Aziza Nasrin

Drama Tragedy

3  

Aziza Nasrin

Drama Tragedy

যশোদা

যশোদা

3 mins
273



পরনে সাদা শাড়ী | শাড়ীটা গোড়ালির উপরে কিছুটা ওঠা থাকত | শাড়ীর আঁচলটা কাঁধ বেয়ে উপরে উঠে পিঠের পিছন দিয়ে ফিরে এসে আবার কোমরে এসে গুঁজত| ধূলোমাখা খালি পা | গায়ের রঙ কালোই বলা চলে | অযত্ন আর অবহেলায় গায়ের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় ফাটল ধরেছে | বয়সও নেহাত কম নয় | নয় নয় করে ষাট বছর তো হবেই | মাথায় একটা মাঝারি সাইজের ঝুড়ি,আর তাতে থাকত নদীর জ্যান্ত মাছ | আমার কাছে ওই ঝুড়ি ছিল এক বিস্ময়কর যাদুমন্ত্রের গোলা | তখন আমি চার-পাঁচ হব | আমরা তখন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম , যশোদা তার ওই জাদুমন্ত্রের ঝুড়িতে মাছ নিয়ে উঠত আমাদের বাড়িতে | আমাদের বিশাল বড় রোয়াকে তার মাছের বাজার বসিয়ে দিত | আশেপাশের বাড়ি থেকে ,বলা যায় পাড়ার সবাই মাছ কেনার জন্য প্রতিদিন সকালে এসে জুটত আমাদের বাড়ি | এপাড়াতে আমাদের বাড়ি থেকে বিক্রি করে চলে যেত অন্যপাড়ায় | আমার ঠাকুমার সাথে তাঁর ছিল খুব ভাব |


আর আমার সাথেও কিছু কম ছিল না |আর আমি তাকে ডাকতাম "যশো " | যশো প্রতিদিন আমাদের বাড়ি আসত আর আমি তাকে বলতাম " যশো আমি তোমাকে একটা নতুন ঝুড়ি কিনে দেব |" যশো এটা শুনে খুব খুশি হত আর তার ডান হাতের আঙ্গুল আমার ছোট্ট ঠোঁটে স্পর্শকরে তা নিজের ঠোঁটে ছুঁয়ে চুমু খেত | তার এই অদ্ভুত চুমু খাওয়ার কায়দা আমাকে খুব মজা দিত | বলত " বেঁচে থাকো দিদিভাই, ভালো বর পাও,অনেক বড় ঘর পাও,বড় হয়ে আমাকে একটা নতুন ঝুড়ি দিও |


 দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে | আমি তখন ১০ | দেশের দারিদ্র‍্যতা চরমে পৌঁছেছে| মানুষ খেতে পায় না| গ্রামে গ্রামে মানুষ মরছে খিদের যন্ত্রণায় | রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি শুনেছি গ্রামে বিদ্যুৎ এনে দেওয়ার ,যেখানে একমুঠো খাবার পাওয়া যায় না | মানুষকে আটা রান্না করে খেতে দেখেছি মাসের পর মাস | নদীর জল শুকিয়ে মাছ মরেছে | ফসল শুকিয়ে মাঠ জ্বলেছে | যশো বহুদিন পরে আবার তার বুড়ো অসুস্থ শরীরে ঝুড়ির বোঝা টা নিয়ে হাজির হয় আমাদের বাড়ি | মাছ বিক্রি করে চলে যায় | ঠাকুমা লুকিয়ে তাকে কিছু চাল ডাল আর কয়েকটি টাকা হাতে দেয় |


খাবার সময় আমার জ্যাঠামশাই আবিষ্কার করেন যশো আমাদের পচা মাছ দিয়ে ঠকিয়েছে | তিনি টাকা দিয়ে কেন পচা মাছ কিনবেন ? বাড়ি মাথায় করে তুললেন | তার মুখ থেকে যে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনেছিলাম তার বর্ণনা নাহয় আর নাই বা করলাম | যে মানুষটা এতদিন ভালো মাছ দিল তার কাছে একদিনের পচা মাছ তার আগের সব ভালোত্ব নষ্ট করে দিল এক নিমেষে | আমি অবাক হই মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কি করে | জ্যাঠামশাই এর কড়া হুকুম যশোকে যেন বাড়িতে না ঢুকতে দেওয়া হয় | কিন্তু সবাইকে অবাক করে যশোকে আর পরের দিন থেকে দেখা গেল না | বেশ কয়েকমাস পর একদিন সকালে , ঝুড়ি নিয়ে যশো হাজির | আমরা সবাই হুমড়ে পড়লাম তার ঝুড়িতে জ্যাঠামশাইয়ের হুকুম ভুলে | সেদিন যশো এক এত্ত বড় রুই মাছ এনেছিল আমার জন্য | মাকে দিয়ে বলেছিল " দিদিভাই কে দিলাম ,ভালো করে রান্না কোরো বউমা |"হঠাৎ এমনসময় কোথা থেকে জ্যাঠামশাই এসে উদয় হলেন |


তারপর সেদিনের সেই পচা মাছের জন্য পাড়ার সবার সামনে তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করলেন , যশো একটি কথা না বলে বেরিয়ে গেছিল বাড়ি থেকে | জ্যাঠামশাইকে ঠাকুমা পর্যন্ত ভয় পেতেন | তার অমানবিক ব্যবহারে আমরা কেউ সেদিন প্রতিবাদ করতে পারিনি |তবে ঠাকুমা রাগ করে দুদিন ভাত খাননি, আর আমি যশোর সেই করুণ মুখ মনে করে মাছের এক টুকরোও মুখে তুলতে পারিনি | তবে জ্যাঠামশাই খুব তরিবৎ করে খেয়েছিলেন |(


আমি বহুবছর সেই গ্রামের বাড়ি যাই নি | ঠাকুমা বা যশো কেউ আজ বেঁচে নেই | অনেক বড় হয়েছি | চাকরি পেয়েছি, স্বাবলম্বী হয়েছি | মনের মত ঘর পেয়েছি ,ভালো বর পেয়েছি | কপাল গুনে শ্বশুর শাশুড়ী পেয়েছি | তবে আজও যখন বাজার থেকে আমার বর রুই মাছ এনে বলে "ভালো করে রেঁধো তো , আজ কবজি ডুবিয়ে খাবো" , তখন আমার চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama