শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics Inspirational

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Tragedy Classics Inspirational

গরম ভাত!!

গরম ভাত!!

5 mins
191


"বন্দেমাতরম্৷

সুজলাংসুফলাংমলয়জশীতলাম্

শস্যশ্যামলাং মাতরম্ !শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনী

ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদলশোভিনী

সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণী সুখদাং

বরদাং মাতরম্"৷৷


দূরে মাইকে গানটা বাজছে। তারই হাল্কা সুর ভেসে আসছে বাতাসে। ঘরের ফুটো ত্রিপলের চাল এবং ছোট্ট কঞ্চির জানলা ভেদ করে সূর্যের আলো ঘরে ঢুকছে। আলো মুখের ওপর পড়তেই ছোট বিলাই এর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাঁশের তৈরী মাচার ওপর বসে নিচে তাকিয়ে দেখল মা.... শুয়ে নেই! তারমানে কাজে চলে গেছে, অবশ‍্য প্রত‍্যেকদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই বিলাই এর মা লতা কাজে চলে যায়। অনেকগুলো বাড়ির কাজ করে, ভোর থাকতে না বেড় হলে যে.... বেলা হয়ে যায় , সবাই তখন দুকথা শোনায় লতাকে। বিলাই শান্ত মনে চোখ বন্ধ করে গানটা শুনতে লাগল । হঠাৎ হাতের ওপর উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে দেখল, ওর ভাই ভোলা..., ফোঁকলা দাঁতে হাসি হাসি মুখে ওর দিকেই চেয়ে আছে।

------বিলাই ভোলার ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে, ঈশারায় কথা বলতে বারন করল। কিন্তু ভোলা আরও কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেনে চুপ করবো দাদা? কি.. হয়িছে?

------বিলাই একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, কেনে শুনতে পাচ্ছিসনে... গান বাজতেছে!

------গানের কথা শুনেই ভোলার চোখে মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। ভোলা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, গান বাজতেছে, বিয়ে বাড়ি নাকি রে... দাদা? চল কেনে দেখে আসি!!! ভালো মুন্দ খাওয়া হবে আজ তাহলে...!

-----বিলাই ভোলার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল, নারে.... ভাই, বিয়ে বাড়ির গান বাজতেছে বলে মোনে তো... হতেছেনা!

------ভোলা বলে উঠল চল কেনে, দেখেই আসি!!! কোথায় বাজতেছে গান, আর কিসের জন‍্যি

-----বিলাই হাসিমুখে বলে উঠল, চল দেখেই... আসি....

বিলাই আর ভোলা দঁড়িতে ঝুলতে থাকা অর্ধ ছেঁড়া গেঞ্জিটা গায়ে গলিয়ে, একটা বস্তা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। অবশ‍্য একটু পরেই বেরতে হত কাজে, মা ফিরে আসলেই, আজ না... হয় একটু আগেই বেরলো!!! তাড়াতাড়ি ফিরবে না হয়!!বিলাই আর ভোলা তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে রেল লাইনের ধারে ধারে পড়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল, প‍্যাকেট কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে থাকল, আর এগিয়ে যেতে থাকল ভেসে আসা গানকে অনুসরণ করতে করতে।

***********************

হঠাৎ বিলাই আর ভোলার চোখে পড়ল ছোট ছোট ওদের মত ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে সাদা জামা পড়ে হাতে জাতীয় পতাকা, ফুলের মালা নিয়ে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, আর ওদের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে কত দিদিমনি, মাস্টারমশাই সবাই সাদা পোশাক পড়েছে, আর একসাথে গাইছে........


"জয় হে... জয় হে... জয়... হে

জয়... জয়...জয়... হে.."।


----ভোলা দাদাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে বলে উঠল কিরে... দাদা দাঁড়ালি কেনে? যাবিনা..! আর ওরা কোথায় যাচ্ছে রে..??

-----বিলাই ভোলার দিকে তাকিয়ে বলল, ওরা ইস্কুলে পড়ে ভাই, দিদিমনি মাস্টারমশাইদের সাথে বেড়িয়েছে পতাকে লিয়ে, আজকে স্বাধীনতা দিবস কিনা, এর লাইগা জাতীয় সঙ্গীত গাইতেছে।

------ভোলা দাদার মুখের দিকে অবাক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল স্বাধীনতা মানে কি... রে দাদা?

------বিলাই বলল অত জানিনেরে ভাই। চল আমরা ওদের পিছন পিছন যাই। ওরা ইস্কুলে গিয়ে পতাকা উড়াবে, তারপর গান হবে, দিদিমনি মাস্টারমশাইরা কত কথা বলবে, আমরা দাঁড়িয়ে শুনবো ভালো হবে।

------ভোলা বলে উঠল তাহলে কাজের কি.. হবে দাদা, পয়সা পাবনাতো, গরম ভাত খাব কেমনে??

-----বিলাই বলে উঠল চল, একটুখানি থেকেই কাজে চলে যাব।

------ভোলা হাসিমুখে বলে উঠল চল।

*************************

ততক্ষনে বাচ্ছাদের দল অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। বিলাই ভোলার হাত ধরে কাঁধে বস্তা নিয়ে দৌঁড়াতে লাগল। ওদের কাছাকাছি এসে গেলে ওদের সুরে সুর মেলাতে লাগল। বাচ্ছারা সব সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন দিদিমনি সাদা শাড়ি লালপাড় পরা, সামনে এগিয়ে গিয়ে লম্বা পোলের কাছে দাঁড়িয়ে দঁড়ি ধরে টানতে লাগল, আর কিছুক্ষনের মধ‍্যেই পোলের মাথায় তিরঙ্গা ফর... ফর... শব্দ করে উড়তে লাগল, আর একগুচ্ছ ফুল ঝড়ে পড়ল নিচে। আনন্দের চোটে বিলাই আর ভোলা হাততালি দিয়ে নেচে উঠল। সাথে সাথে সবার চোখ ওদের ওপর গিয়ে পড়ল।

----ভোলা গুটি গুটি পায়ে বিলাই এর পিছনে লুকিয়ে ধীর স্বরে বলে উঠল, এ... দাদা মারবে নাকি...রে আমাদের? আমরা ভুল করে ফেলেচি নাকি হাততালি দিয়ে ?

বিলাই কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সামনে তাকিয়ে রইল। বাচ্ছাদের ভীড় ঠেলে সেই সাদা শাড়ি লাল পাড়ের দিদিমনি এগিয়ে এসে বিলাই আর ভোলার সামনে দাঁড়াল। বিলাই ভোলার হাতটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

-----দিদিমনি বিলাই এর মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল, কি.... নাম তোমাদের? কোথায় থাকো তোমরা?

----বিলাই হাসিমুখে বলে উঠল, আমি বিলাই আর ও ভোলা আমার ভাই, আমরা রেললাইনের পারে বস্তিতে থাকি।

-------দিদিমনি বলে উঠল স্কুল যাও তোমরা?

------বিলাই এর হাসি ঠোঁটের কোন থেকে মিলিয়ে গেল। বিলাই বলে উঠল, না... কাজে যাই। ইস্কুলে গেলে ভাত খাব কেমনে!!! আর কাজ না করলে কেউ খেতে দেইনে!!

------দিদিমনি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠল, তোমরা দাঁড়াও এখানে আমি আসছি।

-----বিলাই আর ভোলা হাসিমুখে মাথা নেড়ে হ‍্যাঁ.... বলল।

ভোলার ভয় কমেছে তাই বিলাই এর পিছন থেকে বেড়িয়ে এসে ফোঁকলা দাঁতে হেসে উঠল। বাচ্ছারা আড় চোখে বিলাই আর ভোলাকে দেখতে লাগল, আর একবার করে নিজেদের। আসলে ওরা ওদের সাথে নিজেদের পার্থক‍্যটা বোঝার চেষ্টা করছিল। দিদিমনি দুটো প‍্যাকেট হাতে এগিয়ে এসে বিলাই আর ভোলার হাতে দিল।

-----বিলাই বলে উঠল এটা কিরে দিদিমনি??

----দিদিমনি হাসিমুখে বলে উঠল খাবার।

খাবার কথাটা শুনেই বিলাই আর ভোলার মুখের হাসিটা আরও চওড়া হয়ে গেল, এবং চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল আনন্দে। বিলাই হঠাৎ করে দিদিমনির পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করল, আর দাদার দেখে ভোলাও তাই করল।

------দিদিমনি ওদের মাথায় হাত রেখে বলে উঠল, অনেক বড় হও, এগিয়ে যাও জীবন পথে।

----বিলাই ভোলার হাত ধরে আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ির পথে রওনা দিল। বাড়ি ঢোকার আগেই বিলাই মা.... মা...করে চিৎকার করতে লাগল।

-----ছেলের গলার আওয়াজ পেলে বিলাই ভোলার মা লতা ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠল, কি...হয়েছে চিৎকার করছিস কেন???

------বিলাই আর ভোলা মায়ের সামনে প‍্যাকেটটা ধরে বলল, এই দেখ কেনে... খাবার এনেচি।

-----বিলাই এর মা.. লতা বলে উঠল, সক্কাল সক্কাল খাবার কে.. দিল তোদের???

------ভোলা হাসিমুখে বলে উঠল ইস্কুলের দিদিমনি।

লতা খাবার গুলো থালায় বেরে ছেলেদের খেতে দিল। বিলাই এক টুকরো মিষ্টি আর একটু কলা পাউরুটি ছিঁড়ে মায়ের মুখের সামনে তুলে ধরল। ছেলের এইরকম কান্ড দেখে বিলাইএর মা দুই ছেলেকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।

---বিলাই মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে উঠল, কাঁদিস নে.. মা... আমরা আছিতো।

-----ভোলাও সাথে সাথে বলে উঠল, হ‍্যাঁ... মা কাঁদিস নে..., চল খাই খুব খিদে পেয়েচে।

-----বিলাই এর হাত থেকে খাবারটা মুখে পুড়ে চোখের জল মুছে লতা নিজের হাতে ছেলেদের খাইয়ে দিতে লাগল । আর দূর থেকে গানের সুর ভেসে আসতে লাগল বাতাসে........


"আমরা করব জয়

আমরা করব জয়

আমরা করব জয়

নিশ্চয়ই"।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy