Banabithi Patra

Drama

2  

Banabithi Patra

Drama

মিথ্যা সুখের জাল

মিথ্যা সুখের জাল

5 mins
2K


 সেদিন নিধিকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ-ই দেখা চন্দনার সাথে । নিবেদিতা আর চন্দনা স্কুলজীবনের হরিহর আত্মা বন্ধু । একটা দিন দেখা না হলে বুকের ভেতরটা যেন হাঁকুপাকু করতো । আর আজ বোধহয় দেখা হলো ষোল-সতের বছর পর । নিবেদিতার বিয়েতে এসেছিল চন্দনা , সেই বোধহয় শেষ দেখা । তারপরও কিছুদিন চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল দুই বন্ধুর । চন্দনা বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল, কার্ডের সাথে চিঠিও দিয়েছিল । বার বার করে যেতে বলেছিল । কিন্তু নিবেদিতার যাওয়া হয়নি । নিধি তখন মাত্র চার মাসের। অতো ছোট মেয়েকে নিয়ে বন্ধুর বিয়েতে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি শাশুড়ী মা । আজও মনে পড়ে চন্দনার বিয়ের দিন রাতে , শশাঙ্কের কাছে মনখারাপ করে কেঁদেছিল , ভেবেছিল কষ্টটা ও হয়তো বুঝবে! কিন্তু শশাঙ্কও বিরক্ত হয়ে বলেছিল,

"উফ্! একটা বিয়েবাড়ি যেতে পারোনি বলে এত রাতে ঘ্যানঘ্যান কোরো না তো। "

 

আজ কতবছর পর হঠাৎ-ই চন্দনার সাথে দেখা । মুহুর্তেই কত ঘটনা ভেসে এলো স্মৃতির জমানো খাতা থেকে । চন্দনা সেই তেমনি আছে, তেমনি হুল্লোড়ে । এতবছর পর বন্ধুকে দেখেই জড়িয়ে ধরেছে । এক শহরে দুই বন্ধু রয়েছে অথচ কেউ জানতো না! কতো জমানো কথ , মান-অভিমান, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি আর শেষ হয়? নিবেদিতা একদিন বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ করে চন্দনাকে। ওর বর আর ছেলেকেও সঙ্গে আনতে বললে চন্দনার উত্তর দেয়,

"কতদিন পর দু-বন্ধুতে একটু মনপ্রাণের গল্প করবো, ঐসব পিছুটান সঙ্গে নেব না। সেই ছোটবেলার মতো গল্প-আড্ডায় কাটাবো কটা ঘন্টা।" 

কাল সন্ধ্যেবেলা চন্দনা ফোন করেছিল। আজ ছেলেকে স্কুল পৌঁছে দিয়ে আসবে । দুপুরটা থেকে ছুটির সময় ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। উফ্! ছোটবেলার মতো আড্ডা আর গল্প ভাবতেই কেমন যেন আলগা খুশিতে ভিজে উঠছে মনটা । শশাঙ্ককে একটু সকাল সকাল উঠে বাজারটা করে আনতে বলেছিল,তাতে রান্নাটা একটু তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারত। কিন্তু সেই উঠতে দেরি, বাজারেও লেট। তাড়াহুড়ো করে ওদের বাবা-মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে বাকি রান্নাটুকুতে মন দেয় নিবেদিতা । তবু শশাঙ্ক আজ নিধিকে স্কুলে পৌঁছে দিল বলে অনেকটা সুবিধা হলো।

মাংসটা কষতে কষতে খেয়াল হয়, এ মা! চন্দনা যে মাংস খেত না সেই কথাটা পুরো ভুলে গিয়েছিল। ফ্রিজে কিছুটা কাটাপোনা মাছ আছে। সেটা বের করে আনে,একটু পোস্ত দিয়ে রান্না করবে না হয়! শশাঙ্ক তো ওর হাতের রুইপোস্ত খেতে ভীষণ ভালোবাসে। রান্নার মাঝেই ছুটে ছুটে গিয়ে যতটা পেরেছে গুছিয়ে নিয়েছে ঘরগুলো। বেডরুমের ময়লা পর্দাগুলোয় পাল্টে ফেলেছে। ফ্ল্যাটের ইএমআই টা এখনো শোধ হয়নি, তাই এখনো সেভাবে সাজিয়ে উঠতে পারেনি। তবু যতটা সম্ভব মলিনতাটুকু ঢাকার চেষ্টা করছে নিবেদিতা । নিজের সংসারের কোন মলিনতা ধরা দিতে চায় না বন্ধুর চোখে। মেয়ের পড়ার টেবিলটাও যতটা সম্ভব গুছিয়ে রাখে।


রান্না প্রায় শেষ, তখনি দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ। নিশ্চয়ই চন্দনা!

দুই বন্ধু মুখোমুখি, কত কথা! তবু যেন কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। শখ করে কেনা কাপ-প্লেট বের করেছে আজ। দুকাপ কফি আর সাথে কিছু স্ন্যাকস্ নিয়ে আসে নিবেদিতা। 

ইস! কাপটা তো খুব সুন্দর।

চন্দনার প্রশংসাতেই নিবেদিতা শুরু করে বরের গুণগান। আসলে শশাঙ্ক খুব শৌখিন মানুষ, সব ওরই পছন্দের। আমার আবার এইসবের অত ঝোঁক নেই।

ইস! তাও ভালো তো, আমার বরের ওসব দিকে কোন ঝোঁক-ই নেই। ট্রান্সফারের চাকরি, তাই সেভাবে ঘর সাজাতে চায়না ও! খালি বলবে নিজের পছন্দ মতো গয়না গড়াও। তুই বল,কত গয়না তৈরি করতে ভালো লাগে? আর যা দিনকাল! গয়না পরতেও তো ভয় হয়--- সবই ব্যাঙ্কের লকারে। তাও একটু গয়না না পরে থাকলে ও খুব রাগ করে। তাই এইটুকু সবসময় পরে থাকতে হয়। 


নিবেদিতা একঝলক দেখে নেয় চন্দনাকে । গলার হারটা বেশ ভারিই হবে। পুলিশের চাকরিতে ঘুষের পয়সাতেই তো লালে লাল। কেন দেবে না বৌকে অত গয়না? শশাঙ্কদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। ঐ পরিবেশে থাকলে মেয়ে মানুষ হবে না বলে ওখান থেকে বেড়িয়ে আসা। নিজের সব গয়না বিক্রি করে দিয়েও ফ্ল্যাটের অর্ধেক টাকা হয়নি। মাসে মাসে একগাদা টাকা ইএমআই গুনতে হচ্ছে এখনো। 

ইচ্ছা করেই কথা ঘোরায় নিবেদিতা। 

---তোর ছেলের কোন্ ক্লাস হলো?

---থ্রি....

---ও বাবা সবে মাত্র ক্লাস থ্রি। আর আমার নিধির ক্লাস নাইন । সামনের বার মাধ্যমিক, পড়াশুনোর কি চাপ তুই ভাবতে পারবি না !মেয়ের স্কুল-টিউশন সব আমাকে সামলাতে হয়। শশাঙ্ক তো স্কুল আর নিজের লেখালিখি নিয়েই ব্যস্ত। ওর লেখা মাঝেমধ্যে তো নানা জায়গায় বেড়োয় হয়তো দেখেও থাকবি।

---কি যে বলিস তুই, পড়াশুনো আর আমি? এখন ঐ বাবা-ছেলের আবদার আর দস্যিপনা সামলাতে সামলাতে নাজেহাল।

চোখের ইশারায় কৌতুকের লহরী তুলে হেসে গড়িয়ে পড়ে নিবেদিতার গায়ে!

শশাঙ্কের লেখা নিয়ে আর কথা বাড়ায় না নিবেদিতা । কঞ্চিৎ কখনো কোন লোকাল ম্যাগাজিনে ওর লেখা বেড়িয়েছে, এখন যদি চন্দনা দেখতে চায় মুশকিল।


চন্দনার ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, তার কত খরচ আর কত চাপ সেইসব কথা; পুলিশে চাকরিতে বর সময় দিতে পারেনা কিন্তু বছরে একবার বেড়াতে চায় সেই সব গল্প শুনতে হয় নিবেদিতাকে।

সেও কম যায়না ....শশাঙ্ক ওকে কতটা সময় দেয়, মেয়েকে নিয়ে ওর স্কুলের টিচাররা কত আশাবাদী সব শোনায় চন্দনাকে!

চন্দনা এখন মাংস খায়। মাংস আর রুইপোস্ত দুটোই খুব তৃপ্তি করে খেয়েছে। ওর বর ওকে আগুনের তাতে যেতে দেয়না। রাঁধুনির হাতে খেয়ে খেয়ে মুখে নাকি চরা পড়ে গিয়েছিল। দুবেলা রান্না করে করে ক্লান্ত নিবেদিতার একটু যেন হিংসা হয় বন্ধুকে। তবু চন্দনাকে আদুরে গলায় কপট অভিযোগ করতে ভোলে না,

---তুই কি লাকি রে! আমার কর্তাটির তো আবার আমার রান্না ছাড়া মুখেই রোচে না। বলবে, তুমি আর যাই করো লক্ষ্মীটি রান্না ছেড়ো না। আমি তাহলে না খেয়ে মরে যাবো।

আবার কৃত্রিম হাসিতে ভরে ওঠে ঘর ।

আর সময় হয়ে আসছে, ছেলের ছুটি হয়ে যাবে। একটু সময় এখনো আছে। খাওয়াটা একটু চাপাচাপি হয়ে গেছে, দুই বন্ধু শরীর এলিয়ে দেয় নিবেদিতার বেডরুমের বিছানায়। নিবেদিতার বারবার মনে হচ্ছে, সংসারের কোন দৈন্যতা, শশাঙ্কের একগুঁয়েমি বদরাগি স্বভাব কিছু ধরা পড়ে গেলনা তো চন্দনার কাছে??

নিবেদিতার কতো সুন্দর সাজানো সংসার, শৌখিন বর দেখে কেমন যেন মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে চন্দনার। এতো গয়না, ঐশ্বর্য তো ও চায়নি। এমন একটা সাজানো সংসার চেয়েছিল। নব্যেন্দুর প্রতিদিন ড্রিংক করে ফেরাটা তো আজও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি!


চন্দনা চলে গেছে। নিবেদিতাকে বার বার করে বলে গেছে ওর কোয়াটার্সে একদিন যেতে, না গেলে খুব রাগ করবে।

নিধিকেও স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে, নিবেদিতাকেও বেরোতে হবে।

কাল সন্ধ্যে থেকে মনে মনে কত প্ল্যান করেছিল কত গল্প করবে! সেই এক্কাদোক্কা খেলা, স্কুলের বাইরের সেই বুড়িমার আচার, প্রথম প্রেমপত্র আরো কতো গল্প ছিল! কিছুই হলো না....

আগের মতো প্রাণ খুলে কোনো কথা তো বলা হলো না বন্ধুকে!! শুধুই নিজেকে সুখী প্রমাণ করতে মিথ্যার জাল বুনে গেল দুজনে।

ছোট্ট মফস্বল শহরের কমলাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের হরিহর আত্মা দুই বন্ধু চন্দনা আর নিবেদিতা কখন যে এতোটা পাল্টে গেছে, নিজেরাও যেন জানতে পারেনি!!

(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama