একটি মেয়ে.. ( পর্ব তিন)
একটি মেয়ে.. ( পর্ব তিন)
চঞ্চল কতক্ষণ এমন করে দাঁড়িয়েছিল তা সে জানেনা।ওর মনে হলো পেছনে কে এসে দাঁড়িয়েছে, সে চমকে পেছনে তাকালো দেখলো সেখানে কেউ নেই, ভাবলো মনের ভুল। কিছুক্ষণ আগে নিজের করা ব্যবহারে সে নিজেই লজ্জিত হয়ে গেল।কারণ একজন ভদ্রলোকের বাড়িতে একজন ভদ্রমহিলাকে লুকিয়ে দেখা অভদ্রতার পরিচয়। চঞ্চল নিজের বিছানায় এসে আধশোয়া হয়ে আবার ভ্রমণের বইটা খুললো।কিন্তু মন বসলো না, বারবার মেয়েটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। একটা সন্দেহ আসছিলো মনে ..তবে নিজেকে শাসন করে বললো সে কি ভাবছে। একটা ভদ্রপরিবারে এসব হয় নাকি।তাছাড়া রাতে যেগুলো ঘটনা ঘটেছে বলে ওর মনে হয়েছে, সেগুলো তো ওর মনের ভুলও হতে পারে। একা একা থাকতে থাকতে এসব কল্পনা করে নিয়েছে, এসব হওয়া তো অদ্ভুত না। নিজের মনেই বলে উঠলো এবার বিয়েটা সেরে নিতেই হবে। নইলে আরও কত কি দেখতে থাকবো। এমন সময় দিদির ফোন আসাতে চিন্তা ছিন্ন হলো।
" হ্যাঁ দিদি বল। "
" কেমন আছিস ভাই? দিদিকে তো ভুলেই গিয়েছিস?"
" হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো আছি, তুই কেমন আছিস বল, আর জামাইদা?"
" ভালোই আছে, খারাপ থাকবে কেন ও? তুই তোর কথা বল, একা একা অতদূরে পড়ে রয়েছিস।"
" আমার কথা বাদ দে, আমি খুব ভালো আছি,আর কি সুন্দর জায়গা, ঘুরে বেড়াচ্ছি খালি, বরং তুই নিজের খেয়াল রাখ, আমার মামাটার খেয়াল রাখ।"
" সে ডাক্তার বলেছে তোর মামা ভালোই আছে, আমিও তো পিসি হবো, তুই একটা বিয়ে কর ভাই। সে যেখানেই থাক বৌকে সাথে নিয়ে থাক। মনে একটা শান্তি থাকে তোর সাথে আপন বলে কেউ আছে।"
" আরে বাবা বিয়ে নিয়ে তুইও পড়লি, একটু সময় দে না দিদি, তুই তো আমাদের বুঝিস বল, মায়ের মতো তো তুই ছিলি না কোনো দিনই.."
" সে যাই বলে যা, চিন্তা তো হয়, জানিস তোকে নিয়ে কিসব হাবিজাবি স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তারপর পেটে যা যন্ত্রণা হয়েছিল তোকে কি বলব, ভাই তুই বুঝিস না কেন? তুই যে আমার একমাত্র ভাই.."
" দিদি কেন এতো চিন্তা করিস,আমি ভালো আছি, সত্যি ভালো আছি। বল ব্যাঙ্গালোরে তো একাই ছিলাম, তুই শুধু তোর শরীরের খেয়াল রাখ।"
" সে আমি রাখছি,একা ছিলি না ছাই" বলে হাসে, তারপর বলে" শোন না একটা মেয়ে রয়েছে"
"কে?"
" আমার ছোট মামা শ্বশুরের মেয়ে।"
" কি বলছিস? তোর মামাতো ননদ"
" হ্যাঁ তুই তাকে চিনিস।"
" আমি চিনি!! আমি চিনি!! কে কেয়া? "
" কি রে এক ঝটিকায় চিনে নিলি, কি ব্যপার।"
" আরে না না, কিছুই ব্যাপার না, মনে ছিলো মানে তোর বিয়েতে ঝগড়া হয়েছিল তাই .."
" বাব্বা সে তো বছর তিন আগের কথা.. "
" হু, তা বটে, তা ও কি এখনো ঝগরুটে আছে? "
" ধুর ও মোটেও ঝগরুটে না, বিয়ে বাড়িতে ওসব হয়, ওই মেয়ে Zoology তে Msc শেষ করে বছর দেড় হলো বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছে। তবে কি জানিস মেয়েটার তিন বছরের পুরনো প্রেম ভেঙ্গে গিয়েছে, তারপর থেকে মেয়েটা কেমন ভেঙে পড়েছে,দুই বাড়ি জানতো কিনা, মেনেও নিয়েছিল, এবছরই বিয়ে করত ওরা। এখন বাড়ির সবাই এখন বিয়ে দিতে চায় ভালো পাত্র পেলে।"
" কি বলিস ৩ বছরের প্রেম ভেঙ্গে গিয়েছে, তাই বলি এখনকার দিনে Single মেয়ে মেলে! তা এমন হওয়ার কারণ? "
" আর কি? চিরাচরিত ঘটনা, ছেলেটা চাকরি পেয়েছে এক বছর হয়েছে, ওখানকার একটা মেয়ের সাথে প্রেমে জড়িয়েছে। জানিস কেয়া কম করেনি ছেলেটার জন্য। কত ফর্মের টাকা নিজে দিতো, মাঝে মাঝে হাতখরচ পর্যন্ত দিয়েছে। চাকরি পেয়েও সব ভুলে গেল, কত অকৃতজ্ঞ ভাব। কত ভালো ভালো সম্বন্ধ ছেড়েছে মেয়েটা।"
"কি? ছেলেটা চাকরি পেয়ে অফিসের কলিগের সাথে প্রেম করতে শুরু করে, সত্যি দিভাই ঠিকই বলেছিস আজকাল কোনো কিছুর নিশ্চয়তা নেই, কাউকে ভরসা নেই."
" তারমানে তুই রাজি ভাই"
" আরে না না, আমি কখন বললাম রাজি?"
" আরে রাজি না হ, ফোন নাম্বারটা অন্তত রাখ।"
" না না আমি ওসব ফোন নাম্বার টাম্বার নিতে পারবনা, বাড়ি যাই ছুটি পেয়ে একদিন তুই তোর যে কোনো একটা বাড়িতে নিয়ে আয় ওকে।"
" সে আমি ডাকতেই পারি ওই বাড়িতে হোক কি এ বাড়িতে, মাসিমা চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দেবে আমার সাথে, কিন্তু তার আগে তোদের একটু পরিচয় পর্বটা হয়ে যেতো,মেয়েটা বড় মনোকষ্টে ভুগছে রে ভাই।"
" কি? আমি ওসব পারবো না, অকারণে মানসিক অবসাদে যাওয়ার কি আছে?"
" ভাই তুইও তো এই পরিস্থিতির উপর দিয়ে গিয়েছিস।"
" আমার ব্রেকাপ হয়েছিল দেখে আমি বুঝতে পারবো.. কি বলিস আমাকে ক্ষমা কর।"
" কি শোন আর নাই শোন আমি তোকে তোর ফোনে ওর ফোন নাম্বারটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
" না না দিদি ফোন নাম্বারটা দিস না।"
চঞ্চলের দিদির ফোন আসার পরে থেকেই আগের মতোউ ঝোড়ো হাওয়া দেখা দিচ্ছিলো, চঞ্চল লক্ষ্য করেছিলো বটে, পাত্তা দেয়নি, মাকে ফোন করার সময় হয়েছিল। ভেবেছিলো এখানে এমন হয়ই।এতোক্ষণ চুপ থাকলেও যখন জানালার কাঁচটি ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়লো, তখন বাধ্য হয়ে ফোনটা রেখে বাইরে বেড়িয়ে এলো। কিছুই দেখতে পেলো না, খালি একটা কালো বিড়াল প্রায় ওর গা ঘেঁষে চলে গেল। চঞ্চল বেশ চমকে উঠলো। তারপর ধাতস্থ হতে ওর হাসি পেলো, ও নিজের অকারণে ভয় পাওয়াতে নিজেকে শাসন করে বললো "এই তোর সাহস?"
ঘরে যেতেই দেখে ওই বাড়ির সময় সময়ের কাজের মাসি জানালা গলিয়ে টেবিলে খাবার রাখছেন। চঞ্চল এগিয়ে এসে বললো " কেমন আছেন আপনি? "
সে বেশ চমকে উঠলো, " ও আপনি? আমি ভেবেছিলাম..." বলে চুপ করে গেলো।
চঞ্চল হেসে উঠলো " এই ঘরে তো আমি একা থাকি,আমি ছাড়া কেই বা থাকবে?"
বছর পঞ্চাশের মহিলাটি কাষ্ঠ হেসে বললো "ও হ্যাঁ তাই তো, তাই তো.." বলে আর কিছু উচ্চবাচ্য না করে চলে গেল।
চঞ্চলের ওর ব্যবহার অন্য রকম লাগলো।ঠিক কি রকম সে জানেনা।
চঞ্চলের বেশ খিদে পেয়েছিল, থালা তুলে মন ভরে গেলো, লুচি, আলুর তরকারি আর ছোলার ডাল আর দুটি রসগোল্লা। প্রায় সব কিছু গরম।বাড়িতে থাকলে চঞ্চল হয়তো আরও গোটা দুই লুচি খেতো। অবশ্য অনেকগুলোই দিয়েছিলো, রান্না অসাধারণ, মানে ঘরোয়া। তাই ক্ষিদেটা মিটলো না মনে হলো। খাওয়া দাওয়া সেরে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লো। কালকে এ জঙ্গলটা ঘোরানোর জন্য মেষপালকে বলে রেখেছে। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো, সেই একই অনুভূতি, প্রতিদিনের মতো আজও নিজেকে আটকাতে পারলো না। ডুবে গেলো সেই খেলায়, যেন সে সম্মোহিত কারো দ্বারা। তবে এই সম্মোহন তাকে আনন্দ দিচ্ছিলো। সে যে এসবের পরে কখন ঘুমিয়ে পড়লো তা সে জানেনা। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন ১০টা বেজে গিয়েছে, ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই উঠে বসলো। তারপর কালকের ঘটনা একে একে মনে পড়লো,সে সাথে সাথে দুটি দরজার দিকে তাকালো, অদ্ভুতভাবে দুটোর বন্ধ। একটা দরজা চঞ্চলের ঘরে যাতায়াতের জন্য, অপরটা বাড়ির দিকে খোলে। অবশ্য এই দরজা প্রথম থেকেই বন্ধ,দুই দিক থেকেই। চঞ্চল উঠে দাঁড়িয়ে দুটো দরজাই পরীক্ষা করলো। না দুটোই বন্ধ, চঞ্চলের এবার পাগল পাগল লাগলো। সে আজকে নিশ্চিত যে সে স্বপ্ন দেখেনি, তবে কোথা থেকে আসছে সে। মাথাটা খারাপ হওয়ার জোগাড়। শেষে ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি করে স্নান করতে গেলো। তবুও যেন মন থেকে কথাটা সরাতে পারছেনা। জোর করে কোনো মতে কথাটা মন থেকে সরিয়ে ঘরে এসে দেখে খাবার দিয়ে গিয়েছে, টোস্ট, অমলেট আর চা। সাধারণত এই সময় খাবার দেয়না। অবশ্য প্রতি রবিবার সে ঘুরতে বেড়িয়ে যায়। আজ এখনো যায়নি তাই বুঝি খাবার দিয়ে গিয়েছে। মনে মনে বাড়ির মানুষগুলোকে ধন্যবাদ দিলো। কারণ সত্যি বলতে তার বড্ড খিদে পেয়েছিল। খাবার পেয়ে মনের মধ্যে আসা সব সন্দেহকে দূরে সরিয়ে দিয়ে খাবার খেতে বসে গেলো। তারপর খাবার খেয়ে বাসন গুলো হাত ধোয়া ধুয়ে, পোশাক বদলে দরজা বন্ধ করে, সেই মোড়ের কাছে এসে দেখে সেই মেষপালক এসে গিয়েছে।
" আপনি কিন্তু ১০ মিনিট দেরি করে ফেললেন। "
" হ্যাঁ দাদা দেরী হয়ে গেল, কিছু মনে করবেন না।"
মেষপালক কথা না বাড়িয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলো, চঞ্চলও পিছু নিলো তার।
(চলবে..)