Manasi Ganguli

Tragedy

3  

Manasi Ganguli

Tragedy

ঝরা গোলাপ

ঝরা গোলাপ

6 mins
560


  বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' বইটা হাতে নিয়ে খুলতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ল লাল গোলাপের কিছু শুকনো পাপড়ি অহনার কোলের ওপর। সেইদিকে তাকিয়ে অহনা ফিরে গেল তার স্কুলের দিনগুলিতে। কিছু পাপড়ি হাতে তুলে নিয়ে অহনা গালে ছোঁয়ালো পরম মমতায়,যেন তাতে আজও সে দীপকের স্পর্শ অনুভব করল। তখন বোধহয় ওর ১৫বছর বয়স,একই সঙ্গে কেমিস্ট্রির টিউশন নিত দীপকও অভয়বাবুর কাছে। পড়ার ফাঁকে পাশাপাশি বসে খুনসুটি দিয়ে শুরু,পেন কেড়ে নেওয়া,খাতা উল্টে দেওয়া,চিমটি কাটা(যেন 'একটুকু ছোঁয়া লাগে'),স্যারের কাছে নালিশ,তবু সেটা প্রেমে পরিণত হতে সময় লাগেনি বেশিদিন। অভয়বাবুর চোখেও পড়ত কিছু কিছু। ওদের রকমসকম দেখে হাসতেন মনে মনে,যদিও গাম্ভীর্য ধরে রাখতেন মুখে। অন্য ছেলেমেয়েরাও মজা পেত খুব এতে। টিউশন শেষে বেরিয়েও ওরা জটলা পাকাতো সবাই। অহনা আর দীপকের পিছনেও লাগত সবাই খুব। এভাবেই টিউশনের দিনগুলো এগিয়ে চলতে চলতে বছর ঘুরতে চলল। ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার আর কটাদিন বাকি,টিউশন বন্ধ,কেবল প্রয়োজনে স্যারের বাড়ি যাওয়া। ৬ই ফেব্রুয়ারী দীপক অহনার বাড়িতে খবর দিল,"স্যার কাল সন্ধ্যে ৬টায় যেতে বলেছেন ডাউটস ক্লিয়ার করার জন্য,দেখে রাখিস।" অহনা সারাদিন কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে থাকল,নোট করে নিল যা জানবার আছে ওর। পায়ে হেঁটেই পড়তে যেত অহনা,মিনিট ১০সময় লাগত তাতে। সেইমত ৫.৩০টায় বেরলো ও বাড়ি থেকে। দিনটা যদিও একটু বড় হয়েছে তখন,তাও সূর্য অস্ত গেছে বেশ কিছু আগে,পশ্চিম আকাশ লালে লাল,পূবেও তার কিছু প্রতিফলন। অহনার খুব ভাল লাগছে। পরীক্ষা সামনে বলে মায়ের কথায় জ্যাকেট, মাফলার সব নিতে হয়েছে,খানিক হাঁটার পরই গরম ধরে গেছে,যদিও বেশ একটা মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। মাফলারটা খুলে ব্যাগে ঢোকাবার জন্য দাঁড়িয়েছে কেবল ,হঠাৎ দেখে সামনে দীপক সাইকেল নিয়ে। চমকে ওঠে অহনা,"কি রে তুই এই পথে? মাটি ফুঁড়ে উঠলি নাকি?" "তোর জন্য", দীপকের জবাবে অবাক অহনা। " মানে? কেন? আমি তো যাচ্ছিলামই স্যারের বাড়ি"। জবাব না দিয়ে দীপক বলল, "এদিকে আয়"। অহনা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে দীপককে অনুসরণ করল। একটু নিরিবিলি একটা গলির মধ্যে ঢুকতেই অহনা প্রায় হৈহৈ করে উঠল,"ওদিকে কি আছে,ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?" দীপক দাঁড়িয়ে পড়ে অহনার হাতটা চেপে ধরল,"চ্যাঁচাস না,আজ স্যার পড়াবেন না,তোকে আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম।" অহনা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে দীপকের দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীপক সাইকেলে স্ট্যান্ড দিয়ে রেখে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে,একটা আধফুটন্ত টকটকে লাল গোলাপ ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে,"হ্যাপি রোজ ডে"। অহনা হাত বাড়িয়ে গোলাপটা নিয়ে দীপকের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে,মুখে তার রা-টি নেই। দিনের আলো ফুরিয়ে গেছে,আবছা চোখ সওয়া আলোয় দুজনে কেবল দুজনের চোখদুটোই দেখতে পাচ্ছে,বাকী আর কিছুই তখন দৃশ্যমান নয়। এক আবেশের মধ্যে রয়েছে যেন ওরা। আঁধার ঘোর হচ্ছে,অনেকদূরের একটা লাইটপোস্টের টিমটিমে আলোয় দুজনের অস্তিত্বটুকুই কেবল টের পাচ্ছে ওরা। মৃদুমন্দ হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো যেমন দুলতে দুলতে গায়ে গায়ে ঘষাঘষি লাগছে,ঝিরিঝিরি,তিরতির আওয়াজে তা বোঝা যাচ্ছে,তেমনি মাঝে মাঝে ওদেরও গায়ে গায়ে ছোঁয়া লাগায় অহনা শিউরে উঠছিল। প্রথম প্রেমের পরশ,প্রথম পুরুষ পরশ,এক স্বর্গীয় ভাললাগায় আচ্ছন্ন তখন ও,হয়তোবা দীপকও। কতক্ষণ এভাবে ছিল ওরা তার হিসাব নেই ওদের দু'জনের কাছেই। এক বাইকের আলোয় ওদের দুজনের ঘোর কাটল। দীপক জিজ্ঞাসা করল," কি রে,খুশি তো?" অহনা, "ধ্যাৎ" বলে ওকে একটা চিমটি কাটল। দীপক এবার অহনাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে কিছুক্ষণ নির্জন,অচেনা রাস্তা দিয়ে ঘুরতে লাগল। দুজনে আজ দুজনের সান্নিধ্যটুকু উপভোগ করছে ভীষণভাবে। সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরা দীপকের হাতদুটো অহনার গা ছুঁয়ে আছে,খুব ভাল লাগছে ওর। দীপকও যেন একটু ইচ্ছাকৃত ওর গায়ে হাতদুটো ঠেকিয়ে রেখেছে। তারুণ্যের উদ্দাম ভালবাসা তখন লাগামছাড়া,কারও মুখে কথা নেই কেবলই অনুভব। নীরবতা ভঙ্গ করে দীপকই,"চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি,অনেকক্ষণ হল,কাকীমা চিন্তা করবেন। দেরী দেখে আবার স্যারকে ফোন করে না বসেন।" অহনার এতক্ষণে সম্বিত ফিরল, "হুম,ঠিকই,তবে তোকে যেতে হবে না, আমি একাই চলে যাবো।" প্রেমের স্বীকৃতি পেয়ে দীপক এই অল্প সময়ের মধ্যেই যেন অহনার গার্জেন হয়ে উঠেছে,"না,এদিকটা নির্জন,অন্ধকার,তোকে আমি একা যেতে দেবো না।" বেশ লাগে অহনার দীপকের এই কর্তৃত্ব,বলে,"বেশ,আমাদের গলির বাইরে নামিয়ে দিস তাহলে।" "একসপ্তা রোজ এইখানে,এইসময়ে আমরা দেখা করব, ভ্যালেন্টাইন্স ডে পর্যন্ত, আসবি তো?" অহনা একগাল হেসে দীপকের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে,"আসব,আসব"। বাড়ি ফিরে এক ঘোরের মধ্যে থাকে অহনা,তার পৃথিবী তখন দীপকময়। পড়াশুনোয় মন বসাতে পারছে না,বইয়ের সমস্ত পাতায় তখন সে দীপকের মুখ ভেসে উঠতে দেখছে। কটাদিন ঘোরের মধ্যে কাটল ওদের, সবকটাদিন যথাযথ পালন করে ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে ওরা শপথ নিল,মন দিয়ে পড়ে ভাল রেজাল্ট করবে,সেটাই হবে দুজনের দুজনকে দেওয়া সেরা উপহার।

   বরাবরই ভাল ছাত্রী অহনা। স্কুলে পরীক্ষায় প্রথম দিকেই তার পজিশন থাকে বরাবর। সেই সূত্রেই 'আনন্দমঠ' বইটি তার প্রাইজ হিসাবে পাওয়া। আরো অনেক প্রাইজের বই আছে তার।কয়েকবছর আগে তার মা তার সব জিনিসপত্র তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাবা-মার একমাত্র সন্তান অহনা। বাবা মারা যাবার পর মা আর কোনো কিছুর দায়িত্ব নিতে চাননি। অহনাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। আজ মাও নেই। আজ সে বড় একা। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,ছেলে বাইরে চাকরীক্ষেত্রে,যদিও বিয়ে হয়নি তার। তিনমাস হল রজত,অহনার স্বামী মারা গেছেন। তাই সে আজ একা,ভীষণই একা। অখন্ড অবসর তার,যা তাকে গিলতে বসেছে। একেকটা মিনিটও তার কাছে বড় দীর্ঘ,কিছুতেই তাকে অতিক্রম করে উঠতে যেন আর পারে না অহনা। বই পড়ার পুরনো অভ্যাসটাকে নতুন করে ঝালিয়ে নিয়ে কিছু সময় রোজ বইয়ের সাথেই কাটায় সে। আজ পুরনো বইগুলো নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে আনন্দমঠ বইটা হাতে নিতেই যখন গোলাপ পাপড়িগুলো ঝরে পড়ল,অহনা স্মৃতির পাতা খুলে চলে গেলো অনেক পিছনের দিনগুলিতে। যে দিনগুলি ছিল বড় মধুর,আনন্দময়। 

     স্কুলে পড়ার সময়,ক্লাস-৯ এ কোচিংএ পড়তে যাওয়ার সময় যে ভালবাসার সূত্রপাত হয়েছিল দীপকের সাথে তা গভীরতা পায় যখন ওরা কলেজে যায়। একই কলেজ,দুজনেই কেমিষ্ট্রি তাই প্রায় সব সময়ই একসাথে আর তখনই দুজন দুজনের কেমিষ্ট্রি আরো ভাল করে পড়ে নেয়। সবাই জানে ওদের ভালবাসার কথা। দুজনেই 1st class পেয়ে পাশ করে M.Sc করতে যায় Universityতে। আবার সেই একসঙ্গে। এমন হয়েছে যে দুজনে দুজনকে ছেড়ে একটুও থাকতে পারে না। ছুটির দিনও কোনো না কোনো অজুহাতে বেরিয়ে দুজনে দেখা করে। হয়তো বা গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে দুজনে। দীপক অহনার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে থাকে সে সময়টা। প্রতিটি পল উপভোগ করে সে। হাতে হাত রেখে কত না বলা কথার আদান-প্রদান হয় দুজনের মধ্যে। অহনার খুব ভাল লাগে,ছেড়ে আসতে প্রাণ চায় না,তবু ফিরতে হয় সামাজিক অনুশাসন মেনে। 

   এভাবেই বেশ চলতে চলতে একটা বছর পার,ফাইনাল ইয়ার। অহনার বাবা এবার তার জন্য পাত্র দেখা শুরু করলেন,পাশ করলেই বিয়েটা দিয়ে দেবেন। অহনা বাবার খুবই আদরের ছিল কিন্তু রাশভারী বাবাকে ভয়ও পেত। তাঁর মুখের ওপর কিছু বলার ক্ষমতা তার ছিল না। সব দেখেও চুপচাপ ছিল। একদিন পাত্রপক্ষ দেখতে এসে তাকে পছন্দ করে যায়। এবার সে দীপককে সব জানায়,তাকে বিয়ে করে নিতে বলে। এর জন্য দীপক মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে একটু সময় চায় কিন্তু সেটাই তো অহনার দেওয়া সম্ভব নয়। বাবা এদিকে বেশ তোড়জোড় শুরু করেন। মায়ের কাছ থেকে অহনা জানতে পারে,বাবা কানাঘুষোয় তার আর দীপকের সম্পর্কের কথা কিছু শুনেছেন। সর্বদাই তিনি বাড়িতে খুব গম্ভীর থাকেন,অহনা এই বাবাকে যেন চেনেনা,বড় ভয় পায় সে। ভয়টা যে অমূলক নয় তা কিছুদিন বাদেই টের পায় সে। এরই মাঝে অহনার পরীক্ষাও শেষ হয়। পরীক্ষার পর বাড়ী থেকে বেরনো বন্ধ হয়েছে তার,বাবার আদেশ। রেজাল্টের দিন বাবা সঙ্গে করে নিয়ে যান মার্কশিট আনতে। ব্যস,আবার গৃহবন্দী। বন্ধুদের মাধ্যমে দীপকের সাথে যোগাযোগ চলে,তখন মোবাইলের যুগ নয়,তাই বন্ধুরাই যোগসূত্র। বিয়ের দিন ঠিক হলে,দীপককে চিঠি লিখে সব জানায়। ঠিক হয় একদিন রাতে বাড়ী থেকে অহনা বেরিয়ে পড়বে,দীপক বাড়ীর কাছেই যে বকুল গাছটা আছে তার তলায় অপেক্ষা করবে। তারপর দুজনে একসাথে পালাবে,পালিয়ে মন্দিরে গিয়ে বিয়েটা সেরে নেবে। দুজনেই M.Sc পাশ করেছে,কিছু না হোক টিউশনি করে তো চালাতে পারবে। তারপর দেখা যাবে।

  রাতে বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়লে,অহনা চাবি নিয়ে অন্ধকারে সন্তর্পণে সদর দরজা খুলে বেরতে যাবে আর চাবির গোছাটা হাত থেকে পড়ে যায়। নিস্তব্ধ রাতে সে আওয়াজটা তীব্র হয়ে বাবার ঘুম ভাঙ্গতে সাহায্য করে। উনি এসে সবই দেখলেন,এবার পাহারা আরো কড়া। মা এসে পাশে নিয়ে শুলেন,অহনার আর বেরনো হল না। পরদিন বকুল গাছতলায় দীপকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। রাতের অন্ধকারে গাছতলায় অপেক্ষা করার সময় দীপককে বিষাক্ত সাপে কামড়ায় আর তাতেই দীপকের মৃত্যু হয়।

  অহনার বুক ফাটে তবু চোখ ভাসে না। উপায় নেই। ক'দিন পরেই বিয়ের পিঁড়িতে তাকে বসতে হয়। সুন্দর,সুপুরুষ,উচ্চউপার্জনশীল স্বামী তবু অহনার তার সাথে সারাজীবন শুধু কর্তব্যের সম্পর্ক। মনটা তাকে দিতে পারল না। আজ দীপকের রোজ ডে তে দেওয়া প্রথম গোলাপ ফুলের ঝরে যাওয়া পাপড়ি তাকে সমস্তটা নতুন করে মনে করিয়ে দিল। অহনা দু'হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল,যে কান্না সে দীপক মারা গেলে কাঁদতে পারে নি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy