দর্পণ
দর্পণ
মেয়ের ডায়েরির একটা পাতা :আজকের দিনটা আমি কোনদিনই ভুলব না| জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা "মাধ্যমিক পরীক্ষা", সেখানে আমি ব্যর্থ, কয়েকটা নাম্বারের জন্য স্টার মার্কস আমার আসেনি| সেই ছোটবেলা থেকেই আমি বুঝেছিলাম আমাকে নিয়ে বাবা মায়ের অনেক স্বপ্ন, আর আমারও পড়াশোনা করে অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছা টা সেই ছোট থেকেই অনুভব করেছি | নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, অভাব জিনিস টা খুব কাছে থেকে দেখেছি কিন্তু বাবা মা কখনও অভাবকে আমায় ছুঁতে দেয়নি | আমিও প্রাণপণে চেষ্টা করছি বাবা মাকে খুশি রাখতে | একমাত্র মেয়ে আমি আমার কাছেই তো তাঁদের সব আশা ভরসা, ইচ্ছা ছিল স্টার নিয়ে পাস করব, হল না | অনেক বড় হব, না আমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা নাই, আমি একজন ভালো "স্কুল টিচার" হব | স্বপ্নের সিঁড়িতে ওঠার আগেই একটা সিঁড়ি তো ভেঙ্গেই গেল, সেই সকাল থেকে নিজের স্বপ্নপূরনের ব্যর্থতার যন্ত্রণার সাথে বাবা মায়ের কষ্টাও বুকে খুব করে বাজছে | রাতের পর রাত জেগেছি সাথে মাও জেগেছে, বাবা সাথে করে বাড়ি থেকে রোজ ৪ কিমি দূরের টিউশন গুলোতে হাসিমুখে ঝড় -রোদ-জলের দিনগুলোকে অবলীলায় উপেক্ষা করে আনতে গেছে নিয়ে এসেছে | মাঝে মাঝে তাঁর পরিশ্রান্ত ঘেমো মুখের ওই হাসি আমার বুকের পাঁজর এ ছূঁচ ফুটিয়ে চোখে জল এনেছে | স্কুল ফেরত আমার অপেক্ষারত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের মুখ, খুব মনে পড়ছে আমার | সবাই ভেবেছিল আমি স্টার পাব, পেলাম না, কিছুজন এতে আনন্দিত অবশ্য.... একজন টিচারের মেয়ে টিচার হতে পারে অনায়াসে কিন্তু একজন কৃষকের মেয়েকে অত সহজে কেউ বোধহয় মানতে পারে না | বাবা তুমি আমাকে ক্ষমা করো, মা আমাকে ক্ষমা করো | বাবা তো আমার নতুন সাইকেল এর টাকা টাও গুছিয়ে রেখেছিল, খব ইচ্ছা করত সবার মত নিজের সাইকেলে যাই, আমার বাবার কষ্টাও কমে যাবে, সে ইচ্ছাটাও পূরণ হল না, বাবার কাছে চাইব কোন মুখে?_______________________________বাবার মনের কোণের এক পাতা :তুই যখন রেজাল্টের পর মুখটা ভার করেছিলি, মনে হচ্ছিল আমার হৃৎপিন্ডটা কেউ শক্ত করে চেপে ধরেছে | আমার খুব ভয় করেছিল, তুই হয়ত খুব কাঁদবি, তখন নিজেকে আর হয়ত তোর সামনে শক্ত করে ধরে রাখতে পারব না | তুই যদি দেখতিস আমিও খুব ভেঙ্গে পড়েছি তাহলে তোর সামনে এগিয়ে যাওয়া যে খুব কঠিন হবে | অনেক ছোট্ট বেলায় যখন তুই সবার সামনে গড়গড়িয়ে ছড়া বলে অনেক হাততালি পেতিস তখন আমার বুকটা গর্বে ফুলে উঠত | জানিস একবার তুই একবার দোকানে একটা বড় পুতুলের জন্য খুব জেদ করেছিলি, তখন তুই তিন, দাম ছিল আটশো, এনে দিতে পারিনি বদলে তিরিশ টাকা দিয়ে একটা মাটির পুতুল এনে দিয়েছিলাম |তুই কেমন বোকা, না বুঝে সেটা নিয়েই খিল খিল করে হেসেছিলি আর সেই হাসিই আমার বুকে বেশি করে বেজেছিল | রাতের বেলা তুই যখন জোরে জোরে পড়িস আমি কান পেতে শুনি, সেটা কোন ধর্মগ্রন্থ পাঠের থেকে কম কিছু মনে হয় না আমার | আমাদের সবার যে আশাটা ছিল সেটা না হয় পূরণ নাই বা হল, তুই তো চেষ্টা করেছিলি নিজের মতন | এই একটু আগে সাইকেলের দোকানে গিয়েছিলাম, ভাবলাম আজকেই এনে দেব, কিন্তু তোর পছন্দের সেই বেগুনি রঙের সাইকেলটা ছিল না, তাই অর্ডার করে এলাম | তার আগে অবশ্য আমি কিচ্ছুটি বলব না তোকে, একেবারেই সামনে নিয়ে আসব | আগামী দিনগুলোতে আমরা আবার একসাথে অনেক পরিশ্রম করব, অনেক কষ্ট করব তোর জন্য আর তুইও অনেক পরিশ্রম করবি নিজের স্বপ্ন, আমাদের স্বপ্নপূরনের জন্য |