Subhashish Chakraborty

Classics Crime Thriller

3  

Subhashish Chakraborty

Classics Crime Thriller

ইডিপাস কমপ্লেক্স

ইডিপাস কমপ্লেক্স

11 mins
1.2K


হ্যাঁ, ডরোথিকে সেবারই প্রথম দেখেছিলাম। খুব ভালো লাগছিলো ওকে দেখতে। সেদিন-ই কি তাহলে প্রেমে পড়েছিলাম?

জানি না। আজও জানি না।

 

"ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে পুরো জিনিসটায়, একটা rhythm -- পাচ্ছেন, টের পাচ্ছেন?",ডরোথি জিজ্ঞেস করলো। ছোট্ট কপালে একটা বিশাল খাঁজ, চশমাটা কপালের দিকে আরেকবার ঠেলল ও।

শতম কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো টেবিলটার ওপর। তারপর মেঝেতে। তারপর সিলিং-এ। খুব দ্রুত একটা ক্যালকুলেশন চলছে মনে মনে ওর -- চোখের মনি দুটো ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘোরাঘুরি করছে। খুঁজছে খড় কুটোর মতন -- সত্যিই কি যা ভাবছি তা ঠিক?

"শহর জুড়ে মৃতদেহের স্তূপ। সাত দিনে খুন পাঁচজন তরুণী। অনুর্ধা পঁয়ত্রিশ, প্রত্যেকেই বিবাহিত, well-settled, স্বামী আছে, সন্তান আছে, স্বামী উচ্চ-বিত্তবান, ছেলে মেয়েরাও ভালো স্কুলে পড়ে, গাড়ি-বাড়ি, সোনা আর জহরতে - সংসারে অভাব-দৈন্যতার কোনো ছাপ-ই নেই।" সায়ন বলল পাশ থেকে, অনেকটা জং ধরা নিউজ চ্যানেলের ক্লান্ত সাংবাদিকের একঘেয়ে বুলি কপচানো হেডলাইনসের মতন শুনতে লাগলো -- "সবই ঠিক ছিল। এরপরই শুরু হলো সেই নিধন যজ্ঞ -- প্রথমেই টালিগঞ্জে কিটি-পার্টি থেকে ফেরার পথে গাড়ির গ্যারাজে পাওয়া গেলো চিত্রাকে। মাথায় খুব জোড়ে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা চেঁচিয়ে ডাকবার সুযোগটা পর্যন্ত পাননি। তুবড়ে গেছে খুলিটি। স্পট ডেড।"

শতম তাকালো পংক্তিবদ্ধ মরদেহের মিছিলে শুয়ে থাকা শেষের দেহটির দিকে। সাদা এক চাদরে পা দুটি বেরিয়ে আছে। একটা ট্যাগ ঝুলছে, নাম্বার দেওয়া। হঠাৎ দুলে উঠলো হাওয়ায় -- যেন আটেনডেন্স দেওয়ার জন্য, "Present please" বলে উঠলো।   

"এরপর রাধিকা। একই ভাবে মৃত্যু -- মাথায় আঘাত পাবার অনেকক্ষণ বাদ মৃত্যু হলেও -- কিছুই বলে যেতে পাননি। মাথায় চোটের পর লোপ পেয়েছিলো বাকশক্তি -- অনেকক্ষণ ধরে বিস্ফোরিত চোখে হাত-পা নাড়তে, আঙুলে কি যেন দেখাতে দেখাতে থেমে গেলেন। নিউ-টাউনের ওনার ফ্ল্যাটের সোসাইটির মাঠটায় ওনাকে পাওয়া গেছিলো -- রাত্রিবেলা ডিনারের পর সেই রাতে একটু জগিং করতেই গেছিলেন।"

হ্যাঁ -- রাধিকা। রাধিকা আগারওয়াল। গত বছরই রাধিকার স্বামী অর্পণ -- 'আগারওয়াল টিম্বার্সে'র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আসনে আসীন হয়েছেন। বিশাল এক আর্টিকেল বেরিয়েছিল ওনার ওপরে -- এতো কম বয়সের এতো সফল Entrepreneur সচরাচর চক্ষে পরে না। 

রাধিকা চিত্রারই পাশে শুয়ে আছেন। যেন স্বস্তির ঘুম। দুই বন্ধুতে মিলে।

"তারপর বিশাখা মিশ্রা। সেই একই ভাবে মাথায় আঘাত। তারপর রজনী রাউত। দুপুর বেলা ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে দরজা খুলে মাথায় আঘাত -- রজনী কি তাঁর খুনিকে চিনতেন?"

বিশাখা, রজনী উল্টোদিকের সারিতে শুয়ে। রজনীর বাঁ চোখটা খুবলে বেরিয়ে গেছিলো -- মাথার ঘিলুটা চোখের ঠুলিটা ঠেলা মেরে ঢিলে করে দিয়েছিলো। চোখটা একটা কালো রঙের কাপড় দিয়ে ঢাকা।

যেন কানা মাছি খেলছে।

"আর শেষে দৃষ্টি শর্মা। গতকাল সকালবেলা। মাথার সামনের অংশটা শুধু এবার থেতলায়ই নি -- খুলে বেরিয়ে "মেঝের ওপর পড়ে যেন বিপননি সাজিয়ে, মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন বাড়ির সিঁড়ির নিচে। স্বামী অফিসে, ছোটো ছেলে স্কুলে বসে করে বেরিয়ে গেছে। এমন সময় এটা ঘটেছে।"

হাড় হিম হয়ে যায় দৃষ্টিকে দেখলে -- সাদা ব্যান্ডেজে ফ্রেম করা মাথার থেকে যেন তখনও টিপ্ টিপ্ করে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। 

পাঁচ নারী। পাঁচ কথা। পাঁচ-সাত ভাবনা। সাত দিন। সাত পাঁচে পঁয়ত্রিশ। এঁদের কারুরই বয়স পঁয়ত্রিশের ওপর নয়। শতম কয়েক পা পিছিয়ে এলো।

খুনি কি এনাদের পূর্ব-পরিচিত? 

এতো রাগ কিসের? খুন করতে গেলে, গুলি করে খুন করতে পারতো। ছুরি মেরে খুন ও একটা easy option ছিল, তাই না? মাথা ফাটিয়ে তাল তোবড়ানো -- এতো ঘৃণা, জিঘাংসা -- এ যেন কারোর মনের কোনো কালো মাকড়সার জালকেই বোঝাচ্ছে। বহুদিন ধরে আলো ঢোকেনি, বাতাস ঢোকেনি -- থম মেরে যেন সময় দাঁড়িয়ে আছে লুতিকার জালে। কিছু একটা জমে আছে -- কিছু যেন নিজের জীবনের সাথে জুড়ে আছে। পুরোনো কোনো স্মৃতি। বিবর্ণ সেপিয়া ফ্রেমে মোড়া কোনো ছবি। এই পাঁচজনকে দেখে সেই স্মৃতিই যেন খুবলে খুবলে বেরোচ্ছে।

Memory triggering older memories….

কি হয়েছিল? কি সেই স্মৃতি? কি সেই অবসাদে ঘেরা কুয়াশার ছাত -- ঠান্ডা রেলিং-এ জমা শিশিরের মতন বিরক্তির লকলকে জীব যেন মনের কোণের ঢেকে রাখা সেই ঘা-টাকে চেটে চলেছে।

শতম যেন উত্তরটা জানে, তাই না? সবটা জানে। অনেকগুলো ডট। একটা লাইন -- আবছা একটা লাইন --যেন সেগুলো সবকটাকে জুড়ে দিচ্ছে।

চমকে উঠে তাকালো ডরোথির দিকে। সায়ন তখনও অনেককিছু বলে চলেছে -- ডরোথিকে।

অনেকদিন আগেরকার কথা, জানো?

বাবা তাড়াতাড়ি ফিরলেই গল্প বলত। একেকদিন একেক রকমের। গল্পগুলো একটু অদ্ভুত ধরণের। কখনো কাইমেরা আর বেলেরোফোনের সেই ভয়ানক লড়াই। কখনো প্রমিথিউসকে জিউসের দেওয়া সেই শাস্তির কথা -- প্রতি রাতে তোর যকৃৎ হায়নায় ছিঁড়ে খাবে। কখনো বা Achilles আর তার মায়ের গল্প। সারা শরীর লোহার মতন শক্ত হলেও, পায়ের শিন-বোনস গুলি ভঙ্গুর আর দুর্বল। এ যেন দুযোর্ধনকে দেওয়া গান্ধারীর সেই প্রতিশ্রুতি।

তবে খুব ভালো লেগেছিলো পরশুরাম, জমদগ্নী মুনি আর রেণুকার গল্পটা। বাবার কথায় ছেলে মাকে মেরে ফেলায়, বাবা খুশি হয়ে যখন জিজ্ঞেসা করলো -- বর চাও, ছেলে বড় হিসেবে মাকে বাঁচিয়ে তুলতে বলেছিলো, আর বলেছিলো মাকে ক্ষমা করে দিতে। ওরকম ভালো ছেলে সত্যিই পাওয়া যায় না, তাই না?

নিজের জন্য কিছু চায়নি -- শুধু বলল মাকে ক্ষমা করে দিতে।

আমিও তাই চাইলাম।

আমার হাতে মাছ কাটার বঁটি-টায়, তখনও মায়ের রক্ত টপটপ করে মেঝেতে পড়ছে। মা আমার তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে, মাটিতে পড়ে । কিছু একটা বলছিলো।

"মা কিছু বলছে বাবা -- "

"চুপ কর -- দুশ্চরিত্রা, নীচ, লম্পট। ওর কোনো কথাই শুনবো না আজ। মার -- আবার বঁটিটা চালা। শেষ করে দে ওকে। "

না, পারলাম না আমি -- বসে পড়লাম।

মা। মা আমার। আজ মা দুশ্চরিত্রা হয়ে গেলো বাবা? তুমি দিনের পর দিন তোমার নির্জীব পাথরের মূর্তির পূজা-অর্চ্চনা নিয়ে তার জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিলে, সেটা ভুলে গেলে? মা'র আর কিছুই পড়েছিল না জীবনে -- তোমার প্রাণহীন কিছু মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়া। মাকে বোধহয় তুমি আমার জন্মানোর পর থেকে স্পর্শী করনি।

ওহ, ভুলেই গেছিলাম। পন্ডিত তুমি। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। নারীস্পর্শ নাকি পাপ। আসলে কি জানো বাবা, তুমি এই যুগের জন্য ঠিক নও -- তোমার তো সেই মহাভারতের যুগে থাকা উচিত ছিল।

কেন? কি দোষটা করেছিল মা -- তার জীবনে অন্য কেউ যে এসে যাবে, এ আর অসম্ভব কি? আর আজ সেটা জানতে পেরে তুমি রাগে পাগল হয়ে যাচ্ছ....

"মার্...মার্ বলছি...."

"পারবো না বাবা...."

"আমি বলছি -- মার....", চেঁচিয়ে উঠলো বাবা আবার।

বঁটি-টা ফেলে মা-কে সামনে পাওয়া লোহার রড-টা দিয়ে সজোড়ে মাথায় মারলাম।

ধপ করে শেষবারের মতন কি যেন একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো মা।

চিরকালের মতন।

কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। কাঁদলাম। খুব কাঁদলাম। তখন বয়েস নয় বছর -- emotional drag-টা স্বভাবতঃই একটু বেশি। বাবা আর মায়ের লড়াই --তোমরা দুজনই আমার কাছে সমান প্রিয়। মা বললে বাবা বুঝি, আর বাবা বললে মা।

এক্ষেত্রে তোমার কথা শুনলাম বাবা। এবার তুমি আমার কথা শোনো।

"বাবা?"

বাবা বসে বসে গোঙাচ্ছিল। চোখদুটো ইট-ভাটার মতন লাল। খুব ঘামছে।

"বাবা?"

"হুঁ?"

"বাবা -- আমি তো তোমার কথা শুনেছি। এবার তুমি আমার কথা রাখ?"

উঠে তাকালো বাবা।

"মা-কে বাঁচিয়ে দাও।"

কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো বাবা -- "কেন রে? আমায় কি জমদগ্নী পেয়েছিস?"

"কেন বাবা -- উনিও তো ওনার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। তুমি পারবে না কেন?"

আরও কিছুক্ষণ হাসলো বাবা -- "তুই কিছুই বুঝিস নি। ওটা একটা গল্প। একটা ছেলে ভোলানো গল্প ছিল - এতো সিরিয়াসলি নেবার মতন কিছু না।", উঠে দাঁড়ালো বাবা -- "শুয়ে পড় -- কাল ভোরবেলা -- লাশটাকে ঠিকানা লাগাতে হবে।"

লাশ? ওটা আমার মা -- কি বলছো তুমি?

বাবা উঠলো, তখনও ঘামছে -- "আয়, শুবি আয়।"

নাহ, শুতে আমি যাই নি। সারা রাত-ই মা-এর কাছে বসেছিলাম। মাকে দেখছিলাম। অত রক্তেও মাকে কি সুন্দর লাগছিলো। 

বাইরে গাছের মাথায় চাঁদ উঠেছে - এক চিলতে আলো মায়ের সিঁথিতে পড়েছে।

সিঁদুর।

মায়ের ডান-ঠোঁটের ওপর একটা তিল। বাদামি রঙের তিল। মা তুমি এতো সুন্দর?

***

আগুন। আগুনের লাল জিভে শেষবারের মতন দুজনকে একসাথে দেখলাম। বাবা তখনও খাটে শুয়ে -- বুঝতেই পারেনি ঘরে এক তৃতীয় পুরুষ এসেছেন।

অগ্নিদেব।

অনেকক্ষণ বাদে টের পেলো বাবা -- হাতটা একটা গামছা দিয়ে খাটের পেলমেটের সাথে বাঁধা -- বাবা চেঁচাচ্ছিলো। অকথ্য গালাগালি দিচব্রহ্ম

অদ্ভুত সহমরণ। 

আজও মাকে খুঁজি।

আজও মাকে বানানোর চেষ্টা করি। সেই শেষ মহুর্তের 'মা'কে। রক্ত। অভিমান, হিংসা, নির্দয়তা, অশ্লীলতার দায় -- এসবের মাঝেও সেই মোহিনী রূপ। যেন অনেককিছু বলছে।

অপূর্ন ইচ্ছা। অতৃপ্ততা। অসমাপ্ততা।

হ্যাঁ, হ্যাঁ -- আমিই খুন করেছি। মাকে খুঁজছিলাম। অদ্ভুত মিল আছে মায়ের সাথে ওদের। তোমরা বোঝোনি সেটা?

"সিকোয়েন্স। একটা অদ্ভুত মিল. বুঝতে পারছিস"

সায়ন মাথা ওঠালো। তখন থেকে মুখ গুঁজে টুনা -স্যালাড খাচ্ছিলো। বোধহয় খুব খিদে পেয়েছিলো। শতম কিছু খায়নি - মর্গের ডিসিনফেক্ট্যান্ট আর পচা মাংসের গন্ধটা এখনো নাকে লেগে আছে। 

"পাঁচ জন। পাঁচ জনেরই একটা সোশ্যাল ইমেজ। সোশ্যাল স্টেটাস। টুকটাক সোশ্যাল ওয়ার্কিং ও মাঝে মাঝে করেন। লাইব্রেরিতে যান। বই লেখেন। ফেসবুকে সোশ্যাল ক্রাইসিস নিয়ে ভালো ভালো পোস্ট লেখেন। দৃষ্টি গোস্বামী তো আবার শখের কলুমনিস্ট -- বেশ কিছু ম্যাগাজিনে লেখা কবিতাও ছাপানো হয়েছে।"

সায়ন কাঁটা চামচ রেখে সেভেন-আপের কাপে চুমুক দিলো।

"একদিকে বিশাল সোশ্যাল ইমেজ। আবার অন্যদিকে -- এনাদের সবারই একটা কমন ডার্ক-সাইড আছে, জানিস?"

"ডার্ক সাইড?"

শতম কাঁধ ঝাঁকালো সায়ন - "জানি না ডার্ক না লাইট। কিন্তু একটা কমন ব্যাপার আছে, জানিস?"

"কিরকম?"

"পাঁচ জন-ই নিজেদের জীবনে খুব একা। স্বামী সময় দেন না। স্বামীরা সবাই নিজের কাজ ব্যস্ত। স্ত্রীর জন্য কারোরই তেমন কোনো সময় নেই।"

"এটা 'কমন ব্যাপার' বলে মনে হলো স্যার আপনার? আপনিও তো আপনার বাড়ির জন্য কোনো সময়ই দেন না -- বৌদিকে কি তাহলে এই ক্লাসে ফেলা যাবে?"

শালা, সায়নের রোওয়াব দেখে মাঝে মাঝে মনেই হয়না কে কার বস !!!

"আসছি সে কথায়", শতম একটা কফি অর্ডার দিলো -- "এই পাঁচজনেরই একটা কমন ব্যাপার আছে -- আবার বলছি। চিত্রা সেদিন যে কয়টি পার্টিতে গিয়েছিলেন -- সেখানে রজত এসেছিলো। রজত খান্না। নামটা চেনা চেনা লাগছে?"

সায়ন কিছুক্ষণ বোকার মতন চেয়ে বলল -- "রজত। ওরে বাবা -- সে তো বিশাল বড়ো এক খেলোয়াড়। অনেকদিন ধরেই পুলিশে খুঁজছে তাকে। রঙিন কলকাতার সায়াহ্নের এক বিশাল আইটালাইস্ড নাম।"

"পাতি বল না রে এসকর্ট একজন।"

"হ্যাঁ -- গিগোলো।"

কফি নিয়ে এলো একজন এপ্রোন পড়া ওয়েটার -- "রজত ওখানে নিশ্চই টাইমপাস করতে আসেনি। চিত্রার মোবাইলে পাওয়া সেই হোয়াটস্যাপ ইমেজটা মনে আছে?"

হ্যাঁ, হ্যাঁ....আবছা মনে আছে বটে। চিত্রার বান্ধবীরা এক অচেনা পুরুষmasquerade, মনে আছে?"

হ্যাঁ। ঠিক।

"রজতের সাথে কি তাহলে এই খুনের কোনো --"

কফিতে চুমুক দিলো শতম -- "একবারও বলি নি কিন্তু। মাঝখানে বলিস না।"

"ওকে স্যার।"

"দ্বিতীয় জন, রাধিকা। এনার এক স্টেডি বয়ফ্রেন্ড ছিল। মোবাইল ফোনে 'জিম টিচার অন্তরা' বলে যে নম্বরটা সেভ করা -- সেটা আদৌ কোনো অন্তরার নয়। ভালো করে মেসেজের আদান প্রদান দেখলেই বোঝা যাবে -- সেটা আদৌ দুজন কোনো টিচার আর মেনটির মধ্যে হতে পারে না।"

সায়ন চুপচাপ শুনছে। কথা বলা যাবে না এখন।

"এরপর বিশাখা, রজনী, দৃষ্টি। সবারই এক ধরনের গল্প। রজনীর স্বামীর এক বন্ধুর সাথে বেশ পাকাপাকি সম্পর্কই ছিল রজনীর। দৃষ্টির ছোটবেলাকার এক বয়ফ্রেন্ড ছিল -- যে কিনা মাঝে মাঝেই মগ্ন মৈনাকের মতন প্রকট হত।"

"আপনি কি বলতে চান যে আমাদের "মিঃ X" -- এক্সট্রামারিটাল-এর পরিপন্থী। সেই জন্য খুন করেছে?"

"দূর শালা -- শহরে, পৃথিবীতে এটা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মিড্ লাইফ ক্রাইসিস, দাম্পত্য অসন্তোষ, শারীরিক ক্ষুন্নিবৃত্তি -- এতো বহু যুগ ধরেই হয়ে আসছে -- এর জন্য কাকে কাকে খুন করবে?"

"কিন্তু এখানে --"

একটা ফোন আসছে। শতম ফোনটা ধরে উত্তর দিতেই টের পেলো থানা থেকে আসছে -- "স্যার রাকিব বলছি।"

"বলো?"

"একটু আস্তে পারবেন? একটা ভয়ানক মিসিং লিংক পেয়েছি। এত্ত কাছে ছিল পুরো জিনিষটা -- একবার ভেবেও দেখিনি।"

"কি হয়েছে বলো।"

"আসতে পারবেন না কি এখন থানায়?"

"দেরি হবে।"

"বেশ, আমি একটা হোয়াটস্যাপ-এ ইমেজ পাঠাচ্ছি। একটু দেখুন -- সব বুঝতে পারবেন।"

"পাঠাও।"

ফোনটা রাখলো শতম -- এখানে শালা এতো বাজে টাওয়ার, ইমেজ তো কোন ছার, ফোনই পাওয়া যায়না ঠিক মতন করে।

খাওয়া দাওয়ার পর, বিল মিটিয়ে বড় রাস্তায় আসার পর -- সায়ন বললো -- "স্যার -- একটা ভুল হয়েছে মনে হচ্ছে।"

"কি রকম?"

"পাঁচটা লাশ। পাঁচটা পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট। চারটে পেয়েছি। রাধিকার-টা পাইনি।"

"কেন?"

"স্কিপ হয়ে গেছে।"

"এখান থেকে তো মর্গ আরও ঘন্টা খানেকের পথ।"

"আপনি নিশ্চিন্তে থানায় চলে যান স্যার। আমি নিয়ে আসছি।"

"আরে কি মুশকিল -- এখন তো বেশ রাত হয়েছে -- বেশির ভাগ স্টাফই বেরিয়ে যাবে।"

"ওই প্যাথলজিস্ট ভদ্রমহিলা তো বললেন অনেক রাত অবধি থাকেন।"

মাথা নাড়লো শতম, বাইকে বসে -- "বেশ, বেরিয়ে পড়ো -- রিপোর্টটা নিয়ে কিন্তু থানায় এসো -- আজকেই ডিব্রিফিং আছে প্রেসের সাথে।"


হাসলাম আমি। 

ঠিকই ধরেছে।

রজনী, রাধিকা, দৃষ্টি, চিত্রা, বিশাখা।

প্রত্যেকেরই মায়ের সাথে একটা ভয়ানক, subtle, মিল। সেই এক জীবনের না পাওয়ার গল্প। হেরে যাবার গল্প। অন্য কিছুতে নিজেকে ফিরে পাবার গল্প।

আর?

কি হলো ইন্সপেক্টর? সেটা তো কৈ দেখলে না।

ডান দিকের ঠোঁটের ঠিক নিচে বাদামি রঙের তিলটা।

পাঁচ জনেরই মারা যাবার সময়ে থিরথির করে তিলটা কাঁপছিলো -- ঠিক মায়ের সেই শেষ সময়টার মতন।

বাবা -- বাবা, সেই সন্ধ্যাতে মাকে প্রায় হাতেনাতেই ধরে ফেলেছিলো। মায়ের জীবনে হারিয়ে যাওয়া সেই বসন্তের পুনর্মিলন। 

এরপর বহু বসন্তে - কান

আবার গুলি চালাল শতম। 

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সায়ন। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না -- পিঠে গরম গরম হলকার মতন দুটো লোহার শলাকা ঢুকে পেট ফুঁড়ে সামনের দেয়ালে গিয়ে ফুটেছে। মাটিতে পড়ে নির্নিমেষে চেয়ে রইলো শতমেহাত বাড়িয়ে উঠে দাঁড় করলো ডরোথিকে -- "You ok?”

কাঁপছিলো ডরোথি -- মৃত্যুকে এতো কাছে থেকে দেখে। ঠোঁট কাঁপছিলো। ঠোঁটের ওপরের তিলটাও।

"সায়ন রায়। ছোটবেলায় মা আর বাবাকে পুড়িয়ে মারার পর, জুভেনাইল কোর্টে অনেকগুলো বছরই কাটিয়েছে। এরপর ওকে দত্তক নেন আই.জি. ধর। ছেলে পড়াশোনায় ভালই ছিল। পুলিশের চাকরি, তিন তিন বার অ্যাওয়ার্ড এন্ড এচিভমেন্টের ভারী রকমের মেডেল। ডাক সাইটে ডেয়ারসায়। মনের গভীর তলে যে এতো কিছু ছিল -- কেউই বুঝতে পারেনি।"

“মোটা শোলের জুতোয় শব্দ তুলে ঘরে ঢুকে এলো জনা আটেক ইউনিফর্মড পুলিশ।"প্রথমে আমিও বুঝতে পারিনি, জানেন? আমারই এক কলিগ আমায় সায়ন-এর ছেলেবেলার সেই কেস স্টাডিটা ফটো করে whatsapp-এ পাঠাতেই সব কিছু বুঝে গেলাম। জানতাম ও কেন মর্গে ফিরে আসতে চাইছিলো। যাতে আপনাকে পাওয়া যায়। এই সময় বেশি লোক থাকবে না মর্গে - graveyard shift শুরু হবে একটু পরেই"এরকম করার কারণ?"

পিছিয়ে এলো শতম। খারাপ কি আর লাগছে না? সায়ন ওর প্রিয়-পাত্র। নিজের হাতেই ওকে বানিয়েছে। আজ সেই হাতেই"ইডিপাস কমপ্লেক্স। একটা অদ্ভুত sexuality লুকিয়ে আছে, জানেন?"

"মানে?"

"ইডিপাস কমপ্লেক্স। সিগমান্ড ফ্রয়েডের এক বহু controversial থিওরির মধ্যে একটি।""ইডিপাস? সেই গ্রিক চরিত্র, যিনি অজান্তে নিজের মাকে বিয়ে করে ফেলেছিলেন?"

"হ্যাঁ। Jacosta । ইডিপাস কমপ্লেক্স ও খানিকটা এই ব্যাপারটার সাথেই জড়িয়ে আছে- "কি সেটা?"

"ইডিপাস কমপ্লেক্স হলো এক বাচ্চার subconscious মাইন্ডের এক নোংরা খেলা -- যেখানে সে তার অজান্তেই নিজের মাকে sexually ক্লেম করতে থাকে। ছেলেবেলায় বাবা অনেক ছেলের কাছে এক বড় ভিলেন -- তার মাকে বিয়ে করার জন্য। বয়েসের সাথে সাথে এই প্রবৃত্তিটা চলে গেলেও অনেক বছর অবধি রয়ে যায় তার স্বাক্ষরটা। সব ছেলেই তার মায়ের মতন স্ত্রী খোঁজে -- এটা সেই ইডিপাস কমপ্লেক্স এরই এক কার"You mean -- খুন হওয়া সব মহিলাদের সাথেই লুকিয়ে আছে ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া সেই নারীর সাথে লেগে থাকা যৌনতার ফিকে হওয়া কালিটা। সাধারনতঃ -- ইডিপাস কমপ্লেক্স -- একটু বয়েস হবার সাথে সাথেই ফিকে হতে হতে, চলে যায়। যদি না -- কৈশোরে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা সেটাকে বারবার ফিরিয়ে চোখ বুঝলো সায়ন। চোখের পলকে শেষ জলের ফোঁটাটার হিমেল পরশ। দীর্ঘস্বাস ফেললো শতম -- "সায়নের জীবনটা যেন একই বৃত্তাকার loop-এ বারবার ঘুরে চলেছিল । এতো বড়, ব্রিলিয়ান্ট এক ব্যক্তিত্ব - আর তার এমন পরিণতি", হাঁটু গেড়ে বসে সায়নের মাথায় হাত বোলাতে লাগলো শতম -- "What a waste !"

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics