Aziza Nasrin

Drama Romance Classics

3  

Aziza Nasrin

Drama Romance Classics

কেক

কেক

7 mins
547



নীলিমা আজ খুব সকালে উঠে পড়ল | যদিও এমনিতেই সকালে ওঠে সে | বয়সটা বেড়েছে | সাথে সাথে বাতের ব্যথাটাও | কাল ব্যথাটা অসম্ভব বেড়েছিল | সকালে উঠে এখন বেশ ভালো লাগছে | ঘড়িতে পাঁচটা বাজে, গরমের দিনে ভালোই সকাল | রোজ সাড়ে পাঁচটায় ওঠার অভ্যেস নীলিমার | উঠেই পাশের মানুষটার দিকে তাকাল সে| ঘুমিয়ে আছে, অসম্ভব শান্ত মুখখানা| বয়সের ভারে মুখের চামড়া গুলো ঢিলে হয়েছে এই যা, সারল্য আছে কিন্তু সেই বছর ত্রিশের | কতকিছু বদলে গেল ,মানুষটা পঁচাত্তরে এসে পৌঁছাল কিন্তু নীলিমার প্রতি, তাঁর যে ছেলেমানুষিি নির্ভরতা,তা আজও বদলায়নি | মাথা ভর্তি সাদা চুল , ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে, নীলিমা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে | ভালো লাগছে ! মানুষটা ওপাশ ফিরল | ঠিক সাড়ে ছ টায় উঠবে | ঘড়ি ধরে ওঠার অভ্যেস আজ পঁয়তাল্লিশটা বছর ধরে দেখে আসছে নীলিমা | বিছানা ছেড়ে উঠে এলো জানালার পাশে | আজ তেমন ঘুম হয়নি ভালো | সারারাত উসখুস করেছে সে | ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখল, আগের মত আর সে গোছাতে পারে না ঘর দোর | আসলে গুছিয়ে রাখতে পারে না | বয়সের ভারে কি মানুষ অগোছালো হয়ে যায় ? নিজের পরনের কাপড়খানা ভালো করে গুছিয়ে নিল | ঘরের এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলো, কাপড়গুলো গোছাতে লাগল মনের মত করে | টেবিলের উপরটায় দুজনের প্রথম জীবনের দুটো ফ্রেম আছে , মোড়ানো | একটা ফ্রেম দীঘার |তাও আবার জোর করে দুজনকে দাঁড় করিয়ে তুলে দিয়েছিল দেওর ,সোমনাথ | সেই প্রথম দুজনের একসাথে বাইরে বেরনো ,যদিও শ্বশুরবাড়ির সবাই মিলে ঘুরতে গিয়েছিল দীঘায়| তখন চল্লিশ বছর আগে , অতি সাধারন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে সদ্য বিবাহিত দুজন নারী- পুরুষের বেড়াতে যাওয়া বেমানান না হলেও , খুব একটা মানানের ছিল না | ছবিটা যতবার নীলিমা দেখে সেই পুরানো দিনের , নতুন জীবনের গন্ধটা যেন ততবার ফিরে ফিরে আসে | আরেকটা ছবি যেটাতে অর্ণব আছে , একমাত্র ছেলে | ও তখন বসতে শেখা ছেলে , স্বামীর চাকরি হল দিনাজপুরের এই বালুরঘাট শহরে ,তার আগে ফ্যামিলির ব্যবসায় বসতেন অমিতাভ | সেই প্রথম একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে এসে একটা ছোট্ট সংসার পেতেছিলেন এখানে নতুন করে | শ্বশুর গত হয়েছেন ততদিনে | শাশুড়ি নীলিমাকে মেয়ের মত করে আপন করে নিয়েছিলেন | নীলিমা জোর করে তাঁকে নিজের কাছে বালুরঘাটে এনেছিল | চারজনের সংসার সেই শুরু | এইসব কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যেন ছ টা বেজে গেছে | ঘরটাও বেশ গোছানো হল | মলি ,কাজের মেয়ে টা আসে সাত টায় | তখন ঘর ঝাঁট দেবে সে | তার আগেই নীলিমা ভাবল নিজেই একবার ঝাঁড়ু দিয়ে দেবে | বাইরে বেরিয়ে আসতেই ঘুম ঘুম চোখে তাতান ছুটে এলো | এটাই ওর আসার সময় | ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরল | নীলিমা ওকে কোলে নিয়ে ডাইনিং রুমের সোফায় বসলেন | তাতান এখন আদর খাবে ঠাম্মার কোলে বসে | ও ক্লাশ ওয়ানে পড়ে | স্কুলবাস আসে ঠিক সাড়ে সাত টায় | আদর খাওয়া হলে , বৌমা এসে তাতানকে রেডি করে দেবে স্কুলের জন্য | তাতান চোখ বুজে আছে, মুখখানা যেন একদম অমিতাভর থেকে ধার করা| মাথার চুলে হাত বুলিয়ে নীলিমা ফিসফিস করে বললেন ," আজ কেক খাবি দাদু?" দ্রুত চোখ খুলে ,মুখে মিস্টি হাসি দিয়ে তাতান বলল, " খাব , দাও" | নীলিমা বললেন , " এখন তো নাই, স্কুল থেকে এসে খাবি " | তাতান হতাশ হয়ে বলল," তখন কে কিনে আনবে? দাদু? " নীলিমা চোখ টিপে বললে , " না, আমি বানাব, এখন কাউকে বলবি না ,বল |" - "আচ্ছা" বলে তাতান আবার চোখ বুঁজল |


বৌমা নিজের ঘরে রেডি হচ্ছে | ওর স্কুল আছে | অর্ণব চলে গেছে অফিসে | সেও আসবে সন্ধ্যায় | তাতানের স্কুল মর্নিং এ | সে আসবে বারো টায় |অমিতাভ একটু বেরিয়েছেন পাড়ার মোড়ের দিকে | নীলিমা বার বার বৌমার ঘরে উঁকি দিচ্ছে | বলবে কি কথাটা? বলাই ভালো | নাহলে খারাপ দেখাবে | এক পা ,দু পা করে ঘরে ঢুকেই পড়ল নীলিমা | বৌমা চুল ঠিক করছে | বলল, " কিছু বলবেন মা?" নীলিমা ইতস্তত করছিল | আড়ষ্ঠতা কাটতে একটু সময় লাগল | বলল, " বৌমা ,তাতান আজ কেক খেতে চাইছিল | আমার হাতের | তাই..." বলেই কেমন লজ্জ্বা লাগল | বৌমা বহুদিন হল নীলিমাকে রান্নাঘরের কোন কাজ করতে দেয় না একদমই | আজ নিজের ইচ্ছাটা তাতানের নাম দিয়ে বলে যেন নিজেই লজ্জ্বা পেল নীলিমা | বৌমা কিন্তু তেমন কিছু ভাবল না , সহজ ভাবেই বলল, " তাতানের কথার কি কোন ঠিক আছে মা, স্কুল থেকে এসে দেখবেন কেকের কথা ভুলেই গেছে | আপনার এখন শরীর ভালো নাই, কাল তো খুব যন্ত্রণা পেয়েছেন| আজ বরং রেস্ট করুন |" নীলিমা বলল ," না না বৌমা , দাদু খেতে চাইল, না দিলে আমার খারাপ লাগবে |" বৌমা একটু থেমে বলল, " আচ্ছা বেশ, আমি না হয় ফেরার পথে একটা কেক নিয়েই আসব| আপনাকে কষ্ট করে এখন করতে হবে না |একদিন না হয় ছুটির দিনে আমি আর আপনি দুজন মিলে বানিয়ে দেব ওকে |" নীলিমার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল |কিছুটা ব্যাজার মুখেই বলল, " বসেই তো থাকি, ভালো লাগে না মা, কিচ্ছু | আজ না হয় একটা কেকই বানাতাম |"বৌমা একটু অবাক হল এবার | সামান্য একটা কেকের জন্য শ্বাশুড়িমা এতটা হতাশ হবেন তা সে ভাবতে পারেনি | বৌমা এবার একটু কাছে এসে, হেসে বলল," আচ্ছা মা, আপনি বানান আপনার নাতির জন্য | আমি মলিকে বলে দিয়ে যাচ্ছি যা যা লাগবে যেন জোগাড় করে দেয় |" নীলিমার মুখ ঝলমল করে উঠল মুহুর্তমধ্যে, বলল, " তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুমি যাও মা| আমি সব জোগাড় করে নেব | আমি ইউটিউব দেখে নিয়েছি |" বৌমা আর কিছু না বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল |

তাতান দুপুরবেলা স্কুল থেকে ফিরে স্নান ,খাওয়ার পর ঘুমিয়ে গেছে | স্বভাব অনুযায়ী সত্যিই কেকের কথা সে ভুলেও গেছে |এই ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরবেলা নীলিমা নিজেও ঘুমায় ,কিন্তু আজ তার অনেক কাজ | আমিতাভ বিছানায় বসে আজকের নিউজ পেপারটা পড়ছেন | ঘুম নাই মলির চোখে | গোটা দুপুর সে টি ভি দেখে কাটায় | নীলিমা রান্নাঘরে ব্যস্ত খুব , মলি সমস্ত জিনিসপত্র হাতের কাছে সাজিয়ে দিয়ে গেছে , সাথে আজ থাকতেও চেয়েছিল , নীলিমা থাকতে দেননি | বললেন ," তুই টি ভি দ্যাখ ,যা , দরকার পড়লে ডাকব |বহুদিনের অনভ্যাসে হাতের কাজ টা ভালো সরছিল না নীলিমার | কেকটা জমানো হয়ে গেছে, সাজানো টা বাকি আছে এখনও | ক্রীম লাগানো পর্ব টা কিভাবে সারবে তা সে ভাবতে লাগল | মলি চলে এলো ," জেঠিমা , তোমাকে জেঠামশাই ডাকছেন" | নীলিমা বলল, " বল আমি আরেকটু পর আসছি " | মলি দ্রুত চলে গেল ,তার মন আটকে আছে টি ভি তেই | নীলিমা কাজে মন দিল | অনেকক্ষণ বহু যত্ন করে কাজটা সম্পূর্ণ করল,কিন্তু তার মন মত হল না কেকটা | যতটা ভালো ইউটিউবে সে দেখেছিল ততটা ভালো হল না | কাজের সময় হাত টা যেন বার বার কেঁপে যাচ্ছিল |

নীলিমা ঘরে ঢুকতেই অমিতাভ বিছানায় উঠে বসলেন, বললেন, " তোমার তো দেখা পাওয়ায় ভার দেখছি , একটু তো এসে দুপুরবেলা বসে থাকতে পারো আজ আমার কাছে, আর দাদুভাই কি ঘুমালো? "নীলিমা মলিকে বলতে বারণ করেছিল অমিতাভকে সে যেন না বলে যে নীলিমা রান্নাঘরে আছে,কেক বানাচ্ছে |তাই মলি অমিতাভকে বলেছিল তাতানের কাছে আছে নীলিমা | কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীলিমা বলল, " বলো আগে আমায় বকবে না?" ভুরু কুঁচকে অমিতাভ বললেন "কেন? হঠাৎ তোমাকে বকতেই বা যাব কেন?" এতক্ষণ নীলিমার দুইহাত পিছনের দিকে লুকানো ছিল, লক্ষ্যই করেননি অমিতাভ কথায় কথায় | নীলিমা হাত দুখানি সামনে আনতেই দেখা গেল, একটা মাঝারি মাপের প্লেট , তার থেকেও ছোট্ট একটা কেক, চকলেট কেক ! খুব অগোছালো হাতে অথচ পরম মমতায় কেকটা বানানো হয়েছে,তা তাকালেই বোঝা যায় | অমিতাভ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন ! নীলিমা দরজা টা ভিতর থেকে আটকে দিল | কাছে এসে বলল, " নাও , তাড়াতাড়ি কেকটা কেটে ফেল দেখি, যাতে কেউ না দেখতে পায় " | অমিতাভ কি বলবেন বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন !নীলিমা তাড়া দিয়ে বলল, " কই কাটো, হাঁ করে তাকিয়ে থেক না |" আমিতাভ বললেন মুখে হাসি এনে বললেন, " আজকের দিনটা তোমার মনে আছে"?নীলিমা শুধু ছোট্ট করে বলল, " হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু"| বাচ্চা ছেলের মত অমিতাভ বললেন , " থ্যাংক্যু ! ইসস কত্ত সুন্দর কেক বানিয়েছ বলত! দেখেই লোভ হচ্ছে যে "|নীলিমা কপটতার চোখ রাঙিয়ে বলল, " না ,একদম নয়, খুব অল্প খাবে, আর ক্রীমটা বাদ দিয়ে খাবে" | - সে কি! কেন? - পেট খারাপ হবে তো| বয়সটার কথাও তো ভাবতে হবে | ক্রীম না লাগালে বার্থ ডে কেক মানায় না যে !- আচ্ছা বেশ| - চলো এবার কেটে ফেলো | 

ভীষণ আনন্দ হচ্ছে নীলিমার | অমিতাভ যে খুব খুশি হয়েছে তা তার চোখ মুখে ফুটে ওঠেছে | এই খুশিতে ঝলমল মুখটা দেখার মত সুখ নীলিমা কাউকে বোঝাতে পারবে না | ছেলে বৌমার কাছে নিজের এই গোপন সাধটা আজ বাষট্টি বছরের কোটায় এসে বলতে ভীষণ লজ্জ্বা করছিল নীলিমার | কেকটা বানাতে এত বাহানা দিতে হয়েছে নীলিমা কে, তা ভাবলেই হাসি পাচ্ছে তার নিজেরই | এই যে সবার আড়ালে ভালোবাসার প্রকাশ ,এটার মূল্য পৃথিবীর আর কোনকিছুর বিনিময়েই সম্ভব নয় ,তা নীলিমা জানে,ভালো করেই জানে | চোখে সামান্য জলও আসছে | অমিতাভ কেক কাটতে শুরু করল !

গরমের দুপুরবেলা চারপাশের সব কিছু যখন বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত,সেই সময় দুজন মানুষ সবার অলক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে সেলিব্রেশনে মেতে উঠল | একটা হালকা বাতাসে আশে পাশের গাছপালা নড়ে উঠল এমন ভাবে , যেন পাতা গুলো চারিদিকে করতালি দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে | দুজন মানুষের মধ্যে তারাও যেন সঙ্গী হয়ে উঠতে চাইছে ,তাদের আনন্দটুকুকে আরও একটু প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে |


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama