বৃষ্টিধারায় এসো
বৃষ্টিধারায় এসো
সিস্টার এসে স্যালাইনের বোতলে দুটো ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে গেলেন । চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন,
---আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে ? একটু বাইরে গিয়ে বসুন । পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে আমরা আপনাকে ডেকে নেবো।
লাইজল-ওষুধের গন্ধ আর যান্ত্রিক বিপবিপ শব্দে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল কৌশিক। নার্সের কথায় ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকায়। যান্ত্রিক রেখাচিত্রগুলোর ওঠানামা গার্গীর নিথর দেহটাতে প্রাণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিছু বুঝি বলতে যাচ্ছিল কৌশিক। সিস্টার ইশারায় বাইরে আসতে বললেন।
বাইরের টানা বারান্দায় রুগীর বাড়ির মানুষদের অস্থায়ী আস্তানা। ভিতরের মানুষগুলো মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে , আর বাইরের মানুষগুলো গভীর অপেক্ষায়। যেকোন মুহুর্তে হারজিতের খবর আসবে। ভিতরে বসে এতক্ষণ বুঝতেও পারেনি যে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।
পায়ে পায়ে করিডোরের শেষপ্রান্তের কাচের জানলাটার কাছে এসে দাঁড়ায় কৌশিক। পাঁচতলার ওপর থেকে ভোরের শহরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। এলোমেলো ছাট আসছে জানলাটা দিয়ে। আহ! ক্লান্ত শরীরে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটাটা বেশ আরাম লাগছে।
বাবা আমেদাবাদ থেকে ফিরবে বলে দেবুকাকা সকালবেলাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। অন্য গাড়িটা গত ক'দিন ধরে গ্যারেজে। বাবা একবার ফার্স্ট আওয়ারে অফিস যেতে বলেছিল। কিন্তু ওয়ারড্রব খুলেই মুডটা বিগড়ে যায় কৌশিকের। সব জামাপ্যান্টগুলোই বহুবার পরা। কতদিন শপিং করা হয়নি !!!!
ঐশীর সাথে ব্রেকআপের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতেই অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছে কৌশিক। মেয়েটা কৌশিকের আর্থিক প্রাচুর্যতাকেই ভালোবেসেছিল। যখনই বড়ো ব্যবসায়ীর ছেলে করণ মালহোত্রাকে পেয়ে গেলো জীবনে, কতো সহজে কৌশিককে মুছে দিল জীবনটা থেকে। ধুস্! আর ওর কথা মনে করে মুডটা নষ্ট করবে না । আজ একবার ক্লাবে যাবে, অনেকদিন আড্ডা মারা হয়নি।
এটা-সেটা ভাবতে ভাবতেই রাস্তাতে বেরিয়ে পড়েছিল কৌশিক। খেয়ালও করেনি আকাশে ঘন মেঘ করেছিল। একটা ট্যাক্সি নেওয়ার আগেই ঝেঁপে বৃষ্টি। ছুটে গিয়ে একটা বন্ধ ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল কৌশিক। এলোমেলো ঝাটে ভিজে যাচ্ছে কৌশিক, সাথে গরম হচ্ছে মাথাটা। আজকেই বাবাকে আমেদাবাদ থেকে ফিরতে হলো !!!! আজ না ফিরলে দেবুকাকা তো আর গাড়িটা নিয়ে বেরোতো না। বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে মোবাইলটা বের করে। ইস্ সকাল থেকে অন করতেই মনে নেই !!!!
মোবাইল খুলতেই অজস্র জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আজকাল ভুলেই যায় নিজের জন্মদিনটা। বাবার দিনটার কথা মনে পড়ে যখন, তখন ফোনে উইশ করে। তারপর একটা ছুটির দিন দেখে বার্থডে পার্টি।
মা যখন ছিল, তখন দিনটা কত আনন্দের ছিল কৌশিকের। সকালবেলা উঠে স্নান করে মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া,পায়েস খাওয়া,কত রকমের রান্না করতো ঐদিন মা !!!!
সেবার জন্মদিনের দুদিন আগেই মা হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছে। তার কয়েকমাস আগে থেকেই মা ভীষণ অসুস্থ , মাঝেমধ্যেই হাসপাতালে গিয়ে থাকতে হয় মাকে। সেবারও মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কৌশিকের পছন্দের রান্নাগুলো করতে বলেছিল রান্নার মাসিকে। বাবা কিছুতেই কৌশিককে ঢুকতে দিত না মায়ের ঘরে, তবে সেদিন বাবাকে লুকিয়ে চলে গিয়েছিল মায়ের কাছে। মা ওর হাতটা জড়িয়ে কত কেঁদেছিল। সামনের বার জন্মদিনে আবার নিজে হাতে পায়েস রান্না করে দেবে বলেছিল। তার কয়েকমাস পরেই মাকে আবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল, কিন্তু সেবার আর মা বাড়ি ফেরেনি। চলে গিয়েছিল সবাইকে ছেড়ে অনেক অনেক দূরে। তারপর থেকেই জন্মদিনটা প্রাণহীন কৌশিকের কাছে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল কৌশিক। বৃষ্টিটা সামান্য কমেছে কিন্তু বেশ জোরেই পড়ছে এখনো। যাদের কাছে ছাতা আছে তারা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। এবার প্র
চণ্ড বিরক্ত লাগছে। একটা ট্যাক্সিও আসছে না কেন কে জানে এদিকে ?
আরে আরে মেয়েটা পাগল নাকি?!! হাতে ছাতা রয়েছে তাও সেটা না খুলে ভিজছে !!!!
ঐ পাগলামি দেখে সেদিন একটু যেচেই গার্গীর সাথে আলাপ করেছিল কৌশিক।
"প্রথম বৃষ্টিতে নাকি মনের সব কষ্ট ধুয়ে যায় । তাইতো ভিজছি...."
গার্গীর সাথে পরিচয় নাহলে কৌশিক কোনদিন জানতেই পারতো না , বৃষ্টি মনের কষ্ট ধুয়ে দিতে পারে ।
সেদিন গার্গী জোর করে ছাতাটা গুঁজে দিয়েছিল কৌশিকের হাতে। পরেরদিন বিকালে গার্গীর ঠিকানায় ছাতাটা পৌঁছাতে গিয়ে অবাক কৌশিক। গাড়ি ঢোকা তো দূরের কথা, অত সরু গলি কখনো দেখেনি কৌশিক।
গলির প্রায় প্রান্তের নীল একতলা বাড়িটা গার্গীদের। বেচারী তখন জ্বরের ঘোরে শয্যাশায়ী। ওর মা অভিযোগ করেছিল,
"দেখো না পাগল মেয়ের কাণ্ড! বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে, তাও কালকে বৃষ্টিতে ভিজেছে।"
গার্গীর সাথে বন্ধুত্বটা হতে খুব বেশি সময় লাগেনি কৌশিকের। সদ্য বাবাকে হারিয়ে মা-বোনকে নিয়ে অনিশ্চয়তার অথৈ সাগরে ভাসছিল তখন গার্গী।
বাবাকে বলে কোম্পানীতে গার্গীর একটা কাজের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল কৌশিক। বাবার চিকিৎসার জন্য ব্যাঙ্কের কাছে বাঁধা ছিল বাড়িটা। বাড়িটা ছাড়িয়ে বোনটাকে কলেজে ভর্তি করে সবে জীবনটা একটু গোছাতে শুরু করেছিল গার্গী ; তখনি বেয়াড়া রোগটা ধরা পড়লো, একেবারে শেষ পর্যায়ে।বড়জোর তিনমাস কি চারমাস, ডাক্তারবাবু জানিয়েই দিয়েছেন ।
আড্ডা-পার্টি-ড্রিঙ্ক-শপিং-লঙড্রাইভ ছাড়াও যে একটা জীবন আছে গার্গী-ই বুঝিয়েছিল কৌশিককে। নিয়মিত অফিস যেতে শুরু করাতে বাবাও খুশি। এতদিনে বোধহয় ছেলেটার একটু বোধবুদ্ধি হলো।
ব্যাঙ্গালোরে চিকিৎসা করিয়ে এক বন্ধুর মা এখন নাকি ভালো আছে। অফিসের কাজে ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিল যখন গার্গীর সমস্ত রিপোর্টপত্রগুলো নিয়ে গিয়েছিল। অল্প হলেও আশার আলো দেখিয়েছেন ওখানকার ডাক্তারবাবুরা। সামনের সপ্তাহেই পেশেন্টকে নিয়ে আসবে বলে এসেছে কৌশিক।
গতকাল গার্গীর মায়ের ফোন পেলো যখন কৌশিক তখনো ব্যাঙ্গালোরের হোটেলে। কলকাতায় ফিরে সরাসরি নার্সিংহোমে এসেছে কৌশিক। মৃত্যুর সাথে শেষ লড়াইটা লড়ছে গার্গী। মা'কেও এইভাবেই হারিয়ে ফেলেছিল সেদিন। আজ আবার হারাতে বসেছে গার্গীকে। ওকে সাথে নিয়েই জীবনটাকে সাজানোর স্বপ্ন দেখেছিল কৌশিক, সব বুঝি এলোমেলো হয়ে গেলো !!!!
কদিন আগে গার্গী যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়েছিল, একটা আবদার করেছিল কৌশিকের কাছে।
"একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে দিলে নাকি ওর সব কষ্ট কমে যাবে।"
সত্যি কি তাই ?!!
---পাঁচ নম্বরের বাড়ির লোক কে আছেন ?
বেডনম্বরই রুগীর পরিচয় এখানে। ঘুমন্ত করিডোরের নিস্তব্ধতা খানখান করে ওঠে কথা ক'টায় । চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ায় কৌশিক। গার্গীর মা আর বোনকে কাল রাতে জোর করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় কৌশিক ।
কি জানি কি খবর !!!!
----পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে ।
গার্গীর শীর্ণ আঙুলে হাত ছোঁয়ায় কৌশিক । কোন অনুভূতিই নেই ....
ফ্যালফ্যাল চোখে সিস্টারের মুখের দিকে তাকাতেই সিস্টার বললেন,
----জ্ঞান আছে কথা বলুন ।
----বৃষ্টি পড়ছে, চলো ভিজবো দুজনে। বৃষ্টিতে তোমার সব কষ্ট ধুয়ে যাবে।
গার্গীর কানের কাছে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে কৌশিক।
যান্ত্রিক বিপবিপ শব্দকে অতিক্রম করে কথাগুলো বুঝি পৌঁছালো গার্গীর অনুভূতিতে। শীর্ণ আঙুলগুলো একটু বুঝি নড়লো, একটু যেন কাঁপলো বন্ধ চোখের পাতা।
কৌশিক মনের খুশিতে আরো শক্ত করে চেপে ধরে গার্গীর হাতটা । এ হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে কোথাও হারাতে দেবে না গার্গীকে......