Nandita Mondal

Tragedy Classics Children

3.5  

Nandita Mondal

Tragedy Classics Children

গন্ডি

গন্ডি

4 mins
340


আজ চিত্রার সাধ। সেই উপলক্ষ্যে লোক সমাগম আজ বাড়িতে সকাল থেকে তাই সাজ সাজ রব। চিত্রার শরীর টা কদিন থেকেই ভালো নেই। মাথাটা থেকে থেকে দুলে উঠছে। খুব দুর্বল লাগছে। কিন্তু নিয়ম তো নিয়ম! তার অন্যথা হবার যো নেই। তার ওপর বংশে প্রথম সন্তান আসতে চলেছে। চিত্রা দু এক বার বলেছিল কুণাল কে। কিন্তু সেইবা কি বলবে এই সব মেয়েলি ব্যাপারে। উল্টে ওকেই বলে চলে গেল - ' আরে তুমিতো শুধু বসেই থাকবে। তোমাকে তো আর কিছু করতে হচ্ছে না'। এর পর আর কিছু বলার থাকে না চিত্রার। আসল কথা হল কুণালের ওর মায়ের ওপর কথা বলার ক্ষমতা নেই। তাই ওকেই বুঝিয়ে দিয়ে গেল। চিত্রা নিজে যে সাধ হোক চায় না, ব্যাপারটা তা নয়। আসলে ও এত ধুমধাম করে হোক সেটা চায় নি। একটু ফ্যামিলির মধ্যেই ছিমছাম অনুষ্ঠান হোক সেটাই চেয়েছিল। সেই মতো বলেওছিল শাশুড়ি মাকে। কিন্তু ঐ যে বড় করে অনুষ্ঠান করে লোক না খাওয়ালে মান থাকে না।উপরন্তু আরো শুনিয়ে দিলেন অমন শরীর খারাপ এই সময় হয়, বাবু পেটে থাকতে তিনি কত কাজ করেছেন। আজ কালকার মেয়েরা এতটুকু কষ্ট করতে পারে না।আরো কত কি বলেছেন চিত্রা আর শুনতে পারেনি চলে এসেছিল ওখান থেকে।  বলার অপেক্ষা রাখে না শাশুড়ি চিত্রার কথা ধর্তব্যের মধ্যে ধরেননি।

      নানা জন নানা রকম ফল দিচ্ছে চিত্রার আঁচলে । আর নানা রকম হাসি মশকরা করছে। কিন্তু চিত্রার মাথা দুলে উঠছে। ওর এ সব কিছুই ভালো লাগছেনা। তার ওপর 'এতদিন পর নাতির মুখ দেখব' এমনধারার কথা গুলো তার শরীরে আরো জ্বলন ধরিয়ে দিচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে চিত্রার মুখের ওপর বলে দিতে 'কেন নাতনির মুখ দেখলি চোখ দুটো খসে যাবে? নিদেনপক্ষে সুস্থ বাচ্ছা হোক সেটাও তো বলতে পারেন।' এই সব কথা ওর মনেই থেকে গেল। মুখ ফুটে আর বেরলো না। কিছু বললেই সব বলবে ওরা পুরোন দিনের মানুষ। অত কথা ধরলে হয় না। সেই কথা অত ধরলে তো হয়না , কিন্তু কিছু কথার রেশ থেকেই যায় মনের গভীরে যা মাঝে মাঝে কাঁটার মতো বিঁধে। আচ্ছা দোষ কি পুরোন দিনের? নাকি মানুষের ভাবনা চিন্তার? পুরোন দিনেও তো এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাদের চিন্তা ভাবনা সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল। চিত্রা আর ভাবতে পারে না । ঈশ্বর যা করবে ভালোই করবে এই বিশ্বাস রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে।

        কিন্তু যা হয় তা বোধ হয় সবক্ষেত্রে ভালো হয় না। হঠাৎ করে রাত থেকে চিত্রার ব্যথা উঠতে শুরু করে। জল ভাঙতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি করে তাকে হসপিটালাইজড করা হয়।সময়ের তিন মাস আগেই সে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। শুরু হয় আর এক যুদ্ধ। দীর্ঘ আড়াই মাস লড়াই এর পর চিত্রা ফিরে পেল তার মেয়েকে। সবাই খুশি। কিন্তু সব খুশি যে সত্যি খুশি হয় না তা ধীরে ধীরে চিত্রা বুঝল। যত সময় এগতে লাগল নানা মানুষের তার মেয়েকে নিয়ে নানা সমস্যা তার সামনে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। প্রথম আঘাত পেয়েছিল যখন সে প্রসবোত্তর নানা সমস্যায় ভোগার সময় ননদের কাছ থেকে সহবত কুশল জিজ্ঞাসার পরিবর্তে শুনতে হয়েছিল 'এর পরের বার ছেলে হবে'।এমন কথা অনেক বার শুনতে হয়েছে তাকে কাছের মানুষ আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে। ভীষন কষ্ট হয়েছিল। তবে কি কেউ খুশি হয়নি তিন্নি হওয়াতে। সব ওপর ওপর ভদ্রতার মুখোশ পরে আছে।সবাই যেন ওকে সহানুভূতি দেখাচ্ছে, যেন ওকে জোড় করে বোঝাতে চাইছে তোমার মেয়ে হয়েছে দুঃখ কর না । পরের বার আবার চেষ্টা কর ছেলে হবে। ঠিক যেমন লটারীর টিকিট কাটার মতো। চেষ্টা চালিয়ে যাও ঠিক পুরস্কার পাবে। চিত্রার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে এদের 'আমি কোনো সহানুভূতির পাত্রী নয়। আমার মেয়ে হওয়াতে আমার কোনো দুঃখ নেই।' কিন্তু পারে না বলতে। ঐ যে অশান্তি এড়াতে চুপ থাকতে হয় কখনো কখনো। তবে একটা ব্যাপার সে করে যাদের ভদ্রতার মুখোশ তার সামনে খুলে গেছে তাদের সাথে যথা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে। এর পর একটার পর একটা মানসিক হেনস্থা নতুন মা চিত্রার ওপর চলতে থাকে। 'মেয়ে এত রোগা কেন?দুধপায় না নিশ্চয়। তোমার ঠিক মতো দুধ হয় না। আমার বাচ্ছা তো তিন্নির বয়সে বেশ গোলগাল ছিল। ' এমন কথা শুনে শুনে চিত্রা বিরক্ত হয়ে যায়। বেশ কয়েক বার বলেওছে ' ওর শরীরের ধরনটাই ওমন। ও একদম সুস্থ। ' কেউ কেউ তো কোলে নেবার বাহানায় ওজন মেপে দেখে। অথচ কেউ তিন্নির এতটুকু দায়িত্ব নেবে না যাতে চিত্রা একটু বিশ্রাম পায়। তাকে সঠিক গাইড করার বদলে খালি বিচার করা - খুঁত ধরা, অহেতুক উপদেশ দিয়ে যাওয়া। আর একটু বড় হলে 'এখনো হাটতে পারে না? ওমুকের বাচ্ছা আট মাসে হাঁটতে শিখে গেছে। ' 'এখনো কথা বলে না ঠিক মতো ! তমুকের মেয়ে তিন্নির বয়সেই কত ফটফট করে কথা বলে'।'বুধোর ব্যাটা কত অ্যাডভান্স ! দু বছর বয়স থেকেই ছড়া বলে।কত ক শিখে গেছে। তিন্নি তো দেখছি তেমন কিছু পারে না' এমন কথা শুনতে শুনতে চিত্রা প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন আর তার কিছু মনে হয় না। শুধু যারা কথায় কথায় ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে তুলনা করে; একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা করে তাদেরকে নিজের ও তিন্নির জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। একটা অদৃশ্য গন্ডি রেখা টেনে রেখেছে চিত্রা যা সে নিজে পেরয় না আর অপর পক্ষকেও পার হতে দেয় না, তা সে যতই কাছের সম্পর্কের হোক। তিন্নি ওর নিজের মতো করে বেড়ে উঠুক, বড় হোক সর্বোপরি মানুষ হয়ে উঠুক।

        



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy