হারায়ে খুঁজি
হারায়ে খুঁজি
চোখের কোনা দিয়ে মিলিকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। মিলি আমার কোনাকুনি একটা বেঞ্চে বসেছে তৃণা আর পলুর সাথে। পলু মানে পৌলমি, গোলগাল চেহারা, খুব মিষ্টি মুখমন্ডল, তার চেয়েও মিষ্টি ব্যবহারের জন্য এই দুসপ্তাহেই সবার আদরে পৌলমি থেকে পলু হয়ে গেছে। মিলির মনের খবর জানতে আমাকে পলুরই শরণাপন্ন হতে হবে মনে হচ্ছে। “ পরাগ এই পরাগ, এটা কে রে? “ অর্কর ডাকে ঘুরে তাকালাম। নাহ, কালো টি শার্ট, ডেনিম জিন্স পরে আড়াআড়ি ভাবে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে চেনা তো পরের কথা আমি কখনো দেখিনি পর্যন্ত। ছেলেটা ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে সারা ঘরময় ভ্রমরের গুনগুন শুরু হয়ে গেল। “ আমি কেন মেয়ে হয়ে জন্মালাম না রে! “ অর্কর আক্ষেপ শুনে হেসে ফেললাম। সত্যিই আমার জীবনে এখন পর্যন্ত আমি বোধহয় এত সুন্দর ছেলে দেখিনি। গায়ের রঙ মেয়েদের লজ্জা দেবে, হাইট বোধহয় পাঁচফুট ছয় হয়ে যাবে, মাথা ভর্তি চুল, মাপসই ফিগার আর সমুদ্রের মতো নীল চোখ নিয়ে যেন এক গ্রিক দেবতা দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক ভাবেই ক্লাসের মেয়েদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে পড়েছে ছেলেটি অবশ্য ক্লাসের ছেলেদের বর্তমান গবেষণার বিষয় বস্তুও সে। একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে ছেলেটা বসতে না বসতে পি.জে স্যার ঢুকলেন। একঝলক সারা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে স্যার বললেন, “ এই যে অনিন্দ্য সান্যাল, এবছর লেখাপড়াটা করা হবে তো নাকি? “ হ্যাঁ স্যার, এবছরএকদম ফার্স্ট ক্লাস। প্রমিস। “ অবাক হয়ে গেলাম আমরা প্রথম দিন ক্লাসে এসেই স্যার কে প্রমিস করছে ফার্স্ট ক্লাস পাবে! মিলন কানে কানে বললো, “ কে রে ছেলেটা? দেখতে ঋত্বিক রোশন আবার কনফিডেন্স লেভেল এভারেস্টের চূড়ায়? “
দীপেন হলো আমাদের খবরিলাল। পি.জে স্যার যাওয়ার পরই ক্লাস থেকে হওয়া হয়ে গেছিলো। ফিরলো একেবারে আমাদের ক্লাসের আগন্তুক সম্পর্কে সব খবর নিয়ে। নাম অনিন্দ্য সান্যাল। আমাদের চেয়ে একবছরের সিনিয়র। গত বছর শুধু আমাদের ম্যাথেম্যাটিক্স ডিপার্টমেন্ট নয় সমস্ত কলেজে যত ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে ছিল উচ্চ মাধ্যমিকে সবচেয়ে বেশী নম্বর ছিল ওর কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার পর দেখা যায় সেই ছেলের পড়াশুনায় একদমই মন নেই। অর্ধেক দিন কলেজ আসতো না। এলেও চুপচাপ বসে থাকত, কারুর সাথে মিশত না। সেকেন্ড ইয়াররের মিশকাদি একটা অদ্ভুত কথা বলেছে, “ দ্যাখ দীপেন, অনিন্দ্য ছেলেটা ভালো না মন্দ আমাদের জিগ্যেস করিসনা কারণ একটা মানুষের খারাপ ভালো বুঝতে হলে তার সঙ্গে মিশতে হয় আর সেই সুযোগটা অনিন্দ্য কাউকেই দেয় নি। কারুর সাথে বন্ধুত্ব যেমন করেনি কারুর কোনও ক্ষতি করেছে একথাও বলতে পারবো না আমরা। “ ফাইনাল পরীক্ষার সময় একটা পরীক্ষা দিয়ে আর পরীক্ষা দেয়নি। এবছর আবার রিএডমিশন নিয়েছে। দীপেন আরও খবর জোগাড় করে এনেছে, অনিন্দ্য এই শহরের ছেলে নয়। বাড়ি অন্য জায়গায়। বেশ পয়সাওয়ালা বাড়ির ছেলে। বাবা হাই স্কুলের হেডমাস্টার। পৈত্রিক সম্পত্তিও প্রচুর আছে। দাদা চাইল্ড স্পেশালিস্ট। ওদের বাড়ির ওখানেই চেম্বার। প্রচুর পসার। দিদি স্কুল টিচার আর জামাইবাবু কলেজের। এককথায় বেশ ভালোবাড়ির ছেলে। মেসে থাকে না একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে।
এরপর বেশকিছু দিন কেটে গেছে। এরমধ্যে অনেক নতুন ব্যাপার ঘটেছে। যে ছেলে আগের বছর থেকেও নেই হয়ে ছিল সে এবছর একদম নতুন অবতারে। আমাদের ইয়ারের আমি ছাড়া সবাই অনিন্দ্য দা বলতে অজ্ঞান। গতবছর যে ক্লাসমেটদের সাথে মোলাকাত ও ছিল না এখন তাদের সাথে খুব দোস্তি। এমনকি থার্ড ইয়ারের দাদা-দিদি গুলোকেও কিভাবে যে পটিয়ে ফেলেছে। কলেজে বোধহয় এমন একটাও মেয়ে নেই যে ওর জন্য পাগল নয়। আর স্যারদেরও চোখের মণি হয়ে উঠেছে। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক কারণ ছেলেটার মাথায় যে বুদ্ধি আছে সেটা এই কিছুদিনের মধ্যেই খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। অংক জিনিসটা যেন ওর বাঁয়ে হাত কা খেল। ক্লাসের সবাই অনিন্দ্য ফ্যান ক্লাবের সদস্য হয়ে গেলেও আমার একদম সহ্য হয় না ছেলেটাকে কারণটা হলো মিলি। আমি যে কাউকে এরকম পাগলের মতো ভালোবাসতে পারি নিজেই বুঝিনি কোনোদিন কিন্তু মিলিটা শুধু অনিন্দ্যদা আর অনিন্দ্যদা করে যাচ্ছে। আমাকে পাত্তাই দেয় না আর অনিন্দ্যদারও বাকি মেয়েদের চেয়ে মিলি আর পলুর সাথে বেশি দোস্তি। আমি পারতপক্ষে ওর সাথে কথা বলি না। এড়িয়েই চলি। সেদিন বেশ বৃষ্টি পড়ছিল। আমার মনের আকাশও মেঘলা। মিলি বেশ হেসে হেসে অনিন্দ্যদার সাথে গল্প করছে আর আমার বুকে যেন আগুন জ্বলছে। মিলি কাল কলেজ আসেনি। কলেজে এত লোকজন কিন্তু তাও আমাকে শূন্যতা গ্রাস করে ছিল। মিলি হঠাৎ করে আমার দিকে এগিয়ে এলো," পরাগ আমাকে কালকের ডি. পি স্যার এর ক্লাস নোটটা দিবি?" মাথায় আগুন ধরে গেলো, বুকটা দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম," পরাগকে শুধু দরকারের সময় মনে পড়ে।" মিলির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে কেটে কেটে বললাম," আমি দিতে পারব না। তোর তো অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে তাদের কাছে চাইবি যা না।"
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ধারাপাতের আড়ালে আমার চোখের জল হারিয়ে যাচ্ছে। আমার রূঢ় আচরণের পর মিলির মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। চোখের জল সামলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিল। আমিও ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সাইকেল স্ট্যান্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছি। ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না আবার বাড়ি যেতেও পা উঠছে না। মিলিকে যতটা কষ্ট দিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি। কি যে হয়ে গেল সেই মুহূর্তে!
“পরাগ।” কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার সামনে অনিন্দ্যদা।
“ এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছিস কেন?”
“ তাতে তোমার কোনো প্রবলেম আছে?” ক্ষিপ্ত স্বরে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলাম।
“ না আমার কোনো প্রবলেম নেই কিন্তু তোর সমস্যাটা কি? মিলির সাথে ওরকম ব্যবহার করলি কেন? মেয়েটা কত কষ্ট পেয়েছে জানিস?”
“ কারুর কষ্ট পাওয়ার দায় আমার নয়।”
অনিন্দ্যদা মুচকি হেসে বলে উঠলো," তাই নাকি! যার জন্য মন পাগল, যে না এলে তোর মুখখানা শুকনো আমসি হয়ে থাকে, যাকে কষ্ট দিয়ে তোর চোখে জল আসে সত্যিই তো সে দুঃখ পেলে তোর কি।"
আমি ভাবতেই পারিনি এভাবে ধরা পড়ে গেছি তাও আবার অনিন্দ্যদার কাছে! কিন্তু ও আমার কাছে কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে? অনিন্দ্যদা গাঢ় কণ্ঠে বললো," মেয়েটা তোর একটা ডাকের অপেক্ষায় আছে পরাগ।"
ক্ষীণ স্বরে বলি," মানে?"
“ মানে তুই ওকে যতটা ভালোবাসিস ওও তোকে ততটাই ভালোবাসে।”
আমি ভাঙবো তবু মচকাবো না। বললাম," কে বলল আমি ওকে ভালোবাসি?"
“যদি বলি তোর চোখ বলেছে, তোর প্রতিটা এক্সপ্রেশন বলেছে”।
আর কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে অনিন্দ্যদা আমার পিঠে এক চাপড় মেরে বলল," মিলি 45 নম্বর রুমে বসে আছে। অনেক ভিজেছিস এবার যা।" যাকে একটু আগে পর্যন্ত ঘৃণা করতাম এখন তারই শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই। আমি অসহায়ের মত বললাম," মিলি কি আমায় ক্ষমা করবে? আমি এতো খারাপ ব্যবহার করেছি ওর সাথে।" অনিন্দ্যদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো," ভালো যখন বাসিস তখন তার আঘাত সহ্য করার ক্ষমতাও থাকা উচিত। এতো কিছু না ভেবে মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়া, ক্ষমা চেয়ে নিজের মনের কথা বলে দে ওকে তারপর দেখ না কি হয়।"
দু দুটি বছর কেটে গিয়ে আমরা এখন থার্ড ইয়ার। সম্পর্কের সমীকরণ গুলোও বদলে গেছে। অনিন্দ্যদা ঠিকই বলেছিল, মিলি শুধু আমার হাতটা ধরার অপেক্ষায় ছিল। এখন আমরা একদম স্টেডি রিলেশনশিপে আছি আর সবচেয়ে বড় বদলটা এসেছে আমার আর অনিন্দ্য দার সম্পর্কে। একদিন যে ছেলেটা আমার দুচোখের বিষ ছিল আজ তাকেই চোখে হারাই। আমি আর অনিন্দ্যদা এখন বেস্ট ফ্রেন্ড। অনিন্দ্যদাকে যত দেখি অবাক হয়ে যাই। আমাদের ক্লাসের শুভ ওর নাম দিয়েছে মিস্ট্রি ম্যান। সত্যি অদ্ভুত ছেলে। কলেজের প্রথম বছর যে পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে দিয়েছিল আজ সে রেকর্ড মার্কস নিয়ে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট আবার অন্যদিকে ফ্লার্টিং করাটাকে প্রায় শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছে অনিন্দ্যদা। কলেজে বোধহয় এমন একটাও মেয়ে নেই যার সাথে ওর বন্ধুত্ব নেই। তার মধ্যে কিছু মেয়ে আছে মিলি, পলু, অর্পা দের মত যাদের কাছে অনিন্দ্যদা পৃথিবীর সবচেয়ে আদর্শ দাদার প্রতিভূ স্বরূপ আর মিথ্যে বলব না অনিন্দ্য দাও তার এই ভগিনী দলের জন্য সব কিছু করতে পারে। আবার পল সায়েন্সের ডিনামাইট ডিম্পি, বোটানির হট হিয়া এদের মত মেয়ে যাদের কলেজে আসার উদ্দেশ্যই হলো নিজেদের রূপের আগুনে ছেলেদের পোড়ানো তাদের জন্য অনিন্দ্য সন্যালের কলির কৃষ্ণ অবতারের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সেখানেও ছেলেটা অবাক করে। ওই কলেজে ফ্লার্টিং করার বাইরে আর একটা পাও বাড়ায় না কোনও মেয়ের দিকে । সে যতই রূপে রম্ভা হোক না কেন। আমরা বললে হাসতে হাসতে বলে কি করব বল আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাই না। প্রেম করলে একজনকে বেছে নিতে হবে তাহলে বাকিরা কান্নাকাটি করবে তো। এই তিন বছরে অনিন্দ্যদাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুবাদে একটা কথা বুঝেছি অনিন্দ্য সান্যাল আমাদের কারুর কাছে পুরোপুরি ধরা দেয় নি। যতই আমরা ওর ঘনিষ্ঠ হই না কেন।
“ ওই ম্যাজিক দেখবি তো আয়।” রূপমের ডাকে অবাক হয়ে তাকালাম আমরা।
“ ম্যাজিক?” প্রশ্ন করল সোনালী।
“ আরে হ্যাঁ, বোটানির শাওনি যে কলেজ ফেস্টের দিন ম্যাজিক দেখিয়েছিল সে এখন অনিন্দ্য দার ওপর ম্যাজিক করবে।” আমরা এক লাফে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে এলাম। শাওনি ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া ইস্তক অনিন্দ্য দার পেছনে পড়েছে।
“ একটা ম্যাজিক দেখবে?” বেশ কায়দা করে বলল শাওন।
“ ম্যাডাম দেখালে তো দেখতেই হবে।”
“ ওকে হানি।”
শাওনি একবার অনিন্দ্য দার চারপাশে ঘুরল আর
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অনিন্দ্য দার পার্সটা ওর হাতে চলে এল।
“ ম্যাজিশিয়ান না পকেটমার রে!” পলুর কথায় আমাদের সকলের হাসি পেয়ে গেল।
“ দারুণ।” অনিন্দ্য দা পার্সটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো।
“ নো ওয়ে। এটা এখন আমার। আমি এটা খুলে দেখব।” আদুরে গলায় বলল শাওনি।
“ না, শাওনি। ওটা ফেরত দাও।” স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে কড়া গলায় বলল অনিন্দ্য দা।
“ উঁহু।” চোখ নাচিয়ে বলল শাওনি। ততক্ষনে পার্সটা খুলে ফেলছে সে।
“ এমা, কোন অদ্যিকালের একটা লাল হয়ে যাওয়া ফোটো রেখেছ পার্সে। সো ডাউন মার্কেট।” ন্যাকা ন্যাকা স্বরে বলল শাওনি।
অনিন্দ্য দা আবার গম্ভীর স্বরে বলল, “ ওটা এক্ষুনি ফেরত দাও আমাকে।”
“ নো ওয়ে এটার জায়গা ডাস্টবিন।” কথা বলতে বলতেই ফটোটা মুড়ে বারান্দার নিচে বর্ষার জল জমা গর্তটায় ফেলে দিল শাওনি।
“ শাওনি ই ই….”। চিৎকার করে উঠলো অনিন্দ্যদা। মুহূর্তের মধ্যে ছুটে নিচে নেমে কাদা-জলের মধ্যে থেকে পরম মমতায় ফটোটা তুলে নিল।
“ আর ইউ ম্যাড অনি।” শাওনি ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠলো।
“ ইয়েস, আয়াম ম্যাড। আর কোনও দিন ভুলেও আমার সাথে এরকম বিহেভ করার চেষ্টা করো না আদার ওয়াইজ আই উইল নট স্পেয়ার ইউ।” কেটে কেটে কথাগুলো বলল অনিন্দ্য দা। তার দুচোখে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশের সাথে সাথে একটা চাপা কান্নাও যেন উঁকি দিচ্ছে। গটগট করে ব্যাগটা নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল অনিন্দ্য দা। আমরা এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় এতটাই হতভম্ব যে অনিন্দ্য দার সাথে কোনও কথা বলার সাহসটাই পেলাম না।
গত তিন দিন অনিন্দ্য দা কলেজ আসেনি। আজ ছুটি। ফোন করতে বলল জ্বর হয়েছে। এই দু বছরে অনিন্দ্য দা বহুবার আমার বাড়িতে এসেছে। আমার মা-বাবা তো অনিন্দ্য বলতে অজ্ঞান। কিন্তু অনিন্দ্য দা কখনও ওর ফ্ল্যাটে যেতে বলেনি আমাকে বা অন্য কোনও বন্ধুকে। আমি কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বের দোলাচলে ভুগছিলাম কিন্তু আমার চিরকালের মুশকিল আসান আমার মা বলল, “ ও একলা থাকে তাই কখনও ডাকে নি তাই বলে ছেলেটা অসুস্থ আর তুই খোঁজ নিতে যাবি না একবার।” মায়ের কথা শুনে আমার সমস্ত দ্বিধা কেটে গেল। যাওয়ার সময় মা আবার হালকা কিছু খাবার দিয়ে দিল। মায়েরা বোধহয় এমনই হয়।
অনিন্দ্য দার ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন ওর মা। এই প্রথম কাকিমাকে সামনা-সামনি দেখলাম। অনিন্দ্য দার দিব্যকান্তি চেহারার উৎস আজ বুঝলাম। আমি নিজের নাম বলতেই কাকিমা ঝরা শিউলির মত একরাশ হাসি ছড়িয়ে বললেন, “ বাবুর কাছে অনেক গল্প শুনেছি তোমার। তোমার মা-বাবার কথাও খুব বলে। ভালোই হলো এসেছ বলে দেখা হয়ে গেল তোমার সাথে। ভেতরের ঘরে যাও বাবু শুয়ে আছে।”
“ কেমন আছে এখন?”
“ কাল বিকেল থেকে একটু ভালো। ছেলে তো আমার এত চাপা ফোনে একটুও বলেই নি যে এত শরীর খারাপ। ওর গলা শুনে আমার সন্দেহ হয় তাই কাল সকালে চলে এসে দেখছি এই কান্ড। জ্বরে প্রায় বেহুঁশ।”
“ আমাদেরও তো কিছু জানায় নি। “ আমি বলি।
“ দ্যাখো না। ওই রকম পাগল ছেলে আমার। নিজের কষ্টের কথা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। শুধু গুমরে মরে। পারো যদি বন্ধু হয়ে একটু ওর পাশে থেকো বাবা।” কান্নাভেজা গলায় বললেন কাকিমা। আমি কিছুটা অবাকই হলাম কাকিমার এই আচরণে।
অনিন্দ্য দার রুমে ঢুকে দেখলাম চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। স্বভাব কৌতূহলী আমি এই সুযোগে গোটা ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। ঘরের প্রায় একটা দেওয়াল জুড়ে ছোটো বড় অনেকগুলো ফ্রেমবন্দি ছবি। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রতিটা ছবিতে একজন মানুষের উপস্থিতি আছেই। শ্যামলা দোহারা খুব সাধারণ চেহারার একটি মেয়ে। কিশোরীই বলা যায়। বেশিরভাগ ছবিতে কিশোর বেলার অনিন্দ্যদার সাথে। কোনও ছবি আবার বলে না দিলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ওদের ছেলেবেলার । টেবিলের ওপরও একটা ফ্রেম। সেদিনের দোমড়ানো মোচড়ানো ছবিটাকে ঠিক করার চেষ্টাও চোখে পড়ল। সেখানেও অনিন্দ্যদা আর ওই মেয়েটির হাসিমুখ। ছবিটা আকারে ছোট হলেও দুজনের মুখ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেওয়াল জোড়া ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল নেই। আমার সম্বিৎ ফিরল অনিন্দ্যদার ডাকে, “ কখন এলি?” উঠে বসেছে অনিন্দ্যদা।
“ একটু আগে।” আস্তে করে বললাম আমি।
“ আয় বোস।” অনিন্দ্যদার খাটের ওপরেই বসলাম আমি।
“ কেমন আছ?”
“ ভালো।”
আমার মনে হাজার জিজ্ঞাসা কিন্তু কেন জানি না অনিন্দ্যদাকে প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছে না। কলেজে সেদিনের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অস্বস্তি নিয়ে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। শেষে অনিন্দ্যদাই নীরবতা ভঙ্গ করল, হাসতে হাসতে বলল “ কি রে এত কি ভাবছিস? কোথায় হারিয়ে গেলি?” আমি কিছু না বলে শুধু হাসলাম। অনিন্দ্যদা চোখ টিপে বলল, “ মিলিকে নিয়ে আসতে পারতিস তাহলে মা তোদেরকে যুগলে দেখতো।” আমি হেসে ফেললাম। অনিন্দ্যদাকে পরিচিত মেজাজে দেখে সাহস ফিরে পেলাম। একটু দম নিয়ে মনের প্রশ্নটা মুখে নিয়ে এলাম, “ সেদিন ওভাবে এত রেগে গেলে কেন আর এই ছবিটা কার?” অনিন্দ্যদার মুখটা মুহুর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল, “ প্লিজ, পরাগ সেদিনের ঘটনার কথা তুলিস না। মনে পড়লেই মাথায় আগুন জ্বলে যায়। কিছু মানুষ থাকে যারা এত আত্মকেন্দ্রিক যে অন্যের ইমোশন, সেন্টিমেন্ট কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। বারণ করা সত্ত্বেও শাওনি ফটোটা ফেলে দিল! আমি ভাবতেই পারছি না কেউ এরকম হয় কি করে!” অনিন্দ্যদার চেহারায় বেদনার রেখা উঁকি দিচ্ছে।
“ ওসব আর মনে রেখ না। বললে না তো কার ছবি এত যত্ন করে রেখেছ?” নরম গলায় বলি আমি।
ম্লান হেসে গাঢ় স্বরে অনিন্দ্যদা বলল, “ আলো। আমার আলো।”
“ কোথায় থাকে গো?” একটু সহজ গলায় বলি।
“ আমাদের ওখানেই থাকত।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় অনিন্দ্যদা।
“ এখন থাকে না?” পাল্টা প্রশ্ন করি আমি।
মাথা নাড়ে অনিন্দ্যদা, “ চলে গেছে। অনেক দূরে চলে গেছে। বলে গিয়েছিল দুদিন পরেই ফিরে আসবে। এসেওছিল কিন্তু চিরকালের জন্য আমাকে ছেড়ে যাবার জন্য।” কিছু বুঝতে না পারলেও অনিন্দ্যদার যন্ত্রণাটা আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। অনিন্দ্যদা হঠাৎই বিহ্বল হয়ে বলতে শুরু করল তার আলোর কথা, মনে হলো যেন সেদিনের ঘটনার অভিঘাত কাটাতে চাইছে “ জানিস পরাগ কবে যে আলোর সাথে আমার বন্ধুত্বের শুরু আমরা নিজেরাও জানতাম না। কাছাকাছি বাড়ি আমাদের। জ্ঞান হওয়া ইস্তক এটা অনুভব করেছি যে একে অপরকে ছাড়া আমাদের চলে না। কোনও বাচ্চা আলোর পুতুল ভেঙে দিলে অনি তাকে পিটিয়ে দিত আবার কেউ অনিকে কিছু বললে আলো কোমর বেঁধে তার সঙ্গে ঝগড়া করতে লেগে যেত। এভাবেই একে অপরকে জড়িয়ে বড় হতে লাগলাম আমরা। পড়াশোনাতেও দুজনেই ভালো ছিলাম। একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম আমরা। পালা করে ফাস্ট-সেকন্ড হতাম। আলো যতটা না আমার ওপর নির্ভরশীল ছিল আমি ওর ওপর নির্ভর করতাম তার থেকে অনেক বেশি। আমারই প্রশয়ে দিন দিন আলো আমার গার্জেন হয়ে উঠছিল। আমার ওপর ওর কর্তৃত্ব আমি মন-প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতাম। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক আরও গাঢ় হলো যখন আমার দিদির বিয়েতে আমার এক খুড়তুতো মাসির মেয়ে রূপাদির সাথে আলোর দাদা এবং পরিবারের বাকিদের পরিচয় হলো এবং সেই পরিচয় পরিণয় পর্যন্ত গড়ালো। আমার রূপাদি আলোর বৌদি হয়ে গেল। দুই পরিবারের সম্পর্ক আত্মীয়তায় বদলে গেল। আমাদের দিনগুলো পড়াশোনা, খেলাধুলা, মেলা দেখা, হাসি মজা খুনসুটিতে বেশ কেটে যাচ্ছিল। কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই। আমি বাজে ছেলেদের আলোর ধারেপাশেও আসতে দিতাম না আর আমার নাছোড়বান্দা প্রেমিকার দল এবং তাদের প্রেমপত্র সামলানোর দায় ছিল আলোর। কাকে কিভাবে কাটানো যায় তার প্ল্যান করতাম দুজনে। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলত, “ দুনিয়ায় কি একই সাথে দেখতে ভালো আর পড়াশোনায় ভালো একটিই ছেলে আছে?” ছদ্ম অভিমানে বলত, “ সেই ক্লাস সেভেন থেকে শুরু হয়েছে আর আমি পারছিনা তোর প্রেমিকাদের সামলাতে।” আমি চোখ পাকিয়ে বলতাম, “ এই ওরা আমার প্রেমিকা নয়। আমি আজ পর্যন্ত কারুর সাথে প্রেম করিনি। আমার পেছনে পড়বে তো আমি কি করব?” আলো নাক ফুলিয়ে বলত, “ হুম, তুমি তো ন্যাকা কেষ্ট।” মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিকে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হলাম। জোর কদমে পড়াশোনা চলতে লাগলো। আমার প্রিয় বিষয় অঙ্ক আর আলোর কেমিস্ট্রি। দুজনের চোখেই তখন অনেক স্বপ্ন। তখন পর্যন্ত ভাবতাম আলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যখন একদিন আমার সামনেই পরিচিত এক মহিলা আলোর মাথায় হাত রেখে দুঃখ করে বললেন যে ওনার আর বিবাহযোগ্য ছেলে নেই তাই নইলে আলোর মত লক্ষ্মী মেয়েকে তিনি পুত্রবধূ করতেন। সামান্য কথা যার কোনও মূল্য নেই বললেই চলে কিন্তু সেই মুহুর্তে আমার বুকটা চিনচিন করে উঠেছিল। সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আস্তে আস্তে নিজের মনের গহনে লুকিয়ে থাকা সত্যিটা আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, আলো আমার কাছে বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকেও অনেক বেশি কিছু। আমি আলোকে শুধু বন্ধু হিসেবে নয় অন্যভাবেও সারাজীবন আমার পাশে চাই। আলোর প্রতি আমার অনুভূতিগুলোকে আমি নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম। যে মেয়েটার সাথে ছোটবেলায় মারপিট পর্যন্ত করেছি তার হাতের সামান্য ছোঁয়াতে আমার মনে ফাগুনের রং লাগতে লাগলো। কত সুন্দরী মেয়ে আমার পেছনে পড়ে থাকতো, তাদের জন্য কোনও দিন কিছু অনুভব করিনি কিন্তু আলো যখন কোনও বিয়ে বাড়িতে শাড়ী পরে মাথায় একটা গোলাপ গুঁজত আমার মনে হত শুধু ওকেই দেখি। আমি নিজের বোধবুদ্ধি, চেতনা সমস্ত দিয়ে পরিস্কার বুঝে গিয়েছিলাম যে আলোই আমার প্রেম, আলোই আমার ভালোবাসা। বহুবার ইচ্ছে হয়েছে আলোকে নিজের মনের কথা বলার কিন্তু কেন জানি না ভয় পেতাম। আসলে অনেক কম বয়স থেকে এত মেয়ে আমাকে প্রেম নিবেদন করেছে আর সেই সব ঘটনার সাক্ষী আলো এইকারণে আমি আলোকে আমার মনের কথা জানালে ওর প্রতিক্রিয়া কি হবে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাছাড়া আমার কাছে খোলামেলা, প্রাণোচ্ছল হলেও আলোর মধ্যে একটা স্বভাব গাম্ভীর্য, একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল যার জন্য আমি ওকে শ্রদ্ধা করতাম আর অনেকে ভয় পেত। আমার মনে হচ্ছিল আলো যদি আমাকে ভুল বুঝে আমার থেকে দূরে সরে যায়। আসলে বয়সটা তো তখন অনেক কম। সব মিলিয়ে আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম তাছাড়া তখন উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছি পড়ার চাপও প্রচুর তাই আমি আমার মনের কথা মনেই চেপে রাখলাম। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমরা ঠিক করলাম আমি অঙ্ক আর আলো কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সাধ দুজনের কারুরই ছিল না। আমাদের লক্ষ্য বিজ্ঞানী হওয়া। আমি ঠিক করলাম গ্রাজুয়েশন করতে যখন দুজনে বাইরে আসব তখন নতুন জায়গায় গিয়ে আমি আলোকে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেব। আমাদের পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাস খানেক পরে একদিন আলো জানালো যে ও ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা বিয়েবাড়িতে দুর্গাপুর যাচ্ছে। সেদিন রাধাচূড়া গাছটার তলায় বসে আমি ওর হাতটা ধরে বলেছিলাম, “ যাস না আলো। তুই থেকে যা। আমি তোকে রথীপুরের মেলায় নিয়ে যাব। প্লিজ, যাস না।” আলো আমার চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলেছিল, “ পাগল একটা। দুদিন পরেই তো ফিরে আসব। তারপর যাব মেলায়। তোর কাছ থেকে একটা চকলেট আইসক্রিম পাওনা আছে আমার।” চলে গেল আলো চিরদিনের জন্য। দুর্গাপুর থেকে ফেরার সময় একটা ট্রাক ওদের গাড়িটাকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে। ভয়ংকর দুর্ঘটনা। আলো, ওর বাবা-মা আর ড্রাইভার চারজনই স্পট ডেড। জানিস পরাগ আমি ঠিক করেছিলাম পরের দোলে আলোকে লাল আবিরে রাঙিয়ে দেব। শরীরটা রক্তের লালে রাঙিয়ে ফিরল ও। সারা দেহে কাঁচের টুকরো ঢুকে ছিল। জানিস, আলোকে কোনও দিন বলা হলো না হলুদ শাড়িতে ওকে কত সুন্দর দেখায়, আইসক্রিমটাও আর খাওয়ানো হল না, একটাও রক্ত গোলাপ দেওয়া হলো না। আমি আলোর মৃত্যুটা সহ্য করতে পারলাম না। পাগলের মতো হয়ে গেলাম। আলোর ক্ষতবিক্ষত শরীরটা সব সময় চোখের সামনে ভেসে উঠত। উচ্চ মাধ্যমিকের রেসাল্ট বেরল স্কুলের মধ্যে আলো ফাস্ট আর আমি সেকন্ড। কলেজে ভর্তি হলাম কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারলাম না। আমাকে সামলে রাখার মানুষটা যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বাড়ির সবাই অনেক চেষ্টা করেছে আমার পাশে থাকার কিন্তু আমিই সব কিছু থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। একটা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। ঘরবন্দি করে রাখতাম নিজেকে। কয়েকদিন পর হঠাৎ রূপাদি সকাল বেলা ফোন করে আমাকে ডেকে পাঠালো। গেলাম ওদের বাড়ি। সে বাড়ির আনাচে কানাচে থেকে আমার আলোর স্মৃতি ভেসে আসছে। রূপাদি আমাকে সোজা আলোর ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম রূপাদির চোখে জল। ধরা গলায় রূপাদি বলল, “ আলোর আর বাবা-মায়ের রুম দুটো আমরা একই রকম রেখে দিয়েছি। কাল ঝাড় পোঁছ করতে গিয়ে এটা পেলাম। তুই এটা পড়ে দেখ তারপর ঠিক কর নিজের জীবনটা কীভাবে কাটাবি। এরকম তিলে তিলে নিজেকে শেষ করবি না আলো যেভাবে চাইত সে ভাবে বাঁচবি।” একটা ডায়েরী আমার হাতে দিয়ে রূপাদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ডায়েরী খুলেই আমি চমকে উঠলাম। এ কী লিখেছে আলো! “ আমি অনিকে ভীষন ভালোবাসি কিন্তু ওকে কোনও দিন বলতে পারব না। কত সুন্দরী মেয়ে ওর জন্য পাগল আর আমি প্রায় কালো, সাধারণ দেখতে একটা মেয়ে।” পাতা উল্টে উল্টে পড়তে লাগলাম আমি। পরস্পরের প্রতি আমাদের অনুভূতি ছিল একইরকম কিন্তু কেউ কাউকে সাহস করে বলে উঠতে পারিনি। আর আলোটা তো একটা বোকা ভেবে বসেছিল রূপ দেখে মানুষ ভালোবাসে। কেউ হয়ত বাসে কিন্তু ওর অনি ওরকম নয় সেটা ও বুঝতেই পারেনি। আমার কাছে ওর চেয়ে সুন্দর যে আর কেউ নেই। কয়েকটা পাতায় লেখা ছিল, “ আমি হয়ত সারাজীবন অনির সাথে থাকব না কিন্তু আমি যেখানেই থাকি অনির খুশি আমার কাছে সবার আগে। অনির হাসি মুখটা দেখলেই আমি পৃথিবীর সব ভুলে যাই। অনিকে কষ্টে থাকতে দেখলে ওর চেয়ে বেশি কষ্ট আমার হয়। ঈশ্বর, অনি যেন সারাজীবন এই রকম হাসিখুশি, প্রাণবন্ত থাকে।” আলোর ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় শুধু আমি। ডায়েরীটা পড়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম পাগলের মতো । তারপর আলোর সেই ডায়রিটা বুকে জড়িয়ে ওকে প্রমিস করেছিলাম যে আমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব। ওর সব ইচ্ছে পূরণ করব। ও চাইত আমি যেন জীবনে অনেক বড় হই তাই আবার মন দিয়ে পড়াশোনা করব। সব সময় হাসিখুশি থাকব যেমন ওর সাথে থাকতাম। আমি আমার জীবনটাকে সেই ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমি নিজেকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যাব যেখানে আলো আমায় দেখতে চেয়েছিল। সেই সমস্ত জায়গায় ঘুরতে যাব যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল ওর। আমি জানি আলো সবসময় আমার সাথে আছে। আমি রোজ রাতে সারাদিনের সব কথা আলোর সাথে শেয়ার করি। আমার পেছনে লাইন দেওয়া মেয়েগুলোর কথাও। তোদের কথাও। সেই ছোটবেলার অভ্যেস তো। জানিস পরাগ, আমি ঈশ্বরের কাছে প্রতিনিয়ত একটাই প্রার্থনা করি যে এই জন্মে তো আলোকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিলে কিন্তু পরের জন্মে আর না। যদি পাখী হয়ে জন্মাই তাহলে যেন দুজনে একসাথে নীড় বাঁধতে পারি কিংবা ডানা মেলে একসাথে হারিয়ে যেতে পারি নীল আকাশের বুকে। যদি গাছ হয়ে জন্মাই তাহলে যেন আলো লতা হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে।”
টেবিলের ওপর থেকে আলোর ফটোটা নিয়ে গভীর আদরে তাতে ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে অনিন্দ্যদা। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এক সফল প্রেমিককে, সফল বন্ধুকে শুনলাম এক সফল প্রেমের, অন্তহীন বন্ধুত্বের গল্প । শুধু শারীরিক ভাবে কাছাকাছি থাকলে বা মিলিত হলেই কি প্রেমের সার্থকতা? দূরে গেলেই কি বন্ধু ভুলে যায়? নাহ, প্রেম বা বন্ধুত্বের সার্থকতা তো নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসাতে যেখানে থাকবে সাগরের মতো অনন্ত গভীরতা আর ছায়াপথের মত সীমাহীন ব্যাপ্তি। জীবন মৃত্যুর সীমারেখাও যেখানে মুছে যায়। একটা মানুষ চলে গিয়েও আরেকটা মানুষের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছে আর আরেকজন স্মৃতির নৌকোর হাল ধরে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মিস্ট্রি ম্যানের মিস্ট্রিটা সত্যিই মিষ্টি। পৃথিবীর মধুরতম সংগীত তো করুণতম বেদনার রাগেই সুর তোলে।