মা
মা
সেই বিকাল থেকে অতসীর সাথে একটা কথাও বলেনি সুমন্ত। জঙ্গল থেকে ফিরেই বোতল-গ্লাস সাজিয়ে বসে গেছে বনবাংলোর বারান্দায়। ধরমবীর এসে পকোড়া দিয়ে গেছে। অতসীও যেচে কথা বলতে যায়নি। কাল সকালেই ওদের ফিরে যাওয়া। জিনিসপত্র মোটামুটি সব গোছগাছ করে নেয়। হাঁটুটা আজকাল বড্ড জ্বালাতন করে অতসীর। এইজন্যই এখন বেড়ানো ঘোরা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে চায় অতসী। কিন্তু সুমন্ত সে কথা শুনলে তো! এতটা বয়স হয়ে গেল, এখনও ঘোরার নেশা তার কমল না। সবাই বলে,
-তোদের তো কোন পিছুটান নেই, দুটিতে ঝাড়া হাতপা মানুষ, বেরিয়ে পড়লেই হলো।
দুটি মানুষে থাকার সুখটাই দেখেছে সবাই, যন্ত্রণাটা একা অতসীর। সুমন্তও কখনও অতসীর যন্ত্রণাটা আন্তরিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করেনি।
হটজেল ব্যাগটা গরম করে নিয়ে গিয়ে ব্যালকনিতে বসে অতসী। হাঁটুটাতে একটু সেঁক নিলে আরাম হবে।
হলং বাংলোর ব্যালকনি থেকে জঙ্গলটার অনেকখানি পরিষ্কার দেখা যায়। বাংলোর চারপাশ গাছ দিয়ে ঘেরা। অদূরেই হলং নদী। ঐ নদীর ওপারে খোলা জায়গায় সল্টলিকে নুন খেতে আসে বনের পশুরা। সচরাচর গভীর রাতেই আসে তারা। এই বনবাংলোর ব্যালকনি থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। গত দুদিনে একটা পশুরও দেখা মেলেনি। আজকেও দেখা মিলবে কিনা কে জানে! আজ পূর্ণিমা নয় তবে কাছাকাছিই হবে হয়তো। বেশ ঝলমলে চাঁদের আলোতে স্পষ্ট বনভূমি।
সুমন্তই নিজের চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে আসে অতসীর কাছে।
-হাঁটুতে ব্যথা করছে?
কোন উত্তর দেয়না অতসী। সুমন্ত আবার বলে,
-রাগ এখনও কমেনি! তুমি জানো ঐ তীরে ওরা বিষ মিশিয়ে র
াখে। ওটা যদি তোমার গায়ে লাগতো কি হতো বলো তো!
আশেপাশের আদিবাসীরা বনদপ্তরের নজর এড়িয়ে মাঝেমধ্যেই তীরধনুক নিয়ে পশুপাখি শিকার করতে ঢুকে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে। আজ একটা বাচ্চা হাতিকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়তে যাচ্ছিল এক শিকারী। অতসী সেটা লক্ষ্য করে ছুটে গিয়ে বাধা দেয় তাকে। তীর যদি কোন কারণে ধনুকের ছিলা থেকে বেরিয়ে যেত, সেটা অতসীই লাগত।
ঘটনার হটকারিতায় একটু বেশিই রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছিল সুমন্ত। পুরোটাই যে অতসীর কথা ভেবে সেটা কি অতসী বোঝে নি!
আরও কিছুটা কাছে সরে আসে সুমন্ত।
-কি হলো এখনও রাগ কমেনি!
-আমার কথাই ভাবলে! শিকারীটাকে না আটকালে হাতির অতটুকু বাচ্চাটা যে মরে যেত!
একটু উদাস ভাবেই জবাব দেয় অতসী।
অতসীর এহেন উত্তরে কি জবাব দেবে জানা নেই সুমন্তর।
ধরমবীর এসে ঘরেই ডিনার দিয়ে গেছে একটু আগে। খাচ্ছিল অতসী আর সুমন্ত। দরজায় নক করার শব্দ, বাইরে থেকে ধরমবীরের কণ্ঠস্বর।
-"জলদি আইয়ে সাহাব, উহাপে হাতি আয়ী হ্যায়"।
খাওয়া ফেলেই ব্যালকনিতে বেরিয়ে যায় অতসী আর সুমন্ত।
হলং নদীর ওপাড়ে ঐতো দুটো হাতি। বাচ্চা হাতিটাকে চিনতে পারে অতসী। মা হাতিটা শুঁড় তুলে ঘন ঘন ডাকছে।
অতসীর মনে হয়, সন্তানের জীবন রক্ষার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে মা হাতিটা।
কিছুক্ষণ পর, বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলে ফিরে যাচ্ছে মা হাতিটা।
জীবন সায়াহ্নে এসেও একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অতসীর বুক থেকে। নিজের সন্তানকে এভাবেই জড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল সে। এ জন্মে তার আর মা হওয়া হলো না!