STORYMIRROR

Nandita Mondal

Inspirational Others

3  

Nandita Mondal

Inspirational Others

ফুলমতি

ফুলমতি

7 mins
228

বীরভূম জেলার একটি ছোট গাঁ কুসুমডাঙ্গা।গাঁ বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমনি গাঁ। পাকা রাস্তা আর কয়েক ঘর পাকা বাড়ি দেখা যায় বটে। আর একটা কি দুটো দোকান আর একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বড় হাইস্কুল, বড় বাজার- হাট দোকান সব তিন কিলোমিটার দূরে পটাশপুরে। কলেজ তো আরো দূর শহরে। সে সাত আট কিলোমিটার হবে পটাশপুর থেকে। ফুলমতি এবার হায়ার সেকেন্ডারি দেবে তাই রোজ তিন কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সে স্কুলে যায়। সে স্বপ্ন দেখে সে একদিন দাদার মতো তার বাবা মার পাশে দাঁড়াবে। তাদের সহায় হবে। তবে তার স্বপ্নটা একটু অন্য রকম। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে বাবাকে। কত দায়িত্ব নিয়ে এক জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বড় লরি করে অন্য জায়গায় দায়িত্ব নিয়ে পৌছে কখনো একদিন বা তিন দিন অন্তর বাড়ি আসত। মাঝে মাঝে ভিন্ রাজ্যেও যেতে হত। তখন তো এক মাস কি দুই মাস পর বাড়ি ফিরত। সেই ছোট্ট বেলা থেকে বাবার কাছ থেকে এই এত জায়গায় ঘোরার সময় নানা ঘটনা- নানা মানুষ বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শুনে নানা গল্প শুনে তার কিশোরী মনের গভীরেও এক সুপ্ত বাসনা তৈরী হতে থাকে।এক অন্য রকম ভাবনা যা ধীরে ধীরে তার স্বপ্নে পরিনত হয়। সেও তার বাবার মতো বড় লরির ড্রাইভার হবে। এমন অদ্ভুত স্বপ্নের কথা শুনে বাবা মা দাদা প্রথম প্রথম হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন তাদের কাছে রীতি মতো বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়ে আজ দুপুরেই এক প্রস্থ হয়ে গেল মায়ের সাথে ফুলমতির।

-'বলি ম্যাইয়া ছ্যাইলা লরি ট্রাক চালায় কুনো দিন শুনেছিস? অতই যখন কাজ কাম করার শখ তুর তো আরো বেটিছেলের কাজ আছে তা উ সব তুর চোখে পইড়া না নাকি? উ সব বড় গাড়ি টাড়ি চালান ব্যাটা ছ্যাইলা লগের কাম। তুর ঐ হারুর ব্যাটার সাথে মাঠে টেরাক্টর চালানের কি দরকার?'

- হ।কাজ কামের আবার ব্যাটা ছেলে ম্যাইয়া ছেলে! কাজ কাজই হয়। মাঠে তো বেটাছেলে বেটিছেলে দুইজনাই খাইট্যো তাতে তো কাজের তফাৎ হয় না! আজকাল তো ম্যাইয়া ছেলেরা কত কি করছে।ব্যাটাছেলে যা করছে ম্যাইয়া ছেলেতেও তাই করছে। তাদের কত স্বপন পূরণ করছে আর আমি আমার স্বপনের কথা বললেই দোষ।

- সবার সব স্বপন কি আর পূরণ হয় রে? আমাদের মতন চাষি মুনিষের বাড়ির ম্যাইয়ারা মাঠে কাজ কাম করে, বিয়া করে ঘরকন্না করে। তা তুই লিখা পড়া করা ম্যাইয়াতো , আরো কাজ আছে করগে যা। হ বেটিছেলে হয়ে কিনা লরি লিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে!

ফুলমতির মা গজ গজ করতে থাকে, ফুলমতিও আর কোনো জবাব না দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। কিন্তু মনে মনে ও যা ভাবার ভেবে নেয়।

              আমরা কোনো কাজ যতটা সহজ ভাবি ততটা সহজ বোধহয় হয় না। বিশেষ করে খুব কম মানুষই নিজের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে ভাগ্য-সময়-পরিবার-পরিস্থিতির সহায়তা পায়। সংখ্যাটা নেহাতই হাতে গোনা। গরীব চাষির ঘরের মেয়ে ফুলমতি সে হাতে গোনা সংখ্যার মধ্যে পড়ে না। নেহাত ফুলমতির বাবা চাষের কাজের সাথে পাশাপাশি আরো সব ধান্দা করত তাই ট্রাক্টর চালানো শিখেছিল সেই থেকেই সে কোনো ভাবে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসায় লরির চালকের কাজটা জুটিয়ে নেয়। ফুলমতির তো আর সে সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে ক্ষেতে চাষের লেগে গেলে সে হারু কাকাদের ট্রাক্টরটা চালিয়েছে তবে ঐ টুকুই। আরো ভালো ভাবে তাকে শিখতে হবে। সময়ের সাথে সাথে সে স্কুল পাশ করল। কলেজে ভর্তি হতে গেলে তাকে শহরে যেতে হবে।।এই এক সুযোগে সেখানে সে ড্রাইভিং শিখতে পারবে। কিন্তু ফুলমতির মা চায় তার মেয়ে এবার চাষের কাজে হাত লাগাক। তার বয়স হয়েছে সেরকম আর খাটতে পারে না আগের মতো। এই নিয়েও ফুলমতির সাথে তার মায়ের মতান্তর হয়।

- আর কলেজ পইড়্যা কাম নাই। এবার থেইক্যা চাষের লগে যাবি।

- ক্যান? কলেজে যাব না ক্যান? কলেজের লিস্টে আমার নাম বেরিয়েছে। সুযোগ পেয়েও ছাড়ব ক্যান? আর ছুটির দিনে চাষে যাবক্ষন।

- (একটু খেঁকিয়ে উঠে) এই ম্যাইয়া কি আমার কুনো কথাটা শুনবেক লাই ? বলি ডাগর তো ভালোই হয়েছ আর পড়ালিখা কইরা কাম লাই। চাষের কাজ শিখ ঘরের কাজ শিখ। তুর বাপ তুর বিয়া দিবে বলেছে। তাই এখুন থিকা এই সব কাজবাজ শিখ ।তুকে পড়াবার লগে আর পয়সা না খরচ করব।

- আমার পড়া আমি নিজেই চালাইবো। তুমাদের ভাবতে হবে না। আর হ্যা বিয়া আমি এখন করবক লাই। এই ফুলমতিও বইল্যা গেল। এই বলে ফুলমতি এক ছুটে ঘরের দাওয়া থেকে বেরিয়ে গেল তার মাকে বলার সুযোগ না দিয়ে। 

            খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফুলমতি। কয়েকটা টিউশনি ধরেছে সে আশে পাশের গ্রামে। কলেজের কাছেও কয়েকটা বাড়িতে পড়ায় সে। নিজের পড়ার খরচ ও হাত খরচ নিজেই চালানোর তাগিদ যার আছে কোনো কষ্টই তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয় না। ফুলমতিরো তাই, নিজের পড়ার সাথে সাথে অন্যের সন্তানকে পড়ানোর দায়িত্বও সে নিয়েছে কারন নিজের মনের গোপন কুঠুরীতে লালন হওয়া স্বপ্ন পূরণের দায়িত্বও যে তার। হাত খরচ বাঁচিয়ে কিছু টাকা সে জমিয়েছে। যা দিয়ে সে তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম সোপানে পা দিয়েছে। কলেজ ছুটির পর সে 'কার ড্রাইভিং ট্রেনিং'এ ড্রাইভিং শেখে। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। সে ভেবেছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে গেলেই সে বিভিন্ন জায়গায় ড্রাইভার পদে আবেদন করবে। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে যেখান বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে গেল নিজের বাপের কাছে। সেদিনই ফুলমতির বাইরের জগতের সাথে শেষ সম্পর্ক ছিল । এই ঘটনার তিনমাসের মধ্যে ফুলমতির বিয়ে হয়ে গেল এক প্রকার জোর করেই।

                  

                 কিছু কিছু আঘাত মানুষের মনে এমন গভীর ক্ষত তৈরী করে যা সে চাইলেও ভুলতে পারে না। সারা জীবন তাকে সে ক্ষত বয়ে নিয়ে বেরাতে হয়। ফুলমতির ক্ষেত্রেও তার নিজের আপন মানুষ নিজের প্রিয়জনদের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত গভীর ক্ষত তৈরী করেছে। যে জায়গাটা বিশ্বাসের ,ভরসার স্থল সেটাই যদি টালমাটাল হয়ে যায় তখন এক পাহাড় অভিমান মনের কোনে তৈরী হয়। যে কাজ তার বাবা সম্মানের সাথে করতে পারে সেই একি কাজ সে করলে কিসের ক্ষতি তা সে বুঝে উঠতে পারে না। ফুলমতির মনে যে অভিমান তৈরী হল তার ফলে তার জেদ আরো চেপে গেল । যে মানুষরা তার মনের খোঁজ রাখে না তাদের সাথে সামাজিক সম্পর্কটাই শুধু রইল। মানসিক টান বা সম্পর্ক তার বাড়ি থেকে বিদায়ের সাথেই ছিন্ন হল।

        

                ফুলমতির শ্বশুড়বাড়ি অবস্থা তাদের তুলনায় স্বচ্ছল। আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মতোই তার সংসার জীবন কাটতে লাগল। তবে লেখাপড়া জানা ফুলমতিকে তার শ্বশুড়বাড়ির মানুষরা সম্ভ্রমের চোখে দেখত। ফুলমতির কথার সম্মান দিত, গুরুত্ব দিত। এই ভাবেই দিন গড়াতে লাগল। সময়ের সাথে সাথে ফুলমতি মা হল। সংসারের নানা দায়িত্ব কর্তব্যের ভীরে তার এককালে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নটা চাপা পড়ে গেল। বলা ভালো হারিয়ে গেল। মাঝে মাঝে সংসারের কাজ থেকে দুদন্ড ছুটি মঞ্জুর হলে নিজের একান্তে পুরনো নানা কথা ভাবনায় ভেসে ওঠে। সে যে একদিন তার বাবার মতো বড় লরি নিয়ে দূর কোনো অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল এখন তা মনে পড়লে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো অনুভূতি হয় না।বলতে গেলে হাসিই পায় তার এই সব ভাবলে। যতসব অপরিনত ভাবনার স্বপ্ন!অপরিনত বয়সের ছেলেমানুষী। কিশোরী বেলার যাবতীয় অনুভূতি তার মনে আর কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি করে না। নিজের স্বপ্নের কথা বিয়ের পর পর তার স্বামীকে সে একদিন বলেছিল কোনো চপল খেয়ালের বশে। শুনে তার স্বামীটি হেসেছিল আর বলেছিল বাড়ির বউ ড্রাইভারের চাকরী করবে! আমাদের বাড়িতে অমন হয় না। ফুলমতি দমে গেছিল। নিজের আবেগ -অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রন করেছিল শুনে। বুঝেছিল তাকে তার মতো করে ভাবার বা বোঝার কেউ নেই। 

 চিরদিন কারোর সমান নাহি যায়। ফুলমতির সুখের সংসারে হঠাৎ একদিন বিপর্যয় নেমে এল ।             একদিন হঠাৎ খবর এল ফুলমতির স্বামীর কারখানা থেকে। অঘটন ঘটেছে তাকে এক্ষুনি হাসপাতাল যেতে হবে। শুনে ফুলমতির মাথাটা দুলে ওঠে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে সে তখনি পৌছায় হাসপাতাল। গিয়ে দেখে তার স্বামী মৃত্যুর সাথে লড়ছে। কারখানার যান্ত্রিক গোলোযোগের ফলে ক্ষণিকের অসচেতনতায় তার স্বামীর আজ এই করুণ পরিণতি। ফুলমতির চারদিক শূণ্য লাগছে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ক্ষতিপূরণে টাকা না হয় কারখানার মালিক দিয়ে দেবে। কিন্তু তারপর.......

কোনদিক দিয়ে যে দুইমাস কেটে গেল তা বোঝাই গেল না। ফুলমতির স্বামী প্রাণে তো বাঁচল কিন্তু সারাজীবনের জন্য তার বাম হাত খোয়ালো। কারখানা থেকে এককালীন টাকা দিয়ে তাকে অবসর দিয়ে দিল। কিন্তু সেই টাকায় আর কদিন চলবে। দুই ছোট ছোট সন্তান, অক্ষম স্বামী আর বয়স্ক শ্বশুড় শ্বাশুরী নিয়ে ফুলমতি পড়ল মাঝদরিয়ায়। কোন দিকে গেলে কূল পাবে তা ভেবে পায় না। উপায়ন্তর না পেয়ে পরের বাড়িতে রান্নার কাজ শুরু করে। এইভাবেই চলছিল বেশ। কিন্তু মানুষের জীবনে কখন বড় বাঁক আসে বলা মুশকিল। কিছু কিছু ঘটনা মানুষকে তার স্বপ্নের খুব কাছে নিয়ে চলে আসে।

পরের বাড়িতে রান্নাঘরের হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে এক বড় সুযোগ ফুলমতির সামনে চলে আসে। চিত্তপ্রসাদ বসাক বড় একজন শাড়ি ব্যবসায়ী। শাড়ি তৈরীর কারখানা তার। তার বাড়িতে রান্না করার সুবাদে ফুলমতির সেই সুযোগ চলে আসে। একটা বড় লটের শাড়ি পাঠানোর কথা ছিল বাইরে। কোনো কারন বশত ট্রান্সপোর্টের গাড়ি আসতে পারবে না জানালে চিত্তপ্রসাদবাবুর মাথায় তো চিন্তার পাহাড় চাপে। বাড়িতেই বাবুর ফোনে কথা বার্তা শুনে ফুলমতি নিজের অনেকদিনের ইচ্ছাটাকে প্রকাশ করেই ফেলে। উপায়ন্তর না দেখে কিন্তু কিন্তু করে চিত্ত বাবু ফুলমতির ওপর শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখে। অনেক যুগ পরে ফুলমতি আবার গাড়িতে বসল স্টিয়ারিং হাতে। এক ভয় এক উতলা ভেতরে কাজ করছে। সে কি পারবে? কিন্তু পারতে তো তাকে হবেই। তার ওপর মালিক ভরসা রেখেছে। তা তাকে রাখতেই হবে। সে নিজে যেচে এ দায়িত্ব নিয়েছে।বাড়ির বড় গাড়ি নিয়েই এত গুলো শাড়ি পৌছানোর দায়িত্ব নিয়ে ফুলমতি বেরিয়ে পরে। স্বপ্ন পূরনের দিকে এগিয়ে চলছে ফুলমতি দ্রুতগতিতে। পাশ দিয়ে সারি সারি গাড়ি , মাঠ ঘাট পেরিয়ে যাচ্ছে । কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি হয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাস ফুলমতির সমস্ত শরীর ছুঁয়ে চুল এলো মেলো করে চলে যাচ্ছে। ভাগ্যিস সে বুদ্ধি করে ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে রেখেছিল। এরপর আর ফুলমতিকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চিত্তবাবুর ভরসা সে রাখতে পেরেছিল। সেই বিশ্বাসেই অনেক লড়াই করে নিজের ক্ষমতার পরীক্ষা দিয়ে ফুলমতি আজ পূরণ করতে পেরেছে তার স্বপ্ন। ফুলমতির স্বপ্নই এখন তার পরিবারের ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়েছে।

                           **********

            

          



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational