বেড়াল
বেড়াল
ছেলেটা তার মাকে দেখেছে অনেক ছোটবেলায়, কিন্তু সেই স্মৃতিও তার মাথায় তেমন পরিষ্কার নেই, কেমন যেন ফিকে ফিকে। তার কাছে তার মায়ের যেটুকু স্মৃতি, তা হল ডোমঘরে নিজের দেখা নিজের মায়ের কাটাচেরা লাশটুকু, যদিও সেই লাশটা যে তার নিজের মা তা তখনও তার নিজের বোধগম্য হয়নি, সেই মহিলাকে সে নিজের বাবার সাথে দেখেছে ঠিকই, কিন্তু খুব কম, এমনকি নিজের কাছেও যে খুব একটা পেয়েছে তাও নয়। তার বাবার সাথেই সে ঢুকেছিল সেই ডোমঘরে, তার বাবাও তখন এক জলজ্যান্ত লাশ, নিজের ছোট্ট বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে সেই লোকটা ঢুকেছিল নিজের বউয়ের লাশ সনাক্ত করতে, তখনও লাশের কাটাচেরা চলছে, তাদের সামনেই একটা লোক মানে একটা ডোম তার মায়ের নগ্ন নিথর মড়াটা একটা চাকু দিয়ে সুনিপুনভাবে চিরে দিচ্ছিল, কাঁটাছেড়ার দাগগুলো ছাড়াও তার মায়ের লাশ তখন জায়ায় জায়গায় কালশিটের ঘায়ে ভর্তি ছিল, মাঝখান থেকে একেবারে বুক থেকে নিয়ে তার যোনিপথ অবধি একটা লম্বা টানে চিরেছিল। তার মায়ের পেটের ভেতরের সব কিলবিল করে ওঠা নাড়িভুড়ি দেখে তখন সেই বাচ্চাটার ঘেন্না লাগেনি, বরং সে বড় বড় চোখ করে অবাক হয়ে দেখছিল ভেতরটা, একবার তো কাছে গিয়ে তার মায়ের পেটের ভেতরের সব নাড়িভুড়িগুলোকে আঙুল দিয়ে নাড়া দিয়েও দেখেছিল এবং মজা পেয়েছিল, যদিও পরে তার বাপের কাছ থেকে ধমক খেয়েছিল, ডোমঘরের লোকগুলোও যারা তার মায়ের মড়া কাটাছেড়া করছিল তারাও তাকে বকেছিল, আর তার বাপকে একটা বাচ্চা নিয়ে ডোমঘরের ভেতরে ঢোকার জন্য ভর্ৎসনা করে বলেছিল বাচ্চাটাকে নিয়ে বাইরে যেতে। তার বাপও তাই গিয়েছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে সে তার বাপকে অনেকবার জিজ্ঞেসও করেছিল, যে সেই মড়াটা কার, কিন্তু তার বাপ তো তখন থ মেরে ছিল। বেশি বকলে তার মুখে সপাটে একটা থাবড়াও মেরেছিল সে তাকে চুপ করাতে। সে তো তখন বেশ ছোট, ভাল করে তেমন কথা বলতেও শেখেনি, ভ্যা ভ্যা করেই কেঁদে দিয়েছিল। নিজের মাকে তার শেষ দেখা ছিল ওই ডোমঘরেই। এছাড়া নিজের মায়ের আর কোনো স্মৃতি তার নিজের মনেও নেই। তার মার ব্যাপারে তার বাবার কাছ থেকে সে কোনোদিনই কিছু জানতে পারেনি। মা কাকে বলে তাও জানত না সে।
তারপর নিজের মদখোর বেহেড মাতাল বাপটার সাথেই সেই ছেলেটা মায়ের আদর ছাড়া বড় হতে লাগল, কিন্তু তার যে ছেলেবেলা তা খুব একটা সুখের ছিল না, বরং আরও ভাল করে বলতে গেলে, সুখ শালা কোন বালের জিনিস, তা সে জীবনেও দেখেনি বা বোঝেনি। তার বাপটা তাকে বাড়িতে আটকে রেখে না খাইয়ে রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত, ফিরত আকন্ঠ মদ গিলে সন্ধ্যা বেলায়, তারপর নিজের প্যান্টের চারপাশের বেল্টের বাঁধনটা আলগা করে বেল্টটা খুলে হাতে নিয়েই সমানে চাবকাত নিজের ছেলেটাকে। তার ছেলেটাও বুঝতে পারত না যে তার বাপ তাকে কেন মারছে, বস্তির অন্যান্য সব লোকেরাও শুনতে পেত সব, জানত যে কীভাবে বাপটা তার ছেলেটাকে পেটাচ্ছে, কিন্তু তেমন মাথা ঘামাত না তাই নিয়ে। ছেলেটাও তাই নিয়ে কোনো মাথা ঘামাত না, শুধু চুপচাপ মার খেয়ে যেত, আবার অনেক সময় তার ছেলেটাকে প্যান্ট খুলিয়ে নিয়ে বিছানায় উপুড় করে শোয়াত, নিজের হাঁটুর হাঁড় দিয়ে সেই বাচ্চা ছেলেটার পিঠের ওপর চাঁপা দিয়ে তাকে জোর করে শুইয়ে রাখত, প্রচণ্ড ব্যাথায় ছেলেটা শুনতে পেত তারপর তার বাবার নিজের প্যান্টের চেন খোলার শব্দ, তার কিছুক্ষণ পরই একটা প্রচন্ড ব্যাথা সে অনুভব করত, যেন খুব শক্ত একটা কিছু কেউ ঢুকিয়ে দিচ্ছে তার পায়ুদ্বারে, আর তারপর সেটা দিয়েই সমানে তার পায়ুপথটাকে ঘষে চলেছে, যেন জায়গাটা একেবারে ছরে যাচ্ছে, ছেলেটা জানত না বা বুঝত না যে সেটা কী, সে শুধু এটুকু জানত, যে খুব ব্যাথা লাগত তার, সে চিৎকার করতে চাইলে তার বাপটা নিজের ময়লা রুক্ষ হাত দিয়ে ছেলেটার মুখটাকে চেপে দিত, আর তাতেই চাঁপা পড়ে যেত সেই আর্তচিৎকার। আবার অনেক সময় নিজের ছেলেকে বিছানায় নিজের কাছে টেনে এনে অন্ধকারে তার গায়ের জামাটা আস্তে করে খুলত, তাতে অন্ধকারেও দেখা যেত তার গায়ে ছড়ানো মারের কালশিটের দাগ, তারপর নিজের শুকনো কর্কশ ঠোঁট দিয়ে সমানে তার সর্বাঙ্গে চুমু খেত নেশার ঘোরে, নিজের বাপের মুখের মদের পঁচা বোটকা গন্ধে ছেলেটা দূরে সরে যেতে চাইলে বা সরে গেলে তাকে এক হ্যাঁচকা টানে আবার নিজের কাছে টেনে এনে সটান একটা থাপ্পড় মারত সে, সে কাঁদতে শুরু করলে আবারও ধমক দিয়ে আবারও থাপ্পড় মারত, তারপর তাকে সারা শরীরে চুমু খেতে খেতে নিজের সাথে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ত অন্ধকার ঘরে, তার সারাটা শরীরে নিজের হাত আর ঠোঁট বোলাত, ঘাড়্রে গলায় চুমু খেত, মদের গন্ধে অনেক সময় ছেলেতা ঘেন্নায় ওয়াক তুলত, ছেলেটার জঘন্য লাগত, একবার তো তার নাভিতে আঙুল বোলাতে বোলাতে এমন জোরে নখ দিয়ে চাপ দিয়েছিল যে একেবারে ছুলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। এইরকম আরও নানা ধরনের অদ্ভূত অত্যাচার সেই ছেলেটাকে মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হত, অনেকসময় তার বাপটা বাড়ি থেকে দরজা খোলা রেখেই এমনিই বেরিয়ে যেত, সেই দিন গুলো ছিল তার কাছে সত্যিই আশীর্বাদ। কারন তখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ায় বস্তিতে অন্যান্য লোকেদের বাড়িতে গিয়ে তাদের থেকে কিছু খাবারদাবার খেত। অনেকসময় সে তাদের বাড়িতে থাকতেও চাইত। কিন্তু তারা ওই একটু আধটু খাইয়ে দেওয়া অবধিই দয়া দেখাত, তার বেশি না। কেউ তাকে নিজেদের বাড়িতে রাখত না, তাকে আবার বাইরেই বার করে দিত, বাড়ি থেকে সে মনে মনে অনেকবার পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু বাইরে পালিয়ে সে যাবেই বা কোথায়, একবার সুযোগ পেয়ে বস্তির বাইরে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখেছিল সেখানে অনেক গাড়ি ঘোড়া, মানুষজন, চলছে ফিরছে, পথঘাট সবই তার অচেনা, সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা হিজড়ে এসে ধরেছিল তাকে, জিজ্ঞেস করেছিল যে সে কোথায় থাকে, ওরম কুৎসিত দেখতে মানুষ ছেলেটা এর আগে কখনো না দেখায় তাকে দেখে সে তখন ভয় পেয়ে আবার নিজের বস্তির দিকেই উল্টো দৌড় দিয়েছিল। আরও অনেক বার অনেক সময় রাস্তায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে দেখেছে সে, কিন্তু যতবারই গেছে ততবারই রাস্তায় গিয়ে এত গাড়ি ঘোড়া দেখে আরও ভয় আর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, এত লোকের ভিড়ের মধ্যে কোথায় কার কাছে যাবে সে, ফলে প্রতিবারই ফিরে এসেছে নিজের সেই বাপের কাছেই, কারন তাকে ছাড়া আর কোনো আশ্রয় তার জানা নেই; তাকে অনেকসময় তার বাপ খেতে দিতও, কিন্তু নিজের খাওয়ার পর এঁটোকাঁটা উচ্ছিষ্ট যেটুকু থাকত সেখান থেকেই সেই ছেলেটা খেতে পেত। এইভাবেই সেই ছেলেটা বেঁচে ছিল, কোনোমতে, তার শরীরটাও ছিল যথেষ্ট রুগ্ন, প্রায় একটা কঙ্কালের মত, ভাল মত খেতে না পেয়ে, তার উপর আবার তার বাবার অত্যাচার। অনেকসময় আবার তাকে সাইকেল বাধার চেনা বা শিকল দিয়েও ঘরের এক কোণে বেঁধে রাখত।
তার বাঁচার মধ্যে ভাল যেটুকু ছিল তা হল একটা বেড়াল, বস্তিতে তার যে ঘর তার উল্টোদিকে একটা পাঁচিলের পরেই একটা বেশ উঁচু পাঁচতলা ফ্ল্যাট, বড়লোকদের, গরীব এবং বিত্তশালীদের সেটা একটা খুবই অদ্ভুত সহাবস্থান। সেখানে দোতলায় একটা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি মানে ঝুলবারান্দায় মাঝে মাঝেই একটা ছোট্ট সাদা বেড়ালকে সে বসে থাকতে দেখতে পেত। সেটাকে খুবই ভাল লাগত তার। অনেকসময় নিজের ঘর থেকে সেটাকে লক্ষ্য করে সে হাত নাড়ত, তাকে অবাক করে দিয়ে সেই বেড়ালটাও অনেকসময় হাত নাড়িয়ে সারা দিত, যেন তাকে নিজের কাছে ডাকছে, বলছে সেই পোড়ারমুখো বাড়ি আর বস্তি ছেঁড়ে তার নিজের কাছে চলে আসতে। অন্ধকারে অনেক সময় বেড়ালটার চোখগুলো চকচক করত, দূর থেকে দিনের আলোয় বাচ্চাটার দেখে মনে হত, বেড়ালটার চোখগুলো বোধহয় নীলচে রঙের। বেশ সুন্দর ছিল বেড়ালটা দেখতে।
মানেকি নেকো হল জাপানের এক খুব বিখ্যাত হাত নাড়া বেড়াল, যার মূর্তি অবধি সেখানে লোকে নিজের বাড়িতে রাখে তার কারন তাদের বিশ্বাস তা নাকি সৌভাগ্য ডেকে আনে, এমনকি তার মন্দিরও আছে। কথিত আছে সেখানে বহুকাল আগে একবার এক ঝড়ে আটকে পড়া এক পথিককে দূরে এক মন্দিরে বসে থাকা এক বেড়াল সমানে হাত বাড়িয়ে সেই মন্দিরের ভেতরে ডাকছিল, সেই লোকটি সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সেই গাছটিতে বজ্রপাত হয়, তারপর থেকেই সেই বেড়ালটি হয়ে দাঁড়ায় মঙ্গলের প্রতীক, যদিও এই কাহিনীর নানা আলাদা রুপ আছে, তেমনই সেই বেড়ালটাও সেই একইভাবে হাত নেড়ে ডাকত সেই ছেলেটিকে নিজের বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। বেশ ভাল লাগত তার, তার সব মন খারাপের ওষুধ যেন একমাত্র সেই বেড়ালটাই ছিল, তারপর যখনই সেই বেড়ালটা সেই নির্দিষ্ট সময় গুলোতে সেই বারান্দায় থাকত না, তখনই সেই ছেলেটা অধৈর্য উদগ্রীব হয়ে উঠত সেটাকে দেখার জন্য, শুধু একটি বার তার এক ঝলক দেখতে পাবার জন্য। আর যখনই সেটা তাকে দেখা দিত তখন আনন্দে একেবারে পাগল আত্মহারা হয়ে উঠত সে, যদিও সব দিন সেই বেড়ালটা দেখা দিত না। শুধুমাত্র সেই বেড়ালটির দেখা দেওয়াই তার মন ভাল করে দিত। কিন্তু সুখ বেশিদিন শালা টেকে কই।
তার বাপটা সেদিন একেবারে সকাল থেকেই গেলা শুরু করেছিল, সে নিজের ঘরে শুয়েছিল মার খেয়ে। ফিরে এসে আবারও তার প্যান্টটা খুলে পাছাতে বেল্টের বারি মারতে মারতে একেবারে তার পাছা লাল করে দিয়েছিল তার বাপ। একটা ঘরের এক কোণে মেঝেতে মদ খেয়ে নিজের গায়ের ওপরই একগাদা বমি করে রেখে শুয়েছিল সে অজ্ঞান হয়ে। তার ছেলেটা নিজের প্যান্টটা ঠিকঠাক মত পড়ে নিয়ে ঘরের আধ ভেজানো দরজা খুলে বেরিয়ে গেল সেদিন বাইরে, তখন সন্ধ্যে বেলা, একটু আগেই বেশ ভাল বৃষ্টি হয়েছিল। তাদের বস্তির বাইরে যেই ফ্ল্যাট বাড়িতে সেই বেড়ালটা থাকে, আজ সে ভাবল একেবারে সেই ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সেটাকে দেখবে, বস্তির কাছেই সেই জায়গা। সাবধানে খুঁজতে খুঁজতে ঘুরতে ঘুরতে সে সেখানে পৌঁছেও গেল, মাঝে একটা দেওয়াল, তার একদিকে তার বাড়ি আর তাদের গোটা বস্তিটা, আর উল্টোদিকে সেই পেল্লায় বিল্ডিং আর সাথে ওরম আরও অনেক ঝা চকচকে বিল্ডিং আছে, যেখানে বড়লোকেরা থাকে, যেগুলোর ভেতরে সে কোনোদিনই ঢুকতে পারবে না। নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক যে সময়ে সেই বেড়ালটা সেই ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে তাকে দেখা দেয়, তার থেকেও আরও অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত করল সে সেখানে দাঁড়িয়ে সেই বেড়ালের অপেক্ষায়, সময় দেখতে না পারলেও সে জানে ঠিক এই সময়েই তার সেই প্রিয় বেড়ালটির দেখা দেওয়ার কথা, তার বাপ তো মদ খেয়ে বমন করে কেলিয়ে পড়ে আছে, অতএব তার কোনো ভয় নেই, কিন্তু তার আশ্চর্য লাগছে, আজ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও সেই বেড়ালটা তাকে দেখা দিচ্ছে না, এতে একটু নিরাশ মনে হতে লাগল তার, বেড়ালটা কি তার মানে আজ আর আসবে না? তাও সে ভাবল আরও কিছুক্ষণ এইখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে সে, একটা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া আছে বাইরে, যতক্ষণ বাড়ির বাইরে সে থাকতে পারে, ততই ভাল, তারপর আরও অনেক বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল তার সেখানে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়ে খেয়ে, কিন্তু সেই সাদা বেড়ালটার কোনো খবর নেই। তারপর সত্যিই হতাশ হয়ে পড়ল সেই ছেলেটা, ভাবল, আর তার তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই তাকে ফিরে যেতে হবে আবার। মানে আবার সেই ছাপোষা ঘরে মার খেতে তাকে ফিরে যেতে হবে। এই মনে করে সেই বেচারা ছেলেটা আবার করে পা বাড়াল নিজের বস্তি আর বাড়ির দিকে উদাস হতাশ মনে।
বস্তির দিকেই ফিরছিল, হঠাৎ যাওয়ার পথে যেই খোলা নীচু হাইড্রেনটা পড়ে পথপ্রান্তে, সেটাতে আধো অন্ধকারে সাদা মত কিছু একটা ভেসে থাকতে দেখল সে। আগে অত খেয়াল করেনি, এবার তার নজরে এল, এবং কৌতূহল হল, যে সেটা কী, বাচ্চাদের হাজারো রকম জিনিস নিয়ে কৌতূহল। হাই ড্রেনটা বড় রাস্তার ধারে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঘোড়া সব যাচ্ছে, আর সেই বাচ্চাটা ঝুঁকে পড়ে দেখছে আর বুঝতে চেষ্টা করছে যে হাই ড্রেনের নোংরা কালো পাকের মধ্যে পড়ে থাকা সেই সাদা বস্তুটি কী। আসলে কালোর মধ্যে সাদা হওয়ার কারনেই চোখে পড়েছিল সেই জিনিসটা তার সেই সময়। মাটিতে আশপাশে অনেক ভাঙা লোহার জংধরা পাইপের কিছু অংশ পড়ে ছিল, সেরম একটা লম্বা ভাঙা অংশ তুলে নিয়ে সেই বাচ্চাটা সেই সাদা জিনিসটাকে তুলতে গেল, ঝুঁকে ভাসতে থাকা সেই সাদা বস্তুটিকে সেই পাইপের টুকরো দিয়ে টেনে টেনে নিজের দিকে আনার চেষ্টা করতে লাগল সে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা লোক তাকে যেতে যেতে আচমকা চিল্লিয়ে সাবধান করল যে বেশি ঝুঁকলে পড়ে সে নীচে পড়ে যেতে পারে। চমকে উঠে চলে যাওয়া লোকটার সাবধানবাণীকে গ্রাহ্য না করে সে আবারও সেই সাদা জিনিসটাকে সেই রড বা পাইপ দিয়ে কাছে আনার চেষ্টা করতে লাগল। কালো আলকাতরার মত কাদার পাকের মধ্যে থেকে সেই বস্তুটিকে কাছে আনা খুব সহজ ছিল না, কিন্তু তাও অনেক চেষ্টার পর অবশেষে সে সেটা কাছে আনতে দেখল যে সেটা একটা সাদা বেড়ালের ফুলে ওঠা লাশ, নর্দমার কালো আঠালো ময়লা পাক কিছুটা তার গায়ের একাংশেও লেগে আছে।
বেড়ালটার লাশটা দেখেই ভয় পেয়ে গেল সে, এক ভয়ংকর সম্ভাবনা মুহূর্তে তার সমগ্র মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে যেতে লাগল সে, যে সে ভাবছে তা ভুল একেবারেই; তার প্রিয় সাদা বেড়ালটার গায়ের এক পাশের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে সেই কালো দাগটা এই বেড়ালটার গায়েও সেই একই জায়গায় দেখতে পেল সে। লাশটাকে খুচিয়ে খুচিয়ে উপরে তুলে মাটিতে বসে নিজের কোলের উপর রেখে সে বেড়ালের লাশটার চোখের পাতা দুটো খুলে আরও ভয় পেয়ে গেল, এরও মণি দুটো নীল রঙের, দূর থেকে তার সেই প্রিয় বেড়ালের চোখদুটোও কেমন যেন নীলচে দেখাত, ঠিক করে দেখতে না পেলেও দিনের আলোয় দেখে তো তাই মনে হত তার, যদিও সে নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল, যে সে একেবারে নির্ভুল ভাবে দেখতে পেত না, অতএব সে ভুলও হতে পারে, হয়ত সেই বেড়ালটার চোখের রং আসলে নীল নয়, তবে তা সত্ত্বেও পুরোপুরি নির্ভুল এবং সে যে ভুল ভাবছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গেল সে; বেড়ালটা তার যেই হাত নেড়ে সে সেই বাচ্চা ছেলেটাকে হাত দেখাত, ডাকত তার সেই হাত তুলে থাবাটাও দেখল সে, সেটার নীচে কনুইয়ের কাছে একটা জায়গায় যে কালো গোল দাগ মত আছে সেটাও মিলে গেল। অতএব সে এবারে এতক্ষণে বুঝতে পারল, তার প্রিয় বেড়ালের সাথে তার আর দেখা হবে না, হবে না মানে আর কোনোদিনও হবে না, ঠিক যেভাবে নিজের মায়ের সাথে তার আর কোনোদিনও দেখা হয়নি আর হবেও না।
তা সত্ত্বেও অসহায়ভাবে সেই বেড়ালের লাশটাকে নিয়ে নানা লোকের কাছে সাহায্যের জন্য চেষ্টা করতে লাগল সে, রাস্তার ধারের একটা খাবারের দোকানে গেল সে, সেখানে যাকেই সে ছলছল চোখে বেড়ালের লাশটা দেখিয়ে বলে সেটাকে বাঁচিয়ে তুলতে, সেই প্রত্যেক লোকেই তার হাতে একটা মরা বেড়াল দেখে হয় তার থেকে দূরে সরে যায় বা তাকে দূরে সরিয়ে দেয়, আবার রাস্তা দিয়ে যাওয়া অনেকে একেবারে তোয়াক্কা না করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে যেন তাকে দেখতে বা শুনতেই পাচ্ছে না এভাবে বা শুধু ঘেন্নায় অন্যদিকে সরে যায়, অনেক ব্যর্থ চেষ্টা এবং এর ওর কাছে সেই বেড়ালটির প্রাণভিক্ষা করার পর সেই মরা বেড়ালটাকে নিয়ে একটা জায়গায় রাস্তার ধারে নোংরার মধ্যেই বসে ছিল সে, বেশ কিছুক্ষণ নিজের হাতে সেই বেড়ালের মড়াটা নিয়ে এমনই চুপচাপ নির্বাক কোনো কথা না বলে বসে ছিল সে সেই বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে নিষ্পলক, শুধু তার চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু গরম জলের ফোটা মাঝে মধ্যে সেই বেড়ালটার গায়ে পড়ছিল, এবং সে ভাবছিল এই হয়ত বেড়ালটা একটু নড়ে উঠবে বা কেঁপে মিউমিউ করতে করতে জেগে উঠবে, কিন্তু তা আর হল না, সে তা সত্ত্বেও কিছুক্ষনের জন্য আবার করে নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল মনে মনে যে সেই বেড়ালটা তার নিজের সেই প্রিয় বেড়াল নয়, অন্য কোনো বেড়াল হবে হয়ত, কিন্তু তার মনের মধ্যে সেই আশা ভরসা ক্ষণিকের জন্য দেখা দিয়েও আবার করে শেষমেশ মিলিয়েই গেল। মৃত্যু যে কী তা এই জীবনে প্রথমবার বোধহয় এই বেড়াল ছানাটির মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই প্রত্যক্ষ করল সে বেচারা, তাকে মানতেই হল যে তার প্রিয় বেড়াল ছানা মরে গেছে, ঠিক যেভাবে তার মা মরে গেছিল, তার প্রিয় মেকুর বন্ধুটির সাথে এটা কী করে হল হয়ত তাই ভাবছিল সে সেখানে বসে, কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। রাস্তা দিয়ে যাওয়া অনেক লোকেরা তাকে অবাক হয়ে বা কেউ কেউ আবার করুণা বা ঘেন্নার চোখেও দেখছিল, বেশ কিছুক্ষন সময় নিল সে বেড়ালটার লাশটা নিয়ে কোনো একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। এবং অবশেষে বেশ কঠোর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেই সে সেখান থেকে হাতে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মত করে বেড়ালের শবটা নিয়ে হাঁটা দিল।
তার বস্তিতে নিজের ঘরে সেই বেড়ালের লাশটা নিয়ে আস্তে আস্তে করে গিয়ে ঘরে ঢুকে সে দেখল, যে তার মাতাল বাপটা এখনো সেই মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে শুয়েই আছে। তার কাছে আস্তে করে পা টিপে টিপে গিয়ে বেড়ালটার লাশটা তার বুকের উপর শায়িত করে রেখে দিল সে, তার পর আবার করে রান্না ঘরে ঢুকে সিএ এক চাকু বাগিয়ে নিয়ে এসে আবার কড়ে অনেক সময় তার বাপটা মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকলে যেমন করে, তেমনই এবারও সেই চাকু টা নিয়ে এসে নিজের বাপের কণ্ঠনালীর কাছে রাখল সে, কিন্তু তার পর আবারও প্রতিবারের মতই কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর কাঁপা কাঁপা হাতে সেটাকে আবার করে গিয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়ে আসল সে, আর তারপর আবার সেই ঘর আর বস্তি ছেঁড়ে বেরিয়ে গেল।
ধুলোবালি ওড়া বড় রাস্তার উপর অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ কদিন ধরে একটা উড়াল পুল তৈরী হচ্ছে। অর্ধ নির্মিত সেই উড়াল পুলের ধার ধরে হাঁটছে সেই ছেলেটি, একেবারে ধার ঘেষে, ধারে কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা এখনো নেই। ধারের নীচে একবার পা পিছলে বা টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেই অনেক নীচে পড়বে সে। হাঁটতে হাঁটতে থেমে গিয়ে একটা জায়গায় সেই ধারে দাঁড়াল বাচ্চাটা, দূরে অনেক আলো ঝিলমিল করছে, সেগুলো কিসের আলো তা জানে না সে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে সেই আলোগুলোর দিকে এমনি তাকিয়ে থাকল সে, নীচে ঝাঁপ দেওয়ার আগে। তারপর ঝাঁপ দেওয়ার পূর্বেও একবার পেছন ফিরে তার সেই বস্তি যেদিকে আছে সেদিকেও একবার নজর ফিরিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল সে। তারপর আবার তাকাল সেই আলোগুলোর দিকে। আর তারপর সবশেষে তাকাল নীচে নিকশ কালো অন্ধকারের দিকে।
