একদিন বৃষ্টিতে অরুণাচলের পথে
একদিন বৃষ্টিতে অরুণাচলের পথে
মনটা বেশ ক'মাস ধরে খুশিতে উথালপাথাল, বহুদিনের যে ইচ্ছাখানি হৃদয়ের গভীরতম অন্তঃস্থলে লালিত হচ্ছিলো তাই এবারে পূরণ হতে চলেছে, অবশেষে কর্তামশাই রাজী হয়েছেন পুজোর ঠিক পরপরই অরুণাচলে বেড়াতে যেতে। টিকিটপত্র, হোটেল, খাওয়া দাওয়া, গাড়ি ইত্যাদির যাবতীয় দায়িত্ব এক ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে কাউন্ট ডাউন শুরু হোলো মোটামুটি মাসচারেক আগে থেকে। মাঝে মাঝে ফোনে ট্রাভেল এজেন্সির ট্যুরের প্রোগ্রাম এবং ব্যবস্থাপনার অগ্রগতি বিষয়ে তদারকি করতে করতেই হুশ করে কখন যেন যাত্রার দিনটি এসে গেলো। যথাসময়ে যাত্রা করা থেকে গৌহাটি হয়ে তেজপুর পৌঁছনো পর্যন্ত পথের বিষয়ে তেমন কোন বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচরে না আসায় চেনা পরিচিত পূর্বতন অরুণাচল অভিযাত্রীদের পথশ্রম এবং পথের দুর্গমতা.... এই দুই বিষয়ে অরুণাচল ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতাকে বালখিল্য সুলভ বলেই মনে হয় এবং আপনমনে খানিক খিলখিলিয়ে হেসে নিই। এছাড়া সৌন্দর্য্য সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ হতোদ্যম হয়ে পড়লাম, মায় অরুণাচল ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয় নি এতদূরও ভেবে ফেললাম, কিন্তু আপাতকরণীয় কিছু নেইও, অগত্যা গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে একরাশ বিরক্তি মনে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে বসে রইলাম।
চোখটা একটু লেগে গিয়েছিলো বোধহয়, হঠাৎ কাঁধে মেয়ের মৃদু চাপড় খেয়ে চোখ মেলে দেখি এ কোথায়? শিবালিক হিমালয়ের গা বেয়ে রাস্তা উঠছে..... নাগাধিরাজ যেন দেবাদিদেবের প্রকান্ড জটা বেয়ে উর্দ্ধমুখী! গাড়ির সার বমডিলা অভিমুখে, এক একটি পথের বাঁক..... চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে নিপুণ চিত্রকরের আঁকা ছবির খাতাটির এক একটি পৃষ্ঠা। আকাশ এত নীল? নীল নীলিমায় ভাসমান মেঘের ভেলা এত সাদা? পাহাড়ী বনানী এত গাঢ় সবুজ? পাহাড়ের পর পাহাড়, তারপর আবার পাহাড় যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়? পাহাড়চূড়োয় গলানো সোনার মতো ঝকমক করছে ওকী রোদমাখা জমাট বরফ? মুখ হাঁ, নিষ্পলক চোখে অপার বিস্ময় মেখে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের একটি দল...... অবিরাম পানরত প্রকৃতিসুধারসধার! নির্নিমেষ দৃষ্টি আর নিশ্ছিদ্র নীরবতায় ছেদ পড়ল আচমকাই। ড্রাইভারের গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরলো, সামনে বিরাট ধস! সারবন্দী গাড়িগুলো অপেক্ষায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অবিরাম নামতে থাকা ধস সরিয়ে পথের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টায় নিয়োজিত।
পাহাড় যে, হিমালয় পাহাড়! বড় বিচিত্র তার বুকে আবহাওয়ার চরিত্র। আমাদের সমতলের চোখে মনে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তল খুঁজে পাওয়া ভারী দুষ্কর। এই এতক্ষণ চারধারে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের ঢালে ঢালে চূড়ায় চূড়ায় চোখ ঝলসানো ঝলমলে রোদে ভাসছিলো। ধসে আটকে পড়ার খানিক পরেই আকাশের মুখ ভার হোলো। তারপরই রোদন শুরু...... সমান্তরালে ভেসে থাকা মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে। কর্দমাক্ত পিচ্ছিল সে পথপ্রান্তে ধস সামলাতে কার্যতঃ দুর্বিপাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডিউটিরত জওয়ান ভাইয়েরা।
সময় পার হচ্ছে, আর গাড়ির ভেতরে বসে বসে শুনতে শুনতে জানতে পারছি অরুণাচলের পাহাড় সম্বন্ধে নানান তথ্য। যেমন হিমালয়ের এই অংশের পাহাড় তুলনায় নবীন এবং এখনও বর্ধনশীল, আর এই অংশটিতে ধস নিত্য নৈমিত্তিক। এমনকি চব্বিশ ঘন্টারও বেশী সময়ও লেগে যায় কখনো সখনো ধসে পড়ার পরে রাস্তা পরিষ্কার করে চলনোপযোগী করে তুলতে। আজকাল ধস আরও বেড়ে গেছে কারণ পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে সরকারি উদ্যোগে পাহাড় ফাটানো চলছে যে নিয়মিত, অহরহই অত্যুচ্চ শক্তিসম্পন্ন ডিনামাইট চার্জ করে।
বাইরের দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে দ্রুত, বৃষ্টি ধরে গেলো। যেমন সে ধূমকেতুর মতো হঠাৎ এসেছিলো, তেমন আবার প্রকৃতিকে ধারাস্নান করিয়ে হঠাৎই ফিরেও গেলো আপন মেঘের দেশে। আকাশে ম্লান রোদের ছটা ম্লানতর, তাতে মেঘ মিলে মিশে ঘন কালচে ধূসর। চেনা অচেনা সব গাছগুলোই অন্ধকার ঠাসা ঝোপ, আর হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস। এককাপ চা জোটারও কোনও সম্ভাবনা নেই। অতঃকিম ..... অপেক্ষা - অপেক্ষা - অপেক্ষা! ঘড়ির কাঁটাও যেন সরবে না পণ করেছে, সবে সাড়ে চারটে বিকেল? ঘড়ি কি ভুল সময় দেখাচ্ছে নাকি? এখানে ঘড়ি কোলকাতার নিরিখে সময় দেখালেও এটা ভারতের দূরবর্তী পূর্বপ্রান্ত, সূয্যিমামা টুপ করে পাটে যায় আর ঝুপ করে সন্ধ্যাও নামে বিকেল চারটে বেলাতেই। ভূগোল বইয়ের পড়া এবার চাক্ষুষ হোলো। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অতিক্রান্ত, একই জায়গায় গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে।
কোন নেটওয়ার্ক নেই, কাজেই ফোন নিয়ে খুটখাট করারও উপায় নেই। ক্ষিদে তেষ্টা এবং প্রকৃতির ডাকে নিম্নচাপে শরীর কাতর। ডাক ছেড়ে কাঁদলেই বা কে কাকে সামলাবে? হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে একমুখ হাসি নিয়ে মণিপুরী ছোকরা ড্রাইভারটি আমাদের ট্রাভেলার গাড়িতে চড়ে বসলো, রাস্তা ঠিক হয়ে গেছে।
আবার গাড়ি গড়াতে শুরু করলো এবং আক্ষরিক অর্থেই গাড়ি গড়াতে গড়াতেই চলছে। সেনাবাহিনীর কড়া নির্দেশ একটি গাড়ির থেকে অন্য গাড়িকে কম করে দশ বারো ফুটের দূরত্ব বজায় রেখেই চলতে হবে, স্পীড নেওয়া চলবে ন
া একেবারেই, এবং ধস অধ্যূষিত তিনটি বাঁক লুপ এভাবেই চলতে হবে। অন্যথায় গাড়ির ভাইব্রেশনে আবার ধস নামতে পারে। বৃষ্টিভেজা পাহাড়ী রাস্তায় ঘন অন্ধকারের বুক চিরে পিঁপড়ের সারির মতো সভ্য মানুষের দল গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো জ্বালিয়ে, বিকট কর্কশ হর্ণ বাজিয়ে, পেট্রোল-ডিজেলের বিশ্রী ধোঁয়া ছড়িয়ে চলেছে প্রকৃতির ভারসাম্য লন্ডভন্ড করার উদ্দেশ্যে। নিজেদের কেমন যেন খুব ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হোলো। মনে হোলো এই ধসটা আসলে প্রকৃতির প্রতিবাদী রোষ।
হয়তো পাহাড়বাসীদের কাছে এই অভিজ্ঞতা অতি সাধারণ, অহরহই সঞ্চয় হয়, কিন্তু আমি প্রত্যক্ষ করলাম সৃষ্টিকর্তার বিচিত্র খেয়ালে খানখান প্রগতি প্রবাহ, গতিপথরুদ্ধ নগরায়নের অশ্বমেধের ঘোড়ার!
সভ্যতা এখানে স্তব্ধ নির্বাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় দর্শক মাত্র!
এরপর আরও ক'দিন ঘুরে বেড়ালাম, অরুণাচলের পথে প্রান্তরে, শিবালিক হিমালয়ের অন্দরে কন্দরে অলিন্দে অলিন্দে। দিন চারেকের অবস্থান বৌদ্ধ মনাস্টারির শহর তাওয়াঙে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শান্ত, ছবির মতো গোছানো ছোট্ট শহর। পাহাড়ের গায়ে সুন্দর করে বসিয়ে দেওয়া ল্যান্ডস্কেপ একখানা, ক্যামেরায় তো সেই রূপের ভগ্নাংশমাত্রও ধরা পড়লো না। ফিরতি পথ ধরার আগের দিন যাত্রা শুরু তাওয়াঙ বৌদ্ধ শহর থেকে, ভারত-চীন সীমান্তে বুমলা পাসের উদ্দেশ্যে। সে যাত্রাপথ বাস্তবিকই দুর্গম! রুক্ষ পাহাড়, গাঢ় কালচে বাদামী ন্যাড়া পাথরের ওপরে ক্কচিত শুকিয়ে যাওয়া শ্যাওলা আর সাদা ধবধবে বরফ গুঁড়িগুঁড়ি আকারে। তাপমান শূন্যের বেশ খানিকটা নীচে। প্রবল হাওয়ার দাপটে সমতলবাসী আমরা নাজেহাল, দাঁতে দাঁতে কনসার্ট, এককাপ কফি পান করে টলমলানি ঠান্ডায় সামান্য উপশমেরও কোনও উপায় নেই। দূরে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে নজরে আসে শুধু ধূধূ ঊষর পাথুরে পাহাড়ের গায়ে সূর্যালোকে চোখ ঝলসানো বরফ। আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছাউনি এবং প্রকৃতির অত্যাশ্চর্য সৃষ্টির বুকে আদ্যোপান্ত বেমানান বিসদৃশ সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আগ্নেয়াস্ত্র কামান অক্ষৌহিনী তাক করা নির্দিষ্ট অভিমুখে। সেনাবাহিনীর উষ্ণ সহযোগিতা অবশ্যই হৃদয়স্পর্শী। হাড়ের মজ্জা পর্যন্ত কাঁপিয়ে "কোয়লা" হিন্দি ছবির শ্যুটিং স্পট মাধুরী লেকও দর্শণ হোলো। এবার ফেরার পালা, তাওয়াঙ অভিমুখে, আবার সেই দুর্বিষহ যাত্রাপথ!
অরুণাচল ভ্রমণপর্ব সমাধা, এবার গৃহাভিমুখী। সেই একই পথ, বাঁক পাহাড় জঙ্গল ঝর্ণা নদী হ্রদ জনপদ, পথিপার্শ্বস্থ চা-দোকান, ব্যাগপিঠে মঙ্গোলীয় মুখাবয়বের স্কুল পড়ুয়া ক্ষুদে ক্ষুদে শিশুর দল, দুধের শিশু পিঠেবাঁধা পাহাড়ণ মা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে রোদ পোহানো বয়স্কদের অজস্র ঘটনার সাক্ষী কপাল-কপোলের অগণিত বলিরেখা, ডাইনে বাঁয়ে পিছনে ফেলে আমাদের গাড়ি চলছে। ফেরার পথেও পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে মেঘরৌদ্রের লুকোচুরির ক্যানভাস, নাম না জানা পাখির চকিত কলকাকলি, রাস্তা পার হতে চাওয়া দলছুট শাবক চমরীগাইয়ের ভীরু কান নাড়ানো, বিস্তর নাম না জানা ছোটবড় গাছের চকচকে সবুজ পাতায় ঝুলন্ত টলটলে শিশিরকণা, ঘাসের ফাঁকে দোদুল্যমান রঙবেরঙী ছোট্ট ছোট্ট বুনো ফুলের উঁকি ঝুঁকি, পাহাড়ের ঢালে চাষ করা কপি অথবা ভুট্টা ক্ষেতের একঝলক, কখনোবা হঠাৎ করেই ছোট্ট একপশলা বৃষ্টি ভেজা শীতল হাওয়ার বয়ে আনা ধুলোমাখা পাহাড়ীয়া সোঁদাগন্ধ........ সব, এর সবকিছুই প্রকৃতির আপন খেয়ালের চিরন্তনী অপরূপ সৃষ্টি!
এবার শুধু লজ্জা নয়, রীতিমতো অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম। নাগরিক সভ্যতার সৃষ্টির চেষ্টায় আমরা কী নির্মম নৃশংসতায় প্রাকৃতিক সৃষ্টিকে স্থিতিশীল থাকতে দিচ্ছি না, নয়ছয় করে দিচ্ছি সৃষ্টিকর্তার নিপুণ কারিগরীকে। সেই ধস নামা জায়গাটা পার হবার সময় রিফ্লেক্স অ্যাকশনেই চোখটা চলে গেল ওদিকে। থেঁতলানো গাছের পাতা ঘাস, ভাঙা গাছের মচকে থাকা ডাল, বিপজ্জনক ঝুলে থাকা বিশালাকৃতির পাথরের চাঁই জানান দিচ্ছে ওখানে ঘটে যাওয়া দুর্বিপাকের, ঝুরঝুরে মাটি ছিঁড়ে যাওয়া শিকড়বাকড় আঁকড়ে কোনরকমে স্বস্থানে টিকে থাকার অসম লড়াইয়ে।
ঝরতে থাকা মাটি বৃষ্টির জলে কর্দমে পরিণত। তাদেরই পাশে দৈত্যাকার বুলডোজার আর নির্লজ্জ গড়গড়ানিরত পাহাড় কাটার যন্ত্রদানবের উপস্থিতি বুক চিতিয়ে সভ্যতা সৃষ্টির অহংকারী ঘোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
মনটা ভারাক্রান্ত, বাড়ী থেকে আসার আগেকার ফুরফুরে মেজাজটা বেমালুম বেপাত্তা। আর এবারকার কষ্টটা বেড়ানো শেষ হওয়ার কারণে নয়।
প্রত্যক্ষ করে সৃষ্টি স্থিতি লয় অরুণাচলের অন্দরে কন্দরে, মনে এক বিজাতীয় অনুভূতি। এই যে প্রকৃতিমায়ের অকৃপণ স্নেহধন্য, সৃষ্টিকর্তার অদৃষ্টপূর্ব সৃষ্টিকে স্থিতাবস্থায় থাকতে না দিয়ে তাকে তিলে তিলে লয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ভাগীদার হওয়ার দায় কি আমি এড়াতে পারবো? নাকি পারি? আদতে সভ্যতার সৃষ্টি কি এক অনাসৃষ্টি প্রাকৃতিক সৃষ্টির বিনষ্টিকরণে? হায় রে মানবসভ্যতা! মনটা গভীর অপরাধবোধের তিক্তাস্বাদে ভরে গেলো।