হাবলুর কীর্তি
হাবলুর কীর্তি
১
আমাদের রাখাল ময়রার ছেলে হাবলুর বুদ্ধিসুদ্ধির আর বিকাশ ঘটল না কোনোদিনই| কোনো কাজ যদি সময়মত সম্পন্ন হয়! বছর ষোলো বয়স হল, তবু এখনো ষষ্ঠ শ্রেণী উত্তীর্ণ হতে পারল না| অতদূরই বা যাই কেন, সকালের কাজ ওর শেষ হয় বিকালে আর বিকালের কাজ হয় পরের হপ্তায়| মাস্টারের দেওয়া বাড়ির কাজ তো স্কুলে ফেরত আসেই না| বিস্তর কানমলা, বেতের পিটানি খেয়ে খেয়ে হাবলুর আজকাল আর ওসব গায়ে লাগে না| সে মনের আনন্দে সুর দিতে দিতে, ডাঙ্গুলি খেলতে খেলতে, আনমনে ঘুরে বেড়ায় যেদিকে মন চায়| আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ওর পেছনে মিচকে শয়তানি করা সব বন্ধুদেরকে একদিন আচ্ছা করে সায়েস্তা করে ছাড়বে|
যতক্ষন ভাবা, ততক্ষনই| ব্যাস, তারপর ভুলে যায় ওর প্রতিজ্ঞার কথা|
একদিন শেষ বিকেলে, সব বন্ধুরা মিলে খেলার মাঠে গোল হয়ে পরামর্শ করছে| হঠাৎ হাবলু এসে হাজির|
'কি রে হাবলু, পড়া হয়ে গেল এত তাড়াতাড়ি?' ফুট কাটে রমেশ, হাবলুদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়|
'আমি এই সময় পড়ি নে' ভুরু কুঁচকে অসন্তুষ্ট হয়ে বলে হাবলু|
'তবে কোন সময় পড়িস রে?' হাবলুর সুর অনুকরণ করে বলে চন্ডী|
'আরে ও পড়লে তো টের পেতি| মাথায় বুদ্ধি না এসে সব বুদ্ধি যায় হাঁটুতে| তাই তো বছর বছর ক্লাসে না বেড়ে ও লম্বায় বাড়ে' কানাইয়ের এই কথায় সবাই অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল|
বেজায় ক্ষেপে গেল হাবলু| এরা এইটুকু সব ছেলে, ওকে পেয়েছে কি? এত্ত দুঃসাহস! এক্ষুনি মজা দেখাচ্ছে ব্যাটাগুলোকে|
কিন্তু সে এক মুহূর্তের রাগ| হাবলু আমাদের চিরকালই ঠান্ডা মেজাজের| ও জানে যে এই সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে| তা নাহলে যে কাজে এসেছে, সেটাই ভুলে যাবে যে|
'আমি চলেছি মৃদুলমাস্টারের ফুলবাগানে| আমাকে আজ ডেকেছেন, বাগান দেখাবেন স্যার'
'কে নতুন হেডমাস্টার স্যার?' গোল্লাগুল্লা চোখ করে বলে রমেশ
'হ্যাঁ, আমাদের নতুন হেডমাস্টারমশাই' বুক ফুলিয়ে বলে হাবলু
হাবলুদের প্রাইমারি স্কুলে নতুন হেডমাস্টার এসেছেন মাসখানেক হল| কিন্তু তিনি যে বেজায় বদমেজাজি! ছাত্রদের ফাঁকি বা গোলোযোগ দেখলেই, বেধড়ক পেটানি দেন|
একমাত্র হাবলুকেই কোনো রহস্যময় কারণে খুব স্নেহ করেন| সেই কারণটা যে কি, সেটা জানার জন্য হাবলুর বন্ধুরা বড্ড ব্যাকুল| তাই এই সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায়না! নিমেষে পরিবেশের পরিবর্তন হয়ে গেল| সব বন্ধুরা হাবলুকে ধরে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো, তাদেরকেও মৃদুলমাস্টারের ফুলবাগান দেখাতে নিয়ে যেতে হবে|
হাবলু সবরকম প্রস্তাবেই নারাজ| এসব দুষ্ট বন্ধুদের নিজের গুপ্ত কুশলকর্ম দেখানো যায় না মোটেই|
হঠাৎ রমেশ হাবলুর হাতে ধরা একটা পুটুলি দেখিয়ে বললে
'এই হাবলু, ওটা কি রে তোর থলেতে'
'এটা?' খুব হেসে হাবলু বলে 'এই ঝুলিতে ভরে রাখি মৃদুলমাস্টারের ফুলগাছে লাগানোর সার| এ হল খাস ধূমকেতু ধরার থলি'
'কি?' সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল সবাই
'ও তোরা বুঝবিনে| আমায় ছাড় এবার, দেরি হয়ে যাচ্ছে' মুখ বেঁকিয়ে বলে হাবলু|
'না না তা হচ্ছে না' এগিয়ে এসে বলে চন্ডী, 'ঐটা কিসের ঝুলি বললি? কি হয়ে ওতে?'
'তোদের জানাতে মানা আছে| মৃদুলমাস্টার একমাত্র আমাকেই দায়িত্ত্ব দিয়েছেন এই কাজের' কিছুটা গর্বের হাসি হেসে বলে হাবলু
'বটে! বলেই দেখ তবে' বলে রামেশ
'আচ্ছা বেশ বেশ' নাকাল হওয়ার ভঙ্গিমায় হাবলু, 'তোরা যখন এতই পীড়াপীড়ি করছিস তখন বলছি'
'বল বল শুনি' ওকে ছেঁকে ধরে ছেলেরা
'শোন্ তবে' যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে, একগাল হাসে হাবলু|
২
হাবলুর কথা শুনে কিছুক্ষণ সবাই চুপ হয়ে গেল|
তারপর সমস্বরে সকলের গলা শোনা গেল 'আমি যাবো, আমি যাবো, আমি দেবো, আমি দেবো'
কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় ওই বনেবাদাড়ে যাবে কে? ওখানে তো শোনা যায় ভুত - প্রেতেদের বাস| অতি সাহসী লোক ছাড়া ওজায়গা এমন সময় কেউ মাড়ায় না|
কিছুক্ষন গোলমালের পর হাবলুই স্থির করে দিল
'আরে এ কি আর এতই সহজ কাজ? তোরা আজ সবাই আমার সাথে চল| দেখে বুঝে নে ব্যাপারখানা কি? তারপর না হয় ঠিক হবে কে কবে পালা করে আসবি'
এই প্রস্তাব সকলেরই মনঃপুত হলো|
মৃদুলমাস্টারকে খুশি করা নিয়ে কথা! আর হাবলু যখন পারছে, তখন সে যত অসম্ভব কাজই হোক না কেন, ওরা যে কেউ পারবে, এই ব্যাপারে সকলেই সহমত| আহা, তবেই না মাস্টারের অত সুন্দর রাজকীয় বাগানটা ওরা চাক্ষুষ দেখতে পাবে! কে জানে, হয়তো মাস্টারের স্নেহের পাত্র হয়েও উঠতে পারে, হাবলুর মতন|
ভীতত্রস্ত তবু কৌতূহলী একদল ছেলে চলল হাবলুর সাথে|
হাবলুর আজ আর গর্বের শেষ নেই| আজ কি না ও দলপতি!
অবশেষে ওরা পৌঁছায় আমলকি বনে|
'এই রামেশ, ধর তো থলেটা, আমি এগিয়ে গিয়ে জায়গাটা দেখে আসি| শান্তশিষ্ট জায়গা না পেলে এ কাজ হয়না| খুব মনোযোগ লাগে কি না' কিছুটা হুকুমের সুরে কথাগুলো বলল হাবলু|
ওর কথামতন রামেশ খপ করে ধরলো থলেটা| উফফ, কি ভারী! না জানি কত কিছু আছে এর মধ্যে? একদল ছেলে অপেক্ষা করতে লাগল আমলকি বন ঘেঁষে, আর হাবলু মিলিয়ে গেল জঙ্গলের ভেতর|
বেশ অনেক্ষন কেটে গেছে, হাবলুর আর পাত্তা নেই| একে মশার উৎপাত, তায় আবার সবাই ভয়ে জড়সড়, তবুও কেউ জঙ্গলে অগ্রসর হতে বা বাড়িতে ফেরত যেতে নারাজ| গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা প্রায় আসন্ন| টুপটুপ করে জ্বলে উঠছে একটা দুটো করে আকাশবাতি|
এমন সময় হঠাৎ একটা চাঁচাছোলা আওয়াজ
'এই তোরা এই ভর সন্ধ্যায় এখানে কি করছিস?' সবাই ফিরে দেখে মৃদুলমাস্টার|
'স্যার, আমরা আমরা...'আমতা আমতা করতে থাকে চন্ডী|
'কি আমরা আমরা করছিস? এটা আমলকি বন, আমড়াবন নয়' মাস্টারের ধমকানিতে সবাই তটস্থ|
'স্যার হাবলুটা তো জানেন, কোনো কাজ পারেনা ঠিক করে' হাল ধরে রামেশ, 'আপনার জন্য তাই আজ আমরাই ধূমকেতু ধরতে এসেছি স্যার'
'কি করতে এসেছিস?' মৃদুলমাস্টারের চক্ষু চড়কগাছ|
হাসিহাসি মুখ করে কানাই বলে
'স্যার, ওই যে, আমলকির বনে, সন্ধ্যে নামলে, যখন প্রতি মাসে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, তখন সেই সন্ধ্যার সময় একটা ধূমকেতু ছিটকে, খসে পরে জঙ্গলের মাটিতে| আমরা সেই কারণেই তো অপেক্ষা করছি স্যার| ওটা খসে পড়লেই আমরা টুপ্ করে ওটা ব্যাগে ভরে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসব| এক্কেবারে তাজা অবস্থাতেই| ওর থেকে তো গাছের ভালো সার হয়| আপনার বাগানের ফুলগাছ আরও সুন্দর হবে'
'এই দেখুন স্যার, এক ব্যাগ ধূমকেতু' বলে রামেশ থলেটা খুলে মাটিতে ঢালতেই, মাস্টারের পায়ের কাছে হুড়মুড়িয়ে পড়ল কতগুলো থান ইট|
'ছ্যাবলামি হচ্ছে আমার সাথে?' স্যারের হুঙ্কার না বাঘের গর্জন এল, ঠিক বোঝা গেল না| তবে নিমেষে স্থান ফাঁকা হয়ে গেল|
অশ্বত্থ গাছের মাথায় বসে হাবলু তখন টকমিষ্টি লেবু খাচ্ছে আর হোহো করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছে|