকরী করত। মিশুকে ছিল। ও ঐ সব গেম খেলবে মনে হয় না।
আলোক আর অফিসার বক্সিদা এক পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছিল কিছু। ফরেন্সিকের লোক এসে গেছে। সাহানা যা শুনলো আলোকের সাথে অনেকেই সকালে জগিং করছিল, একটা চিৎকার আর ধুপ্ করে কিছু পড়ার শব্দ শুনে কয়েকজন ছুটে এসেছিল এদিকে। তন্নির শরীরটা দু বার কেঁপে স্থির হয়ে যেতে দেখেছে তারা। হাতের মোবাইল ছিটকে পড়ে টুকরো হয়ে গেছে। কানে হেড ফোন তখনো লাগানো। ও বাড়িতে থাকলে ছাদেই জগিং করতো রোজ।
হঠাৎ সাহানার খেয়াল হয় তন্নির দিদা রমলা মাসিমাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। উনি তো ভোরেই ওঠেন। রমলা মাসিমা এমনিতে শক্ত সমর্থ, একাই থাকতেন ছোট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। কয়েক মাস ধরে নাতনী এসে রয়েছে এখানে। সাততলার বিনা বৌদি আর আবিরা দাঁড়িয়ে ছিল। ছ তলার গুপ্তা ভাবী আর মিসেস যাদব হাত নেড়ে কত কি বলছে। ওদের সাথেই সাহানা উঠে এলো উপরে। ঘড়িতে ছটা পঞ্চাশ। 7D ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন কেউ দরজা খুললো না, হাল্কা ঠেলে দেখা গেলো ভেতর থেকে লক্। বার দুই বেল বাজিয়ে ওরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। এবারেও কোনো কাজ হলো না। আবিরা বলল -"মাসিমা ছটার মধ্যে উঠে যায় কিন্তু। "
আরো কয়েকবার দরজা ধাক্কিয়ে ওরা যখন চিন্তিত, বাধ্য হয়ে আলোককে ফোন করল সাহানা।
একটু পরে পুলিশ এসে দরজা ভাঙ্গলো। সবাই দেখলো রমলা দেবী ডিভানের উপর চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছেন। হাত দুটো কেমন অসহায়ের মতো ঝুলছে। পাটা মাটিতে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।আলোক আর বক্সিদা ভালো করে দেখে বলল বালিশ বা কুশন দিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা। আবার নানারকম গুঞ্জন উঠল, তবে কি তন্নি দিদাকে মেরে ছাদে গিয়ে আত্মহত্যা করলো!নাকি ওনাকে মেরে কেউ তন্নিকেও ঠেলে ফেলে দিল!!
ওনার একমাত্র মেয়ে জামাই অর্থাৎ তন্নির বাবা মাকে শিলচরে খবর দেওয়া হলো। ফ্ল্যাটের সব কিছু ভালো করে লক্ষ্য করছিল আলোক। সেন্টার টেবিলে খবর কাগজ আর দুধের প্যাকেট। ছোট্ট ঠাকুরের আসনের সামনে ফুলের প্যাকেট !! অগোছালো বেডরুম, শুকনো কিচেন। ড্রইং রুমের মেঝেতে কিছু একটা পেয়ে আস্তে করে তুলে নিয়ে চট করে বাইরে চলে গেলো আলোক। সাহানা খেয়াল করছিল ওকে। সব কিছু দেখে পুলিশ ফ্ল্যাট সিল করে ছাদ তালা দিয়ে চলে গেলো আপাতত। সাড়ে দশটায় আলোক ঘরে এলো।
সাহানা আজ ব্রেকফাষ্ট বানায়নি। দুধ, কর্নফ্লেক্স নিয়ে দুজনেই ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসেছিলো। আলোক অনেক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, -" তোমার সাথে পরিচয় ছিলো মেয়েটার ?"
-"আলাপ ছিল। জিমেও দেখা হতো কখনো। আবিরার সাথে ভালো আলাপ ছিল। ওদের তো মুখোমুখি ফ্ল্যাট।"
-"কি কারণে দুজনকেই মরতে হল এটাই ভাবাচ্ছে!!"
-"এটা খুন বলছো ?"
-"মাসিমাকে তো কেউ মেরেছে সিওর। এখন যদি মেয়েটা মেরে থাকে আর সেই দুঃখে নিজেও .... কিন্তু আমি মানতে পারছি না। কানে হেডফোন গুঁজে কেউ লাফায় কি ?"
-"এতো সকালে কে ওকে ধাক্কা দিলো ?" সাহানা চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে।
-"যে জানত ও সকালে ছাদে যায় জগিং করতে। "
আলোক একটু পরেই বেরিয়ে গেলো। সাহানার আজ রান্নায় মন নেই। রাতের চিকেনটা গরম করে রাখলো। একটু ভাত আর ডাল করে নিলো। পাঁপড় পুড়িয়ে নেবে খাবার সময়। সাড়ে বারোটায় আবিরার ফ্ল্যাটে গেলো। ওর সাথে তন্নির বন্ধুত্ব ছিল।(চলবে)