গভীর রাতের চারটে কথা
গভীর রাতের চারটে কথা
“ওই, ছাদের ঘরে আরকি, আটকে রেখেছিল মাসিমাকে, কি, তাই না মাসিমা?” বলে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল বৃদ্ধাকে, কিন্তু তখন সেই বৃদ্ধা কথা বলার মত মানসিক অবস্থাতে ছিল না, বিশেষ করে যখন তার সামনে একটি ছোট্ট বাচ্চা ছেলের থেঁতলে যাওয়া মৃতদেহ পড়ে ছিল সাদা কাপড়ে ঢেকে, যাকে তারপর তার সামনে থেকেই তুলে পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হল, আর সেই বৃদ্ধাকে পুলিশ তখন জিজ্ঞেস করছিল তার নিজের ব্যাপারে, কিন্তু কারও বলা কোনো কথাই তার তখন কানে ঢুকছিল না, আর সে কোনো কথা বলতেও চাইছিল না, তার ছেলে আর বউমার ব্যাপারেও তাকে পুলিশ অনেক কথা জিজ্ঞেস করছিল, পাড়া পড়শিরা আগ বাড়িয়ে পুলিশকে বলছিল তাদের মানে সেই ছেলে আর বউমার হাতে সেই বৃদ্ধার মার খাওয়ার এবং আরো নানান অত্যাচারের কথা, কিন্তু সেই বৃদ্ধা নিজে তাই নিয়ে টু শব্দটি করতে চাইছিল না, কারন তার ছেলেকে আর বউমাকে আবার পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে পরে তাকে দেখার আর কেউ নেই, আর সত্যি কথা বলতে গেলে পরে, হাজার হোক, মা তো, তাই ছেলে মারধর করলে পরেও তাকে ছেঁড়ে থাকতে মন চায় না সে বৃদ্ধার, এখনও বুড়ির শখ আছে নাতি নাতনির মুখ দেখে তারপরই মরবে।
তার বাড়িতে তার এক ছেলে আর তার বউ মানে সেই বৃদ্ধার বউমা, এই তিনটি প্রাণী থাকে, তার সেই ছেলে আর বউমা মিলে তার ওপর কথায় কথায় নানা ধরনের অত্যাচার, মানে গালি গালাজ, বা চড় থাপ্পড় লাথি ঘুষি এইসব করলেও সেই বৃদ্ধা মনে মনে কাঁদত শুধু একাকীত্বে, তার থেকে বেশি আর কিছু করতে পারত না, কীই বা আর করবে বেচারি, তার ছেলে আর বউমা তাও তাকে দয়া করে যে একটু খেতে পড়তে দিচ্ছে, এই তার কাছে যথেষ্ট, আর সেসব সে হারাতেও চায় না, তা তার নিজের ছেলে তাকে যতই বকুক আর মারুক না কেন।
একদিন দুজনে মিলে ঠিক করেছে, পূরী বেড়াতে যাবে সেই বৃদ্ধার ছেলের কাজের ছুটিতে, কিন্তু মাকে সাথে নিয়ে গেলে পরে আবার তার বউ যাবে না, তাই তারা দুজনে মিলে ঠিক করে যে সেই বৃদ্ধাকে ছাদের সেই একটা ছোট্ট ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়ে যাবে। যদিও সেই ঘরে সেই বৃদ্ধার প্রয়োজনীয় সব জল খাবার থেকে শুরু করে নিয়ে সব কিছুই রেখে দিয়ে যাবে, সেই ঘরে পায়খানা বাথরুমও আছে, নেই যা তা হল টিভি, অতএব সেই বৃদ্ধার তেমন খুব একটা অসুবিধে কিছু হবে না এই মনে করে যাওয়ার মানে রওনা দেওয়ার আগের দিন তারা দুজনে প্ল্যান মত সেই বৃদ্ধাকে সেই ঘরে তালাবন্ধ করে দিয়ে দোতলা বাড়িটাকেও তালাবন্ধ করে দিয়ে চলে গেল, যাতে সেই বৃদ্ধা আর কোথাও বেড়োতে না পারে। তারা গিয়েছে তা এই এক সপ্তাহ হতে চলল।
সেই বৃদ্ধা বেশ ভালই ছিল সত্যি বলতে সেই এক ছোট্ট ছাদের ঘরে, খুব একটা অসুবিধে তার হচ্ছিল না, অসুবিধের মধ্যে যা ছিল তা হল এই যে, সেই ঘরে কোনো টিভি নেই যাতে সে তার প্রিয় সন্ধ্যের সিরিয়াল দেখতে পারে, আর তার হাতের কাছে কোনো মোবাইল বা ফোনও ছিল না যে সে তার ছেলেকে বা বউমাকে ফোন করতে পারে কথা বলার জন্য।
আর তার মধ্যে, মাঝে হঠাৎ এক দিন তার সেই ঘরের ফ্যানটা নষ্ট হয়ে গেল, ভালই ঘুরছিল, কিন্তু ফট করে কেটে গেল না কী যে হল, তা সেই বেচারি বৃদ্ধা নিজেও বুঝতে পারল না, গরম কাল, ছটফট করার মত গরম, কিন্তু তাও সেই বৃদ্ধা ছাদের ঘরের জানলা খুলে রেখে তা দিয়ে যতটুকু হাওয়া বাতাস ঢোকে তাই দিয়ে কাজ চালিয়েছিল। রাতের দিকে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকত, মাঝে মধ্যে, তার কপাল ভাল থাকলে, আবার অনেক সময় গাছের একটা পাতাও নড়তে দেখা যেত না, কিন্তু তাও সেই বৃদ্ধা সেখানেই মানিয়ে নিয়েছিল বেশ ভাল মতই, নিজের মনে মনে ঠাকুরের নাম করত বসে বসে খালি সময়ে, যা হয় আরকি জীবনের শেষে এসে, অনেকের ধর্মে কর্মে মতি দেখা দেয় সে নিজে সারাজীবন পাপ করলে পরেও, ঠাকুরের নাম নিতে নিতে কখন কীভাবে যে তার সময় কেটে যেত তা সেই বৃদ্ধা নিজেও বুঝতে পারত না। কিন্তু বড় একা লাগত তার, আশপাশের বাড়ির ছাদ যেগুলো চোখে পড়ে সেগুলোও সব নির্জন, খালি। কোনো কথা বলার লোক নেই।
ওদিকে সেই বৃদ্ধা জানেই না, মাত্র একটা সপ্তাহ কাটতে না কাটতে ভিন রাজ্যে বেড়াতে গিয়ে তার ছেলে ইতিমধ্যে কী নতুন কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে, এক হোটেলে রাত্রিবাস কালে হঠাৎ শরীরী মিলনের উত্তাপে তপ্ত উন্মত্ততায় নিজেদের হোটেল ঘরে সঙ্গম করার সময় সেই ছেলের একটু বেশিই উদ্যম চেপে বসেছিল মাথায় আর শরীরে, ফলে একটু বেশিই জোর লাগিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে আবার তার স্ত্রীয়ের যোনী থেকে রক্তপাত শুরু হয় যা বন্ধ হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখায় না, কিন্তু বাইরে লোকে তারা যে হোটেলে সঙ্গম করছিল তা জানতে পারলে কী বলবে, বা ভাববে, বা খিল্লি করবে, এই ভয়ে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে মাঝপথে সঙ্গম থামিয়ে সেই ছেলে নিজের সম্পূর্ণ উলঙ্গ বউয়ের পাশে বসেই নিজের মোবাইল ফোনে অন্তর্জাল খুলে সেখানে এই রক্তপাত বন্ধ করার নানা উপায় খুঁজতে থাকে, ওদিকে তার স্ত্রী তার পাশেই হোটেলের বিছনায় পাতা নতুন ধবধবে সাদা পরিষ্কার চাদর নিজের রক্ততে ভাসিয়ে নোংরা করতে থাকে, আর মাঝে মধ্যেই ব্যাথায় কোকিয়ে কাতরে উঠে নিজের বরকে বলতে থাকে, “পেলে কিছু?” কিন্তু ওভাবে করতে করতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তার সেই স্ত্রী সেই অবস্থাতেই সেই হোটেলের সেই ঘরে মারা পড়ল, এবং শেষমেশ অবধারিতভাবে সেই কেচ্ছা জানাজানি হলই, এবং তার সাথে থানা পুলিশের ঝামেলা।
ওদিকে এই সকল ব্যাপার থেকে অজ্ঞাত সেই বৃদ্ধা একদিন নিজের সেই বাড়ির সেই ছাদের সেই ছোট্ট একখানা দম বন্ধ করা ঘুপচি ঘরের মধ্যে বিছানায় বসে ঠাকুরের নাম নিচ্ছে, তখন বেশ রাত হয়ে গেছিল, খাওয়া দাওয়া করেনি তখনও, রান্না বান্না সামান্য যা করত তা তখনও বসায়নি, বসাবে ঠাকুরের নাম জপ করার পর, হঠাৎ একটা শব্দে চোখটা খুলে বিছানায় বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চমকে আঁতকে উঠল সেই বৃদ্ধা এক প্রকার, তাদের বাড়ির জলের যে পাইপ সে পাইপ বেয়ে একটা ছায়ামূর্তি উপরে ছাদে উঠছে, বৃদ্ধার তা দেখে প্রায় ভেতরে শরীরের খাঁচায় বন্দি আত্মা খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড়, চোর ডাকাত হবে নিশ্চয়, যেই ছায়ামূর্তিটা ভেতরে ঢুকেছে, সেটা যদিও আকারে বেশ বড় না, মানে বেশ দশাসই চেহারর কোনো লোক তার বাড়িতে এভাবে রাতের বেলা যে অনাধিকার প্রবেশ করেছে তা বলা যায় না, বরং দূর থেকে দেখে সেই ছায়ামূর্তিটাকে তার যেন অনেকটা কোনো বাচ্চার ছায়া মনে হল, সেটা দেখে আবার সেই বৃদ্ধার মনের ভয় একটু খানি কমল, বরং সে ভাবতে শুরু করল, যে নিজের বাড়িতে এভাবে বন্দি হয়ে কাটানোর চেয়ে অন্তত এখন চারটে কথা বলার একটা লোক পাওয়া গেল। ছায়াটা তার পর তার সেই ছাদের ঘর লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছিল, ঘরের আলো বৃদ্ধা আগে থেকেই নিভিয়ে রেখেছিলেন, তাতে করে জানলা খুলে রাখলে ঘরটা তাও অনেকটা ঠান্ডা হয়, এখন তো ফ্যানটাও নেই, তাই আর কি, যেই ছায়াটা এগিয়ে আসছিল, সেটাও বুঝতে পারেনি, যে সেই ঘরের ভেতর কেউ বসে থাকতে পারে, কিন্তু কাছে যেতে সেও সেই ঘরের মধ্যে বসে থাকা সেই বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করল, করে তার পর সেও আঁতকে উঠল, বাড়িতে কেউ নেই জেনেই চুরি করতে ঢুকেছিল, এখন দেখছে যে এক বৃদ্ধা এখানে ছাদে এই ছোট্ট একখানা ঘরের ভেতর বসে আছে চুপটি করে, এবং তাকে চুপচাপ লক্ষ্য করছে, সেই ছায়াটা ভয়ে স্থির দাঁড়িয়ে গেল, এবার যদি সেই বৃদ্ধা চিৎকার করে, তাহলে সেখান থেকে যে সে পালাবে দৌড়ে না কী করবে সেই বুদ্ধিটাও তার মাথায় তখন খেলছিল না, আধো অন্ধকারের মধ্যে যতটুকু দেখা যায়, তাতে সেই বৃদ্ধাও দেখল, যে সেই ছায়াটা একটা বাচ্চা ছেলেরই, কত আর তার বয়স হবে, এই বড়জোর চোদ্দ, বা পনেরো হতে পারে খুব বেশি, তাতে করে তার ভয় আরও কমে গেল, বাচ্চা ছেলে ঢুকেছে তার বাড়িতে চুরি করতে, তাকে নিজের কাছে ডাকতে উঠে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে হাত ইশারায় ডাকতে লাগল সেই বৃদ্ধা, যদি একে বলে কয়ে কোনোভাবে সেই ঘরের দরজাটা খোলানো যায় সেই একটা আশাও সেই বাচ্চাটাকে দেখে তার মনের মধ্যে হল। সেই বাচ্চা ছেলেটাও বেশ অবাক হল, যখন সে দেখল, যে সেই বৃদ্ধা জোর গলায় তাকে দেখে চোর চোর বলে চেল্লানোর বদলে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে হাত ইশারায় নিজের কাছে ডাকছে, কিন্তু সেই ছেলেটির কাছে যেতে সাহস হচ্ছে না, যদি সে কাছে গেলে পরে সেই বৃদ্ধা আবার চোর চোর বলে চিৎকার করতে শুরু করে দেয় বা তাকে খপ করে ধরে ফেলে, কয়েক মিনিট কাটল, সে বুঝতে পারছে না যে তাকে এই বৃদ্ধার কাছে যাওয়া উচিত কি না আর ওদিকে সেই বৃদ্ধা সমানে সেই ছেলেটিকে হাত নেড়ে নিজের কাছে ডেকেই চলেছে এবং খুব মিহি নীচু গলায়ও তাকে ডাকছে মাঝে মধ্যে “আয়, আয়” বলে, ওদিকে আবার নীচ থেকে একটা ঢিল এসে পড়ল সেই ছাদের ওপর এবং সেই বাচ্চা ছেলেটির পায়ের খুব কাছেই এসে পড়ল, তাতে সেই ছেলেটি বুঝল, যে নীচে দাঁড়ানো তার আরেক সাথি যেও প্রায় তারই সমবয়সী সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠছে, সে একবার ভাবল নীচে দাঁড়ানো তার সেই সাথিকে গিয়ে ডাকবে, কিন্তু তাকে চলে যেতে দেখেই সেই বৃদ্ধা ঘরের থেকে “একটু দাঁড়া” বলে আস্তে গলায় ডেকে উঠল ছেলেটির উদ্দেশ্যে, এবারে ছেলেটির হল ভয়, যে যদি সে পালানোর চেষ্টা করলে আবার এই বৃদ্ধা একেবারে চিল চিৎকার জুড়ে দেয়, তাহলে মুশকিল, তার যে কী খেয়াল হল, সে হঠাৎ থমকে গিয়ে সেই বৃদ্ধার দিকে ফিরে তাকিয়ে হাঁটু গেড়ে মাটিতে ধপ করে হাত জোর করে বসে পড়ল এবং মুখ দিয়ে কোনো শব্দ না করেই বেশ করুণভাবে তাকাল সেই বুড়ির দিকে, অর্থাৎ তাকে করজোড়ে মিনতি করতে লাগল, যাতে সে চিৎকার করে লোক জড়ো না করে। বৃদ্ধাও এই কান্ড দেখে বেশ অবাক, কারন সে কিছুতেই বুঝতে পারল না যে সেই ছেলেটি হঠাৎ এরম করছে কেন, ওদিকে নীচে যেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে যে কখন শালা পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠা তার সেই আরেক সাথি উপর থেকে তাকে হাত দেখিয়ে একটা ইতিবাচক সাড়া দেবে, সে এবারে অপেক্ষা করতে করতে সত্যিই অধৈর্য হয়ে উঠছে, ভাবছে নিজে একবার একই ভাবে পাইপ বেয়ে উপরে উঠবে কি না, তা করতে চাইছেও কিন্তু তার আবার চড়তে ভয় করছে কারন সে এর আগে কোনোদিন পাইপ বেয়ে উঁচু বাড়িতে ওঠেনি, বড়জোর গাছ বেয়ে দেওয়াল টপকেছে, ওদিকে উপরে ছাদে সেই ছেলেটিকে হাত জোড় করে বসতে দেখে হয়ত ভয় পেয়েছে ভেবে সেই বৃদ্ধা তাকে আবারও হাত নেড়ে কাছে ডাকার চেষ্টা করতে লাগল, “ওঠ, ওঠ” বলতে বলতে, তখন কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেটিও অভয় পেয়ে আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে সেই বৃদ্ধার কাছে সন্তর্পণে একেক পায়ে এগিয়ে গেল। সেই বৃদ্ধা তার পর তাকে আস্তে করে বলল, “শোন না, দরজাটা কোনোভাবে খুলে দিতে পারবি?” বাচ্চা ছেলেটি বাংলা অত ভাল বুঝতে না পারলেও সেই বৃদ্ধা বার বার নিজের হাত দিয়ে সেই তালাবন্ধ দরজাটার দিকে দেখানোয় সে আন্দাজ করতে পারছিল যে সেই বৃদ্ধা তাকে সেই দরজার তালাটা কোনোভাবে খুলে দিতে বলছে, কিন্তু তাও বৃদ্ধা কী বলছে তাকে সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া সত্ত্বেও সে মাথা নেড়ে আস্তে করে বৃদ্ধার সেই অনুরোধের প্রতি অসম্মতিই জানালো, আর তাছাড়া সে ঘরে আটকা সেই বৃদ্ধাকে দরজাটা বোকার মত খুলে দিতে যাবেই বা কেন, ধরা পড়ার জন্য? বৃদ্ধা তার অসম্মতি দেখতে পেয়ে মুখ দিয়ে “ও” বলে একটা নিরাশাবাচক শব্দ করল। তারপর সেই জানলার কাছে দাঁড়িয়েই সেই বাচ্চা ছেলেটির সাথে ভাব জমাবার চেষ্টা করতে লাগল।
“তোর নাম কী?”
বাংলা অত ভাল না বুঝলেও ‘নাম’ শব্দটা শুনে সেই ছেলেটি বুঝল যে সেই বৃদ্ধা তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করছে, সে নিজের নাম বলল।
তার পর সেই বৃদ্ধা তাকে জিজ্ঞেস করল, যে তার বাড়ি কোথায়, সে কোথায় থাকে, তার বাবা মা কোথায়, কিন্তু ওদিকে সেই বাচ্চা ছেলেটি কিছুই বুঝতে পারছিল না।
“তোর বাড়ি কোথায়?”
এবারে সেই ছেলেটি সেই বৃদ্ধার প্রশ্নের মানে বুঝতে পারল না। তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সেই বৃদ্ধা আবার তাকে বলল-
“কিরে, বল না।“
কিন্তু সেই বাচ্চা ছেলেটি এবারেও কিচ্ছু বুঝতে না পেরে ক্যাবলার মত সেই বৃদ্ধার বয়সের ভারে জায়গায় জায়গায় কোঁচকানো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল শুধু। ওদিকে সেই ছেলেটির নিস্তব্ধতা দেখে সেই বৃদ্ধা মনে মনে ভাবল, যে সেই ছেলেটি হয়ত তাকে এই কথাটা বলতে ভরসা পাচ্ছে না বা বলতে চাইছে না, তাই মনে হওয়াতে সেই বৃদ্ধা আবার তাকে বলল-
“ভয় পাচ্ছিস?”
“আপ কিয়া বোল রাহি হো সমঝ মে নহি আ রাহা।“
ছেলেটির মুখে এবারে হিন্দি শুনে সেই বৃদ্ধা এতক্ষণে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারল, ছেলেটি হিন্দিভাষী, নিশ্চয় বাংলায় তার বলা কথাগুলো বুঝতে পারছে না।
“বাংলা বুঝিস না?”
“নহি সমঝ তা।“
সে প্রত্যুত্তরে আবার হিন্দিতে সেই বৃদ্ধাকে জানাল, যে সে আসলে তার কোনো কথা এক বর্ণও কিচ্ছুই বুঝতে পারছে না। সেই বৃদ্ধা হিন্দি মোটামুটি বুঝতে পারত, কিন্তু তা আবার এক বর্ণও নিজে বলতে পারত না। সেই ছেলেটি তার কোনো কথা বুঝছে না দেখে, সেই বৃদ্ধা তারপর তাকে হাত ইশারায় ইঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, যে সে কিছু খাবে কি না, বাচ্চা ছেলেটি প্রথমে বেশ অবাক হয়ে চুপ করেই থাকল, তার বাড়িতে একটা বাচ্চা চোর চুরি করতে এসেছে দেখে চিৎকার করা তো দূরে থাক, এই বৃদ্ধা উল্টে তাকে কিছু খাওয়ার জন্য শুধোচ্ছে, কী হচ্ছে তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে সেই বাচ্চা ছেলেটি আবার একইভাবে সেই বৃদ্ধার পানে চেয়ে রইল, সেই বৃদ্ধা তাই দেখে সে হয়ত এবারও কিছু বুঝতে পারছে না ভেবে তাকে আরেক বার ইশারাতেই জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করল, যে সে কিছু খাবে কি না। এবারে বাচ্চা ছেলেটি আরও কয়েক পা কাছে এগিয়ে এল, এবং তার পর মাথা নেড়ে বলল যে সে খাবে, তার পেটে খিদে আছে, তাই দেখে সেই বৃদ্ধা হাত দেখিয়ে তাকে একটু দাঁড়াতে, মানে অপেক্ষা করতে বলে একটু ভেতরে গেল, সেই বাচ্চা ছেলেটি বুঝল না কিছু, তার মনের কোণে তখনও সেই ধরা খাওয়ার ভয়টা লুকিয়ে ছিল, সে ভাবল বৃদ্ধা আবার ভেতরে গিয়ে পুলিশকে ফোন করবে কি না, আর তাই মনে হওয়াতে সে অনুভব করল, তার বুকের ভেতরে পুনরায় ঢিপঢিপ করতে শুরু করে দিল, মনে হতে লাগল যেন কেউ খুব জোরে তার বুকের ভেতরে দামামা বাজাচ্ছে, ভয়ে তার হাত পা আবার সেই আগের মত অসাড় হয়ে আসতে লাগল, সে যখন দেখল সেই বৃদ্ধা সেখানে নেই এবং তাকে দেখতেও পাচ্ছে না, ভেতরে গেছে, তখন সে আবার ভাবল, যে এই সুযোগে এখান থেকে পালিয়ে আবার পাইপ বেয়ে নীচে নেমে যাওয়াই তার পক্ষে শ্রেয় হবে, হঠাৎ একটা শব্দও শুনতে পেল সে, একটা কুকুরের কান্নার শব্দ, এবং সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারল যে নীচে তার জন্য অপেক্ষা করা তার সেই বন্ধুই এই শব্দ করছে, কোনো বিপদের আভাস পেল না কি কে জানে, ওদিকে তার অপর সেই সাথি কুকুরের মত শব্দ করে তাকে ডাকছিল কারন সেই এক, যে সে আরও অধৈর্য হয়ে উঠছিল, মনে হয় নীচে দাঁড়িয়ে থাকা তার সঙ্গীটি কোনো বিপদের আভাস পেয়েছে, এই কথা মনে হওয়াতে সে তৎক্ষণাৎ ছাদের ধারের দিকে যাওয়ার জন্য কয়েক পা এগোল, কিন্তু তার সাথেই আবার করে পেছন থেকে “কী রে” বলে সেই বৃদ্ধার গলায় ডাক শুনতে পেল সে, আর তখনই আবার থমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সেই ছাদের ঘরের দিকে, জানলার কাছে আবার সেই বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে আবার কিছু জিনিস, একটা প্লাস্টিকের পোটলাতে বাঁধা, সেগুলো হাতে নিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটির দিকে চেয়ে আছে সেই বৃদ্ধা, তাকে আবার সে হাত ইশারায় ডাকল, ছেলেটি থমকে গেল, আর সাথে নীচে তার আরেক বন্ধুর কুকুরের গলা নকল করে ডাকও কারন নীচে দাঁড়ানো সেই বাচ্চাটি আবার বেশি জোড়েও ডাকতে পারবে না পাছে পাড়ায় কারো ঘুম ভেঙে যায় আর কতক্ষণ ধরেই বা সে এভাবে কুকুরের গলা নকল করে ডাকতে পারবে, উপরে সেই ছেলেটি আবার করে একেক পায়ে সেই বৃদ্ধার ঘরের দিকে অগ্রসর হতে লাগল, মাঝে মাঝে থামে, আবার এগোয়, আর সে থামলেই সেই বৃদ্ধা আবার করে হাত নেড়ে তাকে ডাকে, ঠিক অনেকটা যেমনভাবে কোনো কুকুরকে কেউ নিজের কাছে বিস্কুট দেখিয়ে ডাকে আর কুকুরটা যাব কি না এই ভাবতে ভাবতে ইতস্তত পদক্ষেপে এক পা এগোয় আবার থামে আবার এগোয়, সেও ঠিক সেইভাবে সেই বৃদ্ধার ঘরের কাছে যেতেই সেই বৃদ্ধা জানলার শার্সির মধ্যে দিয়ে নিজের দুই হাত গলিয়ে সেই পোটলা সেই বাচ্চা ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিল, সেটাতে কিছু ফল আর মিষ্টি ছিল, রাখা ছিল সেই ছাদের ঘরে, সেই বাচ্চাটা সেগুলো নেবে কি না তা ঠিক করতে না পেরে ইতস্তত করছিল, সেই বৃদ্ধা তাকে শুধোল, “কী রে, নে”, বাচ্চাটি অবশেষে হাত বাড়িয়ে সেগুলো নিয়ে নিল, আর তখনই সেই বৃদ্ধা নিজের এক হাত দিয়ে সেই বাচ্চা ছেলেটির মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিল, আর তার সাথে সেই ছেলেটির হাত দুটোও ছুঁয়ে দেখল, বেশ কর্কশ আর ময়লা ছিল সে দুটো। তাও ভাল, বাচ্চা ছেলেটি মনে মনে ভাবছিল, যে সে সেগুলো নিতে গেলে পরেই সেই বৃদ্ধা তাকে খপ করে ধরে ফেলে চোর চোর বলে চেল্লাতে আরম্ভ করে দেবে। কিন্তু তা না হওয়ায় বরং তার নিজের মনে যা কিছু আশঙ্কা আর ভয় ছিল এতক্ষণ ঠিক তার উল্টোটাই হওয়ায় সেই ছেলেটি তাও অনেকটা ভরসা পেল, তার পর সেই উপহারগুলো নিয়ে সেই বাচ্চা ছেলেটা সেখান থেকে চলে যেতে চাইল, সেই বৃদ্ধা তাকে সেই ফল আর মিষ্টিগুলো দেখিয়ে হাত ইশারায় সেগুলো খেতে বলল, তারপর যখন সে সেখান থেকে সেগুলো নিয়ে চলে যেতে লাগল, তখন আরেক বার পেছন ফিরে দেখে সে লক্ষ্য করল, যে সেই বৃদ্ধা আবার তাকে হাত নেড়ে হাসি মুখে বিদায়ও জানাল, চলে যাওয়ার সময়ও ছেলেটি বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তার সাথে একটু যা যা ঘটল, সে সব কি সত্যি সত্যিই ঘটল, না কি সে ব্যাটা না ঘুমিয়ে জেগে থেকে স্বপ্ন দেখছে, ছাদের ধারে যখন সে গেল, তখন শুনল পেছন থেকে সেই বৃদ্ধা বলছে তার অবোধ্য এক ভাষাতে, “সাবধানে নামবি।“, সে কিছু বুঝল না বটে, কিন্তু সেই কথা শুনে যখন সে বৃদ্ধার দিকে ফিরে শেষবার তাকাল, তখন তার চোখের কোণে নোনতা জল চিকচিক করছিল ঠিকই, যা সেই বৃদ্ধাও তার কমজোরি নজর দিয়ে দেখতে পায়নি, সেই পোটলাটা সেই বাচ্চা ছেলেটা নিজের মুখে নিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল, তারপর আবার খুব সাবধানে সেই পাইপের গা বেয়ে যেভাবে উঠেছিল উপরে, ঠিক সেভাবেই নীচে নামতে লাগল, ওদিকে তাকে আবার নীচে নামতে দেখে আর তার সাথে তার কাছে একটা পোটলা মতও কী দেখতে পেয়ে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা তার সেই অপর বন্ধুটি এসবের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না, তাকে তো উপরে পাঠিয়েছিল যাতে কোনোভাবে ছাদ থেকে বাড়ির ভেতরে ঢোকার কোনো রাস্তা বা ফাঁকফোকর সে আগে গিয়ে খুঁজে-পেতে বের করতে পারে, কিন্তু সে ব্যাটা আবার এখন পাইপ বেয়ে ফের নীচে নেমে আসছে, পাইপ বেয়ে তার সেই সঙ্গীটি ঠিকঠাকই নীচে নামছিল, হঠাৎ একটু, এই সামান্য, পা টা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে ফসকে যাওয়াতে বা পাইপের গায়ে ভুল জায়গায় পড়াতে, সব একেবারে গোলমাল হয়ে গেল। সেই বাচ্চা ছেলেটা যে মুখে করে সেই ফলমুলের পোটলা সমেত নীচে নামছিল আস্তে আস্তে করে, একেবারে সোজা নীচে পড়ল, ধাপ করে আওয়াজও হল, গাছ থেকে তাল পড়লে যেরম শব্দ হয়, সেরম। নীচে একটা বড় ভারি পাথরের মাথায় লেগে সেই বাচ্চা ছেলেটার মাথা থেঁতলে ভেতরের হলুদ ঘিলু বেরিয়ে এল, তার সাথের যেই সঙ্গীটা ছিল, সে এই আকস্মিক দৃশ্য দেখে ভয়ে আতঙ্কে একেবারে চুপ হয়ে গেল, তার পায়ে গোড়ালির কাছে তার সেই সাথির কিছুটা রক্ত এবং ঘিলুর কিছু অংশও ছিটকে এসে ছিটেছিল, সেই শব্দ উপরে ছাদের ঘরে সেই বৃদ্ধাও শুনে চমকে উঠেছিল, শব্দটা অনেকটা ওই তাল পড়ার মত হলেও তার মনে সেই শব্দটা শুনে আশঙ্কা হতে শুরু করল, ছেলেটা পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে পা ফসকে নীচে পরে গেল না তো? কিন্তু ওদিকে আবার সেই বৃদ্ধা নিজের সেই ছোট্ট জেল কুঠুরিতে বন্দি, অতএব নিজে গিয়ে দেখতেও পারবে না, সেই পথও বন্ধ। ওদিকে নীচে সেই বাচ্চা ছেলেটি নিজের সঙ্গীর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে কিছুক্ষণ নির্বাক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর তার সেই মৃত বন্ধুর হাত থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে সেই প্লাস্টিকের পোটলাটা তুলে নিয়ে সেখান থেকে চারপাশটা এক বার সন্তর্পণে দেখে নিয়ে দৌড় লাগাল, একেবারে যাকে বলে চোঁচা দৌড়। দৌড়ে পালানোর পথে সেই পাড়ার কিছু ক্ষ্যাপা নেড়েদের পাল্লাতেও পড়েছিল সে বেচারা, তারা তার পেছনে অনেক দূরই ধাওয়া করেছিল একেবারে সেই পাড়ার বাইরে অনেক দূর অবধিও, ওদিকে সেই বৃদ্ধা পড়ে গেল ভীষণ চিন্তাতে, যে ছেলেটা সত্যিই পড়ে গেল কি না। কিন্তু নিজে বেরিয়ে যে তা দেখবে সে উপায়ও তার নেই। গোটা পাড়া তখন নিঝুম, নিস্তব্ধ, ঘুমিয়ে যেন গভীর ঘুমে। ওদিকে সেই বাচ্চা ছেলেটির লাশ ঘিরে ততক্ষণে প্রচুর ডেয়ো পিঁপড়ে জুটে গেছে, যারা “সরাসরি মৃতের নাসারন্ধ্র, শ্লেষ্মা, চোক, থুতু মারফৎ ঠোঁটের কোণা, দুর্বল মাড়ি ইত্যাদি পছন্দ করে।“ বাকি গোটা রাতটা সেই বাচ্চাটার মৃত দেহটা সেইখানে সেই স্থানেই পড়ে রইল, সেই সব পিঁপড়ে ও অন্যান্য পোকামাকড় ও ব্যাকটেরীয় অণুজীবদের খাবারের খোরাক হয়ে।
পরদিন ভোরবেলা ড্রেন পরিষ্কার করতে আসে যে এক মেথর মাঝে মধ্যে, বেশিরভাগ দিনই আসে না, সে সেদিনও কাকতালীয়ভাবে নিজের কাজ করতে এসে সেই এলাকায় সর্ব প্রথম সেই মৃত দেহটা আবিষ্কার করে। তার পর সেখানে বৃদ্ধার বাড়ির সামনে জমল দারুন ভিড়, সেই কোলাহল শুনে একটা সময় পর সেই বৃদ্ধাও নিজের বাড়ির ছাদের ঘর থেকে হাঁক পাড়লেন নীচে জমায়েত ভিড়ের উদ্দেশ্যে। তার সেই আর্ত চিৎকার শুনে তারা নীচে দাঁড়িয়েই সেই বৃদ্ধার মুখ থেকে তার সেই ছোট্ট ঘরে আটকে থাকার কারন সব সংক্ষেপে শুনল, তার পর কিছু স্থানীয়রা রীতিমত তার বাড়ির তালা ভেঙে সেই বৃদ্ধাকেও উদ্ধার করল, তখনও সেখানে পুলিশ এসে পৌঁছোয় নি, সেই বৃদ্ধা পরে নীচে এসেও দেখলেন যে নীচে কী হয়েছে, সেই বাচ্চাটির লাশ দেখতে যদিও প্রথমে তাকে পাড়াপড়শিরা বাঁধা দিয়েছিল, বৃদ্ধ মানুষ, সেই দৃশ্য সামলাতে না পারলে আবার উল্টো কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে আর তাছাড়া তাকে সেই দৃশ্য দেখতে দেওয়াও উচিত নয়, কিন্তু সেই বৃদ্ধা কিছুতেই তাদের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে চাইছিলেন না, তিনি বেরিয়ে এসে সেই লাশটা দেখলেনই, এবং যেন একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। হতাশায় আর আতঙ্কে মাথা ঘুরে মাটিতে পরে যাচ্ছিল সেই বৃদ্ধা, পাড়ার লোকেরা যারা তাকে ঘিরে রেখে বাড়ি থেকে বের করে এনেছিল, তারা তাকে ধরে ফেলে, তার পর একটা জায়গায় একটা কাঠের বেঞ্চে বসায়।
পরে আসে পুলিশ, এসে স্থানীয়দের থেকে প্রথমে সবটা শোনে, তার পর সেই বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তার মুখ থেকেও কিছু কথা বের করার চেষ্টা করে দেখে, কিন্তু দেখে যে সেই বৃদ্ধা কোনো কথা বলার মতই মানসিক অবস্থাতে নেই। খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে, তাকে বাড়িতে আটকে রেখে তার অপদার্থ ছেলে আর বউমা বাইরে বেড়াতে গেছে, সেটা জানার পর সেই সব স্থানীয়রাও সেখানে দাঁড়িয়ে ছ্যা ছ্যা করতে লাগল। সেই বৃদ্ধার সামনে থেকেই সেই ছেলেটির লাশ সেখান থেকে নিয়ে গেল পুলিশেরা। আর সেই বৃদ্ধা ভ্যাবলার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। পুলিশ বা লোকজন, কারও কোনো প্রশ্নের উত্তরেই সে তখন কিছু বলতে পারছে না, বা বলা ভাল, বলতে চাইছে না। কাল রাতে তার বাড়িতে পাইপ বেয়ে যে বাচ্চা ছেলেটা তার সাথে কথা বলল, এখন তারই মৃত দেহ সেই বৃদ্ধার সামনে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হল, তার মাথাটা থেঁতলানো, চোখও একটা বেরিয়ে গেছে কোটর থেকে, মুখটা হা করা। সেই বীভৎস চেহারা দেখলে যে কারোরই গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে। তার ওপরে সেই বৃদ্ধা একজন অত বয়স্ক মানুষ, কালকে রাতে সেই বাচ্চা ছেলেটার সাথে ইশারায় ইঙ্গিতেও যেটুকু কথা তার হয়েছিল, তাতে সত্যিই তার মনটা একেবারে আনন্দে ভরে উঠেছিল ওই কিছু সময়ের জন্য হলেও, ভেবেছিল পরের দিনও এভাবেই ছেলেটা আসবে কি না। আর আজ, সেই ছেলেটাই তার সামনে মরে পড়ে ছিল এই কিছুক্ষণ আগে অবধি। তার ওপর আবার এখন পুলিশ তার থেকে তার ছেলে আর বউমার ব্যাপারে জানতে চাইছে। যাতে তাদেরকে তারা না ধরে, তার জন্য হঠাৎ সেই বৃদ্ধা পুলিশের সামনে বসেই তাদের কাছে নিজের ছেলে আর বউমার সব কৃত কর্মের জন্য নানাভাবে নিজে থেকেই সাফাই দিতে শুরু করল। আর তাদের কাছে এও বলল যে তারা যেন তাদেরকে মানে তার ছেলে আর তার বউমাকে কিছু না করে। পুলিশের লোকেরা তার কথাবার্তা শুনে কেউ কেউ বেশ অবাক হল, আবার অনেকের মনে তার জন্য বেশ কষ্টও হল। তারা তাকে আপাতত শান্ত করল কথা দিয়ে যে তার ছেলে আর বউমাকে তারা কেউ কিছু করবে না।
সেই পাড়া থেকে অনতিদূরে আবার আরেকটা লাশ উদ্ধার হয়েছিল, একটা বাচ্চা ছেলের লাশ, তাকে সম্ভবত অনেকগুলো কুকুর বা সেরমই কোনো জন্তুরা মিলে কামড়ে খেয়ে ফেলেছিল তার শরীরের সিংহভাগই, একটা ছোট্ট ডোবার মধ্যে থেকে তার সেই লাশটা পাওয়া গেছিল। সেই এলাকায় স্থানীয়দেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে পরে তারা প্রায় প্রত্যেকেই বলে যে তারা কেউ হয় ঘুমিয়ে থাকার ফলে অত রাতে কী হয়েছে কিছুই শোনেনি, আবার অনেকে কিছু চিৎকার শুনতে পেলেও মাথা ঘামায়নি। ছেলেটি কে তা লাশ দেখে চেনার উপায় নেই, একই দিনে দু-দুটো বাচ্চা ছেলের লাশ উদ্ধার হল কাছাকাছি দুটো পাড়া থেকে। পুলিশের কাছে বেকার উটকো যত সব ঝামেলা।
