বিলাপ
বিলাপ


জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনো বছর রথ দেখতে যাইনি এমনটা হয়নি। দাদুর সাথেই বেশি যেতাম, কখনও বা অন্য কারুর সাথে। বাবার অফিস থাকতো তাই বাবার সঙ্গে কোনোদিনও যাওয়া হয়নি।
সে বছর ক্লাস টু তে পড়ি হয়তো, ঠিক মনে নেই। দাদু সে'বার দেশের বাড়িতে আছেন। ফলে রথের দিন রথ দেখতে যাওয়া হলনা। কোনো ব্যাপার নয়, রথ তো দু দুটো দিন আসে। আজ না গেলে কি হবে, উল্টো রথ তো আছে। উল্টো রথের দিন সকাল থেকে বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া, আমার মনেও পুলক। ছোটো ছিলাম বলে দুপুরে সবার আগে ভাত খেয়ে ঘুমোতে যেতাম আমি। সেদিন দুপুরে ভাত খেতে খেতে কেমন যেন সন্দেহ লাগল। কই মা তো বলছেনা, "বিকেলে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠবি"! মনে আশঙ্কা নিয়ে ঘুমোতে গেলাম। মা না বললেও কি হবে সাড়ে তিনটার দিকে নিজেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম, দেখলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাশে ঘুমন্ত মাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঘুম থেকে তুললাম, "মা বৃষ্টি পড়ছে, রথ দেখতে যাবো কি করে?"
মা তো আকাশ থেকে পড়লেন, "তোকে কে রথ দেখতে নিয়ে যাবে আজ? তোর বাবার তো এই আজই জ্বর কেটেছে আর আমি এই বৃষ্টিতে কি করে নিয়ে যাবো!" (তখন আমাদের এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনের মত ছিল না, তাই মায়ের সঙ্গে কোথাও যেতে হলে পায়ে হাঁটা ব রিক্সা ছাড়া গতি নেই)।
বাইরে তো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, আমার চোখে নামল অঝোর শ্রাবণ। তাকে থামাতে পারলেন না মা বা বাবা। অগত্যা বাবা বললেন, "ঠিক আছে, নিয়ে যাবো আমি।"
পুলকে একটা রঙচঙে জামা পরে ফেললাম, একবারের জন্যও ওই মানুষটার মুখের দিকে তাকালাম না যার সেদিন সেই সব জ্বর ছেড়েছে, তাকালাম না ওই আকাশটার দিকে যার মুখটা তখন আরও কালো হচ্ছে।
বাবার সাথে পুলকে জগন্নাথ মন্দিরে গেলাম, রথ দেখলাম। মেলায় একটা গোলাপি লোম ওয়ালা খেলনা কুকুর কিনলাম। তারপর বাবার গাড়িতে বেশ আরাম করে চড়ে বসলাম। কিছুদূর গাড়িটা যাওয়ার পরেই টপটপ করে বড় বড় জলের ফোঁটা গুলো গায়ে পড়তে শুরু করল। বাবা কোনোক্রমে একটা বন্ধ দোকানের শেডে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেন কোট বের করে পরালেন আগে, পরানোর আগে পকেট থেকে রুমাল বের করে মোছালেন আমার মাথা, গা। আমাকে রেন কোট পরাতে পরাতে নিজের গা মাথা যে ভিজে উঠল ভ্রূক্ষেপেই করলেন না সেদিকে। আমাকে সব পরিয়ে দিয়ে এবার নিজের গা মাথা মুছে রেনকোট পরলেন, তারপর বাড়ি এলাম।
গোলাপি কুকুরটা এই কয়েক বছর আগে অবধিও সঙ্গী ছিল আমার। রথ এলেই ওই দিনটার কথা আজও মনে পড়ে। দাদু চলে গেলেন গত ডিসেম্বরে, তাও নিয়ম মেনে রথ এলো এবছরও। বাবা এখন আর অফিস যায়না, রিটায়ার করেছে বছর দুয়েক, চুলে পাক ধরেছে, শরীরে বাসা বেঁধেছে জটিল অসুখ। আমি তবুও আগের মতোই আছি... স্বার্থপর। নাহ ওই বছরের পর থেকে রথ দেখার জন্য বায়না করিনি আর কোনো বছর, গোলাপী কুকুর কেনার শখও আর হয়নি কখনও। এখন শখগুলোর চরিত্র পাল্টেছে, এখনও সেগুলো মেটানোর জন্য ওই লোকটার কাছে অবলীলায় হাত পাতি। পেনশনের টাকা দিয়ে আমার প্রয়োজন থেকে শখ সবই মিটিয়ে যায় চুপচাপ। আর আমি দেশের লক্ষ লক্ষ তথাকথিত শিক্ষিত বেকারের স্রোতে বিন্দুর মত মিশে ভেসে চলেছি... ক্লাসে যাচ্ছি, গিলছি লেকচার, বাড়ি ফিরছি খাচ্ছিদাচ্ছি ঘুমোচ্ছি, ফোন নিয়ে খুটখুট করছি আর ভেসে চলছি...