শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics Others

ইচ্ছেপূরন

ইচ্ছেপূরন

4 mins
229



মাঠের পর মাঠ সবুজ আর সোনালী ধানের চাদরে মোড়া। দুইধারে বিস্তৃত মাঠের মাঝ দিয়ে চলে গেছে লাল মাটির আঁকা বাঁকা পথ। পথের ধারে ধারে অনেক গাছ এখন কঙ্কালসার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারন হেমন্তের আগমনের সাথে সাথে তাদের পাতা ঝড়া শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে হিমেল হাওয়া ভেসে আসছে আর বয়ে নিয়ে আসছে শিউলী ফুলেন মন মাতানো গন্ধ।


হেমন্ত কালে প্রকৃতি এক অন‍্য রকম রূপ ধারন করে। সকাল বেলায় ঘাসের মাথায় ওপর জমে ওঠে শিশির বিন্দু। তাতে যখন সূর্যের মৃদু আলো পড়ে তখন হিরের মত জ্বলজ্বল করে। মনে হয় ঘাসেরা তাদের মাথার ওপর হিরের মুকুট পড়েছে। সত‍্যি অপরূপ এই সৌন্দর্য যাকে ভাষা দিয়ে বর্ননা করা সম্ভব নয়।


প্রত‍্যেক বছরের মত এবারও আরতী আশায় বুক বেঁধেছে। কারন সামনেই নবান্ন উৎসব তাই আরতী যদি গ্রামের বাড়িতে যেতে পারে।কারন কিছুদিনের মধ‍্যেই নতুন ধান উঠবে, গ্রামে নবান্ন উৎসবে হবে। সারা গ্রাম উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হয়ে যায় আরতীর আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না। কারন তার ছেলে আর ছেলের বউ তাদের কর্ম জীবন নিয়ে ব‍্যাস্ত। আর নাতি, নাতনিরা পড়াশোনা, আঁকা, গান, নাচ সবকিছু নিয়ে ব‍্যাস্ত কারোর কাছে সময় নেই।


আরতী আপন মনে তার ঘরের লাগোয়া ব‍্যালকনিতে বসে ভাবতে থাকে সত‍্যি গ্রামের জীবন কত সুন্দর। চারিদিকে সবুজ গাছপালা আর রঙ বেরঙের ফুলে ভরা। আর এই শহরের বুকে কোলাহল, দূষন আর গাড়ীর তীব্র হর্ন ছাড়া যে আর কিছুই নেই। আরতী যখন বকুল পুর গ্রামের বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল তখন ওদের অবস্থা কত ভালো ছিল। গ্রামের সবাই আরতীর শ্বশুরমশাই কে কত সম্মান করত এবং বড়কর্তা বলে ডাকত। আর প্রত‍্যেক বছর কত বড় করে নবান্ন উৎসব পালন করা হত ওদের বাড়িতে । কত লোকজন, আত্মীয় স্বজন আসত ওদের বাড়িতে। কত রকমের ভালো মন্দ রান্না হত। আরতীর বিয়ের আগে কোনদিন এইভাবে নবান্ন উৎসব পালন করতে দেখেনি। তাই আরতীর এই নবান্ন উৎসব খুব ভালো লাগত। গ্রামের সকলে কি সুন্দর এক সাথে আনন্দে মেতে উঠত। কত রকমের গান, বাজনা হত আর আরতী মুগ্ধ হয়ে সবকিছু দেখত।


কিন্তু দিন বদলায়! তাই সময়ের সাথে সবকিছু কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে। আরতীর স্বামী এই জগতের মায়া ত‍্যাগ করে চলে যাবার পর আরতীকে তার ছেলের সাথে গ্রামের অত সুন্দর বড় বাড়ি ছেড়ে এই সুদূর এলাহাবাদ শহরে চলে আসতে হয়েছে। গ্রামের বাড়ির দেখাশোনা করার জন‍্য লোক রাখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু আরতীর কিছুতেই যেন মন মানতে চাইনা এই শহরে। যতই হোক জীবনের অর্ধেকটা সময় তো ঐ গ্রামেই কেটেছে। কত সুন্দর সুন্দর স্মৃতি জড়িয়ে আছে আরতীর গ্রামের বাড়ির সঙ্গে। আরতী চেয়েছিল ঐ গ্রামের বাড়িতেই যেন শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করতে পারে। কিন্তু তা আর বুঝি হবার নয়!


আসলে আরতী দেবীর স্বামীর স্বপ্ন ছিল তাদের একমাত্র সন্তান মস্ত বড় ডাক্তার হবে। সে আর তার মত চাষ বাস করে খেটে খাবেনা। আর ছেলেও সময়ের সাথে বাবার দেখা স্বপ্নকে স্বার্থক করেছে। এই এলাহাবাদ শহরে সে একজন নামকরা বড় ডাক্তার। তাই স্বামীর মৃত‍্যুর পর ছেলের সাথে তাকে শহরে চলে আসতে হয়। প্রথমে আরতী কিছুতেই আসতে রাজি হয় নি শেষ পর্যন্ত ছেলের জোড়াজুড়িতে আসতে বধ‍্য হয় ।শহরের আদব কায়দা আরতীর একদম পছন্দ হয় না। শহরের মানুষদের মধ‍্যে সেই মন, প্রান খোলা ব‍্যাপারটাই নেই। আরতী গ্রামের কথা, নবান্ন উৎসবের কথা নাতি নাতনিদের কাছে যখন বলে। তখন ওরা এই সব,এমন কি নবান্ন উৎসবকে রূপকথা বলে মনে করে।


প্রত‍্যেক বছর আরতী ভাবে নবান্নের সময় গ্রামের বাড়িতে গেলে নাতি নাতনি গুলো উৎসবটা দেখতে পেত কিন্তু অরতী দেবীর ছেলে যে মানুষের কল‍্যানের কাজের সাথে যুক্ত। তাই ছেলেকে ছুটির জন‍্য জোর করতে পারেননা। এই ভাবে প্রত‍্যেক বছর কেটে যায় আর আরতীর বাড়ি ফেরা হয় না। এখন আরতীর একটাই চিন্তা আর কোনদিন বাড়ি ফিরতে পারবে তো! কিন্তু এইবার আরতীর সাথে নাতি নাতনিরাও বায়না ধরছে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার। তাই আরতীর আশা আরও বেড়ে গেছে।


*****************************************

আজ অনেক বছর পর আরতী বকুলপুর গ্রামের মাটিতে পা রাখল। আরতীর চোখের সামনে পুরোন দিনের সব স্মৃতি এক এক করে ফুটে উঠছে। আরতীর চোখ দুটো জলে ভরে এসেছে। চোখের জল মুছে নাতি নাতনির হাত ধরে আরতী এগিয়ে চলল সবুজ ধানের ক্ষেতের মধ‍্যে দিয়ে যাওয়া লাল মাটির পথ দিয়ে। ওরা যেন রুপকথাকে চোখের সামনে দেখছে।


বহুবছর পর আরতী নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে পা দিল। এখনও সবকিছু আগের মত গোছানো। আরতী নিজের হাতে এই ঘরটাকে পরম যত্ন সহকারে গুছিয়ে ছিল। পরের দিন সকাল থেকে শুরু হল উৎসবের তোরজোড়। গ্রামের সমস্ত মহিলারা উঠান জুড়ে রঙ বেরঙের আলপনা ফুটিয়ে তুলল। চারিদিক সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হল। সবাই মিলে একসাথে হাতে হাতে কাজ করছে। কত রকমের রান্না হচ্ছে। আঞ্চলিক গানের তালে মেয়েরা কোমড় দোলাছে। সবাই উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছে।


দুদিন আনন্দ আর হই হুল্লোড় করে কেটে গেল, এবার যে ফিরে যাওয়ার পালা। আরতীর মন ভারি হয়েগেছে সে যে এইখান থেকে কোথাও যেতে চাইনা। আরতী তার স্বামীর ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন। দেওয়াল ঘড়াটা ঢং ঢং করে বেজে সময়ের জানান দিল। আরতীর চোখের কোনে আসা জলটা শাড়ির আঁচলে মুছে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল।

পরের দিন সকালে বাড়িতে কান্নার আওয়াজ ভেসে বেড়াতে লাগল। কারন আরতী আর ঘুম থেকে উঠলোনা। এত বছর পর আরতী কালকে রাত্রে একেবারে নিশ্চিতে এবং পরম শান্তিতে ঘুমিয়েছে। এই ঘুমের মধ‍্যে কোন দুঃখ, কষ্ট, চাওয়া, পাওয়া, মান, অভিমান নেই আছে পরম সুখ আর শান্তি। সত‍্যি আরতীকে আর ফিরে যেতে হলনা। সে যে তার সব থেকে প্রিয় জায়গায় চিরতরে সবার থেকে বিদায় নিল। এই বিদায়ের মধ‍্যে কোন কষ্ট নেই আছে অফুরন্ত আনন্দ আর মুক্তির আস্বাদ।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy