হ-য-ব-র-ল
হ-য-ব-র-ল
হ-য-ব-র-ল
শুভময় মণ্ডল
আমরা হলাম আমাদের গ্রামের একমাত্র কবাডি খেলিয়ে পঞ্চপাণ্ডব দল - লোকে বলে হ-য-ব-র-ল। কারণ, আমাদের পাঁচ জনের নাম - হরি, যাদব, বাপি, রবি আর লাল্টু। আসপাশের কোনো গ্রাম নেই যেখানে গিয়ে আমাদের দল কবাডি চ্যাম্পিয়ান হয়ে ফেরেনি।
আমাদের গ্রামের দিকে বড় দল করে কবাডি খেলার চল নেই - পাঁচ জনের টীম বানালে, এক একটা গ্রাম থেকেই দুই তিনটে করে টীম তৈরী করা যায় সহজেই। আর তাতে ষোলো থেকে বত্রিশটা পর্যন্ত টীম জোগাড় করে ফেলা যায় সহজেই। তাই যেকোন গ্রামের ছোট বড় যেকোন ক্লাবই সহজেই টুর্ণামেন্টের আয়োজন করে ফেলে। বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল এই ধরণের টুর্ণামেন্টগুলো একসময়।
যাই হোক, আমাদের পঞ্চপাণ্ডব টীমকে সমীহ করতো না এমন কোনো দলও ছিল না, আয়োজক ক্লাবও ছিল না। আমাদের খেলা দেখার জন্য ভিড়ও হতো দেখার মত - স্টীভ ওয়া, রিকি পন্টিংএর সময়ের অস্ট্রেলিয়ার মত আমরা তখন একচেটিয়া অপরাজেয় দল হয়ে উঠেছিলাম।
তো এইরকমই একটা টুর্ণামেন্ট খেলতে একটু দূরের এক গ্রামে গিয়েছি - নাম উদাসপুর, ইস্টার্ণ রেলের একটা হল্ট স্টেশন, তার পাসেই খেলার মাঠটা। ট্রেনে আসার সময় একদিন, আমাদের গ্রামের সুকুমার কাকু ওদের টুর্ণামেন্টের খুব জমকালো প্রচার শুনে, আমাদের বলেছিল ওদের ওখানে খেলতে যাবার কথা। খেলতে গিয়েছিলাম আমরা ট্রেনেই। আমাদের ফাইনাল ম্যাচ পড়লো একদিন বিকেল বেলায় - ওদের গ্রামেরই টীম "দুর্জয় দশ"-এর বিরুদ্ধে!
সে এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা - ওদের যিনি কোচ তিনি পেশায় চণ্ডাল, ওদের গ্রামের শ্মশানেই তাঁর আস্তানা! যৌবনে নাকি ওস্তাদ কুস্তীগির ছিলেন, পরে পরিবারের সকলের অকস্মাৎ একদিন মৃত্যু হওয়ায়, সমাজ সংসার সব ছেড়ে বৈরাগী হয়ে শ্মশানবাসী হয়ে যান। কিন্তু, সব কিছু ছাড়লেও খেলাধূলার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছাড়তে পারেন নি। কুস্তীর চল তাদের গ্রামে আর না থাকায়, তিনি গ্রামের ছেলেদের কবাডি খেলা শেখাতে শুরু করেন! তাঁর কুস্তীর মার প্যাঁচও ভালোই শিখিয়ে দিয়েছিলেন দলের ছেলেদেরকে।
ওদের আবার দশজনের বড় টীম - তাই গ্রাম থেকেই দুটো টীম হয়েছিলো। আর দুটো টীমই একটানা জিতেও চলেছিল, কিন্তু মুশকিল হলো সেমি-ফাইনালে সেমসাইড হয়ে গিয়ে - গ্রামেরই দুটো টীম মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায়, একটা টীম সেমি-ফাইনালে ওয়াক ওভার দেয়। অন্যদিকে আমরাও যথারীতি জিতে ফাইনালে উঠেছি। প্রথম রাউণ্ডে ওরা তো দশ মিনিটেই আমাদের সবকটাকে আউট করে দিয়ে জিতে গেল! কি মুশকিলেই পড়েছিলাম - কুস্তীর প্যাঁচে ওরা খুব সহজেই আমাদের বাধা টপকে বেড়িয়ে গিয়ে, আমাদের সকলকে আউট করে দিল!
পরের রাউণ্ডে আমরাও জুজুৎসু প্যাঁচ দিতে শুরু করলাম - যাতে আমাদের বাধা টপকানোর আগেই, ওদের শ্বাস থেমে গিয়ে ওরাও আউট হয়ে গেলো খুব সহজেই! ব্যাপারটা ওদের চণ্ডাল কোচ মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। চিৎকার করে ছেলেদের উৎসাহ দেবার নামে, আমাদের ধমকি দিতে লাগলেন - আমি কথা দিয়েছি যখন, এই গ্রামের বাইরে যাবে না কাপ। তোমরা জিতবে, জিততেই হবে, দরকার হলে আমি নিজে কোর্টে নামবো!
হলোও তাই - শেষ রাউণ্ডে ওদের একজন আউট হবার পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো (নাকি অসুস্থ হবার ভান করলো)! এরপর আমাদের টীমের একজন যখন আউট হল তখন তার বদলে, ওদের টীমের সেই ছেলেটা কোর্টে ফেরার সুযোগ পেল। কিন্তু তার পরিবর্তে ওদের কোচই তখন নেমে পড়লেন কোর্টে - পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে। দেখে তো আমাদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল, আর জেতার জিদটাও বেশ চেপে ধরলো। এক এক করে ওদের চারজন আউট হলে, শেষে কোচ ডাক দিতে এলেন। আমরাও প্ল্যান করে তাঁকে ক্ষেপিয়ে যেতে লাগলাম, আর তাঁর দম ফুরিয়ে আসছে বুঝে একজোটে তাঁকে চেপে ধরলাম।
।চলবে।