Aziza Nasrin

Abstract Fantasy

4.5  

Aziza Nasrin

Abstract Fantasy

গান_আর_ভীনগ্রহ

গান_আর_ভীনগ্রহ

8 mins
349


সাল ২০৫০, জুলাই : 


আজ পৃথিবী থেকে আমার বিদায় নেওয়ার পালা | আমি চিরতরে মুছে যাব এই বসুন্ধরা থেকে | আমার পরিবার , আত্মীয়স্বজন ,বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফেলে আমি চলে যাচ্ছি এক অন্য গ্রহে , আমাদের সবার কাছে যা বহু কাল থেকে রহস্যে ঘেরা , মঙ্গল ! পৃথিবী বহু যুগ ধরে মঙ্গলের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে চলেছে নানা ভাবে ,কিন্তু সেটা মঙ্গলের বাইরে থেকেই | এই প্রথম পৃথিবীর মানুষ পা রাখবে মঙ্গলের মাটিতে ! সারা পৃথিবী জুড়ে উম্মাদনা আর উত্তেজনার শেষ নেই | পাঁচ বছর আগে নাসা বিদ্যা ,বুদ্ধি, শারিরীক এবং মানসিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে পৃথিবী থেকে বেছে নিয়েছে পাঁচ জন মানুষকে যারা মঙ্গলের মাটিতে পা রাখতে চলেছে | সেই পাঁচজনের মধ্যে আমি এক সৌভাগ্যবতী | এই পৃথিবীর মাটি ,জল ,গাছ ,নদী ,পাহাড় কোন কিছুই আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি ,আমার চোখ সবসময় থেকেছে ওই সুদূর আকাশে | রাত্রের বিশালাকার তারা সমৃদ্ধ আকাশ আমাকে মোহিত করেছে বারং বার | ইচ্ছা হয়েছে এই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে চলে যায় আকাশের ওপারে | উপর থেকে পৃথিবী কে দেখার স্বাদ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে | নিজের সাব্জেক্ট কেমিস্ট্রি হলেও আস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি রাতের পর রাত | স্কুল ,কলেজ ,ইউনিভার্সিটি সবেতেই ছাত্রী হিসাবে ছিলাম চোখে পড়ার মত | পাঁচ বছর আগে নাসার এই অভিনব আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছিলাম মঙ্গলে যাওয়ার অভিপ্রায়ে | তখন আমি কলেজে পড়ি , সেকেন্ড ইয়ার ,বয়স কুড়ি | দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে সম্মুখীন হয়েছিলাম নাসার | তারপর যেদিন হাজার হাজার অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে ওই পাঁচজনের লিস্টে নিজেকে দেখলাম ,সেইদিন টাকে আমার জীবনের সেরা দিনের স্বীকৃতি দিয়েছিলাম | আনন্দে আকাশ ফাটানো চিৎকারে উপরের আকাশও হয়ত স্মিত হাস্য করেছিল ! দিনের পর দিন নিজেকে আরও নানাভাবে তৈরি করেছি মঙ্গলের যোগ্য করে নিতে | 

আমি আর কোনদিনও ফিরে আসব না ,জানি ! কিন্তু এই পৃথিবী প্রতি আমার এতটুকু পিছুটান অনুভূত হচ্ছে না | আশ্চর্য ! তার মানে বসুন্ধরা তার মায়ার বাঁধনে আমাকে বাঁধতে পারেনি | আমি যদিও এই বিষাক্ত পৃথিবীতে থাকতেও চাইনা | এই হিংসা ,হানাহানি,আর রক্তপাতের পৃথিবী থেকে আমি বিদায় নিতে চাই ! এখানে শুধু ধর্মের লড়াই চলে , ধনী-দরিদ্রের লড়াই চলে | শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বলকে পদানত করে রাখে | মানুষের অসহিষ্ণুতা পরিবেশকে বিষিয়ে রেখেছে চারদিক থেকে | কেউ কাউকে সহ্য করার কোন ক্ষমতা রাখে না ! 

 পৃথিবীর সবাই ভাবছে ইচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছি আমরা পাঁচজন , কিন্তু আমার মনের কোথাও না কোথাও এই বিশ্বাস জন্মেছে যে সামনের দিন গুলোতে আমি কিছু অসম্ভব চিত্তাকর্ষক দিনগুলির সম্মুখীন হতে চলেছি | আমার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে চলেছি! 

(১)প্রায় ৭২ ঘন্টা জার্নি করার পর মঙ্গলে নেমেছি | এই ৭২ ঘন্টায় আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলল ,ফলে এখন আমার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই পৃথিবীতে ছিলাম আর এই মাত্র এসে নামলাম মঙ্গলে ! আমাদের পাঁচজনকে বিভিন্ন পাঁচ জায়গায় নামানো হয়েছে | এখন রাতের অন্ধকারে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না | আমার পিঠের অক্সিজেন সিলিন্ডারের ভার টা যেন বেশি লাগছে | আমার গা টাও কেমন অবশ হয়ে আসছে | আমার হাতে একটা ইলেক্ট্রনিক মাইক্রো টর্চ আমি দূর থেকে দূরান্তরে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না | সামনের দিকে একটা বিশালাকার লালচে মত কিছু আছে ...মনে হচ্ছে যেন লালচে পাহাড় | এখানকার মাটি বেশ রুক্ষ ,পাথুরে | আমি আকাশের দুটো উপগ্রহের একটাও দেখতে পেলাম না | আকাশ পুরো অন্ধকার ! এখানেই বসে পড়লাম | অপেক্ষায় রইলাম দিনের আলো ফোটার |নিজেকে কেমন যেন সত্যজিৎ রায়ের সেই " বঙ্কুবাবুর বন্ধু" গল্পের মিস্টার আং এর মতো মনে হতে লাগল |


(২) 

ইউরেকা ! সকালের সূর্য আমার মুখের উপর এসে পড়েছে | আমি একটা রুক্ষ ফাঁকা পাথুরে জমিতে শুয়ে আছি | এখানকার আকাশ পৃথিবীর আকাশের মতই ,তবে পৃথিবীর থেকে যেন বেশি নীল ! বেশি শান্ত ! আরও একবার চমকে ওঠার পালা | দূর থেকে আমি যাকে লাল পাহাড় ভেবেছিলাম তা আসলে এখানকার জঙ্গল | এখানকার গাছের পাতা লাল | আমি সাহস করে অক্সিজেন মাস্ক টা মুখ থেকে সরিয়ে দিলাম | আহ! কই কিছু কষ্ট হচ্ছে না তো ! ফ্রেশ বাতাসে শ্বাস ভরে নিলাম | দেহের আরাম লাগছে | এখানকার পরিবেশ পৃথিবীর থেকে অনেক বেশি বিশুদ্ধ | আমার উন্মাদ প্রাণ আরও উন্মাদিত হল | আমি ছুটে গেলাম জঙ্গলের দিকে আরও নতুন কোন প্রানের খোঁজে ! 

আমার হাতে ছিল রিমোট কন্ট্রোল যা নাসা তার সেন্টার থেকে যোগাযোগ করতে পারবে মেসেজের মাধ্যমে | এখানে এসে টাইপ করা যাচ্ছে না ,তবে রেড বাটন টিপে জানিয়ে দিতে পেরেছি যে আমি বেঁচে আছি | 

গত দশদিন আমি লোকালয়ে রয়েছি | এখানে মানুষ বসবাস করে | পৃথিবীর থেকে আলাদা কিছুই মনে হচ্ছে না আমার | কিন্তু মঙ্গল পৃথিবীর থেকে অনেক বেশি সাজানো ,গোছানো , অনেক বেশি সুন্দর | এখানকার সব মানুষই যেন শৃঙ্খলা পরায়ন | এখানকার ভাষা আমার জানা নাই ,তাই কোনও মানুষের সাথে আলাদা করে প্রাণভরে কথা বলা হয়ে ওঠেনি | 

(৩) 

গত দশদিন এখানকার মানুষদের মধ্যে যা যা লখ্য করেছি তার মধ্যে পৃথিবীর মানুষদের জীবনযাত্রার কোন বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করিনি | কিন্তু একটা জায়গাতেই বিশেষ খটকা লাগছে আর তা হল রবার্ট ম্যাসকট, | তিনি একজন গায়ক | যার গান এখানকার মানুষদের মধ্যে অদভুত ভাবে মোহিত করে রেখেছে | 


সমগ্র মঙ্গল আজ একজন কে একঝলক সুস্থ শরীরে দেখার জন্য প্রার্থনায় বসেছে সেই রবার্ট ম্যাসকট, সারা মঙ্গল যাকে সঙ্গীত সম্রাট নামে আখ্যায়িত করেছে, তিনি সবে মাত্র দীর্ঘ তিনমাসের অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেয়েছেন | এখানকার লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয় ভরা ভালোবাসা আর তাদের অকৃপণ, নি:স্বার্থ প্রার্থনায় যেন আবার মঙ্গল ভরে উঠবে রবার্টের সুর মূর্ছনায় | প্রকৃতি কখনও জুয়া খেলে না | প্রকৃতি তোমাকে দু হাত ভরে দিয়েছে সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে আজও তুমি তার দয়ায় অস্তিত্ত্ব রেখেছ | রবার্ট ম্যাসকট ও প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি, এক অনবদ্য শিল্পের জাদুকর, গান যদি হয় ধর্ম, তাহলে তিনিই ঈশ্বর, | মঙ্গলের প্রায় ১৫০ টি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন | গানকে তিনি আলাদা ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, তার সৃষ্টি সুর পৃথিবীর সঙ্গীতকে আলাদা মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে, মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, সম্পর্ক, অশ্রুবিন্দু, মুখের হাসি.... সমস্ত কিছু নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন | মানবতার গান, সে গানের কোন ধর্ম নাই, জাত নাই.... আছে অফুরন্ত ভালোবাসা, ভালোবাসার গান, মানুষকে ভালোবাসার গান, মঙ্গলকে ভালোবাসার গান | মানব জীবনের এমন কোন জায়গা বোধহয় নেই যেখানে তার গান স্পর্শ করেনি |তাঁর গানের অদভুত শক্তি আছে মানুষকে সম্মোহিত করার | মঙ্গল আজ শান্ত তাঁর গানের জগতের দ্বারা, | আজ মঙ্গলের কোন দেশে দাঙ্গা বাঁধে না, কোন শিশুদের স্কুলে এসে কেউ রক্ত ঢেলে দেয় না, কোন রেস্টুরেন্টে এসে মানুষের গলা কেটে কেউ বিশ্বকে পদানত করে রাখার ভয় দেখায় না, বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর কোন কেউ ষড়যন্ত্র করে না | সমস্ত হিংসা, রাগ, মানবতা লঙ্ঘনকারী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুলি যেন সেই হ্যামিলটনের বাঁশিওয়ালার পিছু পিছু বিদায় নিয়েছে মঙ্গল থেকে | মাঝে মাঝে ভাবি এতকিছু সম্ভব হয় কি করে, সেটা কি শুধুই রবার্ট ম্যাসকট? শুনেছি সঙ্গীতে সব সম্ভব,যে গান শোনে না সে নাকি মানুষ খুন করতে পারে..... রবার্ট সত্যিই এক জাদুকর, তবে তার জাদুর পিছনের রহস্য ভেদ করা আমার অসাধ্য, একমাত্র ঈশ্বর পারেন | কিন্তু আমার মনে একটা সন্দেহ দানা বাঁধছে যার সত্যতা আমাকে যাচাই করতেই হবে |


 রবার্টের বাড়ির সামনে হাজার মানুষের ভীড়, সবাই একবার তাঁকে একবার দেখতে চায়, সুস্থ হয়ে উঠে এই প্রথম তিনি মানুষ সমক্ষে আসবেন, টেলিকাস্ট করা হবে এই তারকার সাক্ষাৎ | দূর দূরান্তে টিভি খুলে সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে | সত্তোর্ধ ব্যক্তি, একমাথা সাদা চুল, খানিকটা ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, একমুখ সাদা দাড়ি, সাদা পাজামা পাঞ্জাবী তে সুসজ্জিত, অসম্ভব স্নিগ্ধতা চোখে মুখে স্মিত হাস্যমুখে বেরিয়ে এলেন | মানুষের ভালোবাসার চিৎকারে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল, সমস্ত ক্যামেরা তাঁর দিকে | মানুষের চোখের কোণে জল, বুকের ভিতরে এক শান্তি....এর ব্যাখ্যা আমি দিতে পারি না | রবার্টকে যদি মানুষ কখনও ভুলে যায়, তাঁর গানকে কখনও নয় |

(4)

পরিষ্কার আকাশ, অগুন্তি তারা আর ফটফটে আলোয় আলোকিত মঙ্গলের দুই উপগ্রহ | আজকের রাতের আকাশেও অগুন্তি তারা, ছাদের বেদিটায় রবার্ট বসে আছেন, হাতে তার গিটার |রাত ১২ টা সাত, তাঁর সবথেকে প্রিয় ছাত্র, যার মাঝে রবার্ট নিজের ছবি তৈরি করেছেন নিজ হাতে, এসে বার বার ঘরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে, কিন্তু বহুদিন পর রবার্ট খোলা আকাশের নিচে গুনগুনিয়ে উঠেছেন, কেমন যেন ছেলেমানুষী তার চেপে বসেছে, জীবনে তিনি অনেক কিছু অর্জন করেছেন, মানুষের মনে এক বড় জায়গা করে নিয়েছেন | আমি বহুকষ্টে রবার্টের সাথে দেখা করার অনুমতি নিয়ে যখন ছাদে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম , তিনি অবাক করে দিয়ে আমাকে বললেন ," কেমন আছো?" ভীনগ্রহে আজ প্রায় ১ টা বছর পর নিজের বাংলা ভাষায় কাউকে কথা বলতে দেখে আমার চোখে জল এসে পড়ল | আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তাই | পায়ের কাছে বসে বললাম "আপনিই তো বিখ্যাত বাঙ্গালী সায়েন্টিস্ট সতীশ দত্ত যিঁনি দীর্ঘদিন ধরে মঙ্গলে প্রাণ আছে কিনা তাই নিয়ে গবেষণা করেছিলেন ! আপনিই প্রথম বলেছিলেন যে মঙ্গল বাসযোগ্য | আপনিই বলেছিলেন যে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের আবিষ্কার আপনি করে দেখাবেন,তার কিছুদিনের মধ্যেই আপনাকে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কিছু মিথ্যা চুরির দোষারোপে আপনাকে সবাই বয়কট করল | আপনার জীবনী আমি পড়েছি | আমি এও পড়েছি আপনি অসাধারন গান করেন ,সংগীতের প্রতি আপনার অগাধ ভালোবাসা আছে | তারপর হঠাৎ করেই আপনি গায়েব হয়ে গেলেন পৃথিবী থেকে | সবাই ভাবল আপনি লজ্জায় হয়ত আত্মহত্যা করেছেন" |

রবার্ট ম্যাসকট সামান্য হাসলেন | এই হাসি যেন সারা পৃথিবীর প্রতি অবজ্ঞার প্রকাশ | আমার মনে হতে লাগল আমার খুব আপন কাউকে কাছে পেয়েছি | তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন আশীর্বাদের ভঙ্গীতে | বললেন , " আমি জানতাম পৃথিবীর মানুষ একদিন মঙ্গলে পদার্পণ করবে " | আমি বললাম ," কিন্তু তারা পদার্পণ করেছে ঠিকই কিন্তু না জেনে | কিন্তু আপনি এলেন কিভাবে ?" তিনি বললেন ," সে গল্প হবে পরে কোনও একদিন | তারপর তিনি গিটারটা হাতে নিয়ে গান ধরালেন .... সেই গানে আমার সারা শরীর স্বস্তিতে অবশ হয়ে পড়ল | আমি তাঁর পায়ের কাছেই বসে রইলাম | রাত্রের আকাশের নীচে রবার্ট ম্যাসকট কে দেখাচ্ছে ঋষির মত ! আমি অভিভূত হয়ে যেন তাঁকে দেখছি | আমি গোটা একটা বছরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ,আজ তাঁর পায়ের তলায় শান্তির স্নেহে যেন প্রান ফিরে পেলাম | আমি আর কোথাও যাব না | এই পায়ের তলায় আশ্রয় করেই আমি তৈরি করব নিজেকে আবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার , সাথে থাকবেন রবার্ট | তিনি কি রাজী হবেন ? আমাকে রাজী করাতে হবে | রাস্তা খুঁজতে হবে | তাঁকে তাঁর প্রাপ্য স্থান ফিরিয়ে দিতে হবে | আর সেই সাথে তাঁর সুর মূর্ছনায় ফিরিয়ে আনতে হবে পৃথিবীর শান্ত ,সৌম্য চেহারা | এখন আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে....


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract