চাদর (ইস্মত চুগতাইয়ের ছোটগল্প ‘লিহাফ’ এর ছায়া অনুসরণে)
চাদর (ইস্মত চুগতাইয়ের ছোটগল্প ‘লিহাফ’ এর ছায়া অনুসরণে)
29 mins
18
বাইরে চারদিকে দারুন বৃষ্টি চলছে, আর সাথে মেঘের গুড়ুমগাড়ুম। সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এর আগে বিকেল থেকে পাড়ায় এক রাজনৈতিক দলের সভা হচ্ছিল, আর মাইক থেকে ভেসে আসছিল নানা কথা, দেশে ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ধর্মীয় হিংসা, হানাহানি, এ রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় ঐক্যের নামে হিন্দিভাষী বহিরাগতদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজ্যে রাজ্যে গৃহযুদ্ধ, আর্থিক মন্দা, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মূদ্রাস্ফীতি, এইসব নানা বিষয় নিয়ে, তবে যখন থেকে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে তখন থেকে সেই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে। একটা গোসাপ মাটিতে থপথপিয়ে চলেছে, গাছের ডালে উল্টো ঝুলে বৃষ্টির জলে ভিজে তা নিজেদের লোমশ গা চেটে খেয়ে নিজেদের জল পিপাসা মেটাচ্ছে বাদুড়েরা। একটা দোকানের শেডের তলায় আশ্রয় নিয়েছে একটা ভীতু ভিজে বেড়াল। কয়েকটা কুকুর আশ্রয় নিয়েছে একটা লম্বা টারপলিনের ছায়ায়, যেটা পথের ধারে টাঙানো হয়েছিল চাকরির জন্য অনশনকারীদের দুনিয়ার নজর থেকে ঢেকে দেওয়ার জন্য, অধৈর্য্য হয়ে সেই আন্দোলনকারীরা রণে ভঙ্গ দিলেও সেই টারপলিন এখনও আছে, সেখানে পড়ে থাকা প্ল্যাকার্ডের গায়ে কুত্তারা মুছতে হাগছে ও একে অন্যের গু খাচ্ছে, অনেকসময় অনেক ভিখারি মাতালরাও তার তলায় আশ্রয় নেয়। একটা দোতলা ছোট বেশ পুরোনো বাড়ি, বা বলা চলে, বাড়ির অবশিষ্ট কঙ্কালটুকু, তার বাইরে একটা জায়গায় একটা বোর্ড ঝুলছে, যার গায়ে লেখা আছে পরিষ্কার বাংলায়, "এখানে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়" আর তার নীচে কত টাকা, কী বৃত্তান্ত, সেইসব লেখা। বাড়ির ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ মহিলার কর্কশ গলার কিছু ঝাঁঝি কানে এল, আর তার সাথে এক বাচ্চা ছেলের ভীতু গলায় কান্নার শব্দ, তার পরই একটা ধমক, তার পর একটা সপাটে চড়ের শব্দ, তার পর সব শান্ত।
বাড়ির ভেতর সাদা শাড়ি ব্লাউজ আর চোখে গোল গোল চশমা আঁটা এক বৃদ্ধা একটা ঘরে রাগে গজগজ করতে করতে ঢুকে দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ করলেন। আর তারপর একটা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বের করে খস করে একটা দেশলাই জ্বেলে আধো অন্ধকার ঘরে জানলার ধারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফুকতে লাগলেন, আর তারপর একটা সময় বিরক্তির সাথে বললেন, "শালা খানকির ছেলেরা, ব্যাঙের পেচ্ছাপের মত একটু বৃষ্টি হলেই এই গরমেও কারেন্ট কেটে রেখে দেয়।" জানলার কাঁচের ওপর সমানে আছরে আছরে পড়ছে বৃষ্টির জল। সেই নীচে একতলায় আরেকটা ছোট্ট চোরাকুঠুরির আকারের ঘরে একটা ছোট্ট ময়লা মত বিছনায় একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে গায়ে একটা ময়লা চাদর জড়িয়ে।
বাইরে এক মেয়ে, অসহায়ের মত ঘুরে বেরাচ্ছে এদিক ওদিক, একটা আশ্রয়ের খোঁজে। একটা অন্ধকার গলিতে ঢোকার মুখেই শুয়ে থাকা কতগুলো কুকুর তাকে সেখানে দেখে তার ওপর ঘেউ ঘেউ করে চিল্লাতে শুরু করে দিয়েছিল, যেভাবে পলিটিশিয়ানরা এদেশে চেল্লায় একে অপরের ওপর। সেখান থেকে ভয়ে সেই মেয়েটি সরে যায়, তার পর অনেক এদিক ওদিক ঘুরে শেষে সে দেখতে পায় সেই বাড়ি, আর তার বাইরে সেই বোর্ড। অতএব তা দেখে সে যায় সেখানেই, আর তার পর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কী ভেবে সে বেলটা টিপতে হাতটা তোলে, তার পর মাঝপথে আবার থামে কয়েক সেকেন্ড, তার পর বেলটা টিপেই দেয়। কিন্তু ভেতরে কোথাও কোনও সারা শব্দ নেই শুধু বৃষ্টির ঝড়ের শব্দ ছাড়া। আর বাইরে ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে কারো এসে দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা সে। কিছুক্ষণ যখন দেখল যে কেউ খুলছে না, তখন সে বেলের বোতামটা আবার করে এক বার টিপে দিল, বেচারির খেয়ালই নেই যে পাড়ায় বিদ্যুৎ নেই। ভেতরে সেই বৃদ্ধা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সেই সিগারেট খেয়েই চলেছে আর সেই বাচ্চা ছেলেটি চুপচাপ বিছনাতে শুয়েই আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি এক বার দরজার গায়ে কান পাতল কেউ আসছে কি না তা শোনার জন্য। ভেতরে সেই বৃদ্ধার ঘরে অন্ধকারে একটা আরশোলা তার আলমারির ভেতরে চুপিচুপি ঢুকে পড়ল। ওদিকে বাইরে সেই মেয়েটি এবারও কোনো সারা না পেয়ে আশা না ছেঁড়ে সেই দরজার গায়ে বারি মারল, প্রথমে এক বার, আস্তে, পরে আবার বেশ কয়েক বার জোরে। আর সাথে চিল্লিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কেউ আছেন নাকি?" সেই বাচ্চা ছেলেটি শুনতে পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের ঘর ছেঁড়ে বেরোতে তার আর সাহস হল না। ভেতরে থাকা সেই মহিলা প্রথমে শুনতে পান না, পরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো উত্তর না পেয়ে সেই বেচারি মেয়েটি আবার করে দরজায় ধাক্কা মারে আর জিজ্ঞেস করে, "বলছি, কেউ কি আছেন?"
ভেতরে থাকা মহিলা এবারে শুনতে পেলেন, এবং আস্তে গলায় নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, "এত রাতে আবার কে এল জ্বালাতে?" বলে নিজের হাতের প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেটটাকে নিভিয়ে দিয়ে একটা টর্চ বাগিয়ে গেলেন দরজা খুলে দিতে।
বাইরে সেই মেয়েটি ওদিকে কোনো সারা না পেয়ে হয়ত এই বাড়িতে কেউ থাকে না, এই ভেবে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ পেছনে দরজায় শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল, আর তার পর সঙ্গে সঙ্গে দরজার দিকে যেতে গিয়ে কাদায় এক বার হোঁচট খেল, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে আবার করে গেল দরজার কাছে। সেই বৃদ্ধা দরজা খুলে দেখলেন, বাইরে এক শিক্তবসনা জোয়ান মেয়ে দাঁড়িয়ে, কোনো কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে ঠান্ডায়।
"কী চাই?" বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন।
"ইয়ে, মানে, আজকে রাতে থাকার জন্য একটু জায়গা পাওয়া যাবে?"
"টাকা আছে?"
"টাকা? মানে…"
"টাকা ছাড়া বিনা পয়সাতে থাকতে চাও?"
"মানে, ঝড়ে আটকে পড়েছি, তাই আরকি, অন্তত কিছুক্ষনের জন্য হলেও…"
সেই বৃদ্ধা মহিলা এক বার আপাদমস্তক সেই মেয়েটিকে দেখে নিলেন।
"ঠিক আছে, এস।" আগের তুলনায় বেশ মোলায়েম কন্ঠে বললেন। সেই মেয়েটি আস্তে করে ঢুকল ভেতরে, সেই বৃদ্ধা দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর মেয়েটিকে বললেন নিজের পায়ের জুতোগুলো ঘরের একটা কোণায় ছেঁড়ে রাখতে। মেয়েটি অন্ধকারে তাই করল তার কথামত। সেই মহিলা টর্চ জ্বেলে চলতে লাগলেন, তার পেছনে সেই মেয়েটি।
পুরোনো কাঠের বাড়ি, মেয়েটি দেখল, নোংরা, ভাঙাচোরা। সেই বৃদ্ধার পেছন পেছন চলল সে, তারা দুজনে উপরে উঠে গেল কাঠের সিঁড়ি দিয়ে। তাদের হাঁটাচলায় কাঠের ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হচ্ছিল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চুকচুক করে শব্দ করা একটা বড় ছুঁচো না ইঁদুর ধা করে দৌড়ে গেল তাদের সামনে দিয়ে, মেয়েটি ভয় পেয়ে চিৎকার করে খামচে ধরল সেই বৃদ্ধার এক হাত। "আরে, ভয়ের কী আছে? ও কিচ্ছু করবে না। এসো।" মেয়েটি একটু শান্ত হয়ে এবার সেই মহিলার হাত ধরে ভয়ে ভয়ে হাঁটতে লাগল।
"আপনি এখানে ইঁদুর ছুঁচোর মধ্যে থাকেন আপা, আপনার ভয় করে না?" মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।
"শুধু ইঁদুর কেন, আরও অনেক কিছুই আছে, তবে ভয় পেও না।"
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকাল এক বার সেই বৃদ্ধার মুখের পানে।
তারা অবশেষে উপস্থিত হল একটি ঘরের সামনে, সেই বৃদ্ধা নিজের শাড়ির আচলের খুঁটে বাঁধা চাবির গোছাটা তুলে টর্চের আলোয় দেখলেন। "এটা একটু ধরো তো।" বলে নিজের হাতের টর্চটা এগিয়ে দিলেন সেই মেয়েটির দিকে। মেয়েটি সেটা হাতে নিল। সেই বৃদ্ধা নিজের আচলের খুঁটে বাধা অনেকগুলো চাবির মধ্যে থেকে একটা খুলে নিয়ে সেটা দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন।
"আহ! টর্চটা ভাল করে ধরো।" একটু বিরক্তি মেশানো স্বরে সেই বৃদ্ধা বললেন সেই মেয়েটিকে। "জি…জি।" একটু চমকে উঠে আস্তে মোলায়েম গলায় উত্তর দিল সেই মেয়েটি। আর সাথে টর্চটাকেও ভাল করে ধরার চেষ্টা করতে লাগল। একটা শব্দ হল কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার, কিন্তু দরজাটা তখনও আটকে ছিল, মানে খুলছিল না হাট করে, লকটা খুলে যাওয়ার পরেও। আসলে অনেক দিন ধরে আটকে থাকতে থাকতে যা হয় আরকি, দরজা অনেক সময় এঁটে যায়। সেই বৃদ্ধা দরজা খুলতে ধস্তাধস্তি করতে লাগলেন, "আমি কি সাহায্য করব?" সেই মেয়েটি বলল। "দাঁড়াও, দেখছি।" দরজা ঠেলতে ঠেলতেই সেই মহিলা উত্তর দিলেন। অবশেষে অনেক চেষ্টা ধাক্কাধাক্কির পর, সেই দরজাটা খুলল। সেই বৃদ্ধা সেই মেয়েটির হাত থেকে আবার করে নিজের টর্চটা ফেরত নিলেন, তারপর তারা দুজনেই ঢুকল সেই ঘরের ভেতর।
ঘরটা অন্ধকার, বাইরে থেকে যতটুকু আলো আসে, তাতেই মোটামুটি বোঝা যায়। ঘরের ভেতর পা রাখতেই একটা বোটকা গন্ধে সেই মেয়েটি নিজের নাক চেপ ধরল, তা দেখে সেই বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, "একটা গন্ধ পাচ্ছো, না?" "না, মানে…" নিতান্তই গোবেচারা ভাবে মেয়েটি বলল কথাগুলো, বৃদ্ধা আবার বললেন, "পুরোনো ঘরে যেরম একটা ভ্যাপসা গন্ধ থাকে, সেরম তো?" মেয়েটি সম্মতিসূচক মাথা হেলাল, বৃদ্ধাও তা দেখে নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে যাক, তার মানে একটু আগেই যে তিনি বায়ু নিষ্ক্রমণ করলেন, অর্থাৎ কিনা পাদলেন, তার গন্ধ মেয়েটির নাকে যায় নি। বদ অভ্যেস, কী আর করবেন, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। "আসলে অনেক দিন পর এই ঘর টা খোলা হল, আজ প্রথম, এই বাড়িতে কেউ তেমন তো আর আসে না থাকতে, তাই আজ কে তোমার জন্য খুললাম। একে যা গরম পড়েছে, এত বৃষ্টি, তাও গুমোট ভাব কমে না। তার উপর আবার শালারা ব্যাঙের মূতের মত হালকা ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলেও কারেন্ট কেটে রেখে দেয় সারাদিনের নামে। কিছুক্ষণ এখানে থাকো, ঝড় না থামা অবধি, আমি এই ঘরে একটা মোম জ্বেলে দিচ্ছি, ভয় নেই, এই ঘরে কোনো ইঁদুর ছুঁচো বা অন্য কিছু নেই।" যদিও ভদ্রমহিলার কথায় মেয়েটি তেমন কিছু সাহস পেয়েছে বলে মনে হল না। ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরোলেন, মেয়েটি আস্তে করে গিয়ে বিছানার উপর বসল, আবার করে ঘরে সেই ভদ্রমহিলা ফিরে এলেন। "কিছু খাবে? দেবো?" "হ্যাঁ? না, লাগবে না।" বেশ মোলায়েম কন্ঠেই সেই মেয়েটি জানান দিল। "তোমার জামাকাপড় তো সব ভিজে গেছে, ঠান্ডা লাগবে, দাঁড়াও, আমার আলমারি থেকে কিছু কাপড়ও দিচ্ছি।" মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, "না না, থাক, লাগবে না আপা, এই বৃষ্টি টা কমলেই আমি চলে যাবো। বেশিক্ষণ আর হবে বলে মনে হয় না।" "না না মানে? ঠান্ডা লাগবে, দাঁড়াও।" বলে সেই বৃদ্ধা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মেয়েটির পড়ার জন্য কিছু কাপড় খুঁজে আনতে। মেয়েটি বিছনা থেকে আস্তে করে উঠে ঘরটা পায়চারি করে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর আবার করে বিছনায় গিয়ে বসল দুই পা তুলে, ইঁদুরের ভয়ে।
ওদিকে নিজের ঘরে গিয়ে সেই বৃদ্ধা নিজের ঘরের আলমারি খুলে দেখতে গিয়েই ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই আরশোলাটা তিরিং করে লাফ মেরে প্রায় তার গায়েই গিয়ে পড়ল, সেই বৃদ্ধা হালকা একটা চিৎকার মেরে সেই আরশোলাটাকে ঝেড়ে ফেললেন নীচে মাটিতে, তার হাত থেকে অতর্কিতে টর্চটাও মাটিতে পড়ে গেল, তার আলোয় তিনি দেখলেন আরশোলাটা গিয়ে একটা ছোট্ট মত ড্রয়ারের তলায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। একটু ধাতস্থ হয়ে তারপর সেই মহিলা আবার নীচে থেকে কুড়িয়ে নিলেন প্রথমে টর্চটা, তারপর আলমারি থেকে বেঁছে কতগুলো কাপড় বের করলেন, আর সাথে একটা মোমও বের করলেন ভেতর থেকে, একটা বেশ বড় মোমবাতি, আর সাথে একটা বিছনার চাদরও, ভাবলেন, ঘরের বিছনাতে এই পরিষ্কার চাদরটা পেতে দেবেন মেয়েটির জন্য, তারপর আলমারিটা বন্ধ করে দিলেন, তারপর টর্চের আলোটা ফেললেন ঠিক সেই চেস্ট ড্রয়ারের ওপর যার তলায় গিয়ে আরশোলাটি লুকিয়েছিল, তার উপরে একটা লাইটার রাখা আছে, একটু ইতস্তত ভাবে সেই মহিলা আস্তে আস্তে করে এগোলেন সেই ড্রয়ারের দিকে, তারপর সেটার উপর থেকে লাইটারটা তুলে নিলেন, তারপর সেগুলো নিয়ে চললেন সেই মেয়েটির ঘরের দিকে।
কাঠের সিঁড়ি, তার উপর দিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ফেলে হাটছেন সেই মহিলা, হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ টর্চের আলোয় লক্ষ্য করলেন তিনি, যে কাঠের সিড়ির উপর অনেক জায়গায় রক্তের ছিটে আর দাগ আছে, তা দেখে বেশ অবাক হলেন সেই মহিলা মনে মনে। ভাবলেন, মেয়েটি কী কোথাও কোনো জায়গায় আঘাত পেয়েছে নাকি। তা নাহলে তো এখানে রক্ত আসার কথা না।
মেয়েটির ঘরে ঢুকে তিনি দেখলেন, যে সে চুপটি করে বসে আছে সেই ঘরের বিছনার উপর, তিনি ঘরে ঢুকতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে ফিরে তাকাল। সেই ঘরের মেঝেতেও এখন সেই মহিলা টর্চ ফেলে অনেক জায়গায় দেখতে পেলেন সেই একই রক্তের দাগ। "তোমার কি কোথাও কেটে গেছে?" সেই বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন। এই প্রশ্ন শুনেই মেয়েটি বিদ্যুতাহতের মত চমকে উঠে দাঁড়াল। "কই, ন-না তো।" জবাব দিল মেয়েটি। "না, মাটি তে জায়গায় জায়গায় রক্ত দেখছি, এ তো থাকার কথা না, দেখো, কোথাও চোট পেলে আমাকে বলো, তাহলে ওষুধও লাগিয়ে দেবো।" মেয়েটি এই কথার জবাবে কিছুই না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সেই বৃদ্ধা দেখলেন টর্চের আলোয়, যে মেয়েটির দুপায়ের মাঝে থেকে রক্তের ধারা নেমে এসেছে তার দুই পায়ের পাতা অবধি, তার পায়ের পাতার নীচও নিশ্চয়ই তাতে ভিজেছে, আর তাই নিশ্চয় সেই রক্তের দাগ লেগেছে মেঝেতে, তিনি তা দেখে হয়ে গেলেন অবাক। সেই বৃদ্ধা টর্চের আলোয় তার দেহে সেই ঘা গুলো দেখতে পেয়েছে দেখে সেই মেয়েটি তাড়াতাড়ি নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের যোনি টা ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল। "এই ঘা গুলো তোমাকে কে দিয়েছে?" "না না, ওটা কিছু না।" "কিছু না মানে?!" মেয়েটি সেই বৃদ্ধার এই ধমক শুনে এবার প্রায় কুঁকড়ে কেঁদেই উঠল।
ঘরের মধ্যে একটা ছোট্ট গোল মত টেবিলের উপর সেই মোমটা জ্বালানো, ঘরের বিছনার উপর নিজের দুই পা সামনে ছড়িয়ে বসে রয়েছে সেই মেয়েটি, আর তার সামনে বসে বিছনার ওপর সেই মোমের আলোয় তার যোনি আর পায়ের আরও অন্যান্য জায়গাতে থাকা সকল ঘা পরিষ্কার করে যাচ্ছে সেই মহিলা বৃদ্ধা। "এই ঘা গুলো তোমায় কে দিয়েছে?" কোনো উত্তর এল না। "না বলতে চাইলে বোলো না।" সেই বৃদ্ধা বললেন। একটু কমার লক্ষণ দেখিয়ে বাইরে বৃষ্টি আবার জোরে শুরু হয়েছে। টেবিলের ওপর মোমের পাশে একটা খালি জলের গ্লাসও রাখা আছে, মহিলা আবার জিজ্ঞেস করলেন, "আরও জল খাবে?" মেয়েটি মাথা নেড়ে জানাল, খাবে না। আরও কয়েক সেকেন্ড কাটল নীরবতায়। কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটি উত্তর দিল, "আমার বর।" "হুমম?" "আমার বর দিয়েছে।" "এই ঘা গুলো?" "হ্যাঁ।" "ও।" আরও কিছুক্ষণ কাটল নীরবতায়। তারপর মেয়েটির ঘা পরিষ্কার করতে করতে সেই বৃদ্ধা আবার জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার বর কেমন জন্তু, যে তোমাকে এভাবে মারে?" কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মেয়েটি বলতে থাকল থেমে থেমে ধীরে সুস্থে, "আখলাখকে আমি ভালবেসে বিয়া করছিলাম, আমার আব্বা আম্মাও রাজি হয়েছিল, বিয়েও দিছিল অনেক কম বয়েসে, কিন্তু বিয়ের পরপরই ও যেভাবে আমাকে অত্যাচার করা শুরু করল জানোয়ারের মত, আমাকে ওরা সকলে মিলে খুব খাটায় আর মারে, ওর মা, মানে আমার যে শাশুড়ি, সেও অত্যাচার করে, এমনকি…" মেয়েটি একটু থামল পরের কথাগুলো বলার আগে, তার পর আবার বলতে শুরু করল, "আমার চুলের মুঠি ধইরে পেটানো, মানে মারপিট ছাড়াও, আমার শাশুড়ি আমার ওপর ওই ধরনের অত্যাচারও করত।" "কী ধরনের অত্যাচার?" সেই বৃদ্ধা জানতে চাইলেন তার ঘা সাফ করতে করতেই। কয়েক সেকেন্ড পর মেয়েটি চুপ দেখে তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, "বললে না, কী ধরনের অত্যাচার করতেন তোমার শাশুড়ি?" মেয়েটি আবার বলতে লাগল, "ওই ধরনের অত্যাচার আরকি, যেটা আখলাখ আমার সাথে রাতে বিছানায় করত, সেই ধরনের অত্যাচার।" বলে মেয়েটি নিজের বুকের উপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, "এই আমার বুকে আর পেটে, আখলাখের সাথে আমার শাশুড়িরও দাঁতের আর নখের দাগ মিশে আছে।" সেই বৃদ্ধা এই কথা শুনে থেমে গিয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন মেয়েটির পানে, অবাক হয়ে, তারপর আবার তিনি তার ঘা গুলো পরিষ্কার করতে লাগলেন। মেয়েটি ব্যাথায় কোকিয়ে উঠছিল। "যা ঘা দিয়েছে, ব্যথা তো করবেই।" সেই বৃদ্ধা বললেন।
মেয়েটি এবার নিজের পিঠ উলঙ্গ করে বসে আছে, সেই বৃদ্ধার উল্টোদিকে মুখ করে বিছনার উপর। আর তার পিঠের সব ঘা পরিষ্কার করে মুছিয়ে দিচ্ছে সেই বৃদ্ধা। বিছনার উপর একটা রক্তজলে ভরা পোরসেলিনের বাটি, আর একটা রক্ত ভেজা সাদা তোয়ালে তার পাশে, বৃদ্ধার আনা বিছনার চাদরটা আলগাভাবে বিছনায় পেতে দিয়েছে, এখনও গুঁজে পাতা হয়নি। মেয়েটি এবার হঠাৎ সেই বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা, একটা কথা বলবেন?" "হ্যাঁ, বলো।" "এই বাড়ি তে কি আপনি একা থাকেন?" "হ্যাঁ, আমার বরের পৈত্রিক বাড়ি।" আবারও কিছুক্ষণ স্তব্ধতা থাকল। বাইরে শুধু বৃষ্টির শব্দ যার ছাট ক্রমাগত জানলার কাঁচে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। "আপনি কি সিগারেট খান?" মেয়েটি আবার প্রশ্ন করল, এই প্রশ্ন শুনে সেই ভদ্রমহিলা মনে মনে একটু অবাকই হলেন। "কেন বলো তো?" "না, মানে, সিগারেটের কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম বাড়ি তে ঢোকা থেকে, এখনও পাচ্ছি, তাই আর কি, জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনি কিছু মনে করলেন না তো?" "না না। হ্যাঁ, খাই। আমি নিজেই খাই। কেন?" "আপনি নিজেই খান?" "কেন, খেতে নেই?" ভদ্রমহিলা বললেন। "না, মানে-" "কী মানে? তাই তো মানে। তাই তো তুমি অবাক হোচ্ছো।" একটু থেমে সেই একই ভীতু ভীতু গলায় মেয়েটি আবার বলল, "হ্যাঁ, সাধারণত তো মেয়েদের-" তাকে শেষ করতে না দিয়েই ভদ্রমহিলা আবারও বললেন, "তোমাদের ধর্মে তো নিশ্চয়ই মহিলাদের এসব করা আর আরও অনেক কিছুই হারাম, তাই না?" মেয়েটি বলল, "না আপা, আমাদের ধর্মে এইসব সবার জন্যই হারাম আছে।" "তাই অবাক হোচ্ছো?" "না, মানে…হ্যাঁ, আপা, আরকি, তাই বলছিলাম।" মেয়েটির পিঠের ঘা গুলো সেই ভদ্রমহিলা যত্ন সহকারে পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন আর সেই মেয়েটি মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা, আপনার বর আছেন?" "না, এই সাদা শাড়ি দেখতে পাচ্ছো না?" ভদ্রমহিলা খারাপ পেয়েছেন বা রাগ করেছেন ভেবে মেয়েটি আবারও মাফ চেয়ে নিল, "না, মাফ করবেন আপা, আসলে-" মেয়েটির কথায় কথায় ক্ষমা ক্ষমা চাওয়ার স্বভাব আর বিনয়ী ভাব দেখে সেই মহিলা বেশ কৈতুক বোধ করছিলেন মনে মনে। "কথায় কথায় ক্ষমা চাও কেন, হ্যাঁ? ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই, তোমাদের ধর্মে যা শুনেছি, কালো কাপড় পড়ে বোধ হয় মরে গেলে পড়ে, তাই হয়তো জানো না।" "না, সবাই কালো পড়ে না, অনেকে সাদাও পড়ে আমাদের ধর্মেও।" "তাই হবে, যাই হোক, তবে…এমনিতেও সে নেই দেখে আমি বেশ ভালই আছি।" মেয়েটি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কে?" "আমার বর।" উত্তর এল, আর সাথে একটা গরম দীর্ঘ নিঃশ্বাস, যা সেই মেয়েটির ঘাড়ে আছড়ে পড়ল। আবারও কয়েক মুহূর্ত কাটল নিস্তব্ধতায়। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতারা সেই মেয়েটির কাছে কোনো এক অজানা কারনে বেশ অস্বস্তিকর বলে ঠেকছিল, হয়ত যেভাবে সেই ভদ্রমহিলা সেই মেয়েটির যোনি, থেকে আরম্ভ করে তার নগ্ন পিঠ অবধি তার দেহের সমস্ত ঘা পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন তাকে সামনে বসিয়ে রেখে, হয়ত সেটাই তার কাছে অস্বস্তিকর ঠেকছিল। আর সেই অস্বস্তি কাটাতেই হয়ত সে কথা চালিয়ে যাচ্ছিল সেই বৃদ্ধার সাথে। সে আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, "এই বাড়ি তে একা থাকতে আপনার ভয় করে না?" কয়েক সেকেন্ড পর সেই বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, "হ্যাঁ, প্রথম প্রথম করত, কিন্তু তারপর একদিন একটা গরীব বাচ্চা ছেলে এসে আমার বাড়িতে কাজ চাইল, ছেলেটা বিহারি, বাড়ি তে বাড়ি তে নাকি কাজ এর জন্য ঘুরছিল, ওর বাবা মা নাকি এখানে থাকে না, ওকে এখানে ট্রেন এ করে পাঠিয়ে দিয়েছে, ছেলেটাকে দেখে মায়া হল, তাই রেখে নিলাম নিজের কাছে, এখন সে আমাকে হাতে হাতে কাজ করে দেয়, এই বাজার টুকটাক করে দেওয়া, ঘর এর কাজে সাহায্য করা। আমি এই টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে যা টাকা পাই তাই দিয়ে সংসার চলে যায় মোটামুটি। আর ওই বাইরে যেই বোর্ডটা আছে, ওটাও লাগিয়েছিলাম, একটু আয় সেখান থেকেও হত।"
"আপনার কি আপনার বরের কথা মনে পড়ে না?" আরও কয়েক সেকেন্ড পর আবার সেই বৃদ্ধাকে আরেক প্রশ্ন করে বসল সেই মেয়েটি। এবং কাজ করতে করতেই সেই বৃদ্ধা পাল্টা একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, "তোমার মনে পড়ছে তোমার বরের কথা?" তার কন্ঠে একটু বিরক্তির ভাব স্পষ্ট ছিল। তাই এই পাল্টা প্রশ্ন শুনে সেই মেয়েটি চুপ করে গেল। তাই দেখে আবার পড়ে সেই বৃদ্ধা তোয়ালে দিয়ে মেয়েটির পিঠের রক্ত আর ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে উত্তর দিলেনও, "হ্যাঁ, পড়ে। মনে পড়ে, তবে কোনও আনন্দের স্মৃতি নয়, বরং ব্যাথার আর মারের কথাই মনে পড়ে। তার মারের দাগ এখনও বোধ হয় আমার গায়ে খুজলে পাওয়া যাবে, এই তোমার গায়ের ঘা গুলোর মতই। শেষ দিকে লোকটা আরও খুব বেশি করে মদ খাওয়া ধরেছিল, মদ খেত, আর আমাকে পেটাত, এই নাকি পুরুষ মানুষ।" মেয়েটি সেই বৃদ্ধার এই উত্তর শুনে এবার বুঝতে পারল যে কেন তিনি বললেন যে তার বর আর নেই দেখে তিনি ভালই আছেন, আর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "আপনার বরও আপনাকে পেটাত?" সেই বৃদ্ধা এর আর কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সেই মেয়েটির ঘা গুলো পরিষ্কার করতে থাকলেন। "সত্যিই তো, এই নাকি এরা মর্দ।" মেয়েটি কিছুক্ষণ পর বলে উঠল।
"আচ্ছা, উনি যখন মরে গেলেন, তখন আপনি আবার নতুন করে-" মেয়েটি কী বলতে চলেছে তা আন্দাজ করে নিয়ে তাকে শেষ না করতে দিয়েই সেই বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, "তখন আমার আবার নতুন করে শুরু করার মত বয়স ছিল না, ততদিনে আমার চুল পেকেছে, বুড়ি হয়ে গেছি, আর তাছাড়া, একজন পুরষ মানুষ কে পেয়ে যা দেখলাম, তার পর আমার নতুন করে নতুন কোনো বিপদ ডেকে আনার কোনো শখ ছিল না।" "না, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু, মানে…" "কী মানে?" কয়েক সেকেন্ড থেমে মেয়েটি আবার বলল, "হয়ত ভাল কোনো পুরুষ মানুষকে আপনি পাইতে পারতেন।" "পাইনি, তাতে বেঁচেই গেছি।" "এভাবে বলছেন কেন?" মেয়েটির এই প্রশ্ন শুনে সেই মহিলা ঘা সাফ করা থামিয়ে আস্তে করে সেই মেয়েটির দিকে তাকাল, "তোমার কী মনে হয়, কেন এভাবে বলছি?" "না, মানে," মেয়েটি বলল, "সব পুরুষ মানুষও নিশ্চয়ই খারাপ নয়।" "তাহলে এই ঘা গুলো তোমায় কে দিল? পালিয়েই বা এলে কেন?" এই কথা শুনে আবার সেই মেয়েটি চুপ করে গেল। "কী হল? বললে না?" "না, মানে, আপনি খারাপ পাবেন না, আমি আসলে-" "আমি খারাপ পাই নি, এখন একটু শান্ত হয়ে বসো, তোমার ঘা গুলো এখনও পরিষ্কার করা বাকি আছে।" বলে সেই বৃদ্ধা আবার মেয়েটির ঘা পরিষ্কার করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ আবারও কাটল নীরবতায়। তার পর মেয়েটি আবার ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করল, "আচ্ছা আপা, আপনি বাইরে এই বোর্ডটা-" "হুমম? বোর্ডটা? একটা সময় লাগিয়েছিলাম, উপরের এই ঘর টা আর বাকি আরও দু-চারটে ঘর যা আছে, সেগুলো সাধ্য মত ঠিকঠাক পরিষ্কার করে ভাঁড়া দিতাম, আমার বরের মোটর গ্যারাজের দোকান ছিল একটা, কিন্তু সেটা পরে বাবরি মসজিদ কে নিয়ে বিরানব্বই এর দাঙ্গার সময় জ্বালিয়ে দিয়েছিল কিছু মোল্লারা।" সেই মহিলার মুখে মোল্লা কথাটা শুনে খারাপ লাগলেও সেই মেয়েটি তাকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না, মহিলা বলে চললেন, "তার পর বেশ কয়েক বছর লোকটা বেকার বসে থেকে একদিন হার্ট আর লিভার এর রোগ ধরে মরে গেল, যদিও মদ খাওয়ার অভ্যেসটা ওর অনেক আগে থেকেই ছিল, ওকে ভালবেসে বিয়ে করার সময় আমি তা জানতে পারি নি।" বলে ভদ্রমহিলা একটু থামলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, "বোকা ছিলাম তো, ভেবেছিলাম সব পালটে যাবে, লোকটাও আবার আগের মত হয়ে যাবে, যেমনটা প্রথম প্রেমের সময় ছিল, তাই না বেরিয়ে থেকেই গেছিলাম। যাই হোক, ও চলে যাওয়ার পর কী করে খাবো, তাই প্রথমে সেলাই করে তেমন বেশি খরচ উঠছে না দেখে সাথে ওটাও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু দুয়েক জন ছাড়া আর কেউ আসতো না, আর বেশি ঘরও নেই, নিজেরই বাড়িতে ব্যবস্থা করেছি, দু তিনজনের বেশি কাউকে রাখা যায় না, বহু বছর কেউ আসেও না আর। ভেবেছিলাম ওই বোর্ডটা এক দিন খুলে রেখে দেব, তুমিই এই প্রথম আজ এলে।" "ওহ, আচ্ছা।" কিছুক্ষণ চুপ থেকে বৃদ্ধা আবার বলতে লাগলেন, "তার ওপর যখন ভাঁড়া দিতাম, তখন থেকে আমার সব পাড়াপড়শিরা আমাকে আর যারা এখানে ভাঁড়া থাকতে আসত, সেইসব ছেলেদের নিয়ে নোংরা নোংরা গল্প বানাতে শুরু করল, আমার কানেও সেইসব কথা এসেছিল, কিন্তু রাগ হলেও আমি কখনো তাদের কাউকে কোনো কথা শোনাইনি।" আবার একটু থামলেন ভদ্রমহিলা, তারপর আবার বলতে লাগলেন, "অবশ্য…এক বার একটা ছেলের সাথে শোয়ার চেষ্টা করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তখন তো আমার বয়স হয়ে গেছে, আর কি কেউ আমার সাথে তখন শুতে চাইত? তবে ওই এক বারই চেষ্টা করেছিলাম, ব্যস।" মহিলার এই কথা শুনে মেয়েটি অবাক হয়ে আস্তে করে সেই মহিলার দিকে ঘাড় ঘোরাল। "বলেন কি আপা?" "অবাক হওয়ার কী আছে? আসলে বোকা ছিলাম, তার উপর শরীর এর খিদে ছিল, সে তো এখনও আছে।" "হ্যাঁ?" প্রায় শোনা না যাওয়ার মত আওয়াজে মেয়েটি বলল। "হ্যাঁ, আমিও তো মানুষ নাকি, (একটু থেমে) তবে ওই এক বারই, সেই ছেলেটি সেই রাতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পালিয়ে গেছিল, এতই খারাপ লেগেছিল আমার তখন যে অপমানে রাগে একেবারে চোখমুখ লাল হয়ে গেছিল, তারপর আর সেই চেষ্টা ভুলেও করিনি, সত্যি বলছি, কিন্তু তাও আশেপাশে সবাই নোংরা নোংরা কথা গুলো ছড়িয়েছিল, যার বেশির ভাগই মিথ্যা।" এই কথাটা বলে হঠাৎ করে তার হাতের তোয়ালে যেটা দিয়ে সেই মেয়েটির পিঠের রক্ত তিনি মুছে দিচ্ছিলেন সেটা ছুঁড়ে বিছনার উপর ফেলে দিয়ে সেই বৃদ্ধা পাগলের মত হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন এই কথাগুলো, "আমি কি খানকি মাগী নাকি?! আমার কোনো চাহিদা থাকতে নেই?! আমার শরীরের কোনো চাওয়া না চাওয়া থাকবে না?!" সেই বৃদ্ধার এই আকস্মিক অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ায় সেই মেয়েটি ভয় পেয়ে একেবারে আঁটোসাঁটো হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে, নিজেকে ধাতস্থ করে, আবার করে তোয়ালেটা তুলে নিয়ে সেই মেয়েটির পিঠের ঘাম রক্ত মুছিয়ে দিতে দিতে তিনি বললেন শান্ত গলায়, "তুমি, কিছু মনে কোরো না, আসলে অনেক সময় আমার মাথার রাগের চোটে ঠিক থাকে না, কখন কেন যে কী করে বসি, নিজেও বুঝতে পারি না।" সেই মেয়েটি এরপর আর কীই বা করে বা বলে? চুপচাপ বসে রইল।
"তুমি কি ভয় পেলে?" সেই বৃদ্ধা আবার জিজ্ঞেস করলেন সেই মেয়েটিকে। "জি? না, আপা।" "তাহলে আর কথা বলছো না যে?" "না, মানে, এমনি।" তারপর তারা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করেই রইল।
বেশ কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটি ফের মুখ খুলল, "আচ্ছা, আপনার কোনো ছেলেপুলেও নাই?" "না গো, নেই।" তার ঘা গুলোতে ওষুধের ছিটে পড়তে জ্বালা করে ওঠায় সেই মেয়েটি মাঝে মাঝে হালকা স্বরে চিৎকার করে উঠছিল। "যদি আজকে আপনার ছেলে থাকত, তাইলে তো আপনাকে অন্তত দেখে রাখতে পারত বলেন?" সেই বৃদ্ধা সেই মেয়েটির কাঁটা ঘায়ে ওষুধ ছেটাতে ছেটাতে বললে, "রাখত কি না, কে বলতে পারে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো আবার বাবা মায়েদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়ে আসে, কে বলতে পারে, আমাকেও রেখে দিয়ে আসতে পারত। অথবা হয়ত আমাকে ধরে সেও পেটাত, যেমন আজকালকার অনেক ছেলেপেলেরা পেটায়, যদিও তাতে খুব একটা অসুবিধে হত না আমার, বরের হাতে তো এত বছর মার খেয়েই এসেছিলাম, বাকি জীবনটা না হয় ছেলের হাতে খেতাম। তার চেয়ে একা আছি এই বাড়িতে দুইটি প্রাণী মিলে, বেশ আছি।" শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে সেই বৃদ্ধার চোখদুটো যে জলে টলটল করে এসেছিল, তা সেই মেয়েটি পেছন ফিরে থাকায় দেখতে না পেলেও সেই বৃদ্ধার কেঁপে ওঠা কণ্ঠস্বর শুনে সে তা সহজেই ধারনা করতে পেরেছিল। কিন্তু তাও কিছু বলেনি আর।
কিছুক্ষণ পর, আবার সেই বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, "তবে একটা ছেলে থাকলে অন্তত, কে বলতে পারে, আমার ওপর জানোয়ারটা এতটা অত্যাচার করত না, ওর স্বভাবটা বদলালেও বদলাতেও পারত।" এই বলে আরেক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সেই মহিলা। "আপনার শশুড় শাশুড়ি কেউ…" তাদের কোনোদিন দেখিনি, শুনেছিলাম তারা নাকি আগেই মারা গেছে, তার কোনো দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয় বা কেউ, কাউকেই কখনো কোনোদিনও আসতে দেখিনি এই বাড়িতে, শুধু ওর কয়েকজন লম্পট মাতাল বন্ধুদের ছাড়া।" মহিলা একটু থামলেন, সেই মেয়েটিও উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল একটা আওয়াজ, বাইরে থেকে খুব জোরে জোরে ব্যাঙেরা গ্যাঙও গ্যাঙও করে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে বৃষ্টিতে। "ব্যাঙরা ডাকছে।" "জি।" মেয়েটি বলল ক্ষীণ গলায়। মেয়েটি তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, "আপা, আপনে কইছিলেন, আপনার বরের বন্ধুরা…" "হ্যাঁ, তারা আসত, নানাভাবে অকথ্য অত্যাচার করত। এই লোকটাকে ভালবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, বাবা মায়ের অমতে। ভেবেছিলাম, কষ্টে থাকলেও অন্তত সুখে তো থাকব। কিন্তু কোথায় শালা কী?" "আপনার বাড়ির লোকেরা এখন আর কেউ-" "জানি না, নিশ্চয়ই বেঁচে নেই আর, আমারই এখন এত বয়স হয়ে গেছে, তাদের সাথে কোনোদিন আর যোগাযোগ করিও নি, বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে ছিলাম আমি। আমার বরের সাথে পালিয়ে এক মন্দিরে বিয়ে করার পর এক বার গিয়েছিলাম দুজনে মিলে, তারা আমাকে সেই সময়ই মুখের ওপর বলে দিয়েছিল 'তুই এখন আমাদের জন্য মরে গেছিস।' তার পর তো সেখান থেকে চলে এলাম এই এক অভিশপ্ত পোড়ো বাড়িতে। তার পর থেকে তাদের কাছে আর যাই নি, কোন মুখেই বা আর যেতাম।" "আপা, আপনার বরের বাড়ির কেউ-" "বললাম যে, তাদের কাউকে কখনো দেখিনি, শুধু ওর মানে আমার বরের বন্ধু গুলো আসত বিরক্ত আর অত্যাচার করতে। তারাও অনেক রকমের অত্যাচার করত আমার ওপর, ভোগ করেছে আমায়, একেক করে বা অনেক সময় একেবারে সবাই মিলে, তখন খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, কিচ্ছু করতেও পারতাম না। আর তখন আমার নামে আকথা-কুকথা বলা শুরু করেছিল যেসব হারামিগুলো একটু খেটে খাওয়ার চেষ্টা করছি দেখে, তারা সব জেনেও আমার চিৎকার শুনেও কেউ বাঁচাতে আসেনি কোনোদিন।" মেয়েটি অবাক হয়ে শুনছিল সেই বৃদ্ধার সব কথা, একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করল, "আপনার নিশ্চয়ই তখন খুবই কষ্ট হত, না আপা?" একটু হালকা হাসলেন সেই মহিলা, মেয়েটি তাতে একটু অবাক হল, তারপর তিনি আবার বলতে লাগলেন, "হ্যাঁ, তা তো হত, তবে মজার কথা, একটা সময় পর ব্যাপারটা আমারও না কেমন যেন গা সয়া হয়ে গেছিল, আবার একটা সময় তো ব্যাপারটা আমার বেশ ভালই লাগতে শুরু করে দিয়েছিল।" "কী বলছেন আপনে আপা?!" "হ্যাঁ, এরম বলছি কেন জান?" মেয়েটি এর উত্তরে কিছুই বলল না, চুপ করে থাকল, কিছুক্ষণ পর সেই বৃদ্ধা আবার বলতে শুরু করলেন, "বলছি, কারন আমার বরের থেকে ওর বন্ধুদের তাও বিছানায় ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। তাই আমিও ব্যাপারটায় আর বাঁধা না দিয়ে উপভোগ করতাম, এক বার তো তার এক বন্ধু কে কথায় কথায় বলেওছিলাম যে তার গায়ের জোর আমার বরের থেকে অনেক বেশি, সে আমাকে ভোগের পরে আমার বরের সাথে গল্প করতে করতে সেই কথাটা ওকে বলে ফেলেছিল, সেটা জানার পর সেইদিন ওরা সব চলে গেলে আমার বর আমাকে বিছনায় ল্যাংটো করে ফেলে নিজের বেল্ট দিয়ে চাবকেছিল ভীষণভাবে, আর সেইদিন থেকে তার বন্ধুদের আমার বাড়িতে আসা বন্ধ করেছিল সে নিজেই। তার পর থেকে ওরা বাইরে কোনো হোটেলে যেত কিন্তু তাও আর কোনোদিন এই বাড়িতে সে তাদের নিয়ে আসেনি।" কথাগুলো বলে সেই মহিলা পাগলের মত হেসে উঠলেন, আর সেই মেয়েটিও তার বর্ণনা আর বলার ধরন শুনে না হেসে পারল না। "হ্যাঁ, কিন্তু তার পরেও আমার ওপর আমার বরের অত্যাচারটা চলতই।" সেই মুহূর্তে ফট করে সেখানে জানলার শার্সির ওপর আছরে পড়ল একটা চামচিকে, সেই আওয়াজে সেই মেয়েটি চমকে উঠেছিল, চামচিকেটা সমানে কাঁচের গায়ে নিজের মাথা দিয়ে বারি মারছিল এমনভাবে যেন বারি মারতে মারতে সেটাকে ভেঙেই ফেলবে, চামচিকেটা ছোট হলেও তার নড়ন্ত ছায়াটা ছিল বিশাল, যেটা সেই দুজনের মুখের ওপর পড়েছিল, কিছুক্ষণ পর সেটা চলেও গেল সেখান থেকে, সেই মেয়েটি একটু শান্ত হল তারপর, সেই মহিলা বললেন, "আগে এরম বহু চামচিকে ঘরে ঢুকে পড়েছে, জানলা দিয়ে বা অন্য ফাঁকফোকর দিয়ে, আর আমাকে তাড়াতে হয়েছে।" বলে সেই মেয়েটির ঘা গুলোতে ওষুধ দিতে লাগলেন আবার করে।
এবার আর সেই মেয়েটি প্রশ্ন করল না, সেই বৃদ্ধাই প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা, তোমার বর কি তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে না কি তুমি নিজেই-" "তাড়িয়ে দিয়েছে মেরে ধরে, আমিও বেরিয়ে গেছি চুপচাপ, ওই বাড়িতে ওই জল্লাদ গুলোর সাথে কে থাকবে? কিন্ত বাইরে না খেয়ে না ঘুমিয়েও বা কয়দিন থাকতে পারি, রাস্তা থেকে অনেক সময় এঁটোকাঁটা তুলে খেয়েও থেকেছি, কিন্তু তাও বেশিদিন খিদে পেট নিয়ে থাকতে না পেরে, আবার ওই বাড়িতেই যেতে হয়েছে, বাবা মা দূরে থাকেন, তাদের কাছে যে যাব, সেই ক্ষমতাও আমার নেই, তাদেরকে বলেওছি বহুবার, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে, তারা শোনেনি, দেখা করতে আসাও বন্ধ করে দিয়েছে তারা এখন তো, রাস্তাঘাটে থাকাও তো আমার মত মেয়েমানুষের জন্য নিরাপদ না আপা, বাড়ি বাড়ি অনেক লোকের কাছে গিয়েও বলেছিলাম, আমাকে রাইখে নেন, আপনাদের বাড়িতে থাকব, সব কাজ করে দিব, শুধু একটু খেতে আর থাকতে দিবেন, কিন্তু আজকাল শালা কাজের লোকও কেউ রাখতে চায় না।" "কখনো পুলিশের কাছে যেতে চেষ্টা করোনি?" "আপনি চেষ্টা করেন নাই আপা কোনোদিন?" মেয়েটির এই উত্তর শুনে এবার সেই ভদ্রমহিলা চুপ করে গেলেন, আর চুপচাপ তার ঘা গুলো পরিষ্কার করতে লাগলেন, মেয়েটি কিছুক্ষন পর বলে উঠল, "পুলিশ কোনোদিন কিছুই করে না, করেও নাই, আমি গেছিলাম অনেক বার, বার বার বলেছে, আরও বড় কিছু হলে বা করলে, তখন তারা যাবে, আমার শরীরের সব দাগ ওদের দেখায় বলেছিলাম এর থেকে বড় আর কী হতে পারে, কিন্তু তাও তারা কিছুই করেনি।" একটু থেমে আবার সেই মেয়েটি বলল, "মাঝে মাঝে কী মনে হয় আপা জানেন, মনে হয়, কেন যে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মাতে গেলাম।" " তা, তোমার নেই, ছেলেপুলে?" একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সেই মেয়েটি, তারপর বলল, "আছে, দুটো বড় ছেলে, বেশি বড় না, একটা পনেরোর, আরেকটার বয়স বারো, কিন্তু আমার নয়, আগের পক্ষের, শুনেছি সেই বউটাও নাকি গায়ে আগুন দিয়ে মারা গেছিল, কিন্তু আমার বাবা সব জানা সত্ত্বেও মত দিয়েছিল বিয়েতে, কারন আমিই বোকার মত ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে। সেই ছেলেদুটোও আমাকে চুলের মুঠি ধরে পেটায়, অনেক সময়, বাপের দেখাদেখিই শিখেছে কিনা, আমার শশুড় বাড়ির লোকেরাও অবধি ওই বাচ্চাগুলোকে উৎসাহ দেয়।" "তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, যে আমারও কোনো ছেলে না হয়ে বেশ ভালই হয়েছে। আর মেয়ে না হয়েও, না হলে তার ওপরও যে জানোয়ারটা কী অত্যাচার করত কে জানে।"
ঘরের মধ্যে রাখা মোমের অনেকটাই গলে গেছিল, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, তাও যেটুকু ছিল, সেটাই ঘরে আলো দিয়ে যাচ্ছিল। "মোম টা অনেকটা পুড়ে গলে গেছে, আর বেশিক্ষণ এটা টিকবে বলে মনে হয় না, আরেকটা মোম আনতে হবে খুঁজে।" সেই বৃদ্ধা বললেন। সেই মেয়েটির শরীরের, পিঠের ঘা গুলো পরিষ্কার করতে করতে নিজের হাত দিয়ে খুব মোলায়েম ভাবে সেই ঘা গুলোর ওপর হাত বুলিয়ে আদর করছিলেন সেই মহিলা মাঝে মাঝে, আর তাতে একটু চমকে চমকে আর শিউরে শিউরে উঠছিল সেই মেয়েটি মাঝে মাঝে, এক বার তো নিজের নাক তার পিঠের চামড়ার কাছে নিয়ে গিয়ে তার ঘামের গন্ধও শুকে দেখলেন তিনি। তখন সেই মেয়েটি বলে উঠেছিল, "আররে, আপা, আপনি…এটা কী করছেন?!" উত্তরে সে শুনেছিল এই কথাগুলো, "তোমার চামড়া বেশ মোলায়েম গো, তাই একটু ছুঁয়ে দেখছিলাম।" "হ্যাঁ? জি, মানে…ধন্যবাদ, আপা।" ওরম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আর কী বলবে ভেবে না পেয়ে বোকার মত ধন্যবাদ বলে ফেলেছিল সেই মেয়েটি সেই বৃদ্ধাকে। মাঝে মাঝে সেই মেয়েটির রক্ত আর ঘামে ভেজা সেই সাদা তোয়ালেটাও সেই বৃদ্ধা শুকে দেখছিলেন। আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে, বজ্রবিদ্যুৎ আর ঝড়ের শব্দে, ঘাম আর রক্তের গন্ধে একাকীত্বে কাটল সেই দুজনের।
পিঠের ঘা গুলো পরিষ্কার করা হয়ে গেলে পরে সেই মহিলা বলে উঠলেন, "নাও, তোমার পিঠের সব ঘা পরিষ্কার করা হয়ে গেছে, এবার তোমার সামনের দিকে কোথায় কোথায় কী কী ঘা আছে, দেখাও, সেগুলোতেও ওষুধ লাগিয়ে দিই।" মেয়েটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "জি?!" 'আরে, এত অবাক হচ্ছো কেন এখন আবার? তোমার ওখানকার ঘা অবধি পরিষ্কার করলাম, তুমি দেখালেও। এবার তোমার সামনেটা দেখাও।" মহিলার যুক্তি ঠিকই, কিন্তু এই অনুরোধ শুনে, সত্যি বলতে, কেন সে নিজেও জানে না, তবে সেই মেয়েটির কানের পাশগুলো গরম হয়ে এল, "আররে এখন আবার এত লজ্জা পাচ্ছো কেন? দেখাও।" "না, আপা, কোনো ঘা নাই।" মেয়েটি ম্লান কন্ঠে বলল। "তোমার বুকের কাছে কয়েকটা আচরের দাগ লক্ষ্য করেছি আমি।" মেয়েটি চুপ করে রইল। "কী হল, দেখাও?" "না, আপা, আপনি অনেক করছেন, থাক, আর লাগবেনা।" সেই বৃদ্ধা আস্তে করে সেই মেয়েটিকে নিজেই নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন, মেয়েটি লজ্জায় নিজের দুই চোখ বন্ধ করল, তার গায়ে কাঁটা দিল, তার হৃদস্পন্দন আর শ্বাসপ্রশ্বাস গেল বেড়ে, তার উন্মুক্ত নগ্ন সুডৌল ক্ষতবিক্ষত স্তনগুলোকে আদর করে সেই মহিলা সেগুলোর উপর হাত বোলাতে লাগলেন, সেই মেয়েটির তাতে এক অদ্ভুত আরাম লাগতে লাগল। "ইসস, কী অবস্থা করেছে ওই জন্তু গুলো তোমার! এগুলো তো পেকে ঘা হয়ে যাবে একটা সময়।" আস্তে করে চোখ খুলে নিজের দুই অশ্রুসজল চক্ষু দিয়ে সেই মেয়েটি তাকাল আবার করে সেই বৃদ্ধা মহিলার দিকে। তারা কয়েক মুহূর্ত শুধু নিষ্পলকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর সেই বৃদ্ধা সেই মেয়েটিকে বললেন, "কোনোদিন, কখনো কোনো মানুষের আদরের ছোঁয়া পেয়ে দেখেছো?" মেয়েটির এক চোখ দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি জড়ানো গলায় বলল, "এসব আপনি কী বলছেন?" সেই বৃদ্ধা আবারও বললেন, "বলো, বলো না, কেউ কখনো তোমার এই ঘা গুলোতে আদর করে এভাবে হাত বুলিয়েছে? কখনো ভালবেসেছে?" "না আপা, আমাকে ছাড়েন।" মেয়েটি নিজেকে সেই মহিলার হাতের পেশির নাগপাশ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই সেই মহিলা তাকে আরও জোরে চেপে ধরে নিজের আরও কাছে টেনে নিলেন, এত কাছে যে তাদের একে অন্যের গায়ে তারা নিঃশ্বাস ফেলছিল। তারপর আস্তে করে নিজের এক হাত দিয়ে সেই বৃদ্ধা সেই মেয়েটির গালে আদর করতে লাগলেন, তার চোখের জলও মুছে দিলেন, আর তারপর আবার বললেন, "কখনো এমন আদর পেয়েছো?" "আপনি এইসব…আপা…" "তোমার এই ঘা গুলোর মত আমার গায়েও প্রচুর শুকিয়ে যাওয়া ঘায়ের দাগ আছে, দেখবে?" একটা সময় পর ঘরের দেওয়ালে মোমের আলোয় দেখা গেল, দুটো ছায়ামূর্তি একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে, সেই মেয়েটির পায়ের ধাক্কায় অতর্কিতে সেই বিছনায় রাখা সেই পোরসেলিনের রক্তজলসুদ্ধ বাটিটা মাটিতে পড়ে শব্দ করে ভেঙে গেল। তাতে তারা দুজনেই চমকে উঠেছিল। মেয়েটি আমতা আমতা করে বলতে যাচ্ছিল কিছু একটা, "আসলে, পা লেগে-" তাকে পুরো কথা না বলতে দিয়ে তার ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে ইশারায় চুপ করতে বললেন সেই মহিলা, আর আস্তে মোলায়েম গলায় বললেন, "আর কোনও কথা নয়।" সেই মেয়েটিও তখন অবশিষ্ট মোমের আলোয় সেই মহিলার মুখটা দেখে নিল ভাল করে, কন্ঠনালীর আর চোখমুখের নানা জায়গার শিরা-উপশিরা ফুলে উঠলেও তিনি যে একটা সময় বেশ সুন্দরী ছিলেন তা তাকে দেখলে এখনও বোঝা যায়। এখনও তার আসল বয়স কত তা না জানলেও তাকে সেই মেয়েটির সুন্দর দেখাল বেশ সেই আধো অন্ধকারে। তারা একে অপরকে পাগলের মত জাপটে ধরার আগে সেই মেয়েটির গলা থেকে উঠে এসে তার মুখ থেকে বেরিয়ে ছিল একটা অস্ফুট শব্দ –"আপা!"।
সেই পোরসেলিনের বাটিটা মাটিতে পড়ে ভেঙে যাওয়ায় সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেছিল নিচের তলায় নিজের ছোট্ট ঘুপচি ঘরে ঘুমানো সেই বাচ্চা ছেলেটির। কোথা থেকে কী শব্দ হয়েছিল তা বুঝতে পারেনি সে, ঘুম ভেঙে জেগে নিজের ঘরের জানলায় বৃষ্টির জলের ছাট দেখছিল সে বিছনায় শুয়ে শুয়ে, কিছুক্ষণ পর আবার তার কানে এল খাটের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ, যা আসছিল উপর তলা থেকে, উপরে ছাতের দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগল যে শব্দটা কিসের, তখনই আবার থেমে গেল শব্দটা, কিন্তু তার পর যখন সে বিছনায় শুয়ে আবার জানলার দিকে তাকিয়েছে তখন ফের সেই শব্দটা শুরু হল। সে অবাক হয়ে এবার বিছনা ছেঁড়ে নিজের ঘর থেকেও বেরিয়ে এল ভয়ে ভয়ে আর কৌতূহলে।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ফেলে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল সে সাবধানে, সামনে প্রথমেই যেই ঘরটা পড়ে, তার দরজাটা আলতো করে ভেজানো ছিল, তার ফাঁক গলে ঘরের ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ কাঁপা কাঁপা আলোর রেখা এসে পড়েছিল বাইরে মাটিতে, আস্তে করে পা টিপে টিপে সেই ছেলেটি সেই ঘরের দরজার কাছে গেল, সেই ফাঁক দিয়ে তার চোখে প্রথমে এসে পড়ল সেই ঘরের একটা দেওয়ালের ওপর একটা অদ্ভূত ছায়া, যেটা দেখতে অনেকটা এক পাগলা হাতির মত যা সমানে দুলছে("পাগলা হাতির মাথা নড়ে")। সেই ছেলেটা সাহস করে আরও এগিয়ে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে নিজের চোখ গলিয়ে দেখতে পেল, যে সেখানে ঘরের ভেতর বিছানার ওপর দুটো নগ্ন শরীর সমানে হুটোপুটি খাচ্ছে একে অপরের ওপর, তাদের গায়ের ওপর একটা চাদর, আর সেই চাদরে ঢাকা তাদের দেহদুটো মিলেই ঘরের দেওয়ালের ওপর সেই অদ্ভূত ছায়াবাজি তৈরী করছে, এমনভাবে বিছানায় হুটোপুটি খেয়েছে একে অন্যকে জড়িয়ে যে গায়ের ঘামে সেই বিছনার চাদর অবধি তাদের শরীরে লেপ্টে গেছে। তারা দুজনে মাঝে মাঝে একে অন্যকে দেহের নানা জায়গায় চুমুও খাচ্ছে, খামচাচ্ছে, আচর কাটছে। মেয়েটির গায়ের ঘা গুলোতে আদর করে চুমু খাচ্ছে সেই বৃদ্ধা।
তাদের ওভাবে দেখে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ল সেই ছেলেটির লৌহদন্ড, সে সেখানে দাঁড়িয়েই নিজের প্যান্টের ভেতর থেকে নিজের হাতিয়ার বের করে তাতে শান দিতে লাগল সেখানে দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখতে দেখতে। বয়সের সাথে এগুলো হয়।
বাইরে শালার ঝড় বৃষ্টি একটু ফোঁটাও থামেনি, সেই ঝড়ে বাড়ির বাইরে টাঙানো সেই বোর্ডটা আলগা হয়ে একটা সময় খুলে সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল। সেই আওয়াজে চমকে উঠল সেই ঘরের মধ্যে বিছনার ওপর থাকা দুটো মানুষ, তাকাল একে অপরের দিকে, সেই ছেলেটি আরও সতর্ক হয়ে লুকিয়ে পড়ল, মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, "কিসের একটা আওয়াজ হইল না বাইরে?" "ও কিছু না, কিছু হবে হয়ত, এসো।" বলে তারা আবার করে একে অপরকে জড়িয়ে নিজেদের ঘামে ভেজা শরীরগুলোকে আদর করতে শুরু করল। আর সেই ছেলেটিও আবার করে শুরু করল নিজের কাজ।
হঠাৎ করে সেই বৃদ্ধা ঘরের দরজার আড়ালে দেখতে পেয়ে গেলেন সেই ছেলেটিকে, আর সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠলেন, "কিরে এই! কী করছিস তুই এখানে?!" ছেলেটি তড়িঘড়ি সেখান থেকে পালাল। মেয়েটিও দেখেছিল সেই ছেলেটিকে, সে জিজ্ঞেস করল, "ছেলেটা কি আমাদেরকে দেখে ফেলল?" আশঙ্কার সুরে। "হ্যাঁ?! সেই বৃদ্ধার মুখ থেকে বেরোল কথাটি। তারপরই তারা শুনতে পেল উভয়ে এক শব্দ, যেন কেউ একটা সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ শব্দ করে নীচে পড়ে গেল। চমকে উঠে তারা দুজনেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মেয়েটি সেই শব্দ শুনে ভয় পেল বেশ।
সেই বৃদ্ধা নিজের শাড়ি আর সেই মেয়েটি সেই চাদর গায়ে কোনোরকমে জড়িয়ে ধরে থেকে বেরোল ঘর থেকে, বৃদ্ধার হাতে ধরা টর্চের আলো এখন অনেকটা কমে এসেছে, সিঁড়ির কাছে যেতেই তারা দুজনেই দেখতে পেল, নীচে সেই ছেলেটি কেলিয়ে পড়ে আছে মরা কোলাব্যাঙের মত। তার মাথা থেকে অনেকটা রক্তও বেরোচ্ছে, একটা আরশোলা মাটিতে সেই রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে একটা লাল রেখা মাটির ওপর কিছুটা দূর এঁকে চলে গেল সুরসুর করে। তাদের দুজনের মধ্যে সেই ভদ্রমহিলাই নামলেন নীচে, কারন সেই মেয়েটির তখন ভয়ে প্রায় মারা যাবার মত হালত। ভদ্রমহিলা নীচে গিয়ে সেই ছেলেটির কাছে হাঁটু গেড়ে বসে তার নাকের ফুটোর কাছে হাত রাখলেন, দেখলেন, শ্বাস চলছে, তার বন্ধ চোখের পাতার নীচে নড়াচড়াও লক্ষ্য করলেন, তার মানে, এখনও সামান্য হলেও জ্ঞান আছে, হয়ত হাঁসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যাবে, সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তিনি মাথা নেড়ে জানালেন যে ছেলেটি আর বেঁচে নেই। সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটি তখন আরও ভয় পেয়ে গেল, সেই মহিলা কিছুক্ষণ পর হঠাৎ এক অদ্ভুত উক্তি করে বললেন, "একে ভাবছি পুঁতে ফেলবো কোথাও।" কথাগুলো উচ্চারণ করার সময় সে মহিলার চোখমুখে কেমন স্পষ্ট একটা খুনি ভাব ফুটে উঠেছিল, যা চোখে পড়েছিল সেই মেয়েটিরও। এই কথা শুনে সেই মেয়েটির মনটা ছাঁৎ করে উঠল। "আর কোনো উপায়ও তো নেই, এ তো মরে গেছে। আমার এই বাড়িতে একটা শাবলও আছে।" মেয়েটির মাথাটা আরও গুলিয়ে গেল, সে কিছুতেই বুঝতে পারল না যে সেই বৃদ্ধা হঠাৎ এইসব কথা কেন বলছেন। সে নিজেও একটা সময় আস্তে আস্তে করে নীচে নামতে লাগল। "তুমি আবার আসছো কেন?" সেই মহিলা তাকে নামতে দেখে বললেন, তাতে মেয়েটি একটু থমকে গেল, কিন্তু তারপর আবার করে নামতে লাগল নীচে। নিজে গিয়ে সেই ছেলেটির হাত আর নাকের কাছে আঙুল ধরে দেখে সেই মেয়েটি বুঝে গেল, যে সেই ছেলেটি আসলে এখনও বেঁচে আছে। আর তা বুঝে উঠতেই অবাক হয়ে তাকাল সেই মহিলার দিকে। "এ তো এখনও বেঁচে আছে, হ্যাঁ?" তারপর আবার করে সেই ছেলেটির শরীরের দিকে দেখে দেখল, তার দেহে ভর্তি অজস্র সিগারেটের ছ্যাঁকা, নখের আচর আর দাঁতের কামড়ের দাগ, তার মধ্যে কয়েকটা দেখে বোঝা যাচ্ছে সেগুলো তাজা। যেন ছেলেটির ওপর চেপে বসে কেউ সমানে কামড়েছে আচরেছে তাকে, মেয়েটি আবার করে তাকাল সেই মহিলার দিকে, আর জিজ্ঞেস করল আরো অবাক হয়ে, "এই ছেলেটির গায়ে এত কামড় আর আচরের দাগ কেন?" মহিলা এতক্ষণ সেই মেয়েটির দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল, এবার হঠাৎ সেই মহিলার দুই চোখ থেকে খুনে ভাবটা মিলিয়ে গিয়ে একটা অস্বস্তি আর বিড়ম্বনার ভাব ধরা পড়ল, অনেকটা চোর ধরা পড়ার মত। তিনি আস্তে করে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিলেন সেই মেয়েটির দিক থেকে।
বাইরে তখনও বৃষ্টি চলছে।
