এখনো শিউলি ফোটে
এখনো শিউলি ফোটে
হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল শুভাশিস। এখান থেকে সে যাবে দমদমের কাছে স্পেশ টাউনশিপে। অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরছে শুভাশিস,বলতে গেলে প্রায় পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর বেঙ্গালুরুতে থাকতে থাকতে কোলকাতা মহানগরীকে সে প্রচণ্ড মিস করেছে। কোলকাতাতেই তার জন্ম,কোলকাতা তার কাছে মায়ের মতো। আর মাকে কি এতো সহজে ভোলা যায়। বেঙ্গালুরু যতোই উদ্যান নগরী হোক না কেন,যতোই গাছপালায় ঘেরা সুন্দর সবুজ শহর হোক না কেন, বানেরঘাট্টা জাতীয় উদ্যান যতোই চিত্তাকর্ষক হোক না কেন,কাছে যতোই মাইশোর ও উটির মতো সুন্দর জায়গা থাকুক না কেন,কোলকাতা কোলকাতাই। এতোদিন মহানগরী থেকে দূরে থেকে তার প্রাণ কিরকম ওষ্ঠাগত হয়ে গেছে,তা একমাত্র শুভাশিসই বলতে পারবে।কৃত্রিমতায় হাঁফিয়ে উঠেছে,তাই তো আজ হাতছানি দিয়ে ডাকছে সোনার বাংলা-কোলকাতা।
হাওড়া স্টেশনে এসে অ্যাম্বাসাডর ধরল শুভাশিস। ভোরের আকাশে শারদীয়ার গন্ধ। এয়ারপোর্ট পেরিয়ে ফাঁকা জমিতে সাদা কাশফুল আর আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ জানান দিচ্ছে যে,পুজো আসতে বেশি দেরি নেই। শুভাশিস মনে মনে আবৃত্তি করে উঠল কবিতার কবিতার দুই লাইন," আজিকে তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে/ হে মাতঃ বঙ্গ,শ্যামল অঙ্গ ঝলিল অমল শোভাতে।" আকাশে রঙের খেলা। হালকা কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে উদিত হচ্ছেন কমলারঙের দিবাকর। সারা শহরের ঘুম ভাঙছে ধীরে ধীরে।শহর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
আগে জায়গাটাকে বলা হত বকুলপুর,আর এখন স্পেশ টাউনশিপ। এই চার-পাঁচ বছরে জায়গাটার কতো পরিবর্তন,অবাক হয়ে গেল শুভাশিস। প্রকৃতির সেই নিবিড় সান্নিধ্য , সবুজের সেই সদর্প স্নেহময় উপস্থিতি আর নেই,তার বদলে কেবল কংক্রিট আর কংক্রিট। আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটবাড়ি । চারদিকে শপিং মল আর বহুতল। পাড়াতেও সেই অবস্থা। তাদের বাড়ির সামনে সুন্দর সাজানো পার্ক ছিল। এই পার্কে শুধু যে
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলা করতো তাই নয়,বিকেলের দিকে বুড়োরাও ঘুরতে আসতেন। নিজেদের মধ্যে গল্প করতেন,হাসিঠাট্টা করতেন,বাচ্ছাদের সঙ্গে ভাব জমাতেন। এভাবেই তারা শেষ বয়সে লাভ করতেন প্রকৃতি ও ভালোবাসার সান্নিধ্য,কেটে যেত তাদের জীবনের নির্জনতা,নিঃসঙ্গতা। অন্তরঙ্গতা আর উষ্ণতা তাদেরকে ভুলিয়ে দিত সব বেদনা,সব বিষাদ। শরৎকালে এই পার্কেই ফুটত স্থলপদ্ম আর শিউলি। শিউলির মিষ্টি সুবাসে ছেয়ে যেত চারদিক।
ছোটবেলায় এই পার্কে বেড়াতে আসত শুভাশিস তার দাদুর সাথে। বিকেলবেলা গাছের ছায়ায় পড়ন্ত রোদের আলোয় বসে দাদু শোনাতেন দেশ বিদেশের রূপকথার কতো গল্প- কখনোও বা আরব্য রজনী,আবার কখনো পঞ্চতন্ত্র, আবার কখনো ধর্ম ও নীতিকথার কাহিনী। অনাবিল হাস্যরসের গল্প শুনে যেমনি দাদুর সাথে প্রচণ্ড অনাবিল হাসিতে ফেটে পড়ত সে,তেমনি দাদুর মুখে গ্রাম বাঙলার গা ছমছমে ভূতের গল্প শুনে কেঁপে উঠত থরথর করে। সেই আতঙ্ক আর সেই হাসি উভয়ের মধ্যেই কোনোরকম কৃত্রিমতার ছোঁয়া ছিল না-শুধুই ছিল সারল্য। দাদুর সাথে স্নেহ আর ভালোবাসায় কাটানো কতো মুহূর্ত কাটিয়েছে এই পার্কটায়,কতো আবেগমাখানো স্মৃতি আছে,হায় সেই পার্কটাই আর নেই। সেখানেও তৈরি হয়েছে এক হাইরাইজ বিল্ডিং। হারিয়ে গেছে শৈশবের উচ্ছলতা,হারিয়ে গেছে শিউলির সুবাস। না,এই স্পেস টাউনশিপ বকুলপুর নয়,এখানে না আছে সেই অন্তরঙ্গতা,না আছে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। এখানে কেবল আছে কৃত্রিমতা,কেবল আছে যান্ত্রিকতা। শুভাশিসের মনে হতে লাগল এ যেন তার চেনা শহর নয়,এ এক মায়াবী যক্ষপুরী। এখানে শিশুরা শৈশবের অর্থ ভুলে গেছে,শিউলি আর ফোটে না।
আটটা নাগাদ বাড়িতে ঢুকল শুভাশিস। বাড়ি বলা ভুল হবে,তাদের বাড়িটাও ভেঙে এক আকাশচুম্বী ফ্ল্যাট হয়েছে। সেখানেই থাকে ওর মা বাবা। মাকে দেখে সব ক্লান্তি,সব বেদনা ধুয়ে মুছে যায় শুভাশিসের। মাথায় সিঁদুর,লাল গরদের শাড়ি পরে মাকে দেখে সত্যিই দেবী বলে মনে হচ্ছে। মা সদ্য স্নান করে পূজা সেরে উঠেছেন। মায়ের চোখে মুখে অপূর্ব আভা। মাকে প্রণাম করে শুভাশিস। বহুদিন পরে ছেলে বাড়ি এসেছে। মা জড়িয়ে ধরেন তাকে।
"দাদুকে তো দেখছি না। দাদু কোথায় মা?" কান্নায় ভেঙে পড়েন মা। আর মায়ের কাছ থেকেই শুভাশিস পায় সেই বুকভাঙা দুঃসংবাদ।
দাদু রীতিমতো মর্নিং ওয়াক করতে বেরোতেন। এই আশি বছর বয়সেও রীতিমতো শক্তসবল ছিলেন। আগের সপ্তাহে মর্নিং ওয়াক করতে করতেই হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর। আর সেখানেই মৃত্যু। মর্নিং ওয়াকের সঙ্গী শেখরকাকু এসে বাড়িতে খবর টা দেন। এরপর দাহকার্য সমাধা হয়। দাদু অত্যন্ত প্রিয় ছিল শুভাশিসের,তাই দীর্ঘ প্রবাসে ছেলে দুঃখ পাবে ভেবেই খবর দেওয়া হয় নি শুভাশিসকে।
নিজেকে সামলাতে পারল না,আবেগজড়িত কান্নায় ভেঙে পড়ল শুভাশিস। দাদু আর নেই,শিউলি আর ফোটে না,এরকম যান্ত্রিকতাযুক্ত সমাজে বাঁচার কি আদৌ কোনো লাভ আছে।
কিন্তু মৃত্যু থাকলে জন্ম থাকবেই। গাছের পুরনো জীর্ণ পাতা ঝরে পড়লে জন্ম নেয় নবীন কিশলয়।
কিন্তু পৃথিবীর এখনো কোথাও না কোথাও এখনো বেঁচে আছে শিউলি,এখনো আছে শিউলির সুবাস,এখনো আছে উচ্ছল শিশুদের কলতান। আছে সবুজে ভরা,ভালোবাসায় ভরা এক সোনালী পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন।