হেডফোন
হেডফোন
গুনগুন করে মনে মনে তখনও , হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গান গেয়ে যাচ্ছি "এই পথ যদি না শেষ হয়।"
ও আপন মনে ঢেউ এর ভিডিও তুলছে, ওকে আজ নতুন করে আবিষ্কার করলাম। পুকুরে ঢেউ আর নদীর ঢেউ এর মধ্যে কি পার্থক্য জানেন ? পুকুরের ঢেউ পরে কাছে এসেই শান্ত হয়ে যায়। নদীর ঢেউ পারটাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায় দূরে কোথাও।
এই পথ যদি শেষ হয় গানটাও যেনো হারিয়ে যাওয়ার কথা বলে। যাইহোক এই গানটিতে যে আবেগ তৈরি হয়, এখনকার গানে সেটা হয় না। "পদ্মানদীর মাঝি" উপন্যাস থেকে "কহ না পেয়ার হে" মতো মুভি, সব জায়গায় দেখে প্রেম করলেই হারিয়ে যেতে চায় ,এই দুনিয়ায় থেকে । বিচ্ছন্ন হয়ে যেতে চায় এই সমাজ থেকে। এবিষয়ে আমি একটা যুক্তি আছে।
তবে আমার এই চিন্তার কিছুটা সমর্থন রবীন্দ্রনাথের " ছুটি" গল্পে পেতে পারেন।ছোট থেকে বাবা মা সবার আদরের আমরা মানুষ হয়ে থাকি কম বেশি। ।হঠাৎ হাত-পা এ লম্বা হতেই যতো বিপদ আমাদের। অদুঅদু কথা বলেই দূর ছা করে আবার বড় দের মতো কথা বললেও বিপদ। গুরুজনের থেকে দূরত্ব বেড়ে হয়ে তাই একা। বন্ধু বান্ধব সাথে মজা হুল্লোর মধ্যে মান অভিমান ঝগড়া হয়। তাই মন বিকল্প খুঁজে অন্য কোন মানের মানুষ। এবার এই দুই জন আসলে একা হয়ে যায়। আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক স্বপ্নের জগত গরতে চাই । তাই হারিয়ে যাওয়া ভাবনা নিয়ে মন গেয়ে ওঠে " এই মন চেয়ে আমি হারিয়ে যাবো। হারিয়ে যাবো তোমার সাথে।"
ও ফোট তুলতে ব্যাস্ত।ওর মাথার উপর কতো ফড়িং ওড়ছে। আমি ওকে বললাম দেখিছিস "কতো ফড়িং। "
ওর অফিস থেকে ফোন এসেছে। ফোনটা কিছু কথা বলে বলল" হেডে ফোন আনি নি বলে দেখলে বুঝে গেলো আমি ঘুরতে বেরিয়েছি। ওয়াক ফ্রম হোম জীবন টা শেষ করে দিলো। আজ বেড়াতে বেড়িয়ে ফড়িংটা বাড়তি পাওনা আজ কাল দেখাই যায় না ফড়িং।"
আমি বললাম" দেখা যাবে কি করে ফ্লাট সংস্কৃতি তে পুকুর ডোবাতো সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে।পুকুর, হ্রদ, ঝর্ণা এবং জলাভূমির আশেপাশে পাওয়া যায়, কারণ এদের লার্ভা, নিম্ফ জলজ। সবচেয়ে বড় কথা ফড়িং এর অন্যান্য পতঙ্গের মতো ছয়টি পা থাকলেও এরা হাঁটতে পারে না, এদের পা কাঁটাযুক্ত এবং ডালপালায় বসার উপযোগী। ফড়িং এর মাথা বড় এবং ইচ্ছেমতো ঘুরানো তে পারে। একজন বলছিলো এই ফড়িং দেখিয়ে জল দুষিত কিনা তাও নাকি বোঝা যায়। "
ও বললো " ছোট বেলা য় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আমি ও ফড়িং ধরতাম। ফড়িং চোখ দুটো আমার বড়ো ভালো লাগে।একটি ফড়িংএর চোখে প্রায় ৩০,০০০ এর মতো লেন্স বা ওমাটিডিয়া রয়েছে, জানো। এটা পৃথিবীর আদিমতম পতঙ্গ।"
দূরে নৌকায় মাঝি গান করছে । ও চোখটা বুজে ঐ গানটা অনুভব করতে চাইছে। একটু দুরেই ছেলেটাকে দেখে , দয়া হলো। কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ঘাটছে। এই সুন্দর মুহূর্ত গুলো ও অনুভব করতে পারছে না। সন্ধ্যার অন্ধকারের একটা আলাদা গন্ধ আছে। ও টেরও পেলো না। ভাবলাম, ছোট একটা হেডফোন মানুষ কে কত একা করে দেয়। প্রযুক্তি মানুষ ব্যবহার করে তাদের কাজের সুবিধার জন্য। কিন্তু মানুষ আজ পুরোপুরি যন্ত্র নির্ভর হয়ে যাচ্ছে।ছোট বেলা শুধু মহালয়া নয়। আমরা মান্না দে, কিশোর গান টেপরেকর্ডার জোরে জোরেই চালিয়ে দিতাম। একা নয় শুনতো পাড়া লোকেরা। টিভি ও দেখতাম একসাথে বসে। আরে বাবা, গান একা শোনা জিনিস নাকি। ধান ভানার সময়, কল সারাইয়ের সময় , সবাই একসাথে গান গাইতো। হেডফোন সবাই কে আজ একা করে দিয়েছে।
মন চাইছিলো না ফিরতে। ওর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো খুব ভালো লাগে। বাড়িতে আমার আনমোনা হাসি দেখে বুঝে গেলো আজ আমি অন্য কোথাও গেছি। বাড়ির ছোট রা একটু খুনসুটি করছিলো। আমি হেডফোনটা কানে গুঁজে নিলাম আত্মরক্ষার তাগিদায়। যতক্ষন না ওরাও যুদ্ধে বিরতি দিলো।
