STORYMIRROR

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

4  

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

গাজন উৎসব

গাজন উৎসব

4 mins
334

গ্রাম বাংলায় শিবের ভক্তদেরা চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী নেন এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে গাজন উৎসবের সমাপ্তি হয়। 

গাজনের ভক্তরা বা সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্য দিয়ে ইষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট চেষ্টা করেন। গাজন সময় শোভাযাত্রা করে দেবতার মন্দিরে যান। বাংলায় কিন্তু তিনটি গাজন চালু আছে। শিবের গাজনে দু'জন প্রধান সন্ন্যাসী শিব ও পার্বতী সেজে আর অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতির সং সেজে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এই শোভাযাত্রায় শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয় , তার তালে চলে নাচ । চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা বা কালিকা পাতারি নাচ। জ্যৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেয়, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করে।

এই শোভাযাত্রায় সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের নাম গাজন । তবে গাজন শব্দটিকে ভাঙলে গ্রাম বা গা এবং জন বলতে জনসাধারণ ; গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসব গাজন হতে পারে।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী,হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয় গাজন উৎসবের দিনে।আগে বলেছি গাজন তিন প্রকার নানা পৌ্রাণিক ও লৌকিক দেবতার নামের , শিবের গাজন, নীলের গাজন,ধর্মের গাজন, আদ্যের গাজন,বীর বলাই’ গাজন।‘বীর বলাই’ গাজন( বীর বলাই বিষ্ণুর অবতার)।

ভালো করে লক্ষ্য করুন এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য । তার পত্নী হিসেবে পৃথিবী কল্পনা করা হচ্ছে। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই অনুষ্ঠান এই উৎসব। চৈত্র মাস সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের সূচনা করিয়াছিল।

আসলে হিন্দুদের ত্রিদেবের আবির্ভাব ঘটে সূর্য থেকেই।

আসলে এই লৌকিক উৎসবের সাথে অনেক পৌরাণিক কাহিনী যুক্ত হয়ে আছে। যেমন এই উৎসব বানফোড়া হয় , তাঁর পিছনে একটি কাহিনী আছে।শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের ও   মেয়ে ঊষার প্রেম কাহিনী। দৈত্যরাজ বাণরাজ মানতেন পারিনি তাদের প্রেম। অনিরুদ্ধ বন্দি হলেন তার হাতে । কৃষ্ণের তাই বাণগড় আক্রমণ করলেন । যুদ্ধে পরাজিত হল বাণরাজ ।পরাজিত ক্ষতবিক্ষত বাণরাজ মৃত্যু আসন্ন জেনে নিজেকে উৎসর্গ করলেন আরাধ্য ভগবান শিবের চরণে। সেই থেকে এই বানফোড়া প্রচলন।

কৃচ্ছসাধন , পুনর্জন্মবাদ আর মুক্তির আস্বাদ বাণরাজেরই দেখানো পথ চরক উৎসব অংশগ্রহণ করেন ভক্তরা। লোহার হুড়কো দিয়ে চাকার সঙ্গে বাঁধা ভক্তরা চড়কগাছে ঘোরেন। ভক্তদের শরীর , পায়ে, হাতে, পিঠে, জিভে বাণশলাকাবিদ্ধ করে । কেউ নিজের শরীরের জ্বলন্ত শলাকা ফুঁরে দেয় ।

ক্ষেত্র সমীক্ষাক সঞ্জয় ঘোষ বলেছেন "ব্রাত্য জনের রুদ্ধ সঙ্গীত গাজন ।না টাকা বা ভালো খাবার এর লোভ কোনো প্রচার দরকার হয় না লাউডস্পীকার বা আড়ম্বর পূর্ণ মন্ডপ কিছুই লাগেনা লাগেনা  চোখ ঝলসানো দামী গাড়ি বা লরি করে ভাড়াটে লোক আনতে হয় না ।কারন শ্রমজীবি এই মানুষগুলি নিজেদের শ্রমের ওপর আস্থাশীল মাইলের পর মাইল হাঁটতে কোনো অসুবিধা হয় না এঁদের। এতে হাজার হাজার বছরের পরম্পরা প্রতিটি মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এ আয়োজন ।সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষটিও স্বতস্ফুর্ত ভাবে অংশ নেন। স্ত্রী পুরুষ ছোট বড় ভেদ থাকেনা গাজনে ।থাকেনা ধর্ম ভাষা জাতির ভেদ   । যে কেউ অংশ নিতে পারেন ।আদিবাসী তথাকথিত নিম্ন বর্ণের বাঙ্গালি সবাই একসাথে অংশ নেন। না এই বাঙ্গালিদের কাছে এঁরা ব্রাত্য নন।এই বাঙ্গালিদের কাছে উচ্চ বর্ণের চেয়ে এঁরাই বেশী আপন।কারন এঁদের পূর্বপুরুষ এঁদের মতই আদিবাসী ছিলেন।তাই ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য ছাড়াই কোরামুদিদের নিজস্ব পুরোহিত বা লায়ার ।এখানে লায়া রুহিত মুদি। কাছে উত্তরী নিতে এঁদের দ্বিধা নেই।দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কংকণ দিঘির কোরা মুদি আদিবাসী পাড়ার এক আদিবাসী পরিবারের শিব থানে গত কাল ২৮শে চৈত্র ১৪২৯/।জানা গেল এখানে ৯০ জন সন্ন্যাসীর প্রায় ১০ জন বাঙ্গালি ও ৮০ জন আদিবাসী।গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছেন আদেশ কাড়ার /ফুল পড়ার ।কারন তার পরেই অস্থায়ী শিব ঘরে পূজা সেরে তারা দল বেঁধে যাবেন বাবুজান সিপাই স্কুলের মাঠে ঝাঁপে অংশ নিতে । শুধু পুরুষরা ঝাঁপ দেবেন।এঁদের গায়ের রঙ কালো বহু যুগ ধরে সূর্যের তাপ এঁদের গায়ের চামড়ায় প্রভাব ফেলেছে ।কিন্তু মন সূর্যের আলোর মতই সাদা ধবধবে।সেখানে কলংক নেই।এঁদের ঠোঁট মোটা নাক বিস্তৃত কিন্তু ঠোঁট থেকে নিসৃত ভাষায় মানবতা আন্তরিকতা আত্মীয়তা ঝরে পড়ে মনে হয় পৃথিবীটা কত সুন্দর মানুষের বসবাসের যোগ্য।

কত হাজার বছরের পরম্পরা বহন করে চলেছেন এই বৃদ্ধ আদিবাসী ।তাঁর মুখের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে কত শীত বসন্ত গ্রীষ্ম বর্ষার অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে আছে কে জানে।আজও চলেছেন এই বৃদ্ধ তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য সঞ্চারিত করতে উদবুদ্ধ করতে লাঠি হাতে ।তাঁর উপস্থিতিই সম্ভ্রম জাগায় ।নিজ পাড়ায় সূর্য হিন্দুদের শিব পূজ়া করার পর ( আদিবাসীদের সিং বোঙ্গা /ধর্ম )।( মুসলিমদের গাজী )।গাজনের সন্ন্যাসীদের নিয়ে চলেছেন যেখানে একসাথে ৯ পাড়ার ঝাঁপের আয়োজন হয়েছে সেখানে।আদিবাসী বাঙ্গালী একসাথে ঝাঁপ দেখবেন অংশ নেবেন ।এ যে গাজন গাঁ সর্বজনের পূজা।"

বান রাজার মৃত্যু সময় শ্রী কৃষ্ণ কাছে বর চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুদিনে যেন কোন জাত পাতের ভেদাভেদ থাকে না। গাজন উৎসব ব্রাহ্মনবাদ বিরোধে নিম্নবর্ণ মানুষের হুঙ্কার। তবে বাংলা সাহিত্যের পাতা অন্যকথা বলে।গাজন-উৎসব নিয়ে কলকাতার বাবুরা মাতামাতি করতেন। উনিশ শতকে হুতোম কিংবা প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কথা কলকাতার মাদকাসক্ত বা বেশ্যাসক্ত বাবুদের, কলকাতার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা গন্ধবেনেরা শিবের কৃপা লাভের আশায় কৌম ‘গাজুনে বামুন’দের পায়ে লুটিয়ে পড়ছেন। চড়কের রাতে বাবু আহিরীটোলার চৌমাথা, মেছোবাজারের হাঁড়িহাটা, জোড়াসাঁকোর পোদ্দারের দোকান,চোরবাগানের মোড়, সোনাগাছি বটতলায় ভিড় জমাতেন। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত কালীঘাট বা হুগলকুড়িয়ার বাবু শিবচন্দ্র গুহর কালীবাড়িতে বাণ ফোঁড়ার ঘটনা বা চিৎপুর রোডের সং বা জেলে পাড়ার সং কথা বলেছেন।

কোন আদিম যুগ থেকে  আমাদের সূর্য তাপ ও আলো দিয়ে যাচ্ছে  । পরে চাষ বাস এরা আরো সূর্য ওপর নির্ভর শীল হলো । সূর্যকে দেবতা রূপে পুজা শুরু করল। এবং সেখানে থেকেই নানা প্রথা আচার শুরু হয়েছিল।তার অন্যতম এই ঝাঁপ ।হাজার কোটি বছরের পুরোনো সূর্যকে পিছনে রেখে এই তথাকথিত আধুনিক যুগে বাংলার লক্ষ লক্ষ সাধারণ একেবারে তলার মানুষ স্বতস্ফুর্ত ভাবে এই পূজা উৎসবে অংশ নেয়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract